তোর আজকাল কী হয়েছে রে টিংকু? কেন এমন করিস বলতো?
বাড়ির সামনের মাঠটাতে শুয়ে ছিল মুসা। বসন্তের পড়ন্ত বিকেল। ঝিরঝির বাতাসে আশপাশের গাছ থেকে শুকনো পাতা এসে পড়ছিল মুসার শরীরে। সেগুলো শরীর থেকে সরানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই মুসার। বেশ লাগছে তার। তার শরীর ঘেঁষে বসে ছিল টিংকু।
কী হলো কথা বলছিস না কেন? কী হয়েছে তোর?
প্রশ্নটা করে টিংকুর দিকে তাকায় মুসা।
এই মুহূর্তে সে টিংকুর উপর ভীষণ বিরক্ত।
ওহ তুই কী করে কথা বলবি? তুইতো কথা বলতে জানিস না। আরে বাবা মাথা নেড়ে বোঝাতে তো পারিস? না কি তাও ভুলে গেছিস?
মুসার কথা শুনে এবার টনক নড়ে টিংকুর।
সে এক লাফে মুসার গায়ের উপর উঠে বসে।
মুসার রাগ পড়ে যায়। মুসার এই এক সমস্যা। ভয়ানক রাগ নিয়ে টিংকুকে বকা ঝকা করে ঠিকই কিন্তু একটু পরই সব ভুলে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। সে পরম মমতায় টিংকুর মাথাটা তার বুকের সাথে চেপে ধরে।
আর এমন করবি না বুঝলি টিংকু।
টিংকু ঝট করে মুসার বুকের ওপর থেকে নেমে হন হন করে হাঁটতে শুরু করে।
মুসা বুঝতে পারে কথাটি তার পছন্দ হয়নি।
টিংকুর এ পরিবর্তন আহত করে তাকে। মুসা উঠে বাড়ি চলে যায়।
টিংকু মুসার পোষা কুকুর। ওকে সে একদিন আহত অবস্থায় রাস্তা থেকে তুলে এনেছিল। তখনও ছিল একদম শিশু। আস্তে আস্তে খাবার, যত্ন সবকিছু দিয়ে তাকে বড় করে তুলেছে মুসা। নাম রেখেছে টিংকু। টিংকুও মুসার সব কথা বুঝতে পারে। সারাক্ষণ মুসার সাথে সাথে থাকে। রোজ স্কুলে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে স্কুল গেটেই অপেক্ষা কখন ছুটি হবে। তারপর আবার দু’জন একসাথে বাড়ি ফেরে।
বাড়ির সবার কাছেও টিংকু খুব প্রিয় কারণ সে কোনো কিছুর কোনো ক্ষতি করে না। সুবোধ বালকের মতো খেতে দিলে খায়। খেতে দিতে দেরি হলে অপেক্ষা করে।
রাতে মুসার ঘরের সামনে শুয়ে থাকে।
এভাবেই বেশ সুন্দর সময় কাটছিল। ছন্দপতন হয় গত দু’মাস ধরে।
শুরুর দিকটায় মুসাদের বাড়িতে অপরিচিত কোনো লোক এলেই টিংকু প্রচণ্ড জোরে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে।
এটা একটা ভালো দিক। কারণ টিংকুর ভয়ে মুসাদের বাড়িতে কোনো চোর-ডাকাত ঢুকতে পারবে না। কিন্তু সমস্যা হলো ইদানীং টিংকুর যন্ত্রণায় অপরিচিত তো দূরের কথা পরিচিত মানুষও ঢুকতে পারে না মুসাদের বাড়িতে।
আত্মীয়-স্বজন এমন কি প্রতিবেশীরাও ওদের বাসায় আসা ছেড়ে দিয়েছে।
মুসার বাবা স্কুল শিক্ষক। তিনি মুসাদের ক্লাসের অর্থাৎ ক্লাস সেভেনের কয়েকজন ছাত্র পড়ান। কিন্তু টিংকু আজ ভয়ানক এক কাণ্ড করে বসে। মুসার বাবা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছাত্ররা একে একে ঢুকছিল বাড়িতে। ছাত্র মোট ছয় জন। পাঁচজন ঢোকার পর ষষ্ঠজন যেই ঢুকতে যাবে অমনি টিংকু ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। একেবারে রক্তাক্ত করে ফেলল। ষষ্ঠজন ছিল শুভ। শুভ মুসার সবচেয়ে প্রিয়বন্ধু। শুভকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নেয়া হলো। প্রিয়বন্ধুর এ অবস্থা একদম সহ্য করতে পারল না মুসা।
টিংকুকে লাঠি দিয়ে ভীষণ মারতে লাগল।
টিংকু কিছুক্ষণ চিৎকার করার পর একদম চুপ হয়ে গেল। মুসা নিজেই ক্লান্ত হয়ে হাত থেকে লাঠি ফেলে দিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকিয়ে দেয়। টিংকুকে আঘাত করে তারও ভীষণ খারাপ লাগছে। সে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে আর বলতে থাকে টিংকু তুই যেখানে খুশি চলে যা। আমি তোর মুখ দেখতে চাই না। কাঁদতে কাঁদতে মুসা কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে বুঝতে পারে না।
তার ঘুম ভাঙে মায়ের ডাকে।
এই মুসা ওঠ। খেয়ে নে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।
মুসা দরজা খুলে বেরিয়ে আসে।
মা, শুভর কী খবর জানো কিছু?
হ্যাঁ জানি। শুভ বাড়ি ফিরে এসেছে। ডাক্তার ইনজেকশন আর কিছু ওষুধপত্র দিয়েছে।
ঠিক হয়ে যাবে। খেয়ে ওকে গিয়ে দেখে আয়।
কোনো মুখে যাব মা। টিংকু কিভাবে এমন কাজ করল বল তো?
আমিও তো বুঝতে পারছি না। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস?
কী মা?
টিংকু বেছে বেছে তোর সাথে যাদের বেশি ঘনিষ্ঠতা তাদেরকেই আঘাত করে।
এই যেমন আজ তোর বাবার অন্য ছাত্রদের সে কিছুই বলল না। শুভকে আঘাত করল। কারণ শুভ তোর বেস্ট ফ্রেন্ড।
কিন্তু মা ওতো অন্যদেরও তাড়া করে।
হ্যাঁ করে, তবে সবাইকে না। সেদিন তোর শফিক চাচাকে করল। কারণ তোর শফিক চাচা তোর জন্য খাবার নিয়ে এসেছিল।
ওইদিন যে শিউলীকে তাড়া করল।
বেচারি শিউলী তো কেঁদে কেঁদে শেষ।
হ্যাঁ শিউলীও ওর আঁকা ছবিটা তোকে দেখাবে বলে নিয়ে এসেছিল।
তাইতো মা, এভাবে তো, ভেবে দেখিনি।
তাহলে টিংকু আমাকে ভালোবাসে না?
আমাকে পছন্দ করে না?
এর বিপরীতটাও হতে পারে। হয়ত টিংকু তোকে বেশি ভালোবাসে, তাই সে চায় শুধু সেই তোকে ভালোবাসবে অন্য কেউ নয়। এসব চিন্তা বাদ দে, এখন খেতে আয়।
মায়ের কথা বেশ কিছুক্ষণ ভাবে মুসা। তার মনে হয় মা-ই সত্যি। টিংকুকে ভালো করে বুঝিয়ে ঠিক করতে হবে। কিন্তু টিংকু কই?
টিংকু। টিংকু। টিংকুকে ডাকতে থাকে মুসা কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না। কই গেল টিংকু?
এক সপ্তাহ হয়ে গেল টিংকু বাড়ি থেকে চলে গেছে। হয়ত মুসার ওপর ভীষণ অভিমানে। এমন কোনো জায়গা নেই মুসা তাকে খোঁজেনি কিন্তু সে কোথাও নেই।
টিংকুকে হারিয়ে মুসাও পাগল প্রায়।
নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। লেখাপড়ায় মন নেই।
দিন পনেরো পর হঠাৎ একদিন হন্তদন্ত হয়ে শুভ হাজির হয় মুসার বাসায়।
এই মুসা দেখবি চল।
কী দেখব বল আগে।
টিংকুকে।
টিংকু?
হ্যাঁ, কোথায়।
নদীর পাড়ে।
টিংকুর কথা শুনতেই। দৌড়াতে শুরু করে মুসা। তার পেছন পেছন শুভ।
এক দৌড়ে ওরা চলে আসে নদীর পাড়ে,
কই টিংকু। কোথাও তো দেখছি না।
শক্ত করে আমার হাতটা ধর। শুভ ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয়।
মুসা শক্ত করে শুভর বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে।
শুভ মুসার হাত ধরে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে থাকে।
কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায় টিংকু পড়ে আছে বালুতে।
টিংকু বেঁচে নেই। মুসার উপর তীব্র অভিমান করে চিরদিনের জন্য পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে টিংকু।
কিভাবে হলোরে শুভ? কাঁদতে কাঁদতে মুসা জানতে চায়।
জানি না কিছু। একটু আগে গোসল করতে এসে দেখতে পেলাম। দুই বন্ধু মিলে নদীর পাড়েই মাটি খুঁড়ে কবর দেয় টিংকুকে।
টিংকু মারা গেছে এক বছর হলো। মুসাও ক্লাস এইটে উঠেছে। পড়াশুনায় ভীষণ মনোযোগী সে।
ওদেরই ক্লাসের কিছু ছেলে বখে গেছে। লেখাপড়া করে না। ক্লাসে শিক্ষকদের সাথে বেয়াদবি করে। ক্লাসের নিরীহ ছাত্ররা তাদের ভয়ে তটস্থ থাকে। মুসা শুনেছে ওরা নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেটও খায়। ওরা নিজেরাই নিজেদের দলের নাম রেখেছে কিশোর গ্যাং। মুসা সবসময় ওদের এড়িয়ে চলে। ওর কত পড়া!
গতকাল বাবা মুসাকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছে। অনেক দিনের বায়না ছিল মুসার এই সাইকেলটা।
আজই প্রথম সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে মুসা।
বাড়ি থেকে স্কুল কিছুটা দূরে মাঝ পথে আসতেই কিশোর গ্যাং এর কয়েকজন ছেলে তার সাইকেল থামায়।
নেমে আয় সাইকেল থেকে। কিশোর গ্যাং এর নেতা রাজু বলে ওঠে।
কেন নামবো? স্কুলে যাচ্ছি তো। দেরি হয়ে যাবে।
আজ স্কুলে যেতে হবে না। আজ আমাদের সাথে যাবি। ওদেরই একজন সদস্য মিথিল বলে ওঠে।
তোমাদের সাথে মানে, কোথায়? মুসা অবাক হয়ে জানতে চায়।
আমাদের ক্লাব ঘরে। ওখানে দু’ এক টান সিগারেট খাবি তারপর চলে আসবি।
না আমি কোথাও যাবো না।
যাবি না মানে। ওকে টেনে নামা। দলনেতা রাজুর নির্দেশ পেয়ে মুসাকে সাইকেল থেকে টেনে নামায় ওরা।
মুসার নাকে মুখে দুম দুম করে ঘুষি মারতে থাকে।
মুসা চিৎকার করতে যাবে
অমনি একটা গামছা দিয়ে ওর মুখ বেঁধে ফেলে ওরা।
মুসা বুঝতে পারে না ওর অপরাধ কী?
কয়েক মুহূর্ত মাত্র। মাটিতে পড়ে ছিল মুসা। হঠাৎ কোথা থেকে কেউ একজন এসে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
রাজুসহ সবাইকে কামড়িয়ে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলে।
মুসা এতক্ষণ চোখ বুজে পড়েছিল। হঠাৎ চোখ খুলে যা দেখে তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।
এতো টিংকু। হ্যাঁ টিংকুইতো। সেই রঙ, সেই চোখ, সেই লেজের আগায় কালো দাগ। স্বপ্ন না সত্যি তা বোঝার জন্য নিজের শরীরে নিজেই চিমটি কাটে। নাহ এতো সত্যি! টিংকুর আকস্মিক আক্রমণে কিশোর গ্যাং এর সবাই আহত অবস্থায় দৌড়ে পালিয়ে যায়।
মুসা মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায়। মুখের উপর থেকে গামছা সরায়।
টিংকু তুই!
কিন্তু কই টিংকু। এইত একটু আগেই তো ওদের সাথে লড়তে দেখলাম। কই গেল এর মধ্যে।
তাহলে কি এসব স্বপ্ন ছিল? কিন্তু মুসা আঘাত পাওয়া গালে হাত দেয়। উহ। ব্যথায় টনটন করছে। এটা নিশ্চয়ই স্বপ্ন না।
বহু বছর কেটে গেছে। মুসা এখন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। ছোটবেলার পাগলামিগুলো ভাবলে মাঝে মধ্যে সে একা একাই হাসে। একটি অপরিচিত কুকুরকে টিংকু ভেবেছিল। মৃত টিংকু কিভাবে ফিরে আসবে এটা তার ছোট্ট মাথায় কিছুতেই আসেনি।
তবে যাই হোক সেই কুকুরটির দেওয়া আঘাত পেয়ে কিশোর গ্যাং এর ছেলেরা ভালো হয়ে গিয়েছিল। তারা রীতিমতো সব ক্লাস করত। কাউকে উত্ত্যক্ত করতো না। লেখাপড়া করতো।
হঠাৎ মোবাইল ফোনের কল আসায় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে মুসা। বন্ধু রাকিবের ফোন।
হ্যালো রাকিব।
এই মুসা ভুলে গেছিস। আজ রাত বারোটা এক মিনিটে শারমিন ম্যামকে উইশ করতে হবে। ম্যামের জন্মদিন।
হ্যাঁ মনে আছে তো।
তাড়াতাড়ি আয় ম্যামের বাসায় যেতে হবে।
মোহাম্মদপুর চলে আয়। ওখানে সবাই মিলিত হয়ে ম্যামের বাসায় যাবো।
বন্ধুরা সব হলে থাকলেও মুসা থাকে ওর খালার বাসায়। শ্যামলীতে।
ফোন রেখে দ্রুত তৈরি হয়ে রাস্তায় বের হয় মুসা। হাত ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। যথাসময়ে পৌঁছাতে পারবে তো?
ভাবতে ভাবতেই একটা গাড়িকে প্রচণ্ড গতিতে তার সামনে আসতে দেখে মুসা।
সে বুঝতে পারে তাকে দ্রুত সরতে হবে নইলে গাড়ির নিচে পড়বে। কিন্তু তার পা যেন রাস্তার সাথে সুপার গ্লু দিয়ে লেগে গেছে কিছুতেই সরাতে পারছে না। হঠাৎ গাড়ির সামনে একটি কুকুরকে দেখে সে। রাস্তার পাশের মার্কেটগুলোর চোখ ধাঁধানো আলোতে কুকুরটিকে দেখে মুসা চমকে ওঠে। আরো এতো টিংকু। এত বছর পরেও টিংকুকে ও ঠিক চিনতে পারে।
ঘোর কাটতে না কাটতেই গাড়িটা কুকুরকে পিষে ফেলে মুসাও রাস্তা থেকে ততক্ষণে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছে। মুসা দৌড়ে যায় রাস্তায়। টিংকুর মৃতদেহ খুঁজতে থাকে।
নাহ্ কোত্থাও নেই। এমনকি টিংকুর কোনো ছিটেফোঁটা রক্তও কোথাও পড়ে নেই।
তাহলে ওটা টিংকু ছিল? না কি টিংকুর আত্মা। কেন সে বারবার মুসার জীবন বাঁচায়? কেন?