দুপুর গড়িয়ে বিকেল এখন। ভূমধ্যসাগরে সূর্যটা একটু একটু করে দিগন্ত রেখায় তলিয়ে যাচ্ছে। বাতাস নেই, তাই সমুদ্রে মৃদু ঢেউয়ের তরঙ্গ। টোকন মামা, অপু, তিয়ান ও টিয়ানা একটা পাল তোলা ইয়টে মাছ ধরায় ব্যস্ত। টোকন মামার অনেক দিনের শখ ছিলো সমুদ্রে মাছ ধরার। এই ইচ্ছের কথা একদিন তিনি কথা প্রসঙ্গে ইউএস নেভির অ্যাডমিরাল জন ওয়েলবিকে জানিয়েছিলেন। তিনি টোকন মামার বন্ধু। দু’জনেই একসাথে হার্ভার্ডে পড়াশোনা করেছেন। তিনি বন্ধুকে ইউএস নেভির রেগুলার সার্ভিস থেকে বাতিল হয়ে যাওয়া একটি ইয়ট দিয়েছেন। তবে বাতিল হলেও এই ইয়টটি এখনো যথেষ্ট মজবুত ও চলাচলের উপযোগী আছে। টোকন মামা ইয়টটিকে মেরামত করে মাছ ধরার উপযোগী করে নিয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে অপু একটা বড়সড় টুনা মাছ ধরেছে। ওরা ফিশিং হুক ও জাল উভয়টিই ব্যবহার করছে। একটু পরেই টিয়ানার ফিশিং হুকে একটা ব্লু ট্যাং মাছ ধরা পড়তেই সে ইয়াহু বলে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। টোকন মামা জাল ফেলে কয়েকটি পিরানহা মাছ ধরলো। এগুলো হিংস্র মাছ। মুখে খুব ধারালো সুতীক্ষè দাঁত। কচ করে যেকোনো মানুষের আঙুল কেটে খেয়ে নিতে পারে। তিয়ানের ততক্ষণে খিদে পেয়েছে। সে ইয়টের সিঙ্গেল কেবিনটাতে গিয়ে কতোগুলো ফ্রাইড চিংড়ি নিয়ে এসে সবাইকে দিলো। আর নিজে বেশ মজা করে কড়মড় শব্দ করে খেয়ে নিলো গোটা তিনেক বড়সড় ফ্রাইড চিংড়ি। হাত মুখ ধুয়ে তিয়ান সমুদ্রে জাল ফেললো। অনেকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ জালের কর্ডগুলো নড়ে উঠতেই তিয়ান জাল গুটিয়ে উপরে ওঠালো। আরে বাহ্, একটা বড় আকৃতির গোল্ড ফিশ। তিয়ান মনে মনে ভাবলো, এই মাছটি রান্না করে খেতে কতই না সুস্বাদু হবে! পেটুক তিয়ানের জিভে জল চলে এলো। টোকন মামা, অপু, তিয়ান ও টিয়ানা যখন মাছ ধরতে ব্যস্ত, তখন তাদের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে মহাবিপদ। প্রপেলার চালিত একটা চলন্ত দ্বীপ। শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। বাহরাইনের শেখ মোহাম্মদ আল খাইফ এই দ্বীপটি অনেক টাকা খরচ করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে অতি গোপনে তৈরি করে এর নাম রেখেছেন হিচহাইকার মুভিং আইল্যান্ড। এর পেছনে রয়েছে তার অশুভ উদ্দেশ্য।
আরব দেশগুলোর শাসকরা এবং প্রভাবশালী মহল তেল বেচা টাকায় অনেক সম্পদশালী। তাদের অনেকের মনুষ্যত্ব ও বিবেকবুদ্ধি শূন্যের কোঠায়। এখনো, এই যুগেও আরবদেশগুলোতে প্রকাশ্যে বা গোপনে, আইনের মোড়কে কিংবা বেআইনিভাবে দাস ব্যবসা প্রচলিত আছে।
শেখ মোহাম্মদ আল খাইফ এই চলন্ত দ্বীপটি তৈরি করেছের মূলত আরব রাজা, বাদশা ও ধনী ব্যবসায়ীদের দাস, দাসী সরবরাহের খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে। সে চলন্ত দ্বীপটি নিয়ে সমুদ্র পথে সারাবিশ্বে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন জাহাজ, স্কুনার, ইয়ট দখল করে বন্দী করে এর যাত্রী ও নাবিকদের। তারপর নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে বিভিন্ন দামে বিক্রি করে দেয় আরব ক্রেতাদের কাছে। বলাবাহুল্য এইসব দাস দাসীদের ভাগ্যে জোটে নির্মম নির্যাতন, কখনো কখনো এমনকি মৃত্যু। টোকন মামা ও কিশোর দলের সদস্যরা যখন প্রমোদ ভ্রমণ ও মাছ ধরায় ব্যস্ত তখন বাইনোকুলারের সাহায্যে ওদের অবস্থান শনাক্ত করে হিচহাইকার মুভিং আইল্যান্ডের ক্যাপ্টেন দ্বীপটির মুখ ওদের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। ধীরে ধীরে ভূমধ্যসাগরে রাত নামলো। সমুদ্রে রাত মানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ধীরে ধীরে দ্বীপটা ইয়টের পেছনে চলে এলো, টোকন মামা ও কিশোর দলের সদস্যরা তা খেয়াল করতে পারলো না। টপাটপ কয়েকজন আরব দস্যু ইয়টে উঠে টোকন মামা ও কিশোর দলের সদস্যদের আটকে ফেললো। ওরা বাধা দেয়ার কোনো সুযোগই পেলো না। টোকন মামা, অপু, তিয়ান, টিয়ানাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ওরা হিচহাইকার মুভিং আইল্যান্ডের জেলখানায় নিয়ে একটা কক্ষে বন্দী করে রাখলো। কৃত্রিম দ্বীপ বিধায় হিচহাইকার মুভিং আইল্যান্ড আকৃতিতে খুব ছোট। বসবাস করার জন্য কয়েকটা বিল্ডিং, একটা কমান্ড সেন্টার, বড়সড় একটা জেলখানা, একটা এয়ারস্ট্রিপ, একটা সিনেপ্লেক্স, একটা হাসপাতাল, ব্যাস। মূলত জেলখানায় বন্দী দাসদের রাখা হয় বিক্রির আগ পর্যন্ত।
টোকন মামা ও কিশোর দলের সদস্যদের একটা বড় আকৃতির কক্ষে বন্দী করা হলো। গার্ডরা ঘুরে ফিরে জেলখানার সকল কক্ষ পাহারা দেয়। টোকন মামাকে সার্চ করে তার থেকে রিভলবার নিয়ে নিলো আরব দস্যুরা। কিন্তু অপু, তিয়ান ও টিয়ানা ছোট মানুষ বলে ওদেরকে সার্চ করার প্রয়োজন বোধ করলো না। এভাবে দুইদিন বন্দী অবস্থায় কাটলো। তৃতীয় দিন দুপুরে একজন গার্ড খাবার নিয়ে আসতেই অপু তার গুলতিতে বড় বড় মার্বেল জুড়ে গার্ডের মাথা লক্ষ্য করে মারলো। অপুর হাতের নিশানা নিখুঁত। গার্ড উফ্ শব্দ করে অজ্ঞান হয়ে জেলখানার দরজার সামনে পড়ে গেল। তিয়ান বেশ শক্তিশালী ছেলে। সে জেলখানার দরজার শিকের ভেতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে একটু একটু করে গার্ডের অজ্ঞান দেহটাকে দরজার কাছে নিয়ে এলো। গার্ডের কোমর থেকে চাবির গোছা নিয়ে একটার পর একটা চাবি দিয়ে জেলের দরজা খোলার চেষ্টা করলো। কয়েকবার চেষ্টা করতেই একটা চাবি দিয়ে দরজা খুলে গেলো। টোকন মামা তৎক্ষণাৎ গার্ডের কোমর থেকে রিভলবারটা নিয়ে নিলেন। ওরা গার্ডকে জেলে বন্দী করে একটার পর একটা চাবি দিয়ে জেলের বাকি কক্ষগুলো খুলে দিলো। বেরিয়ে এলো কয়েকশ বন্দী। সবাই মিলে জেলের মূল ফটকের দিকে এগিয়ে চললো। পথে দু’জন গার্ড রিভলবার বের করে গুলি করতে যেতেই অপু তার গুলতিতে মার্বেল জুড়ে ওদের মাথায় মারলো। অব্যর্থ নিশানা। গার্ড দু’জন সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলো।
টোকন মামা ও কিশোর দলের সদস্যরা বন্দীদের নিয়ে এগিয়ে চললো। টোকন মামার প্রধান লক্ষ্য এই আরব দস্যুদের কমান্ড সেন্টার দখল করার। ওরা কমান্ড সেন্টারের কাছে আসতেই একজন গার্ড টোকন মামাকে গুলি করার চেষ্টা করলো। টোকন মামা তার আগেই তার হাতে গুলি করলো। লোকটি অন্য হাত দিয়ে হাত চেপে বসে পড়ল। উপস্থিত বন্দীরা সাথে সাথে তাকে ধরে বেঁধে ফেললো। কমান্ড সেন্টারের ভেতর থেকে আরো দু’জন গার্ড বের হতেই অপু ও টিয়ানা ওদের ফ্লায়িং কিক মেরে ফেলে দিলো। কয়েকজন মিলে ওদের বেঁধে ফেলে রাখলো। অবশেষে টোকন মামা ও কিশোর দলের সদস্যরা কমান্ড সেন্টারের ভেতরে ঢুকে পড়লো। টোকন মামা রিভলবার উঁচিয়ে ধরতেই কমান্ড সেন্টারের ক্যাপ্টেন, ক্রু ও অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ানরা হাত তুলে আত্মসমর্পণ করলো। টোকন মামা রেডিওটা খুঁজে বের করে চারিদিকে এসওএস পাঠাতে লাগলো। অবশেষে ভূমধ্যসাগরে দায়িত্ব পালনরত রাশিয়ান যুদ্ধ জাহাজ আর এফ সারাপোভার ক্যাপ্টেন জানালো সে এসওএস পেয়েছে এবং দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলে আসছে। ইতোমধ্যে হিচহাইকার মুভিং আইল্যান্ডের মালিক মোহাম্মদ আল খাইফ প্রায় বিশজন সশস্ত্র আরব দস্যুসহ কমান্ড সেন্টারের ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইলো। শুরু হলো লড়াই। অপু গুলতিতে মার্বেল জুড়ে মেরে একজন দসু্যুকে ফেলে দিলো। তিয়ান তার বাঁকানো চাকুটা দিয়ে ভয় দেখিয়ে একজনকে আটক করতেই উপস্থিত লোকজন তাকে বেঁধে ফেললো। মোহাম্মদ আল খাইফ একের পর এক গুলি করছিলো। তার গুলিতে তিনজন আহত হলো। ক্রমে ক্রমে মোহাম্মদ আল খাইফের দস্যুদল জয়ী হতে যাচ্ছিলো। এমন সময় রাশিয়ান বিমানবাহী রণতরী আর এফ শারাপোভা থেকে একটি হেলিকপ্টার হিচহাইকার মুভিং আইল্যান্ডের এয়ার স্ট্রিপে অবতরণ করলো। হেলিকপ্টারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সাতজন উচ্চ প্রশিক্ষিত কমান্ডো সৈনিক। তারা যুদ্ধে যোগ দিতেই যুদ্ধের গতিধারা বদলে গেল। কমান্ডোদের গুলিতে আরব দস্যু দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড আবু সুফফান মারা গেলো। মোহাম্মদ আল খাইফ বুদ্ধিমান লোক। সে বুঝলো পরাজয় নিশ্চিত। সে এই লড়াইয়ের হট্টগোলের মধ্যে সুযোগ বুঝে কমান্ড সেন্টার থেকে বেরিয়ে একরকম পালিয়ে এয়ার স্ট্রিপে পৌঁছে গেল। ওখানে উপস্থিত থাকা একটি টু সিটার সেসনা বিমানে চড়ে পাড়ি দিলো অজানা গন্তব্যে। যাবার আগে হ্যান্ড মাইক দিয়ে টোকন মামা ও কিশোর দলের উদ্দেশ্যে বলে গেল, ‘আমি আবার তোমাদের সামনে আসবো। আসবোই। ভয়ংকর প্রতিশোধ নেবো, ভয়ংকর।’ অবশেষ সবাই মিলে বন্দী করলো অবশিষ্ট আরব দস্যুদের। চলন্ত দ্বীপটি সিরিয়ার জলসীমায় থাকায় বন্দীদের সিরিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হলো। সেখানে বন্দী দস্যুদের বিচার হবে।

Share.

মন্তব্য করুন