ব্যস্ত রাস্তা আর জনাকীর্ণ গলির মাঝে যেখানে কোলাহল কখনো কমেনা অনেক ময়লা জমে আছে ঠিক তার পাশেই মারিয়াদের ছোট একটা টিনের ঘর।
প্রতিদিন সকালে ওদের রুটিন হলো উস্কো খুস্কো চুলে, গায়ে ময়লা জামা, পায়ে সেলাই করা জুতা খুব পুরনো এক হাতে একটা বই আর অন্য হাতে একটা পাউরুটি বা বিস্কিট খেতে খেতে মক্তবে যাওয়া। আর ওর মা অন্যের বাসায় কাজে যায় ,অন্যের বাসায় সারাদিন কাজ করে রাতে মারিয়ার জন্য খাবার নিয়ে বাড়িতে আসে। সেই খাবার মা ও মেয়ে দুজনে ভাগ করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, এভাবে চলতে থাকে তাদের সংসার।
মারিয়ার উশ্কো খুস্কো চুল গায়ে ময়লা জামা তাই মক্তবের বন্ধু বান্ধবরা কেউ কাছে বসতে দেয়না অবহেলা করে। মারিয়া অনেক কষ্ট পায় কান্নাকাটি করে ওর মা কাজ করে। রাতে বাড়িতে ফিরলে মারিয়া মায়ের কাছে বলতো, মা আমার উস্কো খুস্কো চুল, গায়ে ময়লা জামা, তাই মক্তবের কেউ আমাকে কাছে বসতে দেয়না। মেয়ের কথা শুনে কষ্টে বুকটা ফেটে যায় কিন্তু কিবা করার আছে গরীবের কথার কেউ দাম দেয়না তাই চুপচাপ শুনে যায় কোনো উত্তর না দিয়ে।
রমজান মাস চলতেছে মাত্র কয়েকদিন পরে ঈদ এর মধ্যে মারিয়া বায়না ধরেছে নতুন জামার। মা রাতে বাড়িতে ফিরলে মায়ের কাছে বলে, মা ঝুমার জন্য ওর বাবা ঈদের নতুন জামা কিনে এনেছে আর ওর মায়ের জন্যও একটা সুন্দর শাড়ি এনেছে। মা এবার ঈদে আমার জন্য ঝুমার মত একটা নতুন জামা আর তোমার জন্য একটা শাড়ি কিনবে কিন্তু। কবে কিনবে বলো? মারিয়ার কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। মারিয়া আবার জিজ্ঞেস করল, বলনা মা কবে কিনবে? মারিয়ার মা বলল, মানুষের বাসায় কাজ করে খাই কিভাবে নতুন জামা আর শাড়ি কিনবো মা । এই কথা শুনে মারিয়া কান্নাকাটি শুরু করে দিল কোনোদিনও একটা নতুন জামা কিনে দাওনি, এবার ঈদে যদি নতুন জামা কিনে না দাও আমি বাড়িতেই থাকবো না। পরের দিন সকালে মারিয়ার মা কাজে চলে যায়। যতই হোক মায়ের মন বাসায় কাজ করছে আর ভাবছে কোনোদিন বাপ মরা মেয়েটাকে ঈদে একটা নতুন জামা দিতে পারিনি। বাসার আপাকে মারিয়ার কথা বলে দেখি আপা যদি গরীবের দুঃখ একটু বুঝে। কাজ শেষে বাসার আপার সামনে গিয়ে বলল, আপা আমার মেয়ে ঈদে একটা নতুন জামা কিনে চেয়েছে, আমি কাজ করে খাই মেয়েটাকে কোনোদিন ঈদে একটা নতুন জামা কিনে দিতে পারিনি।
তাই আমার মেয়েটা বায়না ধরেছে এবার ঈদে নতুন জামা নিবে, নতুন জামা না দিলে বাড়িতে নাকি থাকবেনা। ওকে নতুন জামা কিনে দেওয়ার মত টাকা নেই আমার কাছে আপনি যদি আমার মেয়েটাকে একটা নতুন জামা কিনে দিতেন আমার মেয়েটা খুব খুশি হতো, ঈদের দিনে বাপ মরা মেয়েটার হাসি মুখটা দেখতে পেতাম, আল্লাহ আপনাকে সওয়াব দিবে।
এই কথা বলে মারিয়ার মা কাজ থেকে ফিরে রাতে শুয়ে পড়ল। রাতে হঠাৎ প্রচণ্ড জ¦র গা থরথর করে কাঁপছে সকালে জ¦র একটুও কমেনি তাই কাজেও যেতে পারেনি।
সারাদিন জ¦রে বিছানায় শুয়ে আছে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওয়ার মত কেউ নেই। কারণ মারিয়ার জন্মের পর তার বাবা রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। তারপর থেকে একমাত্র মারিয়াকে নিয়ে কষ্টে দিন পার করছে।
এদিকে সারাদিন চলে গেল পেটে ভাত জোটেনি।
মারিয়াদের সংসারে ওর মা ছাড়া আর কেউ নাই খাবার যোগানোর। তাই যেদিন ওর মা কাজে যায় সেদিন কপালে ভাত জোটে তানাহলে না খেয়ে দিন রাত কাটে। রাতে প্রচণ্ড খিদায় মারিয়া কান্নাকাটি শুরু করেছে ঘরে কোনো খাবার নেই। এভাবে না খেয়ে রাত কাটিয়ে গেলো ক্ষুধার জ¦ালা আর সহ্য হয়না তাই সকাল হতে না হতেই মাকে না বলেই অবুঝ মারিয়া বাইরে বের হয়। এত সকালে কোনো মানুষ বা দোকান খোলা নেই, পেটের ক্ষুধা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা হোটেলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে খাবারের দিকে তাকিয়ে রইল।
কাউকে কিছু বলতে পারছে না এভাবে না খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো মারিয়া। ওর কান্নার আওয়াজ শুনে হোটেল থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে আসলো মারিয়ার হাত ধরে বললো কি হয়েছে তোমার কাঁদছো কেনো?
তখন মারিয়া বলল, আমি কালকে থেকে কিছু খাইনি।
ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করল, তোমার বাবা কি করে, মারিয়া বলল আমার বাবা নেই, মা অনেক অসুস্থ এই কথা শুনে ভদ্রলোকের মায়া হলো মারিয়ার হাতে কিছু খাবার দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো।
মারিয়া খাবার হাতে নিয়ে দৌড়ে বাড়িতে এলো এবং বলল, মা ওঠো আমি খাবার নিয়ে এসেছি। মারিয়ার মা দেখতে পেলো মারিয়ার হাতে অনেক খাবার জিজ্ঞেস করল, খাবার কোথায় পেলে তোমার কাছে তো টাকা নাই, কে দিল। মারিয়া বলল, আমি হোটেলের কাকুকে বলছি আমার বাবা নেই মা অসুস্থ্য আমরা কালকে থেকে না খেয়ে আছি, তাই তিনি দয়াকরে আমাকে খাবারগুলো দিলেন।
বিকেল বেলায় মারিয়া বাইরে খেলছে এমন সময় এক ভদ্রলোক ও সাথে একজন ভদ্রমহিলা মারিয়াকে জিজ্ঞেস করল, এখানে রাহেলাকে তুমি চিনো? রাহেলার ঘর কোনটা, মারিয়া উত্তর দিল রাহেলা তো আমার মা, আমি রাহেলার মেয়ে। আমার মা দুই দিন ধরে অসুস্থ বিছানায় শুয়ে আছে, তোমরা আমার মাকে দেখতে এসেছো, আসেন আমাদের বাড়িতে। দরজায় পা রাখতেই মারিয়া মাকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলো। মা, মা দেখো কে যেনো তোমাকে দেখতে এসেছে। রাহেলা অসুস্থ উঠতে পারছেনা শরীফ সাহেব ও তার স্ত্রী ঘরে ঢুকিয়ে পড়ল। ঘরে ঢুকেই দেখে রাহেলার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে কথা বলতে পারছেনা। শরীফ সাহেব রাহেলার এই অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি ডক্টর ডেকে নিয়ে আসলেন।
ডক্টর দেখে ওষুধ দিলেন। শরীফ সাহেবের স্ত্রী বললেন, তুমি দুই দিন ধরে কাজে যাওনি তাই তোমাকে দেখতে এলাম। তোমার মেয়ের জন্য নতুন জামা নিয়ে এসেছি শরীফের স্ত্রী নিজের হাতে মারিয়াকে জামা গায়ে দিয়ে দিলেন। সাথে রাহেলার জন্য নতুন শাড়ি ও ঈদের সমস্ত বাজার করে নিয়ে এসেছে । রাহেলা বলল, আপা আমরা গরীব মানুষ এতকিছুর কি দরকার ছিল। শরীফ সাহেব বললেন, এটা তো আমাদের দায়িত্ব। মারিয়া ঈদের জামা পেয়ে অনেক খুশি।
Share.