বাহিরের ধুলায় জানালার কাচ ঘোলা হয়ে গেছে। যেমনটা ঘোলা হয়ে যায় শীতের কুয়াশার পরশে। তবে পার্থক্য হলো কুয়াশায় কাচ ঘোলা হয়ে সাদা হয়, আর ধুলায় কাচ ঘোলা হয়ে লাল হয়ে যায়। রাস্তায় কুয়াশার মত ঘুরে বেড়ানো ধুলার দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠেন আরমান সাহেব। তিনি তার পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে ‘ধুলাদেও’ এমন আগ্রাসী রূপ কখনোই দেখেন নাই। ‘ইসস! রাস্তার কি অবস্থা! মানুষ চলাফেরা করবে কিভাবে।’ বিড়বিড় করে মনের উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে সে। জুরাইনের পাঁচতলা ভবনের চার নম্বর তলায় তার অফিস। অফিসের বিশাল জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাহিরের হালচাল দেখতে চাইছিলেন। কিন্তু ধুলার কারণে তার দৃষ্টি চার তলা থেকে রাস্তায় নামতে পারল না। সময় দেখার জন্য হাতের দামি রলেক্স ঘড়িটার দিকে তাকালেন। ১২টা ১৮ মিনিট। এতক্ষণে সিয়াম হয়ত স্কুল থেকে বাসায় পৌঁছে গেছে। ছেলের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আরমান সাহেবের। কয়েকদিন ধরেই ছেলেটা সর্দি-কাশিতে ভুগছে। ঢাকার রাস্তায় যে হারে ধুলাবালি উড়ছে মানুষের তো রোগবালাই হবেই। কবে যে মানুষ সুন্দর প্রকৃতির ঢাকা শহর দেখতে পাবে সেটা খোদা ছাড়া আর কেউ জানে না। টেবিলের উপরে রাখা মোবাইলটা যান্ত্রিক কণ্ঠে বেজে উঠল। আরমান সাহেব কল রিসিভ করে কয়েক মুহূর্ত ওপাশের কথা শুনলেন। তারপর আতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন, ওয়াট! আমি এখনি আসছি।
দুই.
প্রায় সাড়ে বার ঘন্টা পর বাঙ্কার থেকে বের হয়ে দোতলার বেলকনিতে এসে দাঁড়াল রিয়ানা। বাহিরে প্রচুর ধুলাবালি উড়ছে। এতে তার কোন আক্ষেপ নেই। সে বরং জোরে শ্বাস টেনে বয়ে যাওয়া বাতাসটাকে অনুভব করল। বাতাসের সাথে ভেসে আসা বারুদের গন্ধ তার নাকে বাড়ি দিতে লাগল। এখন আর এই গন্ধটাকে অতটা অস্বস্তিকর কর লাগে না। বুঝ হওয়ার পর থেকেই গন্ধটার সাথে তার বসবাস। রিয়ানার জন্ম হয়েছিল সিরিয়ার প্রাণকেন্দ্র দামেস্কে। দু’বছর যাবৎ নানার বাড়ি পূর্ব গৌতায় এসে থাকছে। পাঁচ বছর বয়সী রিয়ানা যুদ্ধ বিদ্রোহ বুঝে না। শুধু বোঝে যুদ্ধ ভালো না। বোমের আঘাতে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া একটি বিল্ডিং চোখে পড়ল রিয়ানার। রিয়ানা অবাক হয়ে ভাবছে, ‘তাহলে কি সত্যিই বিশাল দানব এসে এই অবস্থা করেছে। বাবা বলেছিল বাঙ্কারে যেয়ে না থাকলে দানব এসে সব তছনছ করে আমায় নিয়ে যাবে। আচ্ছা দানব কি ওই বাড়ির মানুষগুলোকে নিয়ে গেছে!’ সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে রাতে ঘুমানোর সময় বাবাকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করবে। এখন সময় বেলা ১১টা। যুদ্ধবিরতির সময় চলছে। মানুষজন যার যার প্রয়োজনীয় কাজে রাস্তায় নেমে পড়েছে। এতক্ষণ বাঙ্কারে থেকে রিয়ানার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আবদ্ধ থাকতে তার একদম ভালো লাগে না। বাহিরে যতই ধুলাবালি উড়ুক, প্রকৃতির সাথে তার দেখা করতেই হবে। এক ঝটকা বাতাস এসে রিয়ানার কাঁধ পর্যন্ত চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। বাতাসের ঝামটায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে রিয়ানা। বাতাসের সাথে ভেসে আসা ধুলায় মুখ ভরে গিয়েছে তার। বেলকনির দরজায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে রিয়ানার বাবা। মেয়েকে ডাকতে যেয়েও ডাকলেন না। হয়ত ভাবছিলেন, মেয়েটা বাঙ্কারে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। ওর এখন প্রকৃতির অকৃত্রিম বাতাস দরকার। হোক না সেটা ধুলাবালি মেশানো! যেখানে বেঁচে থাকাটাই ভাগ্যের ব্যাপার সেখানে ধুলার কারণে অসুস্থতার ভয় করাটা বেমানান। রিয়ানার বাবা ঘরের ভেতর চলে গেল। ওদিকে বিকট শব্দ করে খুব নিচ দিয়ে উড়ে গেল একটি যুদ্ধবিমান। বিমান থেকে প্যারাসুটের মত কি যেন একটা নিচে নেমে আসছে। অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে রিয়ানা। এই প্রথম বিমান থেকে কোন জিনিস এভাবে নামতে দেখছে সে। প্যারাসুটের মত বস্তুটা আস্তে আস্তে বাড়ির সামনে এসে নামল। মুহূর্তেই বুম…করে হুংকার দিয়ে উলোট পালট করে দিল আশপাশ। রিয়ানা বুঝতেই পারল না বাবার কাছে শোনা বিশাল দানবটা অতটা বিশাল নয়।
তিন.
প্রচন্ড গতিতে গাড়ি ছুটিয়েছেন আরমান সাহেব। রাস্তা প্রায় ফাঁকা বললেই চলে। ঢাকা শহরের এমন চিত্র বিরল। গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর জাগ্রত করে যাচ্ছে রাস্তার পাশের ঘুমন্ত ধুলাগুলোকে। জাগ্রত হয়ে সেগুলো মনের আনন্দে উড়ে যেয়ে বসছে ফুটপাথে থাকা মানুষের গায়ে। ‘বিনা পয়সায় পাউডার মাখতে চাইলে রাস্তায় নামো’ কথাটা অচিরেই বাংলা ভাষার কৌতুক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করতে পারে। আবার কেউ কেউ ধুলার অপর নাম দিয়েছে ‘গরিবের পাউডার’। আরমান সাহেবকে ঢাকার বিরল চিত্রটা বেশিক্ষণ দেখতে হল না। ট্রাফিক পুলিশের লাঠির ইশারায় তার গাড়ির চাকা থেমে গেল। বিরক্তি আর উৎকণ্ঠার ছাপ, দুটো এক সাথে তার চেহারায় প্রকাশ পেল। ‘গাড়িটা নিয়ে যে, কেন বেরিয়েছিলাম? গাড়িটা পাঠিয়ে দিলে সিয়ামকে হাসপাতাল যেতে হতো না’ বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে দুষছেন আরমান সাহেব। প্রতিদিন গাড়িতে করে অফিসে এসে ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়িটা পাঠিয়ে দেয় সিয়ামের স্কুলে। কিন্তু আজকে অফিসের একটা কাজে গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। যার কারণে সিয়ামকে রিক্সায় করে বাসায় ফিরতে হয়েছিল। সেটাই বিপত্তি ডেকে আনে, ধুলায় সিয়ামের প্রচুর অ্যালার্জি। তাই রাস্তার ধুলাবালি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারেনি সে। জ্যামে আটকে পড়া রিক্সার মধ্যেই জ্ঞান হারায়। একটু আগে মোবাইলে এই দুঃসংবাদটা পেয়েই হাসপাতালের দিকে রওনা হয়েছেন আরমান সাহেব। ছেলের কোন কষ্টে তিনি ছাড় দিতে নারাজ। ইতোমধ্যে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছেন ছেলের জন্য একটা নতুন গাড়ি কিনবেন।
চার.
চারিদিকে শুরু হয়েছে তুমুল গোলা বর্ষণ। দিশেহারা হয়ে পড়েছে বেসামরিক জনগণ। বিকট হুংকার তুলে সব তছনছ করে দিচ্ছে যুদ্ধবিমান থেকে প্রচ- বেগে ধেয়ে আসা বিধ্বংসী বোমা। শিশুর কান্না, নারীর আর্তনাদ সব কিছু ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে শুধু প্রাণঘাতী বোমার হুংকার। যেন পূর্ব গৌতার বুকে চলছে বজ্রসহ অগ্নিবৃষ্টি। যেন মানুষগুলোর ওপর পড়েছে কোন পৃথিবীবিনাশী দানবের অভিশাপ দৃষ্টি। যুদ্ধ বিরতির মধ্য দুপুরেও চলছে বিমান হামলা। পূর্ব গৌতার মানুষদের জন্য দিনের যেটুকু সুময় সুস্থ মস্তিষ্কে বেঁচে থাকার অধিকার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল সেটুকুও যেন হারিয়ে যাচ্ছে বিক্ষিপ্তভাবে উড়তে থাকা ধুলার সাথে। বিমান হামলাকে উপেক্ষা করে রিয়ানার বাবা মেয়েকে নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে হাসপাতালের দিকে। রিয়ানার বাঁ পায়ের হাঁটু পর্যন্ত উড়ে গেছে বোমার আঘাতে। সেখান থেকে রক্ত ঝরছে অঝোরে। ধুলায় মলিন হয়ে আছে চেহারাটা। ফর্সা মুখটায় লেগে আছে রক্তের ছিটা। তবুও নিষ্পাপ মুখটায় পবিত্রতার একটুও কমতি নেই। এমন কোন শিশুকে দেখলে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর মনের মানুষটাও একবার কোলে নিয়ে আদর করতে চাইবে। কিন্তু আজ! কেউ জানে না এই দেবশিশুর মুখে আর কখনো সর্গীয় হাসি দেখা যাবে কিনা! প্রকৃতির একটুখানি দেখা পেতে তার মন আবার চঞ্চল হয়ে উঠবে কিনা! বিশ্বের পরাশক্তিদের জঘন্যতম এক প্রতিযোগিতার বলি হতে হচ্ছে রিয়ানাকে। মৃত্যুর সাথে লড়তে হচ্ছে নোংরা এই পৃথিবীতে বাঁচতে। পৃথিবী যেন জোর যার মুল্লুক তার প্রবাদের একটি প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের ধুলায় ধূসরিত হয়েছে মানবিকতা। রিয়ানার চোখ দুটো খোলা। অপলক শূন্য দৃষ্টি। বোধ হয় বাবার কোলে শুয়ে অবাক হয়ে দেখছে, মানুষ মানুষকে কিভাবে নির্বিচারে হত্যা করে। ‘তোমরা আমাদের ধোঁকা দিয়েছ, আমাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছ, আমরা আর তোমাদের বিশ্বাস করিনা’ কথাগুলো আকাশে উড়ে যাওয়া বিমানকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলল রিয়ানার বাবা। মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করেছে, আমার মেয়ে যদি না বাঁচে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ব বিদ্রোহীদের সাথে।
পাঁচ.
গাড়ি কিনতে বেরিয়েছেন আরমান সাহেব। দুদিন আগের নেয়া প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে যাচ্ছেন। মনটা খুশিতে টগবগ করলেও মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছে। কারণ, ঢাকার চির চেনা জ্যাম। শুভ কাজে দেরি করতে নেই, কিন্তু তাকে দেরি করতেই হচ্ছে ট্রাফিকের লাল সিগন্যালের কারণে। গাড়ির অডিও প্লেয়ারটা চলু করতে যেয়েও থেমে গেলেন পাশের সিটে পড়ে থাকা অবহেলিত পত্রিকাটার দিকে চোখ পড়ায়। আরমান সাহেব জানেন, উনি যেই জ্যামে ফেঁসে গেছেন তার ফাঁস খুলতে কমপক্ষে পনের মিনিট লাগবে, তাই পত্রিকা পড়া শুরু করলেন। প্রথম পৃষ্ঠায় কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে সরাসরি চলে গেলেন আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠায়। পৃষ্ঠার উপরের দিকে বড় করে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক সিরিয়ার বিদ্রোহীর ছবি দেয়া। ছবিটা দেখেই কপালে ভাঁজ ফেলে মৃদু কণ্ঠে বললেন, কি দরকার এতো যুদ্ধ করার, শুধু শুধু অরাজকতা সৃষ্টি ছাড়া কিছুই না। পাশের সিটে পত্রিকাটা ছুড়ে ফেলার ভঙ্গিতে রাখলেন। জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখলেন আরমান সাহেব। শুভ কাজে অনেক দেরি হয়েছে, আর দেরি করতে চান না তিনি। গাড়ি ছোটালেন সামনের দিকে। পাশের সিটে পড়ে থাকা অবহেলিত পত্রিকাটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে, যেন আরমান সাহেকে বলতে চাইছে ‘তুমি যেরকম প্রতিজ্ঞা পূরণে অগ্রসর হয়েছ, সে রকম এক প্রতিজ্ঞা পূরণ করতেই ওই লোক অস্ত্র ধরেছে !’