আমাদের বিজয়টি পেয়েছি ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর। একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি বিজয়টি। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন মেজর জিয়াউর রহমান। সেই ২৬ মার্চ হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধ করার পর এলো আমাদের বিজয়। সেই থেকে ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস বলি আমরা। প্রতি বছর ডিসেম্বর এলেই বিজয় দিবস আসে আমাদের কাছে। আমরা বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠি সবাই। ছোট বড় নারী শিশু বৃদ্ধ বৃদ্ধা ছাত্র ছাত্রী যুবক যুবতী তরুণ তরুণী সকলেই বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করি। সকলেই মেতে উঠি বিজয়ের উল্লাসে। আমাদের এই আনন্দ অন্যরকম আনন্দ!
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই স্বাধীনতা চায়। চায় সেই স্বাধীনতার বিজয়। কেনো চায়? চায় কারণ- মানুষ কাজ করতে চায় স্বাধীনভাবে। চলাফেরা চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্য এমনকি লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও চায় স্বাধীনতা। আর স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় বিজয়ের মাধ্যমে। বিজয় ছাড়া স্বাধীনতা আসে না। তাই ২৬ মার্চ স্বাধীনতার যে ঘোষণা এলো তা-ই বিজয় লাভ করেছে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। এজন্য আমরা প্রতি বছর ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ দিনটিকে বিজয় দিবস বলে পালন করি।
আমরা বিজয় পেয়েছি ৫৪ বছর আগে। অর্থাৎ আমাদের বিজয়ের বয়স হয়েছে ৫৪ বছর। এটি একটি বিরাট সময়। একটি লম্বা সময় পেরিয়ে গেছে আমাদের বিজয়ের। এখন যদি প্রশ্ন ওঠে- বিজয়ের এতকাল হলো, এই বিরাট সময়ে আমরা আমাদের দেশকে কতটা এগিয়ে নিতে পেরেছি। কতটা উন্নতি ঘটিয়াছি। বা কতটা উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পেরেছি! এ প্রশ্নের জবাব কিন্তু খুব আমতা আমতা করে দিতে হবে। অর্থাৎ অনেক উন্নতি করেছি, এমন কথা বলার সাহস আমাদের নেই। হয়তো জিজ্ঞেস করা যেতে পারে কেনো? এই কেনোর জবাবে বলতে হবে- আমরা যতটা উন্নতি করার কথা ততটা উন্নতি করতে পারিনি। দেশকে যতটা উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা ততটা নিয়ে যেতে পারিনি।
এখন আবার প্রশ্ন হতে পারে- কেনো পারিনি?
এরও জবাব আছে নিশ্চয়। পারিনি কারণ অনেক। তবে সবচেয়ে বড় কারণটি হলো- বিজয় অর্জনের পর আমরা সবাই এক বা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারিনি। আমরা বিভিন্ন ছুতোনাতায়
শুধু শুধু ঝগড়া বিবাদ করে একজন আরেকজনের শত্রু হয়ে থেকেছি। সামান্য কারণে ঝগড়া মারামারি হানাহানি করে একজন আরেকজন থেকে আলাদা হয়ে গেছি। বিভিন্ন পক্ষ বিপক্ষ হয়ে নানারকম দল গঠন করেছি। দলাদলি আর রাজনৈতিক টানাটানির মধ্যে আমরা আসল কাজের সুযোগ হারিয়েছি। নিজেরা নিজেদের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে গেছি। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য কোনোভাবেই সম্মানজনক নয়। অথচ এই অসম্মানের কাজটিই আমরা যুগের পর যুগ ধরে করে আসছি। ফলে আমরা উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারিনি। উন্নতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগও হাতছাড়া হয়ে গেছে। যে কারণে আমরা বরাবর পিছিয়ে পড়ে আছি।
পিছিয়ে পড়ার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। কারণটি হলো- আমাদের শিক্ষার পদ্ধতি আমাদের উপযোগী নয়। আমরা যেমন শিক্ষা চাই বা যেমন শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চাই তেমন শিক্ষা আমাদের নেই। এগিয়ে যেতে হলে সময় এবং যুগ উপযোগী শিক্ষা দরকার। কিন্তু আমাদের শিক্ষায় তেমন করে সময় উপযোগী কিছু নেই। ফলে আমরা আধুনিক পৃথিবীর সাথে তাল রেখে এগিয়ে যেতে পারছি না।
শিক্ষার আসল কাজ কি? আসল কাজ হলো নিজেকে জানা। নিজের পরিবার অর্থাৎ বাবা মা’র মর্যাদা এবং দায়িত্ব সম্বন্ধে জানা। ভাই বোন বন্ধু ও প্রতিবেশী সম্বন্ধে জানা। এবং জানতে হবে সমাজ রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিসর। নিজেকে উন্নত চরিত্রের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। হতে হবে উন্নত মানুষ।
পৃথিবীতে আমরা মানুষ, সৃষ্টির সেরা একথা শুনি সবসময়। কথায় কথায় সকলেই বলেন। কিন্তু মানুষ কেনো সেরা! এর জবাব তো জানতে হবে। সৃষ্টির সেরা হতে হলে কাজেও সেরা হতে হবে। কাজ যদি সেরা না হয় সৃষ্টি হিসেবে সেরা কেমন করে হবে!
সত্যি হচ্ছে- আমরা যদি সুন্দর শিক্ষায় শিক্ষিত হতে না পারি তবে আমরা উন্নত চরিত্রের মানুষ হতে পারবো না। আর যদি উন্নত চরিত্রের মানুষ হতে না পারি মানুষ হিসেবে আমাদের মর্যাদা কোথায়! তখন আমরা আমাদের সম্মান রক্ষা করার উপায়ও জানবো না। বিজয় তো মানুষের অর্থাৎ নাগরিকদের সম্মান এবং মর্যাদাকে উঁচু করে তোলে। বিশ্বের দরবারে প্রতিটি নাগরিকের
পরিচয় করে সম্মানিত হিসেবে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের যথাযথ নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বিজয়। সবার আগে আসে শিক্ষার অধিকার। এ অধিকার নিশ্চিত করে বিজয়। তারপর বসবাসের অধিকার সামর্থ অনুযায়ী দেশের যেকোনও জায়গায় একজন নাগরিকের বসবাসের অধিকার রয়েছে। চিকিৎসার অধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অসুস্থ হলে একজন নাগরিকের ভালো চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার থাকতেই হবে। প্রয়োজনে রাষ্ট্র তার নাগরিকের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। চাকরি বাকরির অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বিজয়। একজন নাগরিক সে ইচ্ছে করলে চাকরি করবে। ইচ্ছে করলে ব্যবসা করবে। অথবা ইচ্ছে করলে শিল্প সাহিত্য কিংবা সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে। বিজয় এসব বিষয় নিশ্চিত করে।
এছাড়াও একজন নাগরিক সামাজিক কাজ বা সমাজসেবার কাজ করতে পারেন। কেউ কেউ ইচ্ছে মতো রাজনীতিও করতে পারেন। যার যে দল পছন্দ সে দল করার অধিকার আছে। কারো রাজনীতি নিয়ে কেউ জোর জবরদস্তি করতে পারবে না। কোনো দলকে অন্য দল তাদের কাজে বাধা দিতে পারবে না।
ধর্মের বিষয়েও একই কথা। যে যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। কেউ কারো ধর্মের বিষয়ে জোর করতে পারবে না। বা এক ধর্মের লোককে জোর করে আরেক ধর্মে নিয়ে যাওয়া যাবে না। ধর্মীয় কাজে কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। এসব স্বাধীনতাই তো দান করে বিজয়।
এইতো অল্প কিছু দিন আগে, জুলাই ২৪ এ একটি গণবিপ্লব হয়ে গেছে। বাংলাদেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে কারো ভোট দেয়ার অধিকার ছিলো না। কেউ তার মত প্রকাশ করতে পার তো না। সরকারি দল ছাড়া আর কোনো দলের কথা বলার অধিকার ছিলো না। সভা সমাবেশ বা স্বাধীনভাবে কেউ কাজ করার সুযোগ পায়নি।
আমাদের শিক্ষার বিষয়ে বড় অসুন্দর পদ্ধতি নেয়া হয়েছিলো। শিক্ষার সিলেবাস ছিলো বড়ই আবোল তাবোল। সবকিছু মিলিয়ে কোনোভাবেই ভালো ছিলো না আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। ফলে ছাত্র জনতার প্রচণ্ড আন্দোলনে পতন ঘটেছে শেখ হাসিনা সরকারের। শেষ পর্যন্ত হাসিনা পালিয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকে। এখন আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে কথা বলার অধিকার ফিরে পেয়েছে মানুষ। পেয়েছে নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। আমরা এখন পেয়েছি বিজয়ের স্বাদ।
হ্যা আরও আনন্দময় বিজয় আনতে হবে আমাদের। যে বিজয় দেশের প্রতিটি নাগরিকের সুখ দুঃখের ভাগ নেবে। অভাব দূর হবে। দুর্নীতি সুদ ঘুষ বন্ধ হবে। অন্যায় অবিচার ও জুলুমের সঠিক বিচার হবে এবং সব ক্ষেত্রে ইনসাফ কায়েম হবে। তবেই হবে সত্যিকার বিজয়। সেই বিজয়ের অপেক্ষায় আমরা।
তবে হ্যা এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে- সেই বিজয় আনতে হলে আমাদেরকে আগে যোগ্য এবং সৎ নাগরিক হতে হবে। অন্যায়কে অন্যায় বলতে হবে। ন্যায়কে বলতে হবে ন্যায়। সবাইকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে। হয় ভালো কাজ করতে হবে। নয়তো অন্তত মন্দ কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এটি হলো পরস্পরের সহযোগিতা। ভালো কাজ করতে বলা আর খারাপ কাজ করতে না দেয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে থাকতে হবে সামাজিক বিচার। থাকতে হবে রাষ্ট্রীয় আইন এবং সে আইনের প্রয়োগ। তবেই আমরা পাবো সত্যিকার বিজয়ের স্বাদ।
Share.