তৃতীয়ার চাঁদ মদীনার আকাশ থেকে বিদায় নিয়েছে। খেজুর বাগানের ফাঁক দিয়ে চাঁদের ক্ষীণ আলোক আভা বিলীন হয়ে গেছে। পুরো নগরী জুড়ে কালো আঁধার নেমে এসেছে। রাজধানীতে কোলাহল নেই। নিস্তেজ, নিথর, অবসন্ন রাজধানী। কোন জনমানবের চিহ্ন নেই। সবার চোখে নেমে এসেছে গভীর ঘুম। চারদিকে শুধু নীরবতা, নিস্তব্ধতা।
মসজিদে নববী থেকে সামান্য দূরে একটি ঘর। সে ঘর থেকে একজন লোক হঠাৎ বেরিয়ে এলেন রাজপথে। লোকটি মসজিদে নববীর আঙিনা আর তার আশপাশ থেকে শুরু করে সারা মদিনা চষে বেড়ালেন। পাকা শিকারির মতো কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু পাচ্ছেন না। হন্যে হয়ে ছুটছেন রাজপথ থেকে অলি-গলি এবং উপশহর। এখানেও খুঁজে পেলেন না তাঁর কাক্সিক্ষত বস্তু বা ব্যক্তি।
লোকটি আরো মরিয়া হয়ে উঠলেন। তাঁর ঈপ্সিত বস্তু বা ব্যক্তিকে যেন পেতেই হবে। তিনি উপশহরের শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালেন। যেখানে বিশাল মরু প্রান্তর এসে ঠেকেছে। বিস্তীর্ণ ধু-ধু মরুভূমিতে নেমেছে রাতের হিমেল কুয়াশা। ঘন কুয়াশার আস্তরণ চারিদিকে, খালি চোখে বেশি দূরে কিছুই দেখা যায় না। লোকটি সে কুয়াশাচ্ছন্ন মরুভূমির এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন নির্নিমেষ দৃষ্টিতে। ঝটকা ঝটকা কুয়াশা তাঁর চাহনিতে বাধা দিচ্ছে। তবুও তিনি দেখেই যাচ্ছেন। হালকা মরু বাতাসে কুয়াশার আস্তরণ কিছুটা কেটে গেছে, এমন সময় লোকটির চোখে স্পষ্ট হলো একটি আলোক শিখা মিট মিট করে জ¦লছে দূরে, বহুদূরে। যেখানে দৃষ্টি গিয়ে ফিরে আসে, ঠিক মধ্য মরুতে।
লোকটি আর স্থির থাকতে পারলেন না। ছুটলেন দ্রুত গতিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে দাঁড়ালেন একটি তাঁবুর পাশে। লোকটির কাছে এ তাঁবুটি সম্পূর্ণ নতুন মনে হলো। ইতঃপূর্বে এখানে কোনো তাঁবু ছিল না। এগিয়ে গেলেন তাঁবুর সামনে। একটি সহজ-সরল গ্রাম্য লোক উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে হতাশার কালো ছায়া। রাজধানী থেকে আগত লোকটি হতাশাগ্রস্ত লোকটিকে সালাম জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? লোকটি হকচকিতে উত্তর দিলেন : জি! আমি একজন মুসাফির। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন : কোত্থেকে আসছেন আর কোথায়ইবা যাবেন আপনি? লোকটি বলল, তেহেসার পল্লী থেকে এসেছি, রাজধানী যাবো। এতো রাতে রাজধানীর পথে কেন?
তিনি মুসাফিরকে পুনরায় জিজ্ঞেস করেন। মুসাফির এবার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন, আপনি কি এই মরুভূমির পাহারাদার যে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছেন? না তা নয়; এতো রাতে এ নির্জন মরুতে তাঁবু ফেলে খুব হতাশাচিত্তে দাঁড়িয়ে আছেন, মনে হয় কোন জরুরি প্রয়োজনে মদীনা যাচ্ছেন, তাই একটু জানতে চাই। মুসাফির একটু নরম হয়ে উত্তর দিলেন: আমি খুব দুঃখ-দারিদ্র্যের মাঝে দিনাতিপাত করছিলাম। কিন্তু এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত মরুভূমির পাথর চিবিয়ে খাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তাই মদীনায় খলিফার দরবারে যাবার মনস্থির করেছি। পথে অনেক রাত হলো বলে আপাতত ভোর পর্যন্ত এখানেই থাকবো।
মুসাফিরের কথায় পথিকের হৃদয়ে সমবেদনার সঞ্চার হলো। ঠিক এ মুহূর্তে তাঁবুর মধ্যে থেকে কোন মহিলার কাতর কণ্ঠ শোনা গেল। মদীনার লোকটি ত্বরিত প্রশ্ন করলেন, তাঁবুর ভেতরে যেন কোন মহিলা কাঁদছে? তাতে আপনার কী? মুসাফির পাল্টা প্রশ্ন করলেন। মদীনার লোকটি আবার কিছু জানতে চাইলে মুসাফির খুব বিরক্ত হয়ে বললো, পথিক! আপনার পথে যেতে পারেন। এতো রাতে শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে চলছেন কেন? আপনার কি কোন খারাপ উদ্দেশ্য আছে?
এ বলে মুসাফির তাঁবুর ভেতরে ঢুকে যেতে চাইলেন। মদীনার লোকটি অত্যন্ত দরদভরা সুরে বললেন, দেখুন ভাই; তাঁবুতে কোনো মহিলা খুব কষ্ট পাচ্ছেন। হয়তো আপনার সহধর্মিণীও হতে পারেন। যদি তাঁর কষ্টের কারণ জানতে পেতাম, তাহলে হয়তো কোন উপকারে আসতাম। না জানি বেচারি কত কষ্টে আছে! লোকটির ¯েœহভরা কথায় মুসাফিরের হৃদয় মোমের মতো গলে গেলো। মুসাফির স্বাভাবিকভাবে বললেন, আপনি ঠিকই বলছেন, তাঁবুতে আমার স্ত্রী। তিনি গর্ভবতী। হঠাৎ পথিমধ্যে তার প্রসববেদনা দেখা দিয়েছে। আমি পুরুষ মানুষ, ওসব কিছু বুঝি না। সাথে অন্য কোনো মহিলাও নেই যে, একটু সাহায্য করবে। আল্লাহই জানেন আমার স্ত্রীর কী যে হয়? কথাগুলো বলতে বলতে মুসাফির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ মুছলেন।
পথিক আর স্থির থাকতে পারলেন না। তাঁর কাক্সিক্ষত ফরমায়েশ যেন মিলে গেলো। সামান্য কিসব ভেবে তড়িঘড়ি বললেন, ভাইজান! আপনি একটুও চিন্তিত হবেন না। আমি এক্ষুনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করছি। আপনি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন।
পথিক খুব দ্রুত মদীনায় ফিরে এলেন। রাত গভীর থেকে গভীরতর। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তিনি স্ত্রীর পাশে গিয়ে ধীরে ধীরে ডাকলেন, উম্মে কুলসুম! উঠো, দেখ তোমার জন্য কি নিয়ে এসেছি। উম্মে কুলসুম স্বামীর কণ্ঠধ্বনি শুনে আধো ঘুমে চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসলেন। পথিক স্ত্রীকে আবার বললেন, বাইরে একটি বড় সওয়াবের কাজ ঠিক করে তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি। চলো তাড়াতাড়ি। উম্মে কুলসুম সওয়াবের কাজের কথা শুনে সচল হয়ে উঠলেন। স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললেন: কোথায় সে কাজ? বলুন, আমাকে কী করতে হবে?
স্বামী উত্তর দিলেন, গ্রামের এক অতি দরিদ্র মহিলা মরুভূমিতে প্রসব বেদনায় বড্ড কষ্ট পাচ্ছে। সঙ্গে আর কোন মেয়েলোক নেই যে একটু সাহায্য করবে। বেচারি খুব অসহায়। তুমি একটু সাহায্য করলে মহিলাটি হয়তো এ কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি পেতে পারে। তোমাকে কাছে পেলে মনোবলও ফিরে পাবে নিশ্চয়ই।
প্রিয়তম স্বামী! আপনি আদেশ দিন আমি এক্ষুনি যেতে প্রস্তুত। উম্মে কুলসুম উদগ্রীব হয়ে সায় দিলেন।
লোকটি নির্দেশ দিলেন : আল্লাহ্ তোমার মঙ্গল করুন; জলদি প্রস্তুত হয়ে নাও। প্রসব সারাবার জন্য যা যা প্রয়োজন সব সঙ্গে নিও। প্রাথমিক খাবার তৈরির কিছু খাদ্যদ্রব্য নিতেও ভুলনা কিন্তু।
উম্মে কুলসুম এক পলকে সবকিছু গুছিয়ে নিলেন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে প্রাণপণ জোরে হেঁটে তাঁবুর কাছে উপস্থিত হলেন নিমেষে। মুসাফির তাঁবুর সামনে উ™£ান্তের মতো পায়চারি করছিলো। তাঁবুর ভেতর থেকে মহিলার যন্ত্রণা কাতরকণ্ঠ আরো উচ্চকিত হয়ে মরুভূমির নিস্তব্ধতাকে বিষিয়ে তুলছিল। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে আর দেরি করলেন না। উম্মে কুলসুমকে তাঁবুর ভেতর পাঠিয়ে মুসাফিরকে কাছে ডেকে নিলেন। বললেন, সারাদিন হয়তো আপনারা কিছুই খেতে পাননি। আসুন আমার বাড়ি থেকে আনা সামান্য খাদ্য উনুনে পাকিয়ে নিই। মুসাফির ক্লান্ত-শ্রান্ত মনে পথিকের পাশে বসে পড়লেন। পথিক মরুবালু খুঁড়ে তৈরি করলেন উনুন। জ¦ালালেন আগুন। হাঁড়িতে ঢেলে দিলেন ময়দা, আটা, ঘি।
ক্ষণিকের মধ্যে উম্মে কুলসুম পুরো তাঁবুটি সাজিয়ে নিলেন মাতৃসদনের মতো করে, প্রসূতির জন্য যেরূপ প্রয়োজন। আল্লাহ্র কৃপায় মহিলাটি অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রসব করলেন এক ফুটফুটে সন্তান। তাঁর মন থেকে মুছে গেল সব জড়তা। সৃষ্টির আনন্দে অবসন্ন চেহারায় দেখা দিলো উজ্জ্বল আভা।
পথিকের রান্নাও প্রায় শেষ হয়ে এলো। উনুন থেকে নামালেন হাঁড়ি। একটু শীতল হলেই মুসাফিরকে আহার করাবে। এমন সময় তাঁবুর পর্দা ফাঁক করে উম্মে কুলসুম স্বামীকে ডেকে বললেন, আমিরুল মু’মিনিন! আপনার বন্ধুকে সুসংবাদ দিন, তাঁর একটি চাঁদের মতো ফুটফুটে পুত্রসন্তান হয়েছে। খুশি মনে পথিক বলে উঠলেন- আলহামদুলিল্লাহ্।
মুসাফির লোকটির কান যেনো বন্ধ হয়ে এলো। চোখে বিদ্যুৎ চমকালো। সারা শরীরে এলো কম্পন। নুইয়ে পড়া বাঁশঝাড়ের মতো টলতে টলতে পথিকের পায়ের ওপর পড়ে বললেন, আমিরুল মু’মিনিন! মুসলিম বিশ্বের নেতা; আপনিই কি সত্য শাসক মহান খলিফা হযরত উমর?
“হ্যাঁ ভাই, আমিই তোমাদের খাদেম।”
এ কথা বলে হযরত উমর (রা.) মুসাফিরকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।
কালো আঁধারে ছেয়ে যাওয়া মরুভূমি যেন হয়ে গেলো দ্বাদশী চাঁদের ¯িœগ্ধ আলোয় ঝলমল মরূদ্যান। আমির-ফকিরের এক অপূর্ব মিলন। মুসাফির নিজ আচরণের জন্য ক্ষমা চাইতে উদ্যত হলে খলিফা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন: আমি তোমার কোনো উপকার করিনি ভাই। আল্লাহ্ মাফ করুন, আজ যদি আমার অবহেলার কারণে এ প্রসূতি এবং তাঁর সন্তানের খারাপ কোনো কিছু হতো, তবে কাল কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ্র বিচারালয়ের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো আমাকে। প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হতো, কেন যতেœর অভাবে ঐ প্রসূতি বা তার সন্তানের এমন হলো?
খলিফা সদ্য তৈরি খাবারের হাঁড়িটি তাঁবুর ভেতরে পাঠিয়ে প্রসূতিকে খাওয়াতে স্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন। স্ত্রী নব প্রসূতিকে খাইয়ে সেটি আবার বাইরে পাঠালেন। হযরত উমর (রা.) বাকি খাবারটুকুন লোকটিকে খেতে দিয়ে সস্ত্রীক বিদায় নিলেন। যাবার সময় মুসাফিরকে বললেন: সারা রাত জেগে রয়েছো ভাই; এখন ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকালে মদীনায় এসে আমার সাথে দেখা করো। দেখি তোমাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু করা যায় কি না!
Share.