আবদুল গফুর। একজন সক্রিয় ভাষাসৈনিক। ছিলেন সাংবাদিক, সম্পাদক এবং শিক্ষক। ভাষাসৈনিক হিসেবে তিনি বেশ পরিচিত। রাষ্ট্রভাষা উর্দুর বিরোধিতা করে ১৯৪৮ সালে যোগ দেন ‘তমদ্দুন মজলিসে’। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তোলার পক্ষে একমাত্র প্রতিষ্ঠান হলো তমদ্দুন মজলিস। তমদ্দুন মজলিস হয়ে উঠল তার জীবনের এক মহৎ আদর্শ। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবদুল গফুর স্যার জীবনের সকল আশ-আকাক্সক্ষা এবং স্বপ্ন পূরণে সফলতা পেয়েছেন। তখনকার সময় ‘ভাষা আন্দোলনে’র একমাত্র পত্রিকা ছিল তমদ্দুন মজলিসের ‘সৈনিক পত্রিকা’। ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে তমদ্দুন মজলিসের বাংলা মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ পত্রিকায় তিনি কাজ করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির বর্বরতার বিরুদ্ধে সৈনিকে বিশেষ সংখ্যা বের করায় কারাবরণ করেন এই ভাষাসৈনিক।

পরিচিতি : আবদুল গফুর ১৯২৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজবাড়ী জেলার (তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর) রাজবাড়ী সদর উপজেলা খানগঞ্জ ইউনিয়নের খোর্দ্দদাদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজী হাবিল উদ্দিন মুন্সী ও মাতার নাম শুকুরুন্নেসা খাতুন।
শৈশব-কৈশোর : ভাষাসৈনিক আবদুল গফুর ছোটবেলা থেকে ছিলেন মেধাবী ও দুরন্ত বালক। পিতার মক্তবে পড়ার মাধ্যমে শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি তার। ক্লাস ফোর পর্যন্ত এখানে পড়ার পর চলে যান পাবনা জেলার তারমি নগর জুনিয়র মাদ্রাসায়। এখানে পড়েন ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। এরপর ভর্তি হন ফরিদপুর মইজউদ্দিন হাই মাদ্রাসায়। আবদুল গফুর স্যারদের সময়টায় পড়াশোনা এত সহজ ছিল না। কিশোরকালের পড়া শোনা নিয়ে স্যার বলেন, ‘আমরা অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি এবং মুসলমানদের ভেতরে তখন শিক্ষিত লোকও কম ছিল। আমি ক্লাস টেন পড়বার জন্য ফরিদপুর শহরে গেছি। আমার বাড়ি থেকে ২৭ মাইল দূরে। আবার ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়বার জন্য পদ্মাপাড়ে পাবনা জেলায় গেছি। সেখানে তারিম নগর জুনিয়র মাদ্রাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছি। তখন আমার বাড়ির পাশে কোনো জুনিয়র মাদ্রাসা ছিল না। এত ছোট বয়সে অতদূর গিয়ে কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি ভাবা যায়!”

শিক্ষাজীবন : ১৯৪৫ সালে হাই মাদ্রাসায় কৃতিত্বের সাথে বাংলা ও আসামের মধ্যে সেকেন্ড স্ট্যান্ড করেন এবং স্কলারশিপ হিসেবে পান মাসিক ১৬ টাকা। স্কলারশিপ পাওয়ার পর পড়াশোনার জন্য তাকে আর বাবার টাকার উপর নির্ভর করতে হয়নি। সে সময় তিনি চেষ্টা করেন হুগলি কলেজে পড়তে। কিন্তু হুগলির আশপাশের পরিবেশ পছন্দ না হওয়ায় সেখানে আর ভর্তি হননি। চলে এলেন ঢাকায়।
স্ট্যান্ড করা ছাত্র হিসেবে ঢাকায় তার কদর খুব বেড়ে গেল। ভর্তি হলেন ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের নওয়াব বাড়ির পাশে একটা হোস্টেলে। সে হোস্টেলে তার ভর্তি ফি ও টিউশন ফি দিতে হতো না। শুধু দিতে হতো মাসিক ৮ টাকা মেস বিল। বাকি ৮ টাকা খরচ করতেন ব্যক্তিগত কাজে। সেই নওয়াব বাড়ির পাশেই ছিল বুড়িগঙ্গা নদী। এই নদীতে সাঁতরায়ে গোসল করতেন। দু’হাতের কোশ ভরে খেয়েছেন নদীর পানি।

সাংবাদিকতায় উৎসাহ : সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে আবদুল গফুর স্যারের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো মাসিক ‘সুন্নত ওয়াল জামাত’। এই পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন আমার আব্বা। এটা ছিল ইসলামী ঘরানার পত্রিকা। আমার আব্বা বেশি পড়ালেখা জানতেন না। উনার যখন বয়স হয়ে গেছে, চোখে ভালো দেখতেন না, তখন আমি উনাকে পত্রিকাটি পড়ে শোনাতাম। ‘এই পড়ে শোনানো’-এর থেকে সংবাদ পত্রিকার প্রতি আমার একটি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এই হলো আমার সাংবাদিকতার ভিত্তি।

সাংবাদিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ : ঢাকায় এসে আবদুল গফুর স্যার সাংবাদিকতা শুরু করেন। প্রথমে বংশালে পাক্ষিক ‘জিন্দেগী’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। এখানে তার সাথে পরিচয় হয় ১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর আবুল কাসেম-এর সাথে। কাসেম স্যার ভাষা আন্দোলন প্রথম বই প্রকাশ করেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’। তখন আবদুল গফুর স্যার সাপ্তাহিক ‘জিন্দেগী’ পত্রিকা অফিসে আসতেন। সে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ। সেখানে পরিচিত হন প্রফেসর আবুল কাশেম ও কথাশিল্পী শাহেদ আলীর সাথে। পরে তিনি শাহেদ আলীর সাথে কাসেম স্যারের বাসায় আসা যাওয়া করতেন। ফলে কাসেম স্যারের সাথে হৃদ্যতা জমে ওঠে। একদিন এক মিটিংয়ের আয়োজন করলেন প্রফেসর কাসেম। সেখানে তিনি বললেন যে, “এমন দু-একজন লোক দরকার যারা নিজেরা কোনো বড় হওয়ার চেষ্টা করবে না, বিয়ে করবে না, চাকরি করবে না। শুধুমাত্র জাতির সেবাই করবে।’ কাসেম স্যারের এ কথা শুনে অন্য কেউ রাজি হলো না কিন্তু আবদুল গফুর রাজি হয়ে গেলেন। এরপর এমনভাবে তমদ্দুন মজলিসের সক্রিয় কর্মী হয়ে উঠলেন যে ১৯৫০ সালে অনার্স পরীক্ষার কয়েক মাস বাকি থাকতেই তিনি ফাইনাল পরীক্ষা দেবেন না এবং লেখাপড়াও আর করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। এভাবে ১৯৫০ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি দেশের সেবা করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তমদ্দুন মজলিশের বাংলা মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি পত্রিকাটির সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান।
সেই তরুণ বয়সে কাসেম স্যারের কথায় বিয়ে, চাকরি এমনকি পড়াশোনা ছেড়ে দেয়ার কথা বললেও পরে দেখলেন যে বাস্তবতা অনেক কঠিন। তাই কাসেম স্যারকে দেয়া কথা তিনি আর রাখতে পারেননি। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ১৯৫৮ সালে তিনি বিয়ে করেন। করেন পড়াশোনা এবং চাকরি। কিন্তু সাংবাদিকতা তিনি ছেড়ে দেননি। পরে আরও যেসব পত্রিকায় কাজ করেন তিনি- সহকারী সম্পাদক হিসেবে ১৯৫৭ সালে দৈনিক মিল্লাত ও ১৯৫৮ সালে দৈনিক নাজাত পত্রিকায়, সম্পাদক হিসেবে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ১৯৭১ সালের মে থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ইংরেজি দৈনিক পিপল, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দৈনিক দেশ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। সবশেষ ১৯৮৬ সালে দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠিত হলে তখন থেকে তিনি পত্রিকাটির ফিচার সম্পাদক হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন।
এই সময়ের মাঝে তিনি পেশাও বদলান। চট্টগ্রামে এক বছর সচিব ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট গভর্মেন্ট চাকরি করেন তিনি। সেখান থেকে ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ এবং ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আবু জর গিফারী কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রকাশনা পরিচালক ছিলেন।

ভাষাসৈনিক আবদুল গফুর : একজন ভাষাসৈনিক হিসেবে আবদুল গফুর স্যারের সংকল্প ছিল বাংলা ভাষাকে ভালোভাবে সেবা করা এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সৃষ্টি করা। তার এক সাক্ষাৎকারে জানা যায়, ‘পাকিস্তান আন্দোলনে একটা পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা পূর্ব পাকিস্তানকে অবহেলা করতে শুরু করলো। সেটা থেকেই কিন্তু একটা বিরোধ শুরু হলো। এবং এই যে ভাষা আন্দোলন গোটা পাকিস্তানের সব মানুষের মধ্যে বেশি সংখ্যক হলো বাংলা ভাষা। তা সত্ত্বেও উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা তারা ঘোষণা করলো। তারা মনে করলো উর্দুই হলো ইসলামী ভাষা। আর বাংলা ভাষা হিন্দুদের ভাষা। এটা অত্যন্ত ভুল ছিল।’ এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন মাজিদের সূরা ইবরাহিমের ৪ নম্বর আয়াত উল্লেখ করেন তিনি- আল্লাহ বলেন, “আমি নিজের বাণী পৌঁছাবার জন্য যখনই কোনো রাসূল পাঠিয়েছি, সে তার নিজের সম্প্রদায়েরই ভাষায় বাণী পৌঁছিয়েছে, যাতে সে তাদেরকে খুব ভালো করে পরিষ্কারভাবে বুঝাতে পারে।” ‘এটা মাতৃভাষার মধ্যে যতটা সম্ভব অন্য ভাষার মধ্য দিয়ে ততটা সম্ভব না। সে জন্যই আল্লাহ মাতৃভাষা দিয়েছেন। এজন্য তমদ্দুন মজলিসের সাথে যুক্ত হতে পেরে আমি নিজেকে সার্থক মনে করি।’
ভাষা আন্দোলনে বিষয়ে স্যরের বক্তব্য হলো, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি নয় বরং ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল তমদ্দুন মজলিসের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর। এটার পক্ষ থেকে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু’ এই শিরোনামে একটা পুস্তিকা বের হয় ১৯৪৭ সালের ১৫-ই সেপ্টেম্বর। এটা ২১শে ফেব্রুয়ারির কত আগে! এটা আমরা ভুলে যাই।’
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কাসেম সাহেব তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে যে কথা বলেছিলেন তাতে উল্লেখ করেন যে, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুইটা তথা উর্দু এবং বাংলা।’ পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা উর্দু বলবে আমরা সেটাকে অস্বীকার করতে পারি না। আমরা বাংলা তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারি না। বাংলা তাদের মাতৃভাষা না। কিন্তু আমাদের ভাষার দাবি আমরা বাদ দেবো না।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘বাংলা ভাষাটা বাংলাদেশের একমাত্র ভাষা। ভারতেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। এবং পৃথিবীতে অনেক দেশে বাঙালিরা আছে। হিন্দু বাঙালি। মুসলমান বাঙালি। বিশেষ করে মুসলমান বাঙালি অনেক দেশেই আছে। সে হিসেবে আমি মনে করি যে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি জানানো উচিত আমাদের।’

গ্রন্থাবলি : বাংলা ভাষার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আবদুল গফুর স্যার কলম হাতে তুলে নিয়ে যৌবনে বিরাট অংশ বিসর্জন দিয়েছেন। প্রায় ৯৬ বছরের দীর্ঘ এই জীবনে বাংলা ও ইংরেজিতে লিখেছেন অনেক বই। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে, ইসলামের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য, শাশ্বত নবী, বিপ্লবী উমর, কর্মবীর সোলায়মান, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ইসলাম, কোরআনি সমাজের রূপরেখা, ইসলাম কি এ যুগে অচল, ইসলামের জীবনদৃষ্টি, রমজানের সাধনা, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, ঝড়পরধষ ডবষভধৎব, ঝড়পরধষ ঝবৎারপবং উল্লেখযোগ্য। শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- খোদার রাজ্য, স্বাধীনতার গল্প শোনো ও আসমান জমিনের মালিক। আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আমার কালের কথা-১ (প্রকাশিত) রয়েছে আরও অনেক অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি।

Share.

মন্তব্য করুন