বিকেলে বাঁশঝাড়ের দিকে হাঁটছিল মন্টু। হঠাৎ তার নজর পড়ল বাঁশের ঝোপের ওপর। ঝোপে একটি ঘুঘুর বাসা। বাসায় একটি ঘুঘু বসে আছে। মন্টু বুঝলো-এটি মা ঘুঘু। ঘুঘুর বাসা দেখে সে খুব খুশি হলো। ঘুঘুটি যখন বাসা থেকে উড়ে চলে গেল, তখন সে চুপিচুপি বাঁশ বেয়ে উপরে উঠলো। উঠে দেখে বাসায় দু’টি ঘুঘুর ডিম। ডিম দেখে সে খুব পুলকিত হলো। এরপর প্রতিদিন বিকেলে স্কুল থেকে এসেই সে বাঁশঝাড়ের দিকে যায়। একবার করে ঘুঘুর ডিমগুলো দেখে আসে। একদিন তো সে অবাক!
বাসায় আর ডিম নেই; ডিম ফুটে বের হয়েছে ফুটফুটে দু’টি ঘুঘুছানা। একটির রঙ সাদা অপরটির রঙ ধূসুর। ঘুঘুছানা দেখে তার মনে আনন্দ আর ধরে না। সে ঠিক করলো ছানাগুলো বড় হলে বাসায় নিয়ে যাবে। খাঁচায় ভরে পুষবে। পরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে একটি পাখির খাঁচা কিনলো সে। পাখির খাঁচা দেখে মা বললো, কিরে মন্টু, পাখির খাঁচা পেলে কোথায়?
মুচকি হেসে মন্টু বললো, কিনে নিয়ে এলাম মা।
কেন?
পাখি পুষবো বলে।
পাখি!
হুম।
কি পাখি?
ঘুঘু পাখি।
ঘুঘু পাখি কোথায় পাবে?
ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে মন্টু বললো, জানো মা, আমাদের বাঁশঝাড়ে দু’টি ঘুঘুর ছানা ফুটেছে। সুন্দর। ফুটফুটে।
তাই নাকি?
হুম। ছানাগুলো বড় হলে বাসায় নিয়ে আসব। খাঁচায় ভরে পুষবো।
তারপর ঘরে গিয়ে বুলু কাকুকে ফোন দিলো সে। বুলু কাকু শহরে থাকে। লেখাপড়া করে। বুলু কাকু খুব ভালো। তাকে খুব বুঝে। পাখি খুব পছন্দ বুলু কাকুর। মন্টু যখন ছোট, তখন বুলু কাকুর অনেক প্রজাতির পাখি ছিল। ঘুঘুপাখি, টিয়াপাখি, ময়নাপাখি আরো কত্ত কত্ত পাখি। তাকে নিয়ে বিকেলে মাঠে যেতো বুলু কাকু। মাঠে ঘাসফড়িং ধরত। সবুজ মাঠে ঘাসফড়িং ধরতে মন্টুর কী যে ভালো লাগতো! সেসব কথা মনে আছে মন্টুর।
কাকু বলতো, জানিস মন্টু?
কী কাকু?
ঘাসফড়িং হলো পাখির প্রিয় খাবার। পাখিকে যতো বেশি ঘাসফড়িং খাওয়াবে, পাখি ততো তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠবে।
তাই নাকি?
হুম।
মন্টু খুব খুশি হয়। সেও কাকুকে ঘাসফড়িং ধরে দেয়। সন্ধ্যায় কাকু বাসায় এসে আগে পাখিদেরকে পেটপুরে ঘাসফড়িং আর পানি খাওয়ায় তারপর পড়তে বসে। মন্টুও কাকুর পাশে মাদুরে বসে। মাদুরে বসে কাকুর কাছে অ-আ পড়ে আর পাখির খাঁচার দিকে তাকিয়ে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে। কোকিলের রঙ কালো কেন? ঘুঘুর রঙ সাদা কেন? মন্টুর কথায় কাকু খুব মজা পায়। কাকু তাকে বুঝায়, কালো রঙটা কোকিলের জন্য সুন্দর বলেই কোকিল কালো। মন্টু বলে ও।
কাকু?
আবার কী?
তোমার মতো আমিও বড় হলে কিন্তু পাখি পুষবো। অনেক অনেক পাখি পুষবো।
কাকু হাসে। ঠিক আছে, পুষিস।
মন্টু এখন বড় হয়েছে। স্কুলে যায়। ক্লাস ফোরে পড়ে।
কাকুকে ফোন দিয়ে মন্টু বললো, কাকু?
হ্যাঁ মন্টু, বল।
একটা সুখবর আছে কাকু।
সুখবর!
হ্যাঁ কাকু।
কি সুখবর শুনি?
আমাদের বাঁশঝাড়টা আছে না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
সেই বাঁশঝাড়ের ঝোপে দু’টি ঘুঘুর ছানা ফুটেছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, কাকু।
কাকু খুশি হয়। বলে, তাহলে তো খুব ভালো খবর। এবার তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে।
মন্টু কথা বলে না। মুখ টিপে হাসে।
কাকু বলে, ছানাগুলোকে দেখেশুনে সাবধানে রেখো। কেউ যেন আবার চুরি করে না নিয়ে যায়।
ঠিক আছে, কাকু।
মন্টু প্রতিদিন সকাল-বিকেল ঘুঘুছানা দেখে আসে। ঘুঘুছানা আস্তে আস্তে বড় হয়ে ওঠে। ডানা ঝাপটায়। তা দেখে খলখলিয়ে হাসে মন্টু।
বাসায় এসে কাকুকে ফোন করে। কাকু!
হ্যাঁ মন্টু।
ঘুঘুছানা তো বড় হয়ে গেছে। ডানা ঝাপটায়।
তাই নাকি?
হুম।
তাহলে কালকেই ছানা দু’টিকে বাসায় নিয়ে এসো। নতুবা আর দু-একদিন গেলেই ফুড়ুৎ। তখন আর ঘুঘুছানা দু’টির টিকিটিও পাবে না। তখন বসে বসে আঙুল চুষবে।
কাকু আমি কালকেই ঘুঘুছানা বাসায় নিয়ে আসব।
পরদিন স্কুল থেকে এসেই বাঁশঝাড়ে গেল মন্টু। ছানা দু’টি ধরে বাসায় নিয়ে এলো। খাঁচায় ভরলো। ঘাসফড়িং আর পানি খেতে দিল।
কিন্তু এ কি! ছানা দু’টি যে কিছুই খাচ্ছে না। ঘাসফড়িংও না।
পানিও না।
ডানাও ঝাপটাচ্ছে না।
খাঁচার ভেতর কেমন যেন মন মরা হয়ে চুপচাপ বসে আছে। তা দেখে মন্টুর খুব মন খারাপ হয়। মন খারাপ করা গলায় কাকুকে ফোন দেয় সে, কাকু?
কি হয়েছে মন্টু?
আমার ঘুঘুছানা কিছুই খাচ্ছে না। ঘাসফড়িংও না, পানিও না। ডানাও ঝাপটে না।
আমার মনে হয় তুমি যখন ওদের গাছ থেকে নামিয়েছ, তখন তারা আঘাত পেয়েছে। জখম হয়েছে। তাই ব্যথায় কিছু খাচ্ছে না, ডানা ঝাপটাচ্ছে না। তুমি চিন্তা করো না। আমি কাল সকালেই পশু ডাক্তার নিয়ে যাবো। ডাক্তার ওষুধ দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ঘুঘুছানা আবার খাওয়া শুরু করবে। ডানা ঝাপটাবে।
ঠিক আছে কাকু।
মন খারাপ করে রাতে না খেয়ে শুয়ে পড়ল মন্টু। হঠাৎ তার কানে আওয়াজ আসে, কে যেন চিকন সুরে কাঁদছে। কান্নার আওয়াজ শুনে উঠে বসে মন্টু। কোনদিক থেকে আসছে কান্নার শব্দ বুঝার চেষ্টা করে। বাইরে বারান্দা থেকে আসছে কান্নার শব্দ। মন্টু একটু ভিতু টাইপের ছেলে। কান্নার আওয়াজ শুনে ভয়ে তার বুক টিপটিপ করছে। এত রাতে কে কান্না করছে? ভয়ে টিপটিপ বুকে দরজা খুলে বারান্দায় বের হয়ে আসে সে। বারান্দায় এসে দেখে পাখির খাঁচার ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। খাঁচার ভেতরে কাঁদছে কে? মন্টুর ভয় আরো বেড়ে যায়। ভয়ে ভয়ে খাঁচার কাছে আসে ও। দেখে খাঁচার ভেতর ঘুঘুছানা দু’টি কাঁদছে।
মন্টু বললো, তোমরা কাঁদছ কেন?
একটি ছানা কেঁদে কেঁদে বললো, আমাদেরকে ছেড়ে দাও তুমি। আমরা মায়ের কাছে যাবো। আমাদের জন্য মা কাঁদছে। মায়ের জন্য আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ, তুমি ছেড়ে দাও আমাদের।
ফজরের আজান শুনে ঘুম ভেঙে যায় মন্টুর। স্বপ্নের কথা মনে হতেই মন খারাপ হয়ে যায় তার। বাবা বলেছিলেন, ফজরের সময় কেউ যদি কোনো স্বপ্ন দেখে, তবে সে স্বপ্ন সত্যি হয়। মন্টু ভাবে, তাহলে কি সত্যি সত্যিই বাবা মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে ঘুঘু ছানাদের? সে জন্য তারা কিছু খাচ্ছে না, ডানা ঝাপটাচ্ছে না।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে কাবিলা নামে এক দুষ্ট লোক তাকে অপহরণ করেছিল, তখন মায়ের জন্য তার কী যে কষ্ট হচ্ছিল। পরে মুক্তিপণ দিয়ে বাবা তাকে কাবিলার কাছ থেকে নিয়ে আসে।
মন্টু ভাবে, আমার মতো ঘুঘুছানাদেরও কি মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে? তার মানে আমিও কি দুুষ্ট লোক? কাবিলা শয়তান লোকটার মতো?
মন্টুর নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। ধীরে ধীরে বারান্দায় এসে পাখির খাঁচার পাশে দাঁড়ায় ও। তাকায় খাঁচার দিকে।
খাঁচার ভেতর সব ঘাসফড়িং পড়ে আছে।
পানিও পড়ে আছে।
কিছুই মুখে দেয়নি ঘুঘুছানা।
মন্টু তাকায় ছানা দুটির চোখের দিকে। পানিতে ছানা দুটির চোখ কেমন টলমল করছে। মন্টু বুঝলো মায়ের জন্য কাঁদছে তারা। মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে তাদের। ছানা দুটির চোখের পানি দেখে মন্টুর খুব মায়া হলো। সে ঠিক করলো ছানা দুটিকে আর খাঁচার ভেতর বন্দি করে রাখবে না। ছেড়ে দিবে।
এমন সময় কাকু ডাক্তার নিয়ে হাজির।
তুমি আর চিন্তা করো না মন্টু। ডাক্তার নিয়ে এসেছি। ডাক্তার ওষুধ দিবে।
তোমার ঘুঘুছানা এখন খাবে।
ডানা ঝাপটাবে।
খাঁচার ভেতর ছপাৎ ছপাৎ করে উড়বে।
মন্টু নীরস গলায় বললো, তার আর প্রয়োজন হবে না কাকু।
কাকু অবাক হয়। কেন?
আমি জানি, ঘুঘুছানা কেন খাচ্ছে না? কেন ডানা ঝাপটাচ্ছে না?
কেন?
মায়ের জন্য তাদের মন খুব খারাপ, তাই। আমি আর ওদের খাঁচার ভেতর আটকে রাখবো না, ছেড়ে দিবো। এই বলে মন্টু খাঁচার দরজা খুলে দিলো। দরজা খোলা পেয়ে পড়ি-মরি করে উড়ে যায় ছানা দুটি। পেছনে ফিরে তাকানোর যেন কোনো জো নেই। ডাক্তার আর কাকু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মন্টুর দিকে। মন্টু তাকিয়ে আছে ঘুঘুছানাদের উড়ে চলা পথের দিকে।
Share.