আলালের একমাত্র ছেলে জালাল। তাকে ডাক্তার বানানোর সাধ আছে, সাধ্য নেই। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। দিন আনে দিন খায়। সেখানে ছেলেকে ডাক্তার বানানো স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো। আট বছর বয়স হলো ছেলের। এখনো স্কুল ভর্তি করানো হয়নি। তবে স্কুলে ভর্তি করাতে একবার গিয়েছিলো। কাজ হলো না। অ্যাডমিশন ফির কথা শুনে চোখ কপালে উঠে যায় আলালের। ছেলেকে নিয়ে চলে এলো। চলার সময় বললো জালালকে ‘বাজান আমরা গরিব মানুষ। আমাদের সাধ থাকে কিন্তু সাধ্য থাকে না। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো তোকে পড়ালেখা করাতে। তুই দেখলি মাস্টার কত টাকা চাইলো। এত্তো টাকা কই পামু বাজান ক!’
জবাব পেলো না বাবা। জালাল নীরব। গরিব ঘরের ছেলে-মেয়েরা বাবা-মার কষ্ট বুঝে। সে জন্যই হয়তো সেদিন থেকে আর বায়না ধরেনি জালাল স্কুলে যেতে।
ক’দিন ধরে আষাঢ়ের টুপুরটুপুর বৃষ্টি। গ্রামে গঞ্জে কাজ নেই। প্রতিদিন এক বেলা খেয়ে সংসার চলে আলালের। আজ ঘরে কিছু নেই শুধু তিনটি ডিম আছে হাঁসের। তাদের চারটি হাঁস আছে। জালাল লালন পালন করে। সকালে বের হয় হাঁস নিয়ে আরেক বার সন্ধ্যার সময় আসে। সাথে হালকা খাবার নিয়ে থাকে। কিন্তু আজ মা দিলো না কোনো কিছু। ঘরে নেই মনে হয়। থাকলে দিত মা।
সন্ধ্যা, ঘনিয়ে এলো। এখনো হাঁস নিয়ে জালাল এলো না। মা তাই জোরে আওয়াজ করে ডাকছে- ‘এই জালাল কই তুই বাজান। এখনো এলি না কেনো। যলদি এসে পড়। সন্ধ্যা তো হয়ে গেলো।’ এই বলে বিলের দিকে যাচ্ছে। প্রতিদিন এই সময়ে চলে আসে। আজ আসছে না। বিপদ হলো নাকি! চিন্তায় পড়ে গেলো মা।
এদিকে হাঁস নিয়ে আসছিলো জালাল। হঠাৎ চলার পথে দেখতে পেলো একটি সাপ আর বেজি মারামারি করছে। জালাল মার কাছে শুনেছে বেজি মানুষের বন্ধু আর সাপ শত্রু হয়ে থাকে। বাবা বলেছে সাপ কে যেখানে দেখবি সেখানেই মেরে ফেলবি। তোর দাদুকে সাপ ছোবল দিয়ে মেরেছে। বাবার কথা রাখতে লাটি দিয়ে সাপের মাথায় বাড়ি দিয়ে মেরে ফেললো। দূরে মৃত সাপটিকে ফেলো আবার হাঁস নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো। তখন বেজি তার সামনে এসে মানুষের মতো অনর্গল বলে উঠলো, ‘বাঁচালে ভাই তুমি।’ আর একটু হলেই দম বন্ধ হয়ে যেতো।
ভয় পেয়ে যায় জালাল। ভাবলো সে মনে হয় রাক্ষস। আমাকে এখন খাবে। আমতা আমতা করে বলে ‘মা-নু-ষে-র কথা বলতে পারো তু-মি।
– আমাকে খেয়ো না আমি তোমার উপকার করছি।’
– না, না। আমি তোমাকে খাব না তুনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।
– তুমি রাক্ষস না?
– না আমি সত্যিই বেজি। তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?
– বাড়ি যাচ্ছি হাঁস নিয়ে।
– তুমি পড়ো না? সন্ধ্যার সময় তো মানুষের ছেলেপুলে পড়া লেখায় বসে।
– না পড়ি না।
– ওমা কেনো?
– আমরা গরিব। স্কুলে ভর্তি হওয়ার টাকা নেই। বাবার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার বানাবে কিন্তু টাকার জন্য ভর্তি করাতে পারে না। এই জন্য মাঝে মাঝে বাবা কান্না করে। তিনি দিনমজুর পড়ালেখার টাকা কোথায় পাবে বলো!
‘ওয়াক থু!’ করে বেজি। তার মুখ থেকে একটা জিনিস বের করে বলে, নাও এটা, তোমাদের দুঃখ কষ্ট দূর হবে।
– কী এটা? এটা দিয়ে কষ্ট দূর হবে!
– এটা হলো পরশ পাথর। এটা খুব মূল্যবান পাথর। যে কোনো জিনিসের গায়ে লাগাবে সেটাই সোনা হবে। বাবা-মাকে দিয়ে বলবে ছোট ছোট জিনিসের গায়ে লাগাতে তখন দেখবে সোনা হয়ে যাবে। তারপর সেগুলো বিক্রি করে তোমরা চলবে। আর স্কুলে ভর্তি হবে। তারপর ডাক্তার হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে। সাবধান তিন জনের বেশি কাউকে এই পাথরের কথা বলবে না।
– বললে কী হবে?
– পাথর অকেজো হয়ে যাবে আর কাজ করবে না। বাচ্চারা কান্না করছে একা একা বাসায়। আমি গেলাম ভালো থেকে। এই বলে চলতে লাগলো।
– আবার দেখা করো।
– দেখা হবে না এলাকা ছেড়ে চলে যাবো। আজ রাতেই।
– কেনো?
আর জবাব দিলো না। হয়তো শুনতে পায়নি।
জালাল বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে সব খুলে বললো। প্রথমে তারা বিশ্বাস করে না। তারপর একটি ছোট স্টিলের গ্লাসের গায়ে লাগালো অমনি সোনা হয়ে গেলো। বাবা মা অবাক হয়ে যায়। তারপর থেকে এইভাবে সোনা বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে। তাদের অভাবের দিন ফুরিয়ে যায়। জালালকে স্কুলে ভর্তি করে। তারপর একদিন জালাল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়। মেডিক্যালে পড়ে ক’দিন পরে ডাক্তারি ডিগ্রি নিয়ে বের হবে। এ নিয়ে বাবা-মা আনন্দে আত্মহারা। এখন তাদের সুখে দিন কাটে।
Share.