যারা জানেন না, তারা ভাববেন ফুটবল, ভলিবল, বাস্কেটবলের নাম শুনেছি। হ্যান্ডবলটা আবার কী। বাংলাদেশের ৫৩টি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন আছে। তন্মধ্যে হ্যান্ডবল একটি জনপ্রিয় খেলা।
হ্যান্ডবল খেলাটির জন্ম জার্মানিতে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। জার্মান গীতি কবিতায় ক্যাচবল নামে একটি খেলার উল্লেখ আছে। ধারণা করা হয়, সেখান থেকেই উৎপত্তি আজকের হ্যান্ডবলের। ১৯৮৩ সালে হ্যান্ডবল চর্চা শুরু হয় বাংলাদেশে। ৪০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ২০ মিটার প্রস্থের মাঠে হয় এই খেলা। গোলপোস্টের ক্রসবারের উচ্চতা ২ মিটার এবং দৈর্ঘ্য হয় ৩ মিটার। ৭০ মিনিট খেলা হয়। তন্মধ্যে একেক অর্ধ ৩০ মিনিট। দুইজন রেফারি, একজন টাইম কিপার এবং একজন স্কোরার দ্বারা এই খেলা পরিচালিত হয়। প্রতি দলে থাকে ১২ জন। এর মধ্যে মাঠে একজন গোলকিপারসহ মোট আটজন খেলোয়াড় একসঙ্গে খেলে। খেলাটির চারটি কলাকৌশল হচ্ছে বল ধরা, বল পাস দেয়া, গোলে বল মারা এবং গোল করতে বাধা দেয়া।
এই হ্যান্ডবলেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ মেয়ে হ্যান্ডবল দল। শুধু কি তাই। ৫০ বছরের ইতিহাসে ভারতকে কোনো পর্যায়েই হারাতে পারেনি। সেই ভারতকে হারিয়েই শিরোপা উল্লাস করে লাল-সবুজের মেয়েরা। বাংলাদেশের মাটিতে কদিন আগে হয়ে গেল আইএইচএফ চ্যালেঞ্জ ট্রফি। অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও মালদ্বীপ। অনূর্ধ্ব-১৭ ও ১৯ দুটি ইভেন্টে প্রতিযোগিতা হয়। তাতে অনূর্ধ্ব-১৭ গ্রুপে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন, ভারত রানার্স আপ, মালদ্বীপ তৃতীয় ও নেপাল চতুর্থ হয়। আর অনূর্ধ্ব-১৯ গ্রুপে ভারত চ্যাম্পিয়ন, বাংলাদেশ রানার্স আপ, মালদ্বীপ তৃতীয় ও নেপাল চতুর্থ। স্বাগতিক চ্যাম্পিয়নদের কোচ ছিলেন ডালিয়া আক্তার ও আমজাদ হোসেন।
হ্যান্ডবলের ইতিহাসে দেশে বিদেশে নানা ট্রফি এবং স্বীকৃতি অর্জন করলেও লাল সবুজরা কখনো হারাতে পারেনি শক্তিশালী ভারতকে। সেটি হোক বয়সভিক্তিক কিংবা জাতীয় দল। অলিম্পিকে এবং ওয়ার্ল্ড হ্যান্ডবলে খেলা ভারতকে হারানোর কল্পনা করাও ছিল ধৃষ্টতা। সেই ধৃষ্টতাকেই ধুলায় পর্যবসিত করেছে কোচ ডালিয়ার শিষ্যরা। মাত্র এক মাসের ট্রেনিংয়ে মোসা: মারফি-রুনা লায়লা-দিয়ারা ফাইনালে ৪৬-৪৩ গোলে হারিয়ে দিয়েছে বছরজুড়ে অনুশীলন করা ভারতের মেয়েদের। এই জয়ে সাউথ-সেন্ট্রাল এশিয়া জোন-২ এ দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলবে।
গ্রুপ পর্বে অনূর্ধ্ব-১৭ দল মালদ্বীপকে ৫০-০৪ ও নেপালকে ৪৮-১০ গোলের বড় ব্যবধানে হারিয়ে তৃতীয় ম্যাচে ভারতের সাথে গ্রুপ শীর্ষের লড়াইয়ে ৪৩-৩৩ গোলে হেরে শীর্ষ দুইয়ে থাকে মারফি বাহিনী। সে হিসেবে ফাইনালে তেমন একটা সমীকরণেই ছিল দল। তবে খেলার আগে কোচ ডালিয়া এবং পিচ্ছি খ্যাত রুনা লায়লা (৪ নং জার্সি) জানালেন সাধ্যের সবটুকুই দিবো। প্রধান গোলরক্ষক দিয়াকে ছাড়া এত সাহসী কথাবার্তার প্রমাণ পাওয়া গেল ফাইনাল শেষে। প্রথমার্ধে ২০-২০ গোলে সমতা। সারাক্ষণ এগিয়েই ছিল ভারতের কন্যারা। বেশির ভাগ সময় পেন্ডুলামের মতো দুলেছে ম্যাচের ভাগ্য। দুদলের তীব্র লড়াইয়ে একবার ভারত এগিয়ে যায় তো গোল করে আবারো সমতায় ফেরে বাংলাদেশ। এর মাঝে আরো একজন কিপার মিথিলা ইনজুরিতে পড়ে। পরে তৃতীয় গোলরাক্ষক আয়েশা সামাল দেন ভারতের আক্রমণগুলো। ম্যাচে পরিষ্কার ব্যবধানে এগিয়ে ছিল ভারত ৩৩-২৮ গোলে। চার মিনিট বাকি থাকতে স্কোরবোর্ডে ৪০-৪১। অর্থাৎ প্রথমবারের মতো লিড মারফি বাহিনীর। গ্যালারিতে দর্শকের গগন বিদারী চিৎকারে মেয়েরা পেল আত্মবিশ্বাসের জ্বালানি। তাতেই পুড়ে ছাই ভারত। ৬০ মিনিট শেষ স্কোরবোর্ডে জ্বলজ্বল করছিল ৪৬-৪৩।
কোচ ডালিয়া জানালেন, ‘দলের ইনজুরির কথা চিন্তা করে একজন খেলোয়াড় কম নিয়ে একজন কিপার বেশি নিয়েছি। যার ফলে এই সাকসেস। এক মাসের ট্রেনিংয়ে এ অবস্থা। যদি ভারতের মতো সারা বছর প্র্যাকটিসে থাকে তাহলে ভালো পর্যায়ে যাবে বাংলাদেশ। শেষ হাসিটা বাংলাদেশ হাসতে পেরেছে এজন্য সবার কাছে কৃতজ্ঞ।’
ফাইনালে দলের প্রাণ ছিল মারফি ও রুনা লায়লা। অনূর্ধ্ব-১৭ তে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার উঠেছে মারফির হাতে। পঞ্চগড় তেঁতুলিয়ার এই কন্যা বলেছেন, ‘ভারতকে প্রথমবারের মতো হারাতে পেরেছি এটা যেমন আনন্দের তেমনি বাংলাদেশের জন্য কিছু একটা আমরা করতে পেরেছি তাতে গর্বিত।’
দলে সবার চেয়ে ছোট রুনা লায়লা। ফাইনালে করেছেন ১৪ গোল। জানালেন, ‘গ্রুপ ম্যাচে যখন ভারতের মেয়েদের বিপক্ষে খেলেছি তখন খুব ভয় পেয়েছি। তাদের উচ্চতা-স্টেমিনা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছি। তবে ফাইনালে কোনো ভয় ছিল না। এ জয় দেশের ১৭ কোটি মানুষের।’

ক্রি কে ট

শ্রীলঙ্কার সাথে পারলোনা জ্যোতিরা
মিড অফে নিলাকশি ডি সিলভার সহজ ক্যাচ ছাড়লেন জাহানারা আলম। এই পেসারকেই শেষ ওভারে তুলাধুনা করলেন নিলাকশি। তার ও হার্শিথা সামারাবিক্রমার ফিফটিতে দেড়শ ছাড়াল শ্রীলঙ্কা নারী দলের সংগ্রহ। বোলিং-ফিল্ডিংয়ের মতো ব্যাটিংয়েও বিবর্ণ ছিলেন বাংলাদেশের মেয়েরা। তাতে লক্ষ্যের ধারে কাছেও যেতে পারেনি নিগার সুলতানার দল। কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তৃতীয় ও শেষ টি-২০তে ৪৪ রানে হেরেছে বাংলাদেশ। প্রথমটি জয়ের পর টানা দুই ম্যাচে হারের তেতো স্বাদ পেল তারা। তাতে তিন ম্যাচের সিরিজটি ২-১ ব্যবধানে জিতে নিলো লঙ্কানরা।
সিরিজ জিতলো তামিম বাহিনী
মে মাসটাই যেন ছিল খেলোয়াড়দের। তবে ক্রিকেটটাই বাংলাদেশের জন্য হলো যুৎসই। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করেছে অনেক আগেই। আয়ারল্যান্ডের সাথে দ্বিপাক্ষিক সিরিজটা যেন হয়ে রইলো প্রস্তুতির। ঘরের মাঠে হোয়াইটওয়াশ করার পর ফিরতি সিরিজে ইংল্যান্ডে গিয়ে খেললো টাইগাররা। তাদের হুঙ্কারে উড়ে গেল আইরিশরা। নিজেরদের মাটিতে না খেলে তারা ভেনু হিসেবে বেছে নিলো ইংল্যান্ডকে। তাতে কী ?
ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে সুপার লিগের সিরিজের প্রথম ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যায়। সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন ভাঙে আয়ারল্যান্ডের। দ্বিতীয় ম্যাচে রেকর্ড রান তাড়া করে শেষ ওভারে অসাধারণ এক জয় তুলে নেন টাইগাররা। শেষ ম্যাচেও বুক কাঁপিয়ে জিতল লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।
ম্যাচের লাগাম ছিল আইরিশদের হাতে। জয় ছিল সময়ের ব্যাপার। ওই জয় ছিনিয়ে এনেছেন টাইগার পেসার মোস্তাফিজুর রহমান। তার দুর্দান্ত বোলিংয়ে চেমসফোর্ডে সিরিজের শেষ ম্যাচে ৪ রানের রোমাঞ্চকর জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। সিরিজ জিতে নিয়েছে ২-০ ব্যবধানে।
ঐদিন টস হেরে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। অভিষিক্ত ওপেনার রনি তালুকদার (৪) ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। এরপর তামিম-শান্ত-লিটনরা সেট হয়ে সাজঘরে ফেরেন। তাদের ছোট ছোট সংগ্রহে সাত বলতে থাকতে অলআউট হওয়ার আগে ২৭৪ রান তোলে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের দল। বাংলাদেশ দলের হয়ে তামিম ইকবাল সর্বোচ্চ ৬৯ রান যোগ করেন। শান্ত ও চারে নামা লিটনের ব্যাট থেকে আসে ৩৫ করে রান। এছাড়া মুশফিক ৪৫ ও মিরাজ ৩৭ রান যোগ করেন।
জবাব দিতে নেমে শুরুতে উইকেট হারায় আইরিশরা। তবে দ্বিতীয় উইকেটে শতক ছাড়ানো জুটি গড়েন আন্দ্রে বালবির্নি ও পল স্টার্লিং। তারা ফেরার পরে ম্যাচের লাগাম হাতে নেন হ্যারি টেক্টর ও লরকান টাকার। তাদের জুটিতে জয় দেখছিল আইরিশরা। নাজমুল শান্ত বল হাতে নিয়ে ওই জুটি ভেঙে ব্রেক থ্রু দেন। স্বাগতিকরা জয় হতে তখন ৫০ রান দূরত্বে। মোস্তাফিজ ৪৩তম ওভারে ক্যাম্পার ও ৪৫তম ওভারে জর্জ ডকরেলকে ফিরিয়ে ম্যাচ জমিয়ে দেন। ৪৭তম ওভারে ৫০ রান করা টাকারকে বোল্ড করে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেন।
শেষে ১০ বলে ২০ রান করে ভয় ধরিয়েছেন মার্ক এডায়ার। পথের ওই কাঁটা সরান হাসান মাহমুদ। শেষ ম্যাচে দলে ফেরা মুস্তাফিজ ১০ ওভারে ৪৪ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হয়েছেন। এ ছাড়া হাসান নেন দুই উইকেট। আইরিশদের হয়ে মার্ক এডায়ার নেন ৪ উইকেট। এই জয়ে বাংলাদেশ ওয়ানডে সুপার লিগে দুইয়ে থাকা ইংল্যান্ডের সমান ১৫৫ পয়েন্ট তুলেছে।

মিশন সাকসেসফুল
১৫৫ পয়েন্ট নিয়ে আইসিসি ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ সুপার লিগে তিনে থেকে শেষ করলো বাংলাদেশ। সমান পয়েন্ট বর্তমান বিশ্ব চ‌্যাম্পিয়ন ইংল‌্যান্ডেরও। কেবল নেট রান রেটে এগিয়ে থাকায় তারা দুইয়ে। ১৭৫ পয়েন্ট নিয়ে নিউ জিল‌্যান্ড শীর্ষে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে অনেক আগেই। অধিনায়ক তামিম চেয়েছিলেন শীর্ষ চারে থেকে আইসিসি সুপার লিগ শেষ করতে। তিনে থাকায় নিজেদের মিশন সাকসেসফুল।
যে অনিশ্চয়তা নিয়ে বাংলাদেশের সুপার লিগের যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং যেখানে এসে শেষ করলো তাতে নিজেদের সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের ফরম‌্যাটের সাফল্য সন্তুষ্টই থাকার কথা সকলের। ২৪ ম‌্যাচে ১৫ জয়, ৮ হার। ১ ম‌্যাচে ফল বের হয়নি।
হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপার লিগে মোট আটটি সিরিজ খেলেছে। ঘরের মাঠে চারটি। বাইরেও চারটি। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৩-০, শ্রীলঙ্কাকে ২-১, আফগানিস্তানকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়েছে। কেবল ইংল‌্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ হেরেছে। সেটাও ২-১ ব‌্যবধানে।
দেশের বাইরে জিম্বাবুয়েকে ৩-০ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ২-১ ব্যবধানে। নিউ জিল‌্যান্ডের বিপক্ষে হেরেছে ৩-০ ব‌্যবধানে। আয়ারল‌্যান্ডের বিপক্ষে ২-০ ব‌্যবধানে সিরিজ জিতে শেষটা মধুর হলো।
দুটি ম‌্যাচ শেষ মুহূর্তে জিতে নিজেদের স্নায়ু স্থির রাখার পরীক্ষায় সফল বাংলাদেশ। আগে দেখা যেত, এসব কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেদের প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখতে না পেরে, তালগোল পাকিয়ে অনেক সময়ই ম‌্যাচ খুইয়ে দিতো। প্রতিপক্ষ যেমন-ই হোক অন্তিম মুহূর্তে ম‌্যাচ হারছে না বাংলাদেশ। আত্মবিশ্বাস রাখছে নিজেদের স্কিলে। প্রক্রিয়ায় সফল হচ্ছে। যা নিঃসন্দেহে বড় দল হয়ে উঠার নিদর্শন।
ওয়ানডে ক্রিকেটের সফলতম অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা দায়িত্ব ছাড়ার পর তামিম নেতৃত্বভার পান। অধিনায়কত্ব নিয়ে বিরাট চ‌্যালেঞ্জ ছিল তার সামনে। আইসিসি সুপার লিগসহ অন‌্যান‌্য ম্যাচগুলোতে ভালো করায় অধিনায়ক তামিমের ওপর থেকে সেই চাপ সরে গেছে নিশ্চিতভাবে। কিন্তু ব‌্যাটসম‌্যান তামিমের সামনে বিরাট চ‌্যালেঞ্জ। তা কিভাবে মোকাবেলা করবেন সেই পথ নিশ্চয়ই তার জানার কথা।
পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে ধারাবাহিক সাফল্যে বাংলাদেশ অন্যতম পরাশক্তি হয়ে উঠেছে। ২০২৩ বিশ্বকাপ হতে পারে নিজেদের মেলে ধরার সেরা মঞ্চ। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা ওয়ানডে সুপার লিগে সফল। বাংলাদেশ নিজেদের চ‌্যালেঞ্জে (চারে থাকার) জেতায় মানসিকভাবে বিশ্বকাপে আরও চাঙ্গা থাকতে পারবে।

Share.

মন্তব্য করুন