আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম হয়েছিল ২৪ মে ১৮৯৯ খ্রি: পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। সালটা ছিল বাংলা ১৩০৬ এর ১১ জ্যৈষ্ঠ। তার বাবার নাম কাজী ফকির আহমদ, মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। ফকির আহমদের ছিল তিন ছেলে আর এক মেয়ে। প্রথম সন্তানের জন্মের পর তার পরপর চারটি সন্তানের মৃত্যু হয়। এর পর নজরুলের জন্ম। অনেক দুঃখে পাওয়া সন্তান বলে নজরুলের নাম রাখা হলো দুখু মিয়া। নজরুলের ছিল ভীষণ পড়ার নেশা। এমন স্মৃতিশক্তি তার, একবার পড়লে আর কিছুই ভোলেন না। এমন বিদ্যা নিয়ে মাত্র বারো বছর বয়সেই এক খুদে কবি হয়ে উঠলেন। লিখে ফেললেন এক গজল।
“নামাজ পড়ো মিয়া
ওগো নামাজ পড়ো মিয়া
সবার সাথে জমায়েতে
মসজিদেতে গিয়া।”
ছোটদের জন্য তার বিখ্যাত লেখার মধ্যে অন্যতম হলো ‘ভোর হলো দোর খোল’, খুকী ও কাঠবেড়ালী, খোকার সাধ, সংকল্প, লিচু চোর ইত্যাদি। তার লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, সর্বহারা, ভাঙার গান, ফণীমনসা, জিঞ্জির, প্রলয় শিখা, চক্রবাক, দোলনচাঁপা ইত্যাদি।
অনেক আগে গ্রামে গ্রামে কবির লড়াই হতো। দিনক্ষণ ঠিক করে একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত করা হয় দু’জন কবিকে। দুই কবি সেই অনুষ্ঠানে মুখে মুখে কবিতা রচনা করে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। বুদ্ধিমান, ধর্ম, ইতিহাস ইত্যাদিতে জ্ঞানবান লোক ছাড়া কবিদের এই লড়াইয়ে কেউ অংশ নেয় না। কিন্তু ১২ বছরের এক ছেলে এই নিয়ম উল্টে দিয়েছিল। এক দিনের ঘটনা। এক বয়স্ক কবিয়ালের সাথে তার লড়াই শুরু হলো। লোকটি তো খুব খুশি। যাক, ছোকরাকে সহজেই কাবু করা যাবে। কিন্তু, সে তাকে হারাতে গিয়ে, নিজেই হেরে গেল। পুঁচকে কবি তার বুড়ো প্রতিদ্বন্দ্বীকে লক্ষ্য করে বলল-
“ওরে ছড়াদার, ওরে ‘দ্যাট’ পাল্লাদার
মস্তবড় ‘ম্যাড’
চেহারাটাও মানকি লাইক
দেখতে ভারী ‘ক্যাড’
‘মানকি’ লড়বে বাবরকা সাথ
ইয়ে বড় তাজ্জব বাত
জানে না ও ছোট্ট হলেও
হামভি ‘লায়ন ল্যাড’।”
যাকে তুমি ছোট ভাবছ সে ছোট হলেও সাধারণ ‘ল্যাড’ অর্থাৎ বালক নয়। সে লায়ন ল্যাড। মানে সিংহের বাচ্চা। প্রতিপক্ষকে সে তুলনা করছে ‘মানকি’ অর্থাৎ বানরের সাথে আর নিজেকে তুলনা করছে বাবরের সাথে। হ্যাঁ, মোগল বাদশাহ বাবরের কথাই বলছে। তিনি শুধু বীরই ছিলেন না, অসাধারণ শক্তিমান মানুষও ছিলেন। শোনা যায় দুই বগলে দু’জন বড় মানুষকে নিয়ে তিনি দিব্যি পাঁচিলের ওপর দিয়ে দৌড়াতে পারতেন। বোঝা গেল, ছোট্ট কবিয়াল ইতিহাস সম্পর্কেও ভালো ধারণা রাখে। সিংহের মতো সাহসী এই পুঁচকে কবি ছিলেন আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম যাকে আমরা বিদ্রোহী কবি হিসেবেই বেশি চিনি।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম শিশু-কিশোরদের জন্য অনবদ্য সব লেখা রেখে গেছেন। গান, কবিতা, গল্প, নাটক সবকিছুই লিখেছেন। জাগো সুন্দর চিরকিশোর, পুতুলের বিয়ে (ছোট মেয়েদের নাটক), নবার নাম্তা পাঠ, কানামাছি, ছিনিমিনি খেলা, কে কি হবি বল, জুজুবুড়ীর ভয় ইত্যাদি নাটকে ছোটদের যে আনন্দ আর উৎসাহ দিয়েছেন তার তুলনা চলে না।
ছাত্ররা কখনো ভয় করবে না। ভয়কে জয় করবে। তারা একটি দেশের প্রাণশক্তি। এই অনুভূতি জাগিয়ে তোলে কাজী নজরুল ইসলামের “ছাত্র দলের গান” কবিতাটি।
“আমরা শক্তি আমরা বল
আমরা ছাত্রদল।
মোদের চরণতলায় মূর্ছে তুফান
ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।
আমরা ছাত্রদল।”
শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। কবি তাদেরকে নিয়ে লিখলেন-
“নতুন দিনের মানুষ তোরা
আয় শিশুরা আয়!
নতুন চোখে নতুন লোকের
নতুন ভরসায়।”
(নতুন পথিক)
যেটাকে আমরা আমাদের রণসঙ্গীত হিসেবে বেছে নিয়েছি সেই গান কিন্তু আমাদের জাতীয় কবি নজরুলেরই রচনা। অবশ্য ছোটবেলা থেকে আমরা এটাকে কবিতা হিসেবে পড়ে এসেছি।
সৈনিক জীবনের মার্চ করার বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে তাল মিলিয়ে লিখলেন-
“চল্ চল্ চল্!
ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল,
নি¤েœ উতলা ধরণী তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চলরে চলরে চল।”
(চল্ চল্ চল্)
কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে একটা শিশুসুলভ সারল্য ছিল। তিনি খুব সহজেই শিশুদের সাথে একাত্ম হতে পেরেছেন। নজরুল অনুভব করেছেন, শিশুর প্রাথমিক জগৎ মাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। তাই তার সমস্ত কৌতূহলপূর্ণ প্রশ্ন, মান-অভিমান, আদর-আবদার সব মায়ের কাছেই করে। শিশু অবাক বিস্ময়ে মাকে প্রশ্ন করে,
“মা গো! আমায় বলতে পারিস
কোথায় ছিলাম আমি-
কোন্ না-জানা দেশ থেকে তোর
কোলে এলাম নামি?
আমি যখন আসিনি, মা তুই কি আঁখি মেলে
চাঁদকে বুঝি বলতিস্-ঐ ঘর-ছাড়া মোর ছেলে?”
(কোথায় ছিলাম আমি)
শিশু-কিশোর মনের ইচ্ছেগুলো তার লেখনীতে খুব সুন্দরভাবে ধরা দিয়েছে। তাইতো তিনি “সংকল্প” কবিতায় বলতে পেরেছেন ,
“থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎটাকে ,
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।”
যারা সত্যিকার অর্থে হৃদয়ের দরদ দিয়ে শিশুদের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে লিখেছেন, কাজী নজরুল ইসলাম তাদের একজন। গবেষকরা মনে করেন ‘লিচু চোর’ ছড়াটির মাধ্যমে নজরুলের শিশু সাহিত্য রচনার হাতেখড়ি হয়। এর মতো অভিনয় উপযোগী কবিতা বাংলা শিশুসাহিত্যে খুবই বিরল।
কোন বিশেষ কারণ ছাড়া নজরুল কোনো শিশুসহিত্য রচনা করেননি। যেমন, ‘খাঁদু দাদু’ ছড়া। খান বাহাদুর আনোয়ার হোসেন ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের একজন কর্মচারী। তার এক মেয়ের সাথে লেখালেখির সূত্রে পরিচয় ঘটে নজরুলের। মাঝে মাঝে তিনি বেড়াতে যেতেন তাদের বাড়িতে। একবার কী এক কারণে বাপ আর মেয়েতে ঝগড়া হয়। রাগের মাথায় একমাত্র শিশুকন্যাকে সাথে নিয়ে খান সাহেবের মেয়ে চলে এলেন কবির বাসায়। নজরুল খেয়াল করলেন ছোট্ট মেয়েটির মন খারাপ। কবির বুঝতে বাকি রইল না যে, দাদুকে না দেখতে পেয়েই এমনটি হয়েছে। তখন মেয়েটিকে খুশি করার জন্য প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বসলেন খাতা কলম নিয়ে। লিখলেন চমৎকার একটি ছড়া। নাম ‘খাঁদু দাদু’। ছড়াটির মূল বিষয় ছিল খান বাহাদুর সাহেবের নাক। তিনি লিখলেন-
“অ মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?
খ্যাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা নাক ডেঙাডেং ড্যাং!”
(খাঁদু দাদু)
নজরুল তখন মোগলপুর লেনের বাসিন্দা। পাশের বাসার একটি ছেলে তার বাসায় খেলতে এসে রোজ ঘুমিয়ে পড়ত। ছেলেটির প্রিয় ফুল ছিল ঝিঙেফুল। সে সময়ই তিনি লিখে ফেললেন ‘ঝিঙেফুল’ কবিতাটি।
“ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল।
সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল
ঝিঙে ফুল।”
(ঝিঙে ফুল)
১৯২১ সালের কথা। নজরুল একবার কুমিল্লায় বেড়াতে গেলেন। উঠলেন ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে। তার ভারি দুষ্টু আর মিষ্টি একটা মেয়ে ছিল। নাম ছিল অঞ্জলি। একদিন অঞ্জলি পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে, হাত নেড়ে নেড়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলতে থাকে। বারান্দায় বসে নজরুল শিশুটির কর্মকাণ্ড দেখে অভিভূত হন। নজরুল ভাবেন মেয়েটি হয়তো গাছে থাকা কারও কাছে পেয়ারা চাইছে। কিন্তু কোথায়?
কেউ তো নেই। অঞ্জলিকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছিলে? তারপর অঞ্জলি যা বলে তা সত্যি অবাক করা, ‘কাকাবাবু! ওই দেখ দুষ্টু কাঠবেড়ালী। রোজ রোজ দুষ্টুটা পেয়ারা খেয়ে পালিয়ে যায়। আমাকে একটাও দেয় না।’ নজরুল চমকে ওঠেন। আর এ চমক থেকেই সৃষ্টি হয় নজরুলের কালজয়ী শিশুতোষ ছড়া ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’
‘কাঠবেড়ালী! কাঠবেড়ালী! পেয়ারা তুমি খাও?/ গুড়-মুড়ি খাও! দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?…’
এভাবেই শিশুদের আবেগকে ছন্দে বেঁধেছেন চিরশিশু কবি নজরুল। তিনি শিশুদের মন বুঝতেন।
নজরুল দু’তিনবার চট্টগ্রামে যান। সেখানে গেলে হাবীবুল্লাহ বাহার ও তার ছোট বোন শামসুন্নাহারদের বাড়িতেই উঠতেন। শামসুন্নাহার মাহমুদের জ্যেষ্ঠ সন্তান তিন মাসের ছেলের জন্য লিখেন- ‘শিশু যাদুকর’ কবিতাটি। একদিন হাবীবুল্লাহ বাহার কবিকে বললেন, “এবার শিশুদের জন্য কিছু লিখুন না।” পরদিন সকাল বেলায় কবির খাতায় পাওয়া যায় ‘সাত ভাই চম্পা’ নামক বিখ্যাত কবিতাটি।
“প্রভাতী” কবিতায় ভোরের যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা অনবদ্য।
“ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি উঠো রে!
ঐ ডাকে জুঁই শাখে ফুল খুকি ছোটো রে!
খুকুমণি ওঠো রে! ….”
শিশুদেরকে নজরুল খুব ভালোবাসতেন। তাদের সাথে খেলা করতেন। গল্প করতেন। তাইতো ছন্দমাধুর্যে আর বর্ণনাভঙ্গির গুণে বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে তার শিশুরচনা। তিনি বলেন-
‘আমি হব সকাল বেলার পাখি’ কিংবা
‘আমি যদি বাবা হতুম,
বাবা হ’ত খোকা,
না হলে তার নামতা পড়া,
মারতাম মাথায় টোকা।’
অন্যদিকে, ছোটদের বন্ধু নজরুল সারা জীবন ধরে ছোটদের ডাক দিয়েছেন-
‘তুমি নও শিশু দুর্বল
তুমি মহৎ ও মহীয়ান
জাগো দুর্বার, বিপুল বিরাট
অমৃতের সন্তান।’
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র, ইংরেজি ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু রেখে যান তার বিচিত্র সব সৃষ্টিশীল রচনা। গান, কবিতা, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আজো তার সৃষ্টির মাঝে বেঁচে আছেন।

Share.

মন্তব্য করুন