আকাশে বর্ষার লুকোচুরি খেলা। এমন আবহাওয়ায় সবার কোথায় যেতে মন চায় আমি জানি না, তবে আমার বারবার টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে মন চায়। ২০২৩ সালের এমন সময়ে নিজেদের পরিচিত ভাই ও বন্ধু মিলে আমরা ৮ জনের একটা গ্রুপ তৈরি করলাম। আমাদের গন্তব্য সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে।
আমরা চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে সিলেটের উদ্দেশে রওনা দিলাম। আমাদের ট্রেন রাতের ১১টা ৪৫ মিনিটে সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে দিলো। খোশ-গল্প করতে করতে ভোর ৬টায় আমরা সিলেট পৌঁছালাম। সবাই ট্রেন থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে নিলাম। চায়ের দেশে নেমে চা পান করবো না তা তো হয় না। চা খেয়ে আমাদের রওনা দিতে হবে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে।
জেনে রাখা ভালো, সিলেট থেকে তাহেরপুর ঘাটে যেতে প্রায় ৩ ঘণ্টার পথ। আমরা একটা লেগুনা ঠিক করেছি। ভাড়া ২০০০ টাকা। তিন ঘণ্টার মধ্যেই চলে এলাম তাহেরপুর ঘাটে। এখানে এসে প্রথমে একটা নৌকা ঠিক করলাম। ১০ হাজার টাকা আমাদের নৌকার ভাড়া। আজ দুপুরে ছাড়বে, কাল সকালে আবার নামিয়ে দিবে এই ঘাটে। আমাদের নৌকাটা ১০ জনের জন্যও বেশ বড়। ১২ জন থাকার সিট আছে। সেইসাথে দারুণ একটা ছাদ আছে।
বলে রাখা ভালো, টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে হলে অবশ্যই তাহেরপুর থানা থেকে অনুমতি নিতে হবে। থানা থেকে কনফার্মেশন নিয়েই নৌকা ছাড়া হয়। আমি সেই অনুমতির কাজটা সারতে সারতে আমাদের আরও একটা কাজ অন্য বন্ধুরা সেরে ফেলছে। সেটা হচ্ছে আমাদের দুপুরের খাবার, রাতের খাবার ও পরদিন সকালের খাবারের জন্য বাজার করা। নৌকায় উঠার সময় অবশ্যই যত বেলা খাবার খাবেন সে পরিমাণ বাজার করে উঠবেন।
নৌকায় উঠে আমরা আর দেরি করলাম না। সাথে সাথেই নৌকা ছেড়ে দিতে বললাম। আমাদের প্রথম গন্তব্য ওয়াচ-টাওয়ার। বিকেল ৩টার আগেই আমরা পৌঁছালাম ওয়াচ-টাওয়ারে। সেখানে গিয়ে ওয়াচ-টাওয়ার থেকে চারদিকের দৃশ্য উপভোগ করলাম। পানিতে কিছুক্ষণ খুনসুটিও করলাম। গোসল সেরে নৌকায় উঠতে উঠতে মাঝি বললো খাবার তৈরি করা সম্পন্ন হয়েছে। ইলিশ মাছের দোপেঁয়াজা, ডাল, আলুর ভর্তা, সালাদ আর সাদা ভাত। হাওরের মাঝখানে বসে এই খাবার যেন অমৃত।
খাবার খেয়ে আমরা সবাই জানালা দিয়ে হাওরের দৃশ্য অবলোকন করছি। এর মধ্যেই নৌকা চলছে, পরবর্তী গন্তব্য নীলাদ্রি লেকে। নীলাদ্রি লেকের পাড়ে নৌকা থামলো। আমরা কিছুক্ষণ নীলাদ্রি লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। বেশ সময় নষ্ট করলাম না। কারণ আমাদের লাকমা ছড়া যেতে হবে। একটা অটোরিকশা ঠিক করলাম। ২০০ টাকা ভাড়ায় আমাদের নিয়ে যাবে এবং সঙ্গে নিয়ে আসবে। আমরা লাকমা ছড়ার ঝর্নার ঠাণ্ডা পানিতে সারাদিনের সব ক্লান্তি দূর করে নিলাম। ঝরনায় সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত ছিলাম।
এরপর চলে এলাম নৌকায়। নৌকা হাওরের মাঝামাঝি কোথাও গিয়ে নোঙ্গর করলো। আমরা নৌকার ছাদে চলে গেলাম। হাওরের মাঝে, খোলা আকাশের নিচে আড্ডা দিতে দিতে রাত ১০টা। এমন সময় মাঝি গলা ছেড়ে আমাদের ডাকছেন খাবার খাওয়ার জন্য। রাতের খাবার, মুরগির মাংস, পাতলা ডাল, আলুর ভর্তা আর সালাদ। জম্পেশ খাবার হয়েছে।
খাবারের পর্ব শেষ করে রাতে সবাই আবারও আড্ডা দিলাম, বৃষ্টিতে ভিজলাম। প্রায় রাত ৩টায় সবাই ঘুমোতে গেলাম। বেশিক্ষণ ঘুমোতে পারিনি, ভোর ৬টায় আমাদের ডেকে দিলো মাঝি। মাঝি বললো, এবার আমরা ফিরে যাচ্ছি। চোখের পলকে সময় শেষ!
যাওয়ার পথে একটু অগভীর জায়গায় থামতে বললাম মাঝিকে। সবাই গোসল সেরে নিব। মাঝিও থামলো তেমন স্থানে। আমরা আমাদের শেষ আনন্দ আর খুনসুটি করে নিলাম পানিতে।
এদিকে আমাদের মাঝি সকালের খাবার তৈরি করে আমাদের পরিবেশন করছে। খিচুড়ি, ডিম ভাজা আর মরিচ-পেঁয়াজের ভর্তা। সকালের খাবারটা যেন আরও অমৃত। খাবার খেতে খেতে তীরের খুব কাছাকাছি চলে এলাম। অর্থাৎ তাহেরপুর ঘাটে।
এবার আমাদের ফেরার পালা। যেভাবে এসেছিলাম সেভাবেই আমরা ফিরবো। বেলা ১২.৪৫ মিনিটে আমাদের ট্রেন। তার আগে আমাদের সিলেট পৌঁছাতে হবে। আমরা ফেরার সময় লোকাল সিএনজি করে সুনামগঞ্জ বাস স্টেশনে গেলাম। জনপ্রতি ১২০ টাকা করে সিএনজি ভাড়া নিয়েছে। সেখান থেকে ২০০ টাকা বাস ভাড়া দিয়ে আমরা চলে এলাম সিলেট। আমরা প্রায় দুপুর ১২টায় পৌঁছালাম আমাদের গন্তব্যে। সবাই স্টেশনে গিয়ে চা-নাস্তা খেয়ে সময় মতো ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেনে বসে বসে ভাবছি, সময় কিভাবে ফুরিয়ে যায়!

Share.

মন্তব্য করুন