ইফতেখার। শখের গোয়েন্দা ছিলাম, এখন আর নেই। ‘শখের’ বললাম বটে, কিন্তু বর্তমানের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য তখন ছিল না। ও পথ ধরেছিলাম পেটের দায়ে, গত্যন্তর না পেয়ে। প্রাইভেটে পড়াতাম রাসেলকে, নামটা দিয়েছিল রাসেলের কাকা। ওটা আসল নাম নয়। আসল নামটা বলতে বাধা আছে। গোয়েন্দাদের একটা অফিস লাগে। আমারও বালাই ছিল না। মোবাইল নম্বরে ফোন করলে আমিই গিয়ে হাজির হতাম মক্কেলের কাছে। নম্বর জানতে চাইবেন না। ওটা বদলেছি। কারণ ছিল। মক্কেল বলতে জুটেছিল অবশ্য একজনই। তবে তাই যথেষ্ট। সব অর্থেই, মোটা টাকা, বিপদের ঝুঁকি। কী করে যে এমন মালদার পার্টি আমার খোঁজ পেল জানি না। ভাগ্যের অনেক বিড়ম্বনা মুখ বুজে সয়েছি, কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করিনি। ভাগ্যের এই আকস্মিক সুপ্রসন্নতাও চোখ বুজে উপভোগ করেছি।
বিরাট একটা বাগানবাড়ি। এককালে কোনো জমিদারের বিলাসভবন ছিল সন্দেহ নেই। শুক্রবার ফোন পেয়েছিলাম, হাজির হলাম রোববার বিকেলে। শুক্রবার বিকেলেই হাজির হতে পারতাম। কিন্তু রাসেলের কাকা বলেছিল ফোন পাওয়ামাত্র হাজির হলে ধরা পড়ে যাবে মক্কেলের কাছে। তাছাড়া কাজটা তেমন জরুরি কিছু নয়। বাড়ির কিছু দরকারি কাগজ বাড়ির কোথায় যেন লুকিয়ে রাখা আছে, সেটা আমায় খুঁজে বার করতে হবে। প্রথমে মাথায় ঢোকেনি। যাদের বাড়ি তারা যদি খুঁজে না পায় তবে আমি কি করে পাবো? আমাকে তো বাথরুমে যেতে হলেই বাড়ির লোককে জিজ্ঞাসা করতে হবে! না, তা নয়, একটা নাকি গোপন নির্দেশ আছে, সেটা কোনো সাংকেতিক ভাষায় লেখা। কোনো খামখেয়ালি পূর্বপুরুষের কাজ। বহুদিন এমনিই পড়েছি। এখন হঠাৎ গৃহকর্তা সঙ্কেতের রহস্য ভেদ করতে চান। আরেব্বাস্, এ তো পুরো শার্লক হোমস কি ফেলুদার কেস! কত দেবে বলছে? দু’ হাজার। অ্যাঁ, মোটে দু’ হাজার? আমি ওদের কোটি টাকার গুপ্তধন উদ্ধার করে দেব, আর আমাকে দেবে মাত্র দু’ হাজার? না, না, এটা আগাম! সফল হলে আরও তিন দেবে। আর কোটি টাকার গুপ্তধন নয়, একটা মামুলি ডায়েরি। পারিবারিক স্মৃতিটৃতি কি সব লেখা। আর না পেলে? যাতায়াত ভাড়া, ওই ক’দিনের থাকা খাওয়া, আর ওই আগামটা তো আছেই। মন্দ কী! খুলনার এঁদো গলিতে বাড়ির লোকের মুখ ঝামটা খাওয়ার চেয়ে বড়লোকের বাড়িতে এক সপ্তাহ রাজার হালে থাকা। সঙ্গে দু’ হাজার টাকা, হ্যাঁ, ওই শেষের তিন হাজারের লোভ না করাই ভালো।
বাড়িটা যতটা জমকালো গৃহকর্তা ততটা নন। বেঁটে খাটো মানুষটা শুধু বাড়িটার সঙ্গেই নয়, পরণের ফৎবংংরহম মড়হি-টার সঙ্গেও যেন কেমন বেমানান। একটা মৃদু ঔদ্ধত্য আছে বটে, কিন্তু সেটা যেন বংশমর্যাদা রক্ষার দায়ে। এমনিতে ভদ্রই, গোবেচারা বললেও ভুল হয় না। পৈতৃক সম্পত্তির জোরেই চলে। শহরতলির দিকে কি একটা সিনেমাহলেরও মালিক। আরও কিছু আইনি-বেআইনি কারবারও হয়তো আছে, কে জানে! নইলে একটা ফালতু ডায়েরি খুঁজতে দু’ হাজার টাকা গচ্চা দেয়? কে জানে কি আছে ডায়েরিতে!
‘আপনিই ইফতেখার? প্রাইভেট আই?’ বেশ সম্ভরম হলো নিজের ওপর, সম্বোধনটা শুনে। এই রকম সময়ে শার্লক হোমস বা ফেলুদা হলে কী করতেন? বলা কঠিন। তাঁদের নিজের একটা অফিস ছিল নিজের বাড়িতে। নিজের ডেরায় বসে মক্কেলের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে যতটা স্মার্ট হওয়া যায়, এখানে মক্কেলের বাড়িতে এসে তা হওয়া কঠিন। তাছাড়া কেমন একটা ভয় ছিল যে আমার নামটা শুনে যতটা মনে করেছিলেন, হয়তো চেহারাটা দেখে নিরাশ হয়েছেন। অমূলক ভয়। আমি আসাতে উনি অত্যন্ত নিশ্চিন্ত বোধ করছেন। একটা মামলার কাজে ডায়েরিটা দরকার। পেতেই হবে। সাঙ্কেতিক লিপির কথা যেটা শুনেছিলাম, সেটাই। বাংলা আর ইংরেজি হরফে মিশিয়ে লেখা। আমাকে দেখাবেন রাতের খাওয়ার পর। আমার নিশ্চয়ই আমিষে আপত্তি নেই?
আপত্তি আমার আমিষ-নিরামিষ কিছুতেই নেই। খালি একটু তাড়াতাড়ি সেটা এলে ভালো হয়। পেটটা স্রেফ চুঁই চুঁই করছে। কিন্তু সেটা মুখ ফুটে বলা যায় না। দরকার অবশ্য হলো না। এক গ্লাস ফলের রস, এক প্লেট কাজুসমভিব্যাহারে রেকাবি-বাহিত হয় এসে হাজির। আমার নিশ্চয়ই আপত্তি নেই? একটু বিবেক দংশন হচ্ছিল। একটু ভয়ও। ডায়েরি খুঁজে না পেলে (পাওয়ার কোনো আশা দেখছি না) শেষটা কাজু আর ফলের রসসিক্ত অতিথিবাৎসল্য কী বিপরীত রূপ নেবে কে জানে? কিন্তু ক্ষুধার দংশনে বিবেক দংশন চাপা পড়ে গেল। ডায়েরি না পেলে আমি তো আর শেষের তিন হাজার চাইছি না! বিবেক সমস্যার নিষ্পত্তির আবেগে বোধ করি কাজু ও ফলের রস ভদ্রজনোচিত সময়ের আগেই অন্তর্ধান করেছিল। সেটা ভদ্রলোকের চোখ এড়ায়নি। আরেকটু দিতে বলব? গালের ত্বকের ভিতরে একটা গরম আভা বোধ করলাম। না না, ঠিক আছে, thank you! হোমস বা ফেলুদা হলে প্রথমেই এরকম কাঁচা কাজ করতেন না। কিন্তু তাঁদের রেটও নিশ্চয় বেশি হতো।
গ্রামের দিকে সন্ধ্যা হয় তাড়াতাড়ি। বাগানবাড়িটা কেমন যেন গা ছম্ছমে লাগছে। বিদ্যুৎ অবশ্য আছে। বসার ঘর আর খাবার ঘর দুটোই রীতিমতো আলোকিত। কিন্তু ওই বড় বড় সেকেলে জানালাগুলোর বাইরে কেবল জমাটবাঁধা অন্ধকার। জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকালে চোখে পড়ে অসংখ্য জোনাকি পুঞ্জে পুঞ্জে জ্বলছে নিভছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখে ঘোর লাগে, যেন বহু উপর থেকে একটা বিশাল রহস্যময় নগরীর দিকে চেয়ে আছি। জোনাকিগুলো যেন অসংখ্য গবাক্ষপথে আলোর ঝিকিমিকি। একটা অতি দ্রুতগতিসম্পন্ন সচলতার বহুদুরাগত ইঙ্গিত। কি যেন একটা রহস্যময় কর্মব্যস্ততা চলছে গোপনে গোপনে। কোনো এক অজানা যুদ্ধের প্রস্তুতি।

রাতের খাবারের আয়োজনে অভিনবত্ব ছিল। মাটিতেও নয়, টেবিলেও নয়। খাটো খাটো জলচৌকিতে থালা রেখে খাওয়া। জাপানি রীতি। কোন এক পূর্বপুরুষ জাপান গিয়েছিলেন, সেই থেকে এই কায়দা চালু করেছিলেন। না, ইনি সেই ডায়েরিলেখক পূর্বপুরুষ নন, তাঁর বড়ভাই। এই রকম রীতি নাকি পশ্চিমে খানদানি মুসলমানদের মধ্যেও আছে। অবশ্য আমি চাইলে টেবিলে বসেও খেতে পারি। না, না, জাপানি কায়দায় খেতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নেই, বিশেষত খাবার যেখানে উপাদেয়। কিন্তু ভদ্রলোক আমার আপত্তির কথা এত বার জিজ্ঞাসা করে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছেন। একবারও আপত্তি না করাটা ভদ্রজনোচিত হচ্ছে তো?
খিদে পেয়েছিল বেজায়। খাওয়াটাও হলো অসাধারণ। কিন্তু মন যেন ভদ্রলোকের উপর ঠিক প্রসন্ন হতে পারছিল না। কী গুণ আছে লোকটার? স্রেফ পৈতৃক সম্পত্তির জোরে চালাচ্ছে! মক্কেলের সম্বন্ধে হোমস বা ফেলুদার এই ধরনের মনোভাবের কথা শোনা যায় না। কিন্তু তাদের জীবনে অভাব ছিল না, আর তাছাড়া তাদের মনের সব কথা কি আর ওয়াটসন বা তোপ্সে লিখতে পেরেছে? গোয়েন্দার জীবনকাহিনী লেখা দায়িত্ব তাই একজন গুণমুগ্ধ সহকারীর উপর থাকাই ভালো। অভিনেতা নিজে সমালোচক হলে মঞ্চের কথা লিখতে সাজঘরের কথা লিখে বসে।
বেশ ঘুম আসছিল। ভোজনের বিলাসিতা দেখে মনশ্চক্ষে এর পর একটা দুগ্ধফেননিভ শয্যার ছবি ভাসছিল। কিন্তু আসল কথাটা ভদ্রলোক মনে করিয়ে দিলেন। সাংকেতিক লিপি। সেটা শোবার আগেই দেখাবেন উনি।
একটা সাদামাটা কার্ডে কিছু বাংলা ইংরেজি হরফ লেখা দুই লাইনে। মাথা-মুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একবার ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি যে এর সঙ্গে ডায়েরির কোনো যোগ আছে এমন মনে করার কারণ কী? তারপর ভাবলাম যে সেটা নিশ্চয়ই খুব কাঁচা প্রশ্ন হবে। হাজার হোক, আমিই কিনা গোয়েন্দা! হোমস হলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই আতসকাচ বার করে সাংকেতিক লিপির লেখকের জন্মতারিখ অবধি বলে দিত। আতস কাচের কথায় মনে পড়ল, ওই বস্তুটি আমার ব্যাগেও আছে। ঝকঝকে তীক্ষè চোখ আর আতস কাচ—এ ছাড়া গোয়েন্দা হওয়া চলে না। বাপ-মার কল্যাণে ঝকঝকে চোখ আমার আছে, বেশ ঘুম পেলেও সে দুটোকে যথাসম্ভব তীক্ষ্ণ করে বাগিয়ে রাখারও চেষ্টা করছি। আর আতস কাচটা জোগাড় করেছিলাম চৌরঙ্গীর ফুটপাথ থেকে। সেইটা দিয়ে গম্ভীর মুখে কাগজটার দিকে যথাসম্ভব তীক্ষèভাবে চেয়ে রইলাম। আর কেমন যেন মনে হতে লাগল ভদ্রলোক ততোধিক তীক্ষ্ণভাবে আমার কার্যকলাপ লক্ষ করছেন। সেটা আমার আত্মপ্রত্যয়ের অভাবজনিত ভ্রম নাকি সত্য, তা কে বলবে!
ফাউন্টেন পেনের কালিতে লেখা। গোটা গোটা হরফ। ইংরেজি অক্ষরগুলো সবই বড়হাতের। কাগজের উপরের ডানদিকে সামান্য কালির দাগ। যেন ওইখানে কাগজটাকে আঙুল দিয়ে চেপে ধরা হয়েছিল লেখার সময়ে। কিন্তু তাতে কি এসে যায়? হঠাৎ মনে হল এর একটা চলনসই ব্যাখ্যা হতে পারে এই যে লেখক বাঁহাতি, ডান হাতে কাগজটা চেপে ধরে বাঁহাতে লিখেছে। বাঃ, এইটা বেশ একটা গোয়েন্দাসুলভ মন্তব্য হতে পারে। খাবার সময়ে লক্ষ করেছি ভদ্রলোক নিজেও বাঁহাতি। এখন দেখা যাচ্ছে পূর্বপুরুষও বাঁহাতি। তাতে অবশ্য ডায়েরির হদিস কিছু মিলছে না, কিন্তু এই অস্বস্তিকর নিরীক্ষণ পর্বটার ইতি তো টানতে হবে একটা জুৎসইভাবে।
‘এটা বোঝাই যাচ্ছে যে আপনার সেই পূর্বপুরুষ বাঁহাতি ছিলেন’, বলি আমি, ‘কারণ লেখার সময়ে তিনি ডান হাতের আঙুল এখানে রেখেছিলেন।’
ভদ্রলোক কেমন থতমত খেয়ে গেলেন। ‘না না, ওটা তো পূর্বপুরুষ লেখেননি। ওটা লিখেছি আমি, এই একটু আগে, আপনাকে দেখাব বলে। লেখাটা একই, তবে মূল লেখাটা আছে একটা জরাজীর্ণ খেরোর খাতায়। সেটা সবসময়ে বার করা মুশকিল, তাই।’ আমি কি সেই মূল লিপিটা দেখতে চাই?
আলবত, অবশ্যই। মূল লেখা না সূত্র-টুত্র পাব কি করে, যাকে বলে পষঁব? কিন্তু তাহলে কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমার আপত্তি নেই তো?
দিল তো রাতের ঘুমটা নষ্ট করে! শেষ পর্যন্ত যে বেইজ্জৎ হতেই হবে সেটা ভেবেই এসেছিলাম, কিন্তু একবার লিপিটা দেখার পর পাঠোদ্ধারের দুষ্করতা এবং তার পর একটা অজানা লাঞ্ছনার অনিবার্যতা- এই দুটো অতিমাত্রায় প্রকট হয়ে ঘুম আসার সব সম্ভাবনাই দিলো মাটি করে।
মাঝারি মাপের ঘর। একধারে ছোটো খাট। পায়চারি করার জায়গা অনেকটাই। পায়চারি করেই গেল অনেকটা সময়। চিন্তাগুলো কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এত বড়লোক বাড়িতে থাকিনি কখনো। চারিদিকেই কেমন যেন বিলাসিতার চিহ্ন। কি হয় বিলাসিতা করে? যাদের এত টাকা তারা কেন একটা তুচ্ছ ডায়েরি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে? কী আছে ওতে? নাকি এটা একটা খামখেয়ালিপনা? মোটে দু’ হাজার টাকা দামের এক ধরনের বিলাসিতা? হয়তো এরা সবই বুঝতে পারছে। বুঝছে যে আমার নাম ইফতেখার নয়, আমার গোয়েন্দাগিরি করার কোনো এলেম নেই। হয়তো এও বুঝছে যে আমি কত অসহায়, বিপন্ন বোধ করছি। বুঝছে, আর বুঝে মজা পাচ্ছে, দু’ হাজার টাকা দামে কেনা মজা। আমার কাছে ওই টাকাটা অনেক, ওদের কাছে কিছুই না, তাই—। ডায়েরি খুঁজতে কখনো সাংকেতিক লিপি লাগে?
একটা ঘুমের ওষুধ আনা উচিত ছিল। গোয়েন্দা গল্পে কখনো কাজে নেমে গোয়েন্দা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোয় না। গোয়েন্দা গল্প লেখকদের তো আর নিজেদের গোয়েন্দাগিরি করতে হয় নি!
কি দরকার ছিল কাজটা নেবার? টাকার দরকার ছিল ঠিকই, একটা বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে ঢোকার জন্য। কিন্তু সেজন্য দরকার পঞ্চাশ হাজার। তুচ্ছ দু’ হাজারের লোভে এই ঝামেলায় জড়ানোর মানে কী ছিল? খামোখা ঝোঁকের মাথায়! সোমেনের কাকাটাই যত নষ্টের গোড়া!
আচ্ছা যদি ভদ্রলোককে সব খুলে বলি, ক্ষমা চেয়ে নিই? কিংবা যদি কোনোভাবে ডায়েরিটা পেয়েই যাই? অতি দুঃখেও কেমন যেন হাসি পেয়ে গেল। মাথাটা একটু ঠাণ্ডা লাগল। আশা করতে ক্ষতি কী?
শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কি সব যেন হিজিবিজি স্বপ্নও দেখলাম। ঘুম ভাঙল সাতটা নাগাদ, পাখির ডাকে।
দিনের আলোয় বাগানবাড়িটা ঘুরে দেখালেন ভদ্রলোক। খুব সুন্দর করে গোছানো বলা যায় না। বিলাসিতা আছে, কিন্তু সে যেন গতকালের উচ্ছিষ্টে কলঙ্কিত সোনার থালার মতো। বাড়িতে চাকরবাকর আছে জনাতিনেক। তাদের দু’জন পুরোনো, একজন বোধ হয় নতুন। কেমন যেন ধান্দাবাজ মতন দেখতে। একটা লাইব্রেরিও আছে। সেটাকে লাইব্রেরি না বলে, সংগ্রহশালা বলাই উচিত। বিদঘুটে সব মূর্তিটুর্তি রাখা আছে। তাদের নাকি বাজারে অনেক দাম। পূর্বপুরুষদের সংগ্রহ।
‘আমার কিছুমাত্র আগ্রহ নেই এসবে’, নিজে থেকেই জানালেন ভদ্রলোক। তবে বেচে দাও না কেন বাপু? কি লাভ এত টাকা ঘরের মধ্যে পাথর করে জমিয়ে রেখে?
একটা ঘোড়া দেখালেন। তার চোখ দু’টো নাকি দামি পাথরে তৈরি। কেমন যেন শ্যাওলা সবুজ রঙের। আহামরি কি এমন আছে কে জানে! বড়লোকের বড়লোকামি। কিছুমাত্র আগ্রহ দেখালাম না।
কিন্তু সেই পাথরেই যে আমার ভাগ্য খুলবে কে জানত!
সংগ্রহশালাতেই ছিল সেই খেরোর খাতা, যাতে আছে সাংকেতিক লিপির মূল সংস্করণ। খানিকক্ষণ আতস কাচ দিয়ে সেই খটমট লিপির দিকে কটমট করে চেয়ে রইলাম। স্পষ্ট কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু দিনের আলোয় গত রাতের মানসিক দৌর্বল্য কেটে গিয়েছিল। ফলে গোয়েন্দার অভিনয় করতে অসুবিধা হচ্ছিল না। লাঞ্ছনা যদি আসে তো আসবে, যে ক’দিন আরামে থাকা যায়। সেদিনটা গেল চিন্তা করতে। একটা ফিতে দিয়ে এদিক সেদিক কিছু মাপ নিলাম। ভদ্রলোকের বোধ হয় আর কোনো কাজ নেই, সর্বদা আমার সঙ্গে ঘুরছেন। দুপুরে ঘণ্টাখানেক বোধ হয় দিবানিদ্রা দিচ্ছিলেন, তখনও একটা চাকর আমার উপর নজর রাখছিল। কেমন একটা মরিয়া ভাব এসে গিয়েছিল আমার মধ্যে। এরা আমাকে এত পাহারা দিচ্ছে কেন? আমি কি চোর নাকি? এদের কি এত চুরির ভয়? ডায়েরি?
পরদিন ঘটল ঘটনাটা। দুপুরবেলা আমরা আবার সেই সংগ্রহশালায় গিয়েছিলাম। এখানেই ডায়েরিখানা আছে কোনো একটা মূর্তির পেটের মধ্যে, এইরকম একটা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম। সন্দেহটা ভদ্রলোকের মনে ধরেছিল। না ধরার কারণ নেই। ওই সব মান্ধাতার আমলের মূর্তিভরা ঘরে বিশ্বের যে কোনো রকম রহস্যই লুকিয়ে থাকতে পারে। মূর্তিগুলো তো আর ভেঙে দেখা যায় না। সুতরাং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঠিক কি যে দেখছি জানি না, খালি গম্ভীর মুখে তদন্ত করে চলেছি। ঠিক সেই মুহূর্তেই বুদ্ধিটা খেলে গেল মাথায়।
সেই ঘোড়ার মূর্তিটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম ভদ্রলোকের। মোটামুটি বড় আকার। স্বচ্ছন্দে একটা ছোটো ডায়েরি ভরে ফেলা যায় এর পেটে। যদি কোনো ফাঁক থাকে। হাতে নিয়ে দেখা যায় কি? কাচের বাক্সের চাবি বেরোলো। পুরোনো আমলের শোকেস, বেশ ভারী পাল্লা, চাবি ঢুকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কসরত করতে হল। পাল্লাটা খুলল একদিকে বেঁকে। মূর্তিটা হাতে নিয়ে দেখলাম, বেশ ভারী। পিছনে একটা ফুটো আছে বটে, কিন্তু আঙুল ঢোকাতেই বুঝলাম পথ একটু গিয়েই বন্ধ। কানের কাছে নিয়ে হালকা ঝাঁকুনি দিলাম। অতি মৃদু একটা রিনঝিন আওয়াজ শুনলাম যেন। কোথাও কিছু একটা ঢিলে আছে। কিন্তু নাঃ, ভিতরে ডায়েরি থাকলে সেটা ঢপর ঢপর করত। রেখে দিলাম মূর্তি শোকেসে। ভদ্রলোক তালা দিতে গিয়ে ঘটল বিপত্তি। যতই চাবি ঘোরান, তালা আর লাগে না। আটকে গিয়েছে কোনোভাবে। বিস্ময়কর নয়, যা পুরোনো জিনিস।
পাশের শোকেসেও একটা বেশ বড় মূর্তি ছিল, সেটাকেও একবার নেড়েচেড়ে দেখলাম। লাভ হলো না কিছুই।
দুপুরের খাওয়ার পরে ঘুমের একটা ঝোঁক আসে। ভদ্রলোকও ঘুমোতে যান বোধ হয়। আমি তখন আমার ঘরটায় থাকি, আর বাইরে বুড়ো চাকরটা থাকে, কিন্তু সেদিন সেও নেই। একদল কারা যেন এসেছে, শুটিং পার্টি। পুরোনো জমিদার বাড়ির শুটিং করবে বলে এই বাড়িটা দেখে যাবে। বুড়ো বোধ হয় তাদের তদবিরেই ব্যস্ত। এত বড় বাড়ি, কে যে কোথায় থাকে কে জানে! সুতরাং নিজের মতো কাটানোর পক্ষে আদর্শ দুপুর।
উঠে বসলাম একটা শোরগোল শুনে।
ব্যাপার সাংঘাতিক! সেই ঘোড়ার মূর্তির একটা চোখ খোয়া গিয়েছে। বাড়িতে গোয়েন্দা থাকতে চুরি! গোয়েন্দার পক্ষে এত বড় অপমান আর কী হতে পারে! এক প্রস্থ লাঞ্ছনা তো কপালে নাচছিলই, তার সাথে আরেক প্রস্থ বুঝি বা এখনই যোগ হয়। নাকি উল্টে পাথর উদ্ধারের ভারও আমার উপরেই ন্যস্ত হবে? কিন্তু তার চেয়েও সাংঘাতিক একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল মনে। আমাকেই শেষটা ধরবে না তো? হাজার হোক মূর্তির শোকেসের দরজা যে খোলা ছিল সে তো একরকম আমারই জন্য। নিজের বাক্সটা তন্ন তন্ন করে দেখে রাখি, কোনো সন্দেহজনক কিছু না থাকে।
ভদ্রলোক অনতিবিলম্বেই আমার ঘরে এলেন। ‘পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে তো?’ উৎকণ্ঠিত শুধুই আমি। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পুলিশে খবর দেওয়া হয়নি- এই কথাটা শোনার একটা মৃদু আশা ছিল প্রাণে। কিন্তু না, পুলিশে খবর দিতে লোক গিয়েছে। যতক্ষণ পুলিশ না আসে, কেউ যেন বাড়ির বাইরে না যায়।
‘আর একটা কথা, আপনি যে এখানে ডায়েরির ব্যাপারে এসেছেন তা যেন পুলিশকে বলবেন না। বলবেন আপনি আমার বন্ধু।’
ও হরি, এ দেখি নিজেই ভয়ে মরে! এদিকে এত বড়লোক, ওই দিকে পিছনে কি বাধিয়ে রেখেছে কে জানে!
পুলিশ এলো। সব শুনল টুনল। খানিক জিজ্ঞাসাবাদ করল। সন্দেহের প্রথম চোট শুটিং পার্টির ওপর দিয়ে গেল। আমাকে আর ওই ছোকরা চাকরটাকে খানিক টানা হ্যাঁচড়া করার উপক্রম করেছিল। কিন্তু ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে আমাকে ছাড়িয়ে নিলেন। কিছু একটা গোলমাল যে আছে সেটা আঁচ করেছিলাম অনেকক্ষণ থেকেই। ডায়েরির ব্যাপারটা ভদ্রলোক ভয়ানক গোপন রাখতে চাইছেন। পাছে আমাকে থানায় নিয়ে গেলে আমি বেফাঁস কিছু বলে ফেলি সেই ভয়ে নিতান্ত অপরিচিত আমাকে অনেক দিনের বন্ধু বানিয়ে দিলেন। আসলে বিশ্বাস যে কিছুমাত্র নেই তা তো টের পেয়েছি আমার উপর নজরদারি দেখেই।
হাবেভাবে মনে হয় যেন ঘোড়ার চোখের পাথর চুরি যাওয়াতে বিরাট বিচলিত নন ভদ্রলোক। পুলিশ ডাকাও যেন দায়সারা। ডায়েরি নিয়েই মাথা ব্যথা বেশি। কোনো মামলার কাজে লাগবে বলেছিলেন। হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য আছে তাতে। ডায়েরিটার যে হদিস মিলছে না, সেটা প্রতিপক্ষকে হয়তো জানানো চলবে না। এ সবই অবশ্য আমার কল্পনা। সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করতে সত্যিকারের গোয়েন্দা লাগবে।
পরবর্তী ঘটনা সামান্য। না, ডায়েরির হদিস করতে পারিনি। আরও দু’দিন তদন্তের অভিনয় করে শেষমেশ ক্ষান্ত দিয়েছিলাম। ভদ্রলোক আমার কাজে যে বিরক্ত হয়েছেন সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তবে ওই চুরি যাওয়া পাথর নিয়ে যে আমাকে ঝামেলায় ফেলেন নি, এতেই আমি খুশি।
ব্যর্থকাম হয়ে বিদায় নেবার একটা গ্লানি থাকতে পারত, কিন্তু আমি সেটা অনুভব করছিলাম না। খালি বিদায় নেবার আগে বাগানবাড়িটার চারধারে একবার ঘুরে আসতে গেলাম। এই শেষ পরিক্রমাটার খুবই দরকার ছিল। বড় কাঁঠালগাছের নিচে জমা পাতাগুলো পা দিয়ে একটু নাড়লাম। এই কাজটা কি ভুল করলাম? বিবেকের গ্লানি হয়নি তা নয়, কিন্তু অভাবের তাড়না থেকে মুক্তি পেতে মানুষ কি না করে!
সেই আমার প্রথম ও শেষ গোয়েন্দাগিরি। শেষের তিন হাজার পাইনি বলে দুঃখ নেই। কিই বা হতো তিন হাজারে? বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে ঢুকলাম মাস দুয়েক পরে। প্রথম একমাস পাথরটা বিক্রি করার সাহস পাইনি। বিস্তারিত বিবরণের আবশ্যক নেই। ঘোড়াটা প্রথমবার ঝাঁকিয়ে যখন বুঝলাম যে একটা চোখ আলগা হয়ে আছে সেই সময় থেকে যেন মোহাচ্ছন্নের মত কাজ করে গিয়েছি। কিভাবে ধাঁ করে একটুকরো কাঠি চাবির ফুটোয় ঢুকিয়ে শোকেসের তালাটাকে অকেজো করার কথা মাথায় এসেছিল, তা আমি নিজেই ভেবে পাই না। তারপর সেই দুপুরের কথা। নির্জনতার সুযোগে শেকেস থেকে ঘোড়াটা নিয়ে তার আলগা চোখটা খুলে নেওয়া এবং বেরিয়েই কাঁঠালগাছের নিচে জমা পাতার মধ্যে ফেলে দেয়া–আমাকে আরেকবার সেই কাজ দিলে আমি কিছুতেই পারব না।
বিবেচনাবুদ্ধি সম্পূর্ণ রহিত না হলে অতবড় ঝুঁকি কেউ নিতে পারে না। মোবাইলের নম্বর বদলালাম তার পরেই। পাথরটা বেচতে বেশ হাঙ্গাম হয়েছিল। কিন্তু সে বিবরণে যাবো না। বছর কয়েক কেটে গিয়েছে বটে তারপর, তবু ধরা পড়ার ভয়টা পুরো যায়নি কিনা।

Share.

মন্তব্য করুন