আমার মনের সাধ যা কিছু
দোয়ার মত ফুটছে জানি,
চিরাগ যেমন তেমনি যেন
হয় খোদা মোর জিন্দেগানি।
এই দুনিয়ার আঁধার যেন
দূর হয়ে যায় আমায় দেখে,
রোশ্নি যেন পায় সকলে
আমার আলোক-রশ্মি থেকে।
জীবন আমার করে যেন
দুঃস্থ জনে সমর্থন,
দুঃখী এবং বৃদ্ধ জয়ীফ
যেন আমার হয় আপন।
আল্লা মালিক, প্রভু আমার
বাঁচাও পাপের কলুষ থেকে,
চালাও আমায় সেই পথে,- যার
লিখন শুধু পুণ্য লেখে ॥
এ কোন পুণ্য প্রার্থী কবি, যিনি কম্পিত দু’টি হাত তুলে মহান আল্লাহ্র দরবারে মুনাজাতে বলছেন- হে প্রভু! উজ্জ্বল প্রদীপের মতো প্রদীপ্ত করো আমার জীবন। যে আলোর প্রাণ বন্যায় পৃথিবীর কালো আঁধার দূর হয়ে যায়। সত্য সন্ধানী কাফেলা খুঁজে পায় আলোকিত পথ। দুনিয়ার লাঞ্ছিত, অপমানিত ও অবহেলিত দুঃস্থ মানুষের সেবা করতে পারি। দুঃখ-দারিদ্র্যে গড়া যাদের জীবন, সে সব বৃদ্ধ, জয়ীফ, আধমরাদের যেন আমি আপন করে বুকে টেনে নিতে পারি।
হে সু-পবিত্র আল্লাহ মালিক। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ পঙ্কিল এ পৃথিবীর পাপ থেকে তুমি আমায় মুক্ত রেখো। আমার প্রতিটি কথা ও কাজ যেন কল্যাণকামী হয়। যার ফল স্বরূপ শেষ বিচার দিনে তোমার কাঠগড়ায় ‘পুণ্য লেখা’ নিয়ে দাঁড়াতে পারি।
মহান আল্লাহ্ উদার চিত্তে কবির এ প্রার্থনা কবুল করেন। তাঁর কর্মময় জীবনকে ভরে তোলেন ফুলে ও ফসলে। শত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে তিনি এগিয়ে যান হেরার রৌশনিতে উদ্ভাসিত মনযিল পানে। প্রার্থিত আরাধনার বাইরে একচুল পরিমাণও বিচ্যুত হননি আমৃত্যু।
কোন সে চির সংগ্রামী আপসহীন কবি?
রমজান ঃ
সৈয়দ বাড়ির পশ্চিম মাঠে ছেলে-মেয়েদের আনন্দিত কলস্বর। চাঁদ উঠেছে, চাঁদ উঠেছে।
কিসের চাঁদ?
রমজানের।
কাল থেকে রোযা। আজ রাতেই সাহ্রী খেয়ে রোযা রাখতে হবে। মাত্র ৩০দিন পর খুশির ঈদ। কে কোন ধরনের জামা-কাপড় নেবে তা নিয়ে ছোটদের মাতামাতি। রমজানের চাঁদ দেখেই নতুন পোশাকের পরিকল্পনা।
চারদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সৈয়দ বাড়ির দহলিজে মাগরিবের নামাজ সমাপ্ত হয়েছে। বড়রা এখন মেতে উঠেছেন মাহে রমজানের খোশালাপে। তাঁদের মধ্যমণি খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী।
বাড়ির অন্দর মহল থেকে আসা বাটাভরা পান সবার আলাপকে আরও প্রাণবন্তকরে তোলে। খান সাহেব নিজেও চিবুচ্ছেন, অন্যদেরও দিচ্ছেন খিলি বানিয়ে।
একটি প্রসঙ্গের পর আরেকটি প্রসঙ্গ। রাত কখন দীর্ঘ হলো কেউই টের পেলেন না।
মোল্লাজী আবদুস সামাদ গ্রাম্য পণ্ডিত। দ্বীনি এলেম জানা লোক। এক সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘আর দেরি নয়। আসুন আমরা এশা এবং তারাবীহ নামাজ পড়ে নি। ভোর রাতে আবার সাহ্রী খাবার জন্যে উঠতে হবে।”
আজান হলো।
মোল্লাজী নামাযে ইমামতী করলেন। নামায শেষে তিনি সুষ্ঠুভাবে রোযা পালনের জন্যে আল্লাহ্’র সাহায্য কামনা করলেন হৃদয় উজাড় মুনাজাতে।
খান সাহেব প্রতিবেশীদের একে একে বিদায় দিলেন, এবার নিজে চললেন অন্দর মহলে। ঘরে ঢুকবেন ঠিক সে সময় তাঁর শ্রদ্ধাভাজন মা এসে খুশি মনে বললেন, “হাতেম! তোর একটি ছেলে হয়েছে। বহুদিন পর আল্লাহ্ তোর দিলের আরজু পূরণ করেছেন।”
-আলহামদুলিল্লাহ্, আম্মাজান।
খান সাহেব তিন কন্যার পর দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম-সংবাদে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। ঘরে না ঢুকে আবার চলে গেলেন বাড়ির দহলিজে। জায়নামায বিছিয়ে দু’রাকাত শুকরিয়া নামায পড়লেন। মুনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞতা জানালেন।
নতুন অতিথি আর তার মাকে নিয়ে ঘরের মহিলারা ব্যস্ত। অন্যরা আনন্দ-আলাপে মাতোয়ারা। সারা রাত কোন তরী বেয়ে বিদায় নিল কেউই টের পেলো না।
সাহ্রী খাবার জন্যে সবাই খাবার ঘরে বসেছেন। বিস্মিল্লাহ বলে পহেলা রমযানের খাবার মুখে নিবেন ঠিক সে সময়ে মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠে ভেসে এলো ঃ আস্সাল্লাতু খাইরুম মিনান্ নাউম- ঘুম অপেক্ষা নামাজ উত্তম।
সাহ্রী আর খাওয়া হল না। ফরজ রোযা। অবশ্যই রাখতে হবে। ধার্মিক পরিবারের সদস্যরা শুধু একটুকুন পানি ছাড়া অন্য কিছু না খেয়েই রোজার নিয়্যত করলেন।
মুসলমান পরিবারে সাধারণত ৭ (সাত) দিন পরই নতুন ছেলে-মেয়েদের নাম রাখা হয়। অতদিন কি আর অপেক্ষা চলে? হাতেমের মা পহেলা রমজানে জন্ম বলে আদুরে নাতীর নাম দিলেন ‘রমজান।’
চাচা-চাচী, ভাই-বোন, বাড়ির অন্যরা রমজানকে নিয়ে দারুন ব্যস্ত। বিছানায় একটুও পিঠ ঠেকে না, সারাদিন সবার কোলে। চুমুতে চুমুতে ভরে যায় রমজানের গাল।
৭ (সাত) দিন পর আকীকা। আলেম-ওলামা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কলগুঞ্জনে বাড়ির আঙিনা মুখরিত। ধুমধামে চলে আদর আপ্যায়ন। এবার রমজানের আসল নাম রাখার পালা। অনেকে অনেক নাম বললেন। খান সাহেব নীরবে সব শুনলেন। শেষ পর্যন্ততিনি তাঁর বংশ মর্যাদার সাথে মিলিয়ে দ্বিতীয় ছেলের নাম রাখলেন সৈয়দ ফররুখ আহমদ।
বৃহত্তর যশোরের মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপ-জেলার অন্তর্গত মাঝ আইল গ্রামে ১৯১৮ সালের ১০ই জুন ফররুখের জন্ম।
আব্বা-আম্মা ঃ
বাসে যশোর যাবার পথে এপারে পড়ে কামারখালী ঘাট। মাঝে একটি ছোট্ট নদী মধুমতি। ওপারে মাঝআইল গ্রাম। ছায়া ঘেরা, পাখি ডাকা সুন্দর গ্রাম। এ গ্রামের সবচাইতে শিক্ষিত ও অভিজাত সৈয়দ পরিবারে ফররুখের জন্ম।
আব্বা সৈয়দ হাতেম আলী। আম্মা বেগম রওশন আখতার। বৃটিশ আমল থেকে ফররুখদের পারিবারিক সুনাম সবার মুখে মুখে। ইংরেজ জাঁদরেল কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমন কি হিন্দু ব্রাহ্মণেরাও এই পরিবারের লোকদের সম্মান করতো।
ফররুখের দাদা সৈয়দ আব্বাস আলী ছিলেন শিক্ষিত ভদ্র-লোক। চাকুরী করতেন সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে।
আব্বা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন প্রতাপশালী পুলিশ ইন্সপেক্টর। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন খুবই সৎ। একবার বৃটিশ পুলিশ বাহিনীর দুর্নীতি ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। বিদ্রোহের কারণে তাঁর উপর নেমে আসে সরকারী রোষানল। কিন্তু তাঁর সততা ও ন্যায় পরায়ণতার প্রমাণ পেয়ে ইংরেজ সরকার শেষ পর্যন্ত তাঁকে ‘খান সাহেব’ উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয়।
হে বঞ্চিত ঃ
জননী। শিক্ষিতা, রুচিশীলা, ভদ্র। তিন কন্যার পর তাঁর কোল জুড়ে এলো ফররুখ। অতি আদরের সাথে তিনি শিশু-পুত্রকে লালন-পালন করতে থাকেন।
ফররুখের টানা টানা উজ্জ্বল মায়াবী দু’চোখ, ঈগল ঠোঁটের মত সুউচ্চ নাক আর সদা হাসি লেগে থাকা মুখশ্রী দেখে মায়ের বুক জুড়ে যায়। প্রশান্তিতে ভরে ওঠে মাতৃ হৃদয়।
ইতোমধ্যে তাঁর কোলে এলো ছোট ছেলে সৈয়দ মুশির আহমদ। মুশিরের বয়স মাত্র দেড় বছর। ফররুখের ছয়। ঠিক সে মহূর্তে তাদের ¯েœহ বঞ্চিত করে আম্মাজান এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। শোক সাগরে পতিত হয় শিশু ফররুখ ও মুশির।
দাদীর কোলে ঃ
এই অল্প বয়সে ¯েœহ বঞ্চিত ফররুখের লালন-পালনের ভার নেন মহিয়সী দাদী।
দাদী ছিলেন জমিদার কন্যা। শিক্ষিতা ভদ্র মহিলা। বহুবছর বেঁচে ছিলেন তিনি। সেকালের কঠোর পর্দা প্রথার অন্তরালে থেকেও তিনি পড়া-লেখা শেখেন। ধর্মীয় অনেক বই-পুস্তক, পূঁথি-কাব্য ছিল তাঁর ঠোঁটস্থ।
দাদী মাতৃহীন রমজানকে সব সময় নিজের øেহ ডোরে বেঁধে রাখতেন! একটুও বুঝতে দিতেন না মা হারানোর ব্যথা।
চাঁদনী রাতে রমজানকে সাথে নিয়ে বসতেন উঠোনে পাটি পেতে। পূঁথি খুলে শুনাতেন ‘তাজকেরাতুল আউলিয়া” থেকে অলী-আল্লাহ্, পীর-বুজর্গদের মজার মজার কাহিনী। ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ থেকে শুনাতেন নবী-রাসূলদের জীবন কাহিনী।
ঘুমোতে গিয়ে দাদী কখনো বলতেন, আরব্য উপন্যাসের রহস্যময়ী কিস্সা-কাহিনী। হাতেম তাঈ, সিন্দাবাদ, আলীবাবা ও চল্লিশ দস্যুর কল্প কাহিনী দাদীর মুখে শুনতে শুনতে ফররুখ স্বপ্ন মধুর ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতো।
বড় হবার সাথে সাথে ফররুখের মাঝে চঞ্চলতা বৃদ্ধি পায়। চাঁদনী রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে বেরিয়ে যেত ঘরের বাইরে। উজ্জ্বল তারকাখচিত আকাশে খুঁজতো কোথায় আছে সপ্তর্ষি, কোথায় আদম সুরত, কোথায় শুকতারা? চাঁদ আর সাদা মেঘের ভেলায় সে ভেসে যেত বহুদূর।
কখনো বাগানে গিয়ে খুঁজতো পাখির বাসা। ডাহুক পাখির একটানা ডাকে পাগলপারা হয়ে ঘুরে বেড়াতো বিলের ধারে। আবার কখনো একা একা সবুজ মাঠের মেঠোপথ ধরে হেঁটে হেঁটে দেখতো উদার প্রকৃতি। খরস্রোতা মধুমতির ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ফররুখ হয়ে উঠতো আনমনা।
প্রথম পাঠ ঃ
দাদী ভাবলেন, এভাবে তো আর রমজানকে ছেড়ে দেয়া যায় না। তাকে শিক্ষা দিতে হবে কায়দা-ছিপারা। পড়াতে হবে পবিত্র কুরআন। আরো শিখতে হবে ফার্সী। নইলে সে সা’দীর ‘গুলিস্তাঁ’ আর রুমীর ‘মসনবী’ পড়তে পারবে না। মানুষের মতো মানুষরূপে গড়ে তুলতে হলে রমজানকে ওসব শিখাতেই হবে।
গ্রামের সবচেয়ে ভাল ফার্সী জানা এক বিদূষী মহিলাকে নিয়োগ করা হলো ফররুখকে পড়াতে। তিনি সকাল-সন্ধ্যায় এসে অতি আদরের সাথে আরবী-ফার্সী শিখাতে থাকেন ফররুখকে।
কিছুদিন পর খান সাহেব বাড়ি এলে মা আব্দার করে বললেন- হ্যাঁ রে হাতেম। তোর ছেলেকে কি লেখা-পড়া কিছু শিখাবিনে?
জ্বি মা, কালই মোল্লাজীকে ডেকে তাঁর পাঠশালায় ফররুখকে দিয়ে দেব। উনি সব ঠিক করে নেবেন।
সামাদকে বেশি কষ্ট করতে হবে না। আমি বাড়িতেই রমজানকে আরবী-ফার্সীর প্রথম সবক দিয়ে দিয়েছি। তুই কিন্তু সামাদকে ডাকতে ভুলে যাস্নে।
আপনি খুবই ভাল করেছেন। ভুলবো কেন মা? আমি নিজেই ওকে পাঠশালায় দিয়ে আসবো।
পরদিন সকালে খান সাহেব ফররুখকে নিয়ে গেলেন বন্ধুবর মোল্লাজী আবদুস সামাদ খানের পাঠশালায়। প্রাথমিক কথাবার্তা বলে পুত্রকে ভর্তি করে দিলেন সেখানে।
মোল্লাজী বন্ধুর ছেলেকে পেয়ে খুবই খুশি হলেন। নিজ পুত্র আবদুল খালেকের সাথে পরিচয় করে দিলেন ফররুখকে। একই শ্রেণির ছাত্র হওয়াতে দুই বন্ধু পাল্লা দিয়ে পড়তো। তাদের মাঝে গড়ে উঠে গভীর বন্ধুত্ব।
পাঠশালার পাঠ তৈরি করতে ফররুখের কোন বেগই পেতে হতো না। আরবী-ফার্সী লিখতে পড়তে পারলেও ফররুখ বাংলা পড়তেই খুব ভালবাসতো। মাত্র দু’বছরেই গ্রামের পাঠশালার প্রথম পাঠ শেষ করে ফেলে ফররুখ। এবার বড় স্কুলে ভর্তি হবার লক্ষে বাবার সাথে রওয়ানা দিলেন কলকাতায়।