স্কুল ছুটি হয়েছে অনেকক্ষণ। এখন চারটা চল্লিশ বাজে। চারটা চল্লিশ মানে তো বিকেল। স্কুলের শেষ ঘণ্টা পড়ে চারটা দশ-এ। মিশুক ও খায়ের স্কুলের মেইন গেটের দিকে গিয়েছিল, তখন চারটাও বাজেনি। শেষ পিরিয়ড ছিল সমাজবিজ্ঞান ক্লাসের। রশিদ স্যার পড়ান। রশিদ স্যার বেশ ভালো। ছোটদের খুব ভালোবাসেন। মনটা উদার। বাচ্চাদের সুবিধা-অসুবিধা দ্যাখেন। তো জরুরি কাজের অজুহাত দেখিয়ে অনুমতি নিয়ে ওরা স্কুল ছুটির আধা ঘণ্টা আগেই বেরিয়ে পড়েছিল। গেট সংলগ্ন রেস্টুরেন্ট-এ শিঙ্গাড়া খেয়ে দু’বন্ধু এখন ফিরছে আবার স্কুলের দিকে। ওদের গন্তব্য এখন ২ নং প্লে গ্রাউন্ড। ওখানেই পিন্টু স্যারের থাকার কথা। ক্লাস নাইনে ওটা পাঁচ-ছটা ছেলেকে উনি আজ নতুন কিছু শেখাবেন।
রংপুর জেলা স্কুলের খেলার মাঠ তিনটা। বড় বড় মাঠ। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে স্কুলে ঢোকার রাস্তা। রাস্তাটা পাকা। আর সামনের দুই মাঠের পাশে আছে একটা করে বটগাছ। না, একটু ভুল হয়ে গেল, একটা বটগাছ। আরেকটা অশ্বথ গাছ। দুটোই বিশাল সাইজের। বটগাছের অনেক ঝুরি নেমেছে। বছর দুয়েক আগে মিশুক, খায়েরসহ অন্য বন্ধুরাও ওই ঝুরি ধরে দোল খেতো। খুব দুলতো ছেলেরা। একবার তো দোল খেতে গিয়ে, ওমা! হাত ছলকে পড়ে গেল মিশুক!
নাকে-মুখে বেশ চোট লেগেছিল। সবাই অবাক হয়ে দেখলো মিশুকের নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। কী তাজা রক্ত! রক্ত বেরোচ্ছে তো বেরোচ্ছেই! পরে বন্ধুরা ওকে ধরে রিকশায় তুলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।
ক্লাস এইটে ওঠার পর ওরা আর বটের ঝুরি, ধরে দোল খায়নি। আর এখনতো ওরা ক্লাস নাইনে। স্কুলের সিনিয়র স্টুডেন্ট। মেইন গেট থেকে মাঠের মাঝামাঝি নাগাদ আসতেই অদূর থেকে দৃশ্যটা চোখে পড়লো খায়েরের। খায়ের বলে, এই দ্যাখ! পিন্টু স্যার!
মিশুক বলে, সবগুলো ছেলে ক্লাস এইটের?
খায়ের উত্তর দেয়, দুই-তিনটা বোধ হয় ক্লাস নাইন-এর। আমি জানি না। আই অ্যাম নট সিওর।
মিশুক নিঃশব্দে হাসে। আরও কাছে এলে দেখা যায় পিন্টু স্যার খুব সিরিয়াসলি ছেলেদের প্রিবলিং শেখাচ্ছেন। ছেলেরাও মনোযোগ দিয়ে শুনছে। প্রাকটিক্যাল করছে। সেটা করতে গিয়ে ভুল হচ্ছে। অনেকেই পড়ে যাচ্ছে। পিন্টু স্যার ওদের ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে নিজেই করে দেখাচ্ছেন।
মিশুক লক্ষ করে, হাত দেড়েক পর পর একটা করে মোটা কাঠি পোঁতা হয়েছে। এভাবে পাঁচটা কাঠি পোঁতা আছে। সামনে থেকে বল নিয়ে দৌড়ে এসে ওই কাঠিগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কাঠিগুলো যেন প্রতিপক্ষের এক একজন খেলোয়াড়। কাঠির সামনে এসে দ্রুত বল পা বদল করে এবং বলের আগে-পিছে পা এনে কাঠি পেরিয়ে যেতে হবে। এটাই ড্রিবলিং। এবং ব্যাপারটা করে ফেলতে হবে কয়েক মিনিটের ভেতর।
তিন/চারটা ছেলে আগে থেকেই নবীন খেলোয়াড়দের অনুশীলন দেখছিল। মিশুক খায়ের ওদের এক পাশে এসে দাঁড়ালো। গেম টিচার কিন্তু তার ব্যস্ততার মধ্যেও ঠিকই ওদেরকে দেখেছেন। একটু পরেই আঙুল উঁচিয়ে দাঁড়াও বাবুরা। এই বিশ মিনিট! বলে তিনি আবার কাজে মগ্ন হয়ে গেলেন। দুটো ছেলেকে এক দফা বকাঝকা করলেন। বারবার একই ভুল করছিলো ওরা।
নিচু স্বরে, ঠোঁট প্রায় কানের কাছে এনে মিশুক বলে, পিন্টু স্যার কঠিন জিনিস, নাআ?
খায়ের বলে, হ্যাঁ, তাতো ঠিকই। জানিস, চাকরিতে ঢোকার আগে উনি রহমতগঞ্জ ইয়াং ব্রাদার্স ক্লাবের একজন নামকরা প্লেয়ার ছিলেন?
ইয়াং ব্রাদার্স ক্লাবটা কোথায় রে?
ওটা বগুড়ার ক্লাব। পিন্টু স্যার তো বগুড়ার লোক।
মিশুক বলে, স্যার কিন্তু দারুণ শেখান, তাই না?
খায়ের বলে, আরে উনি ছিলেন দলের স্ট্রাইকার। একবার নাকি ঢাকার আরামবাগ ক্লাব ইয়াং ব্রাদার্সের কাছে হেরে গেছিল মেইনলি ওনার জন্যই।
মিশুক অবাক হলো, সাংঘাতিক ঘটনা। আরামবাগ ক্লাব তো নাম করা দল!
পিন্টু দত্ত গেম টিচার হিসাবে জেলা স্কুলে জয়েন করেছেন ছয় বছর আগে। এখন তার বয়স চৌত্রিশ। এক ছেলের বাবা এই চৌকস ক্রীড়া শিক্ষক সবার মন জয় করেছেন। দু’দুবার ডিভিশন লেভেলে পুরস্কৃতও হয়েছেন। এই সুদর্শন স্মার্ট লোকটি কেবল বাচ্চাদের শেখান না, নিজেও শেখেন। উনি বলেন, শোনো বাবুরা, ওয়ার্ল্ডের বড় বড় প্লেয়াররা কিন্তু যতদিন খেলে ততদিনই শেখে। আর শেখার তো কোনো শেষ নাই, তাই না? পিন্টু দত্ত শুধু দেশি পত্রিকা না, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিদেশি ম্যাগাজিনও কেনেন। তিনটা ক্রীড়া-পত্রিকা সৌজন্য কপি হিসাবে পান। সেগুলোর কোন-কোনটা তিনি তার পছন্দের ছাত্রদেরকে বিশেষ করে যারা স্কুল টিমের উঠতি খেলোয়াড়, দেন। বগুড়া শহরের কাটনার পাড়ায় তার পৈতৃক বাড়ি। ওখানে তার উদ্যোগে একটা ফুটবল ক্লাব গড়ে উঠেছে। প্রতি দু’মাসে তিনি ওই ক্লাবে একবার যাবেনই। তাছাড়া নানাভাবে ওই ক্লাবকে তিনি সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। পিন্টু বাবু কথা দিয়েছিলেন, আজ স্কুল ছুটির পর মিশুককে তিনি দুটো স্পোর্টস ম্যাগাজিন দেবেন। ফুটবল সম্পর্কিত অনেক মূল্যবান কথা ওগুলোতে আছে। বিখ্যাত ফুটবলারদের বিশেষ করে স্ট্রাইকারদের, খেলার কৌশল ছবির মধ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে। তো ওই ম্যাগাজিন নেয়ার জন্যই মিশুক খায়েরকে সাথে নিয়ে হাজির হয়েছে। ক্লাস নাইনের হাফ-ইয়্যারলি পরীক্ষার আগে থেকেই মিশুক জেলা স্কুলের ফুটবল টিমের সদস্য। আর নিজেদের মহল্লার ক্লাব অগ্রণী ক্রীড়া সংঘ-এর একজন ফুটবলার সে ক্লাস এইটে পড়ার সময় থেকেই। ওর দিকে পিন্টু স্যারের বিশেষ নজর। দ্রুত গতিসম্পন্ন এই ন¤্র-ভদ্র ছেলেটাকে ঠিকমতো ট্রেইন-আপ করতে পারলে সে হবে দলের আরেকটা তুরুপের তাস। রঞ্জু, ধীরেন-রাও যথেষ্ট বাজে প্লেয়ার। কিন্তু পিন্টু দত্ত মনে করেন, একটা জেলা স্কুলের নিয়মিত ফুটবল টিমে কমপক্ষে চার জন কোয়ালিটি স্ট্রাইকার যার দরকার। তাহলে পরিস্থিতি বুঝে বিভিন্ন জনকে নামানো যায়।
দুই.
মিশুক ছাত্র খারাপ না। মোটামুটি ভালো ছাত্রই বলা যায় তাকে। বাংলা ও ইংরেজিতে বেশ ভালো সে। অঙ্কে খুব দুর্বল। ক্লাস এইটের পরীক্ষায় পেয়েছিল ঊনচল্লিশ। নাইন থেকে টেন-এ ওঠার সময় আরও কম- সাঁইত্রিশ। এই অঙ্কে পিছিয়ে থাকার কারণে গত তিন বছর ধরে ও ক্লাসের সেকেন্ড বয়। ফার্স্টং বয় হচ্ছে রানা। রানা বাংলা-ইংরেজিতে কখনোই মিশুকের চেয়ে বেশি মার্কস পায় না। সব সময়ই বিশ/পঁচিশ নম্বর পিছিয়ে থাকে। কিন্তু অঙ্কে পঁচাত্তর/আশি পাওয়ার ফলে মোট নম্বরে এগিয়ে যায়। অথচ ক্লাস সেভেন পর্যন্ত মিশুকই ছিল ক্লাসের ফার্স্ট বয়।
ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্টের দিন ওদের ক্লাস টিচার মিজানুর রহমান মিশুকের কান টেনে ধরে রেখেছিল অনেকক্ষণ। কেননা মাত্র চার নম্বরের জন্য ওর রোল নম্বর এক হতে পারলো না। রানা বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে পেয়েছে এক’শ চব্বিশ। মিশুকের সেখানে ওই দুই বিষয়ে মার্কস একশ বাহান্না। রানা এবার অঙ্কে লেটার মার্কস পায়নি- সাতাত্তর পেয়েছে। তাছাড়া ইতিহাস, ভূগোল ও সমাজ বিজ্ঞানেও মিশুকের চেয়ে তার নম্বর কম। মিজান স্যার মিশুককে একটু বেশি আদর করেন। ওর খেলার স্টাইল পছন্দ করেন। তার রাগ, প্রতিবার দুই, তিন বা চার নম্বরের জন্য ওকে দ্বিতীয়ই থেকে যেতে হচ্ছে। কান টেনে ধরে মিজানুর রহমান তাই বলে যাচ্ছেন, আরে এ ব্যাটা…. আর চারটা নম্বর পেলি না! তুই কী রে! ওদিকে কানে ব্যথা পেয়ে মিশুক বলছে, স্যার…. স্যার… প্লিজ স্যার…… আর হবে না স্যার….!
কান ছেড়ে দিয়ে মিজান স্যার বলছেন, হ্যাঁ, মনে থাকে যেন। সামনে আরও দুইটা পরীক্ষা আছে। এবার ফার্স্ট হওয়া চাই। মিশুকের ফর্শা কান লাল হয়ে গেছে। ওই জায়গায় আঙুল বুলাতে বুলাতে সে বলছে, অঙ্ক প্রাইভেট পড়তেছি স্যার। আশা করি সামনের বার পারবো। আপনি খালি দোয়া করবেন।
মিজান স্যার বলে, আরে ব্যাটা, দোয়া তো তোর জন্য আছেই। তুই অনেক বড় হবি জীবনে।
তারপর আদর করে কাঁধে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল, যা এখন সিটে যেয়ে বস।
রানা অবশ্য এসব দেখতে পায়নি। দশম ‘ক’ শাখায় ও বসে। মিশুক ‘খ’ শাখায়। কিন্তু খবর চাউর হতে দেরি হয় না। মিজান স্যার মিশুককে কী কী বলেছে সবই তার কানে যায়। ওই টিচারের ওপর মনে মনে রাগ করে সে। ভেতরে-ভেতরে আরও জেদি হয়ে ওঠে। স্কুলজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে এক নম্বরই থাকতে চায়। অবশ্য দশম শ্রেণী দু’ভাগে ভাগ হওয়ার ফলে এখন দু’জনেরই রোল নম্বর এক। রানা বেশ চাপা ছেলে। মনোভাব প্রকাশ করে নারাজ সে। এমনিতে মিশুকের সাথে তার খুব ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও বন্ধুত্ব তো আছেই। মিশুক স্কুলটিমের ফুটবলার এটা তার ভালোই লাগে। তাছাড়া পিকনিক, বার্ষিক স্পোর্টসসহ নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আয়োজনের সময় অন্য ভলান্টিয়ার ছাত্রদের পাশাপাশি মিশুকের সঙ্গে রানাও থাকে টিচারদের হেল্প করার জন্য। আবার রানা এটাও ভাবে, আর একটা বছর তারা স্কুলে থাকবে। তারপর কে কোথায় যাবে কোনো ঠিক আছে? মিশুকের বড় ভাই ঢাকায় থাকে। রানা শুনেছে, মিশুক এস.এস.সি-র পর ঢাকার কোনো ভালো কলেজে ভর্তি হবে। আর তা না হতে পারলে রংপুরেই থাকবে! সেক্ষেত্রে কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হবে দু’জনেই।
মিশুক ভাবে, আর যাই হোক রানাটা হিংসুটে নয়। ছেলেটা অন্যায় সহ্য করতে পারে না। প্রতিবাদ করে। সেজন্য কোনো কোনো টিচার ওকে দেখতে পারে না। আর হ্যাঁ, একটা কমিক মেজাজ আছে ওর চরিত্রে। নাইলে পড়ার সময় স্কুলের নাটকে একটা কমেডিয়ান চরিত্রে অভিনয় করে খুব হাসিয়েছিল সবাইকে। ওর এই প্রতিভা সহজাত।
তিন.
প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে আরম্ভ হয় জেলা আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা। জেলার প্রধানতম স্কুল হিসাবে রংপুর জেলা স্কুল মাঠে এই উৎসব বসে। দশ/বারো দিন ধরে চলে। রোজ দুটো/তিনটা করে ম্যাচ হয়। ফুটবল উপলক্ষে রীতিমতো মেলার পরিবেশ তৈরি হয়। গত বুধবার স্কুলে যায়নি মিশুক। ফলে ও ক্লাসে নোটিশ শুনতে পায়নি। খবরটা পেয়েছে খায়েরের কাছ থেকে। তারপর থেকে মিশুকের মাথার ভেতর প্রজাপতি উড়ছে। পিন্টু স্যার বলেছে, জেলা স্কুল প্রথম রাউন্ডে আটটা ম্যাচ খেলবে। প্রথম চারটা ম্যাচে মিশুক দলে থাকবে। সে যদি ভালো করে পরের ম্যাচগুলোতেও তাকে রাখা হবে। দারুণ সুযোগ এটা। মিশুক অবশ্য মনে করে, প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের ডি-এলাকায় তাকে রুখে দেয়া সহজ হবে না। সে বল নিয়ে ঢুকে পড়বেই। রঞ্জু বা ধীরেন যদি সুবিধাজনক জায়গা থেকে তাকে পাস দেয় তাহলে কাজটা কিছুটা সহজ হবে। যাই হোক, মিশুকের আত্মবিশ^াস; সে ভালো করবে। আর শুধু ভালো না, চোখে পড়ার মতো ফুটবল খেলবে সে।
ইন্টার স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট-এর সংবাদটা পাওয়ার পর থেকেই মিশুক হাওয়ায় ভাসছে। সেই বিকেল থেকে তার মেজাজ ভারি ফুরফুরে। সন্ধ্যায় পড়ায় মন বসলো না। বইয়ের খেলা পৃষ্ঠায় বারবার ভেসে উঠলো অসংখ্য তাঁবু জেলা স্কুলের মাঠে। অনেকগুলো ফ্লাগ উড়ছে পাশাপাশি। স্কুলের সামনের প্লে-গ্রাউন্ড দুটোর চারদিকের সীমানা, কর্নার, ডি-বক্স, গোলপোস্টের নিচ… এসব জায়গায় চুন দিয়ে রেখা টানা হয়েছে। টুর্নামেন্টের সাথে যুক্ত কর্মকর্তা-স্বেচ্ছাসেবকরা কাজে ব্যস্ত। পিন্টু স্যারকে মধ্যমাঠের দিকে দৌড়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। তার গলায় ফিতা দিয়ে ঝুলানো বাঁশিটা দুলছে। পত পত করে উড়ছে বিভিন্ন স্কুলের নাম লেখা নানা রঙের পতাকাগুলো। তাঁবুর ভেতর বিভিন্ন ভঙ্গিতে শুয়ে-বসে আছে প্লেয়াররা। তারা মাঠে নামার জন্য মানসিকভাবে তৈরি হচ্ছে। আধা ঘণ্টা পরেই তাদের ম্যাচ। মিশুক দেখতে পাচ্ছে, পিন্টু স্যার অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টারের সাথে শলাপরামর্শ করছে। আবার সে দেখছে, রজু-ধীরেন-মিশুককে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে গেম টিচার কিছু বলছে। পিন্টু স্যার রসিক মানুষ। কোনো একটা মজার কথা বলেছেন। ফুটবলার তিন বন্ধু একসাথে হাসছে…। কী প্রাণোচ্ছল আর নির্মল সেই হাসি!
আজ সন্ধ্যায় মিশুকের মনটা একেবারেই চাইছে না পড়তে। টেবিলে বসেছে বটে, বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে শুধু। স্টাডি টেবিল বরাবর মাথার ওপর পেলে, সক্রোর্টিস, জিকো প্রমুখ খেলোয়াড়দের ছবি। মনোয়ারা খাতুন অনেকক্ষণ আগে মিশুকের টেবিলে নাশতা দিয়ে গেছে। ছেলেটা খাচ্ছে না। সে অপলক তাকিয়ে আছে ওই বিশ^বিখ্যাত খেলোয়াড়দের ছবির দিকে।
মনোয়ারা খাতুন বুঝতে পারছে আজ তার ছেলের মন চঞ্চল। সন্তানের খুশি তাকেও স্পর্শ করেছে ঠিকই। স্কুল টিমে ছেলে খেলবে ভেবে তারও গর্ব হচ্ছে। স্কলারশিপ পাওয়ার মতো স্কুলের নিয়মিত খেলোয়াড়রাও টাকা পায়; পাবে মিশুকও এটা ভেবেও ভালো লাগছে তার। কিন্তু স্বামী রাগী মানুষ। বাসায় ফিরে যদি দ্যাখে ছেলে পড়ছে না, তাহলে ক্ষেপে উঠবে। এটা চিন্তা করেই মনোয়ারা বলে, একটু পড় বাবা, অন্তত ডিনার পর্যন্ত। একটু হলেও মন দে। তোর আব্বা এসে তোকে টেবিলে দেখলে খুশি হবে। এমনিতেই অঙ্কে খুব কম নম্বর পেয়েছিল বলে মনে কষ্ট পাইছেন।
মিশুক বলে, ঠিক আছে আম্মা; তুমি টেনশন করো না! বলে নাশতার প্লেট হাতে নেয়। নাশতা খেয়ে অঙ্ক কষতে বসে। এক মাস ধরে কৃষ্ণলাল স্যারের কাছে অংশ শিখছে সে। অ্যালজেবরাটা তার কাছে বিদ্ঘুটে লাগে। পাটীগণিত বরং কিছুটা ইজি মনে হচ্ছে এখন। এখন সে কয়েকটা সরল অঙ্ক কষবে, স্যারের দেখানো পদ্ধতি অনুসারে।
কৃষ্ণকাল বাবু জেলা স্কুলের নামকরা অঙ্কের শিক্ষক। তাকে অঙ্কের পণ্ডিতও বলা চলে। আর কেবল অঙ্ক না, অনেক বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন এই ভদ্রলোক। খুব বেশি ছাত্র পড়ান না। সকালে দুই ব্যাচ, বিকেলে দুই ব্যাচ। সন্ধ্যাবেলা কাউকে সময় দেন না। ওই সময়টা তার নিজের জন্য। মিশুক সপ্তাহে পাঁচ দিন অঙ্ক শেখে তার কাছে। এর ভেতর শুক্রবারও আছে। শুক্রবার তার প্রাইভেটের টাইম সকাল দশটা। গত বুধবার টিফিন আওয়ারে দেখা হয়েছিল পিন্টু স্যারের সাথে। নাশতা খেয়ে মিশুক এগোচ্ছিল কমনরুমের দিকে। বারান্দা দিয়ে আসছিলেন পিন্টু দত্ত। উনি মিশুককে থামান। সামনের শুক্রবার সকালে তোর কাজ কী?
স্যার, কাজ মানে… বাজার তো আব্বাই করেন। আমার প্রাইভেট আছে কৃষ্ণ স্যারের কাছে…।
কটার সময় প্রাইভেট?
দশটা থেকে এগারোটা।
পিন্টু বলেন, কৃষ্ণবাবুর বাসা তো আমার বাসা থেকে বেশি দূরে না। প্রাইভেট শেষ করেই তুই সোজা আমার বাসায় চলে আসবি। রঞ্জু, বাদল, আনিসকে আমি বলে রাখছি। ধীরেনটার দেখা পেলাম না। ও রেগুলার ক্লাস করে না?
করেই তো। ওর আম্মা অসুস্থ। দুই দিন স্কুলে আসে নাই।
পিন্টু দত্ত বলেন, ও! শোন তুই ধীরেনকে বলবি। শুক্রবার কিন্তু মিস করা যাবে না। জরুরি কথা আছে। টুর্নামেন্টের কিন্তু মাত্র ছয় সপ্তাহ বাকি, মাইন্ড ইট!
রাধাবল্লভ ও চাঁপাতলা পাশাপাশি মহল্লা। বাদল ও আনিসের বাসা চাঁপাতলায়। রঞ্জু, মিশুক ও ধীরেন থাকে রাধাবল্লভে। অগ্রণী ক্রীড়া সংঘ রাধাবল্লভে। এর প্রধান হচ্ছেন হাসনাত আমজাদ টিপু। সবার প্রিয় টিপু ভাই। টিপু ভাইয়ের বাসার পেছনের দিকের একটা রুম ক্রীড়া সংঘের অফিস হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। টিপু খুব ডিসিপ্লিনড মানুষ। ছেলেদের যেমন শাসন করেন তেমনি আদরও করেন। এক সময় রংপুর জেলা ফুটবল দল-এর দুর্দান্ত প্লেয়ার ছিলেন। তার কড়া নির্দেশ সপ্তাহে কমপক্ষে চারদিন ফুটবল খেলতেই হবে। কোনও কোনও সপ্তাহে পাঁচ দিনও হয়। কাছেই বড় মাঠ আছে। ফুটবল গড়ায় ওখানেই। টিপু ক্লাবের প্রধান। আবার খেলার গড়ায় ওখানেই। টিপু ক্লাবের প্রধান। আবার খেলার সময় টিপুই রেফারি। সব মিলিয়ে মজার চরিত্র এই হাসনাত আমজাদ টিপু।
বৃহস্পতিবার খেলা ছিল। বাঁশিতে শেষ ফুঁ পড়ার পর কথা আছে বলে মিশুক রঞ্জু ও ধীরেনকে নিয়ে মাঠেই বসে পড়লো। মিশুক ওদের জানালো যে কাল সাড়ে এগারটার মধ্যে অবশ্যই পিন্টু স্যারের বাসায় হাজির থাকতে হবে। মিস করা চলবে না। ইন্টারস্কুল ফুটবলের ব্যাপারে উনি আমাদের সাথে আলাপ করবেন।
চার.
রংপুর জেলা স্কুলে ইন্টার ক্লাস ফুটবল প্রতিযোগের ঐতিহ্য আছে। অনেক বছর ধরে এটা চলছে। বছর তিনেক ধরে হকিও খেলা হচ্ছে নিয়মিত। হকি অবশ্য খেলে শুধু নাইন ও টেন-এর ছাত্ররা। তো ইন্টার ক্লাস ফুটবল খেলা হয় ক্লাস সিক্স বনাম ক্লাস সেভেন, সেভেন বনাম এইট, এইট বনাম নাইন, নাইন বনাম ক্লাস টেন-এর মধ্যে। এ ক্ষেত্রে এইটের বিশেষভাবে বাছাই করা ছেলেরা খেলে টেন-এর অপেক্ষাকৃত লম্বা ছেলেদের সঙ্গে। একটু খাটো প্লেয়াররা তাদের চেয়ে খানিকটা লম্বা প্লেয়ারদেরকে কিভাবে ট্যাকল করে এবং এই ম্যাচে ক্লাস এইটের কোন কোন ছেলে বেশ ভালো ফুটবল খেলতে পারে সেটা দেখাই প্রধান উদ্দেশ্য ওই স্পেশাল ম্যাচের। তার কারণ আছে। কারণটা হলো, যখন ইন্টারে স্কুল ফুটবল হয় তখন দেখা যায়, জেলা স্কুলের টিমে ক্লাস এইটে রও দু’তিন/জন খেলোয়াড় থাকে। বাকি বারো/তেরো জনকে নেয়া হয় ক্লাস নাইন ও টেন থেকে। মোট পনেরো জনের টিম। মজার ব্যাপার, কোনো কোনো বছর দলে ক্লাস টেন-এর চেয়ে ক্লাস নাইনের ছাত্র বেশি থাকে, এক বা দু’জন। এখানে নিচের বা ওপরের ক্লাসের চেয়ে কারা বেটার ফুটবল খেলছে সেটাই আগে বিবেচনা করা হয়। যাহোক ইন্টার ক্লাস ফুটবল টুর্নামেন্টে মোট সাতটা ম্যাচ হয়। ফাইন্যালের আগে এক দিনের বিরতি। নয় দিন ধরে চলে এই উৎসব।
মিশুকরা ক্লাস সেভেনে থাকার সময়ই পিন্টুদত্ত বগুড়া জেলা স্কুল থেকে রংপুর জেলা স্কুলে বদলি হয়ে আসে। ফি বছর জুলাইয়ের প্রথম/দ্বিতীয় সপ্তাহে আরম্ভ হয় ইন্টার ক্লাস ফুটবল। পিন্টু দত্ত তখনই খেলায় করেছে মিশুকের খেলার স্টাইল। ছোটখাটো ছেলে কিন্তু কী তার গতি আর প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে ফাঁকি দিয়ে বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কী ভঙ্গি তার! সারাক্ষণ হাসি মুখে সেই ম্যাচ উপভোগ করেছে পিন্টু বাবু। সেবার ক্লাস এইট তিন গোল হজম করেছিল। তার মধ্যে দুটোই এসেছিল মিশুকের পা থেকে। দ্বিতীয় গোলটি করেছিল ধীরেন। পিন্টুদত্ত তখনই ভেবেছিলেন এই ছেলে দু’টিকে কাজে লাগাতে হবে। বিশেষ করে মিশুকের কথা তার মাথায় এসেছে বারবার। ধীরেনের গড়ন লম্বা। ও ক্লাস এইটে ওঠার পর স্কুলটিমে অন্তর্ভুক্ত হলো। মিশুকের উচ্চতা চার ফুট এগারো ইঞ্চির সামান্য কম। ফুটবল ভালো খেললেই হবে না শুধু, ক্লাস এইটের ছাত্রদের কমপক্ষে পাঁচ ফুট এক ইঞ্চির জন্য। পিন্টু দত্ত বললো, তুই মন খারাপ করিস না। তোর বডির যে গড়ন তাতে মনে হচ্ছে, নাইনে উঠতে উঠতে তুই কোয়ালিফাইয়িং হাইট পেয়ে যাবি। এমনকি পাঁচ ফুট দুই ঞ্চির বেশিও হয়ে যেতে পারে। তুই খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো করবি। আর স্কুলে এসে ডেইলি টিফিন আওয়ারে কমপক্ষে বিশ মিনিট ঝুলবি রিং এ বুঝলি?
মিশুক পিন্টু স্যারের কথা পুরোপুরি ফলো করেছে। সবজি ও ফলমূল নিয়মিত খেয়েছে, খাচ্ছে। ঝোলার কাজেও ক্ষান্ত দেয়নি। আর এক বছর যেতে না যেতেই, সবাই দেখতে পাচ্ছে, তার উচ্চতা কতটা বেড়েছে। মিশুক এখন পাঁচ ফুট পৌনে তিন ইঞ্চি। রঞ্জু ও বাদলও ক্লাস নাইনে ওঠার পর দলে চান্স পায়। রঞ্জুর উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি। আর বাদল তো পাঁচ ফুট পাঁচ। দলে ঢোকার সব যোগ্যতাই ছিল আনিসের। কিন্তু ওকে নেয়া হয়নি বলে ভেঙে পড়েছিল ছেলেটা। সিলেকশন কমিটি পরে, ইন্টারস্কুল ফুটবলের মাস দুয়েক আগে, পনেরো জনের ভেতর আনিসকে রাখে। আনিস কথা বলে কম। জেদি টাইপের ছেলে। এই-যে প্রথমে ওকে নেয়া হলো না, পরে আবার ডাকা হলো দলে এটার উচিত জবাব দিয়েছিল সে। জেলা স্কুল দুটো ম্যাচে জিতে যায় আনিসের করা গোলের জন্যই। একটা গোল তো ও দিয়েছিল শেষ বাঁশি পডার মাত্র দু’মিনিট আগে। তারপর খেলা শেষ হওয়া মাত্র সবাই দৌড়ে যায় মাঠের মাঝখানে। তারা আনন্দের আতিশয্যে আনিসকে ওপরে তুলে ধরে। ওই অবস্থায় বন্ধুরা পনেরো/বিশ কদম হেঁটে যায়। আনিস তখন হাতের ওপর শুয়ে আকাশ দেখছে; আকাশের মেঘ আর পাখি দেখছে। ওই শেষ গোলটা ছিল মহামূল্যবান। গোলটা না হলে ম্যাচ ২-২ এ ড্র হয়ে যেত। জেলা স্কুল আর কোয়ার্টার ফাইনাল পর্বে উঠতেই পারতো না।
পাঁচ.
এগারোটার পরপরই মিশুক ও আনিস কৃষ্ণলাল স্যারের বাসা থেকে বের হয়। আনিস ঘড়ি দ্যাখে, এগারোটা চার মিনিট। মিশুক বলে, অসুবিধা নাই। আমরা ঠিক সময়েই যাচ্ছি। পিন্টু স্যার তো বলছেন, সাড়ে এগারোটার মধ্যে দেখা করতে হবে। এখন থেকে দশ/বারো মিনিট লাগবে। কেরানি পাড়া বড় ব্রিজের ঢাল থেকে নিচে একটু এগোলেই হাতের বাঁয়ে স্যারের বাসা। হাঁটতে হাঁটতে আনিস বলে, ধীরেন, রঞ্জু, বাদলও আসবে। আমি বলি দিছি, তেঁতুলতলা মোড়ে আমরা একত্র হবো। এখন ওরা যদি আট/দশ মিনিট লেটও করে তবুও সাড়ে এগারোটার বেশি হবে না দেখিস।
মিশুক বলে, তাই যেন হয় বন্ধু! পিন্টু স্যার খুব টাইমসচেতন লোক। দেরি হলে কিন্তু বকা নিশ্চিত।
না দেরি হয়নি ওদের। তেঁতুলতলা মোড়ে রঞ্জু ও ধীরেন আগেই এসেছিল। বাদল ওখানে পৌঁছেছে ছয়/সাত মিনিট পর। ছেলেরা যখন পিন্টু দত্তের বাসার দরজায় কড়া নাড়ে তখন ঘড়িতে এগারোটা ছাব্বিশ। পাঁচ বন্ধু পিন্টু দত্তের বৈঠকখানায় বসে আছে। দু’/তিন মিনিট পরেই পিন্টু বাবু উদিত হলেন। ছেলেরা উঠে দাঁড়িয়ে আদাব জানালো। পিন্টু দত্ত ছাত্রদের মুখ বরাবর সিঙ্গেল সোফাটায় বসেই বললেন, গুড! তোমরা টাইম মেনটেন করছো, সেজন্য থ্যাংকস।
পিন্টু বাবু এমনিতেই সুদর্শন, ফর্সা। একটু আগে স্নান করেছেন। গাল ক্লিন-শেভ্ড। তাকে খুব ফ্রেশ দেখাচ্ছে। তাকে বেশ উজ্জীবিতও লাগছে।
রঞ্জু বলে, স্যার আজ আপনাকে খুব স্মার্ট দেখাইতেছে; একদম হিরোর মতো।
পিন্টু বলেন, হ্যাঁ, আমি তো হিরোই; মানে হিরো ছিলাম আর কি!
বলেই স্মিত হাসেন। মিশুক বলে, না স্যার আপনি এখনও হিরো। আমরা আপনার মতো হতে চাই। পিন্টু দত্ত বলেন, কেন; তোমরা আমার মতো হতে চাইবে কেন? তোমরা হবে চিরকালের সেরা ফুটবলারদের মতো। গেট অ্যামবিশাস, গেট রেডি।
মাথার চুল খুব ছোট, টিভটিভে চেহারার একটা ষোলো/সতেরো বছরের ছেলে চা বিস্কুটের ট্রে নিয়ে হাজির হয়। সে চলে যেতেই ছেলেদেরকে বিস্কুট নেয়ার জন্য ইশারা করে পিন্টু বলেন, শোনো যে-জন্য তোমাদেরকে আমি আসতে বলছি; খেলার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আজ কিছু কথা বলবো।
দ্যাখো, আমাদের গ্রুপে যে টিমগুলো আছে, তাতে সেকেন্ড রাউন্ডে আমরা সহজেই উঠে যাবো। আসল খেলা হবে ওই পর্বে। তো সেকেন্ড রাউন্ডে আমাদের ম্যাচ আছে তিনটা। তার মধ্যে ধরে রাখো, দুটো ম্যাচে আমাদের প্রতিপক্ষ হবে গাইবান্ধা পাইলট স্কুল এবং মাহিগঞ্জ হাইস্কুল। মাহিগঞ্জ কিন্তু, তোমাদের মনে আছে? গতবার সেমিফাইনাল খেলেছিল। পরে রবার্টসনগঞ্জ হাই স্কুলের কাছে হেরে গিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ে?
আনিস বলে, খুব মনে আছে স্যার। মাহিগঞ্জ সেবার দুর্দান্ত খেলছিল। দুই দলই এক গোল করে দিয়েছিল। খেলা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট আগে মাহিগঞ্জ প্যানাল্টি গোল খায়।
মিশুক বলে, রবার্টসনগঞ্জ তো সেবার সেমিফাইনাল খেলেছে তাই না স্যার?
আমি তো তা-ই জানি। সেমিফাইনাল তো আমরাও খেলেছি, মনে নাই?
আনিস উচ্চাকাক্সক্ষী ছেলে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে সে কোনো অবস্থাতেই আশা ছাড়ে না। দুই গোল হজম করার পরও, দেখা গেছে, সে মনে করে আমরাই জিতবো। জিততে হলে সেক্ষেত্রে হয়তো দুই বা তিন গোল দিতে হবে। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে এই লড়াই বড় কঠিন। কিন্তু আনিস নাছোড়বান্দা। আর ভয়ানক জেদি। এমন পরিস্থিতিতেও সে ম্যাচ বের করে এনেছে। মুলাটোল ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও জুম্মাপাড়া ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে দু’টি ম্যাচে এমনটা হয়েছিল। রাধাবল্লভ অগ্রণী সংঘের কাছে মুলাটোল হেরে যায় ৩-২ গোলে। জুম্মাপাড়া একটা গোল দিয়েছিল প্রথমার্ধে। রাধাবল্লভ প্রথম দিকে ভালো না করলেও শেষের দিকে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ওদের দুটো গোলই আসে আনিসের পা থেকে। অবশ্য এর অর্ধেক কৃতিত্ব দিতে হবে রঞ্জুকে। রঞ্জু নিখুঁতভাবে পাস না দিলে ওই গোল দুটো সম্ভব ছিল না। মুলাটোলের কাছে প্রথমে দু’গোল খাওয়ার পর অগ্রণী সংঘের পক্ষে প্রথম গোলটা দিয়েছিল আনিসই। পরের দু’টি অবশ্য মিশুক দেয়। বিরতির সময় রাধাবল্লভ এক গোলে পিছিয়ে ছিল। মিশুক খুব অ্যাকশন সমৃদ্ধ ফুটবলে বিশ্বাসী। এর গতির কাছে হেরে যায় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা। কদাচিত এক/দু’জন তার সাথে টক্কর দিতে পারে। তো মিশুক যে কোনো কারণে সেদিন নিজের পুরোটা দিতে পারছিল না। বিরতির সময় আনিসের তুই একদম হোপলেস হবি না। দেখিস; আমরা জিতবো। আমাদেরকে এই ম্যাচে, জিততেই হবে। একটু গা ঝাড়া দিয়ে ওঠ তো দোস্ত’-এই কথায় কাজ হয়েছিল। তারপর সেকেন্ড হাফ-এ দর্শক দেখলো ভিন্ন এক মিশুককে। ওই দুটো গোলের একটা তো সে দিয়েছিল তিনজন খেলোয়াড়কে পাস কাটিয়ে। চতুর্থজন এগিয়ে এসে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই বাঁ পায়ে সজোরে শট নিয়েছিল। নিখুঁত সেই কিক। বল বাঁকা হয়ে গোলবারের প্রায় গা ঘেঁষে ঢুকে গেছে জালের ভেতর। সে একটা দেখার মতো দৃশ্য। হ্যাঁ, এ মুহূর্তে আনিস ওই গোল হওয়ার মুহূর্তটাই দেখছিল।
পিন্টু দত্তের কী আনিস! তুমি বোধ হয় একটু আনমাইন্ডফুল হয়ে গেছে? তাকে এক মুহূর্তে বর্তমানের ভেতর নিক্ষেপ করে। একটু লজ্জা পায় সে। বলে, না স্যার, একটা দুর্দান্ত ম্যাচের কথা মনে পড়ে গেছিল।
আচ্ছা! পিন্টু বলেন, যে কথাটা তোমাদেরকে এখনো বলি নাই সেটা হচ্ছে, আমাদের টার্গেট এবার ফাইন্যাল খেলা।
ধীরেন বলে, আমরা এ বছর কাপ নেবো স্যার। চ্যাম্পিয়ন আমাদের হতেই হবে।
পিন্টু বলেন, ধীরে ধীরে; দ্যাখো, কাপটা নিতে হলে তো আমাদেরকে জিততে হবে। হারজিতের প্রশ্নটা তখনই যখন তুমি ফাইন্যালটা খেলতে পারবে; নাকি? বাদল, ঠিক স্যার। আগে তো আমাদেরকে ফাইন্যাল পর্যন্ত উঠতে হবে। সেমিফাইন্যালের ম্যাচ হবে কঠিন।
রঞ্জু তার সঙ্গে যোগ করে, কোয়ার্টার ফাইন্যালেও দু’একটা শক্ত প্রতিপক্ষের মুখে পড়ে যেতে পারি আমরা।
রঞ্জুর দূরদর্শিতামূলক কথায় খুশি হন পিন্টু দত্ত। স্মিত হেসে বলেন, হ্যাঁ; এটা তোমরা মাথায় রাখবে সব সময়। তবে একদম টেনশন করা যাবে না। আমাদের টিম শেষবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ১৯৭২ সালে। পরের চারটা টুর্নামেন্টের মধ্যে কেবল একবার ফাইন্যাল খেলেছি আমরা; জিততে পারিনি। দু’বার কোয়ার্টার ফাইন্যাল পর্যন্ত। আর একবার দ্বিতীয় পর্বে উঠেই বিদায় নিতে হয়েছে। তোমাদের এখানে জয়েন করার পর আমি এসব জেনে নিয়েছি। সবাই বলছে, আমাদের এবারের টিমটা অনেক স্ট্রং। আমারও তাই মনে হয়। এবার তো আমরা মিশুক, আনিস আর বাদলকে পাইছি। রঞ্জু, ধীরেন খায়েররা গতবার খেলেছে। এবারও আছে। এখনতো ওরা আগের তুলনায় ম্যাচিউরড। বাকি নয় জনের ভেতর থেকে আমরা ছয় জনকে বাছাই করে নেবো।
ধীরেন বলে, স্যার; একটা রিকোয়েস্ট করবো। বলে ফেলো।
আর তো মোটে কয়েকটা সপ্তাহ আছে। শেষের চার সপ্তাহে আমাদেরকে রোববারেও একটু সময় দেবেন স্যার। তাহলে আমরা মোট বিশ দিন প্র্যাকটিস করতে পারবো।
পিন্টু দত্ত বলেন, আমিও সেরকমই ভেবে রেখেছি। শুধু একটা শুক্রবার বাদ যাবে। আমি দু’দিনের জন্য বগুড়া যাবো। জরুরি কাজ। অসুবিধা নাই। প্ল্যান তো সব করাই আছে। তোমরা সেভাবেই কাজ করবে। পজিশন চেঞ্জ করে দ্রুত খেলায় ইনভলবড ব্যাপারটা মনে রাখবে। পুরো ৩৫ মিনিট আক্রমণাত্মক থাকতে হবে। ওকে?
রঞ্জু বলে, ওকে স্যার।
পিন্টু দত্ত বলেন, গুড। তারপর হাতের ঘড়ি দেখে বলেন, ও বাবা! সোয়া বারোটা বাজে! তোমাদেরকে এবার উঠতে হবে। আমি দেড়টায় বেরিয়ে যাবো, জরুরি কাজে। প্রস্তুতির ব্যাপার আছে।
মিশুকদের দল বেরিয়ে আসে পিন্টু স্যারের বাসা থেকে। প্রত্যেকের মাথায় বড় স্বপ্ন। প্রত্যেকের চোখ আকাক্সক্ষা উজ্জ্বল। উত্তেজনায় টগবগ করছে সকলেই।
ছয়.
মিশুকদের বাসা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস ও সংলগ্ন চত্বরের বাউন্ডারির ভেতর। এলাকাটা রাধাবল্লভের মধ্যে পড়েছে। এটা সরকারি কোয়ার্টারস। সামনে কংক্রিটের রাস্তা। তার একপাশে খেলার মাঠ। অন্য পাশটা খালি পড়ে আছে। পেছনে বিস্তীর্ণ জলাভূমি। বর্ষায় ওই জলাভূমি বিলের আকার ধারণ করে। মাছ ধরার ধুম পড়ে যায় তখন। কোয়ার্টারসের বাসিন্দারাই শুধু নয় আশপাশের মহল্লার লোকজনও মাছ ধরার জন্য নেমে পড়ে ওই জলাশয়ে সারা বছরই।
বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব হাঁটা পথে চার-পাঁচ মিনিটের। আবদুস সামাদ, মিশুকের বাবা, অতএব, সকালে নাশতা খেয়ে অফিসে যান। দেড়টার দিকে আসেন লাঞ্চ খেতে। লাঞ্চের পর চল্লিশ/পঞ্চাশ মিনিট পা টান-টান করে শুয়ে থাকেন। তারপর তিনটা বাজলে আবার রওয়ানা হন অফিসের দিকে। এটা প্রতিদিনের রুটিন। রোববার ছাড়া। রোববার তো সাপ্তাহিক ছুটি। তবে কোনো কোনো শুক্রবার আব্দুস সামাদ জুম্মা নামাজের পর সোজা বাসায় চলে আসেন। সেদিন আর অফিসে যান না।
আজ সোমবার। বরাবরের মতই আব্দুস সামাদ দুপুরে বাসায় এসেছেন, খাবার খেতে। রান্নাঘর সংলগ্ন বারান্দার এক কোণে বড় একটা টেবিল আছে। ওটাই ডাইনিং টেবিল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ওই টেবিলেই খেতে বসেছেন সামাদ। বেগুন দিয়ে খনাম মাছের ঝোল তার প্রিয় এক তরকারি। আজ তা-ই রেঁধেছেন মনোয়ারা খাতুন। মাছটা আজ বেশ সুস্বাদু হয়েছে। ভাতের গ্রাস মুখে তোলার আগে ঝোল দিয়ে মাখতে মাখতে সামাদ বলেন, আজ তো আমি আগে-আগেই বের হয়ে গেলাম। মিশুক সকালে পড়ছিলো তো ঠিক মতো?
পড়ছিলো, পড়ছিলো। নয়টা পর্যন্ত টেবিলে ছিল। তারপর গোসল খাওয়া সারি স্কুল গেল।
আব্দুস সামাদ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেন, এক বছর পরেই ম্যাট্রিকের টেস্ট একজাম। তারপরেই তো এস.এস.সি ফাইন্যাল। এই সময় ছেলেটা ফুটবল নিয়ে মাতি গেল! এইটের বার্ষিক পরীক্ষায় অঙ্কে খুব খারাপ করলো। বিজ্ঞানেও তেমন ভালো নম্বর পায় নাই!
অন্যমনস্ক মুডে ভাত চিবাতে থাকে সামাদ। মনোয়ারা বলেন, আর দুইটা মাছ দেই, একটু ঝোল?
দাও। ঝোল অল্প দিও।
মনোয়ারা খাতুন বড় দেখে আরও দুটো খলসে স্বামীর পাতে দেয়। সামাদ বলেন, বুঝছো; এখনতো মনে হচ্ছে ছেলেটা স্কুলের টিমে চান্স না পেলেই ভালো হতো।
মনোয়ারা অবুঝের মতো বলেন, ক্যান্; আপনে খুশি হন নাই?
খুশি হই নাই তা না। কিন্তু এসএসসি হইতেছে ছাত্র-জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় ভালো করতে না পারলে পরে তো সাফার করতে হবে। হায়ার এডুকেশনের জন্য ম্যাট্রিক আর ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট খুব ইম্পরট্যান্ট।
মনোয়ারা খাতুন অভয় দিয়ে বলেন, আমাদের ছেলে মাশাল্লাহ ছাত্র ভালো। দেখবেন ও ভালোই করবে রেজাল্ট। তাছাড়া আপনিই তো ওর খেলার কতো প্রশংসা করেন।
সে তো করিই। কিন্তু ওই যে! পাঁচটা বাজতে-না-বাজতেই ফুটবল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে! এক/দেড় ঘণ্টা বলের পেছনে দৌড়ালে সন্ধ্যায় পড়ার এনার্জি থাকে কারও, তুমিই কও?
মনোয়ারা আশ^স্ত করে স্বামীকে, থাক। আপনি এত চিন্তা কইরেন না তো। ও ফাইন্যাল পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করবে। ফুটবল খেলেও নাম করবে। আর একটু ভাত দেবো?
না না, থাক। আমার খাওয়া শেষ।
আব্দুস সামাদ প্লেটেই হাত ধুয়ে উঠে পড়েন। মনোয়ারা বারান্দায় টানানো রশি থেকে গামছা টেনে নিয়ে স্বামীর হাতে দেন। হাত-মুখ মুছতে মুছতে সামাদ বলেন, আজকে আধ ঘণ্টার বেশি রেস্ট নিতে পারবো না।
ক্যান্, কী হইছে?
আর বলো না! চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাব আসছেন রাজশাহী থেকে। অফিসে ম্যালা কাজ। কালও ব্যস্ততা থাকবে। বড় সাব পরশুর আগে ফিরে যাবেন না।
আব্দুস সামাদ বিছানার দিকে এগোন। মনোয়ারা ব্যবহৃত থালা-বাটি ধোয়ার কাজে লেগে যান। স্বামী অফিসে যাওয়ার পর তিনি খেতে বসবেন।
মিশুকদের বাসায় হকার আগে নিয়মিত দৈনিক বাংলা দিয়ে যেতো। ছেলেটা ক্লাস নাইনে ওঠার পর আব্দুস সামাদ বাংলা পত্রিকার জায়গায় ইংরেজি পত্রিকা রাখতে আরম্ভ করেছেন। ছেলের পড়াশোনার ব্যাপারে এ লোক খুব সিরিয়াস। মিশুক যাতে ইংরেজিটা বেশ ভালো রক্ত করতে পারে সেজন্য বাবা হিসাবে তার চেষ্টার শেষ নেই। দ্য ডেইলি অবজারভার কাগজটি তো সেজন্যই রাখা।
বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েই আব্দুস সামাদের মনে হয় পত্রিকাটায় একটু চোখ বুলাই। আশপাশে দেখতে না পেয়ে তিনি স্ত্রীকে ডাকেন, আছে তো। বাবুর টেবিলে বোধ হয়। আনি দেবো?
দাও। একটু দেখি।
মনোয়ারা পত্রিকার জন্য মিশুকের ঘরের দিকে এগায়। কিন্তু ছেলের পড়ার টেবিলের ওপর অবজারভার নেই। উনি তখন স্টাডি টেবিলের নিচের বাক্স থেকে কাগজটা বের করে এনে স্বামীর হাতে দেন। আব্দুস সামাদ পত্রিকার পাতা মেলে ধরতেই প্রথম পৃষ্ঠার নিচের দিকে তার চোখ আটকে যায়। দুর্ঘটনার ছবিসহ বড় বড় অক্ষরে খবর ছাপা হয়েছে। ইরম ৎড়ধফ সরংযধঢ় শব্দগুলো উনি একাধিকবার খেয়াল করেন। সরংযধঢ় শব্দটির প্রয়োগ তার ভালো লাগে। প্রতিবেদনটিও চমৎকার ইংরেজিতে পরিবেশিত হয়েছে। সামাদ মনে মনে ওই সাংবাদিককে ধন্যবাদ দেন, ধপপরফবহঃ এর বদলে সরংযধঢ় শব্দটি ব্যবহার করার জন্য।
সাত.
পিন্টু দত্ত বগুড়া থেকে ঘুরে এসেছেন। ছাত্রদেরকে দু’দিনের কথা বলেছিলেন। তৃতীয় দিনেই তিনি কর্মস্থলে প্রত্যাবর্তন করলেন। সমস্ত বিষয়েই এ ভদ্রলোক কথা আর কাজের মধ্যে মিল রাখেন। সেজন্য শুধু ছাত্ররাই নয়, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীরাও তাকে খুব পছন্দ করেন। ইতোমধ্যে হেডমাস্টার সাহেবেরও প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়েছেন তিনি। পিন্টু এখন বসে আছেন অ্যাসিসট্যান্ট হেড মাস্টার সাহেবের চেম্বারে। অবশ্য পিন্টু দত্তের যোগাযোগ হেড মাস্টারের চেয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টারের সঙ্গেই অনেক বেশি। কেননা শরীরচর্চা বিষয়ের প্রশাসনিক দিকটা তিনিই দেখভাল করেন। পিন্টু যখন তার চেম্বারে ঢোকেন তিনি কাজে ব্যস্ত ছিলেন। টেলিফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন। কথা বলতে বলতেই ইশারায় পিন্টু দত্তকে বসতে বলেছেন। তার পরেই রিসিভার রেখে দিয়ে স্কুলের প্যাডে তিন/চার মিনিট ধরে জরুরি কিছু একটা লিখতে হয়েছে তাকে। এবার চোখ তুলে পিন্টুর দিকে তাকালেন কী খবর বাবু? কখন ফিরলেন?
এই তো স্যার! গতকাল রাতে ফিরেছি।
প্রথম কিস্তির টাকা পেয়েছেন তো?
জি স্যার পেয়েছি। ওই টাকার বারো আনা খরচও হয়ে গেছে।
আবার একটা ফোনকল আসে। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার কথাবার্তা শেষ করে আবার পিন্টু দত্তের দিকে মনোসংযোগ করেন। পিন্টু বলেন, স্যার, বাকি টাকাটা দিন দশেকের মধ্যে না পেলে তো সমস্যা হয়ে যাবে।
আরে না, কোনও সমস্যা হবে না! আমি অ্যাকাউন্ট্যান্ট সাহেবকে বলে দিচ্ছি। নেক্সট উইকেই টাকা পয়ে যাবেন।
অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার দশ সেকেন্ড কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর বলেন, কিন্তু পিন্টু বাবু; টুর্নামেন্টের খরচ তো এবার বেড়ে যাবে মনে হচ্ছে!
পিন্টু দত্ত হেসে বলেন, কিছু করার নেই স্যার। সবকিছুরই দাম এখন আগের চেয়ে বেশি।
ঠিকই বলেছেন। আচ্ছা, আপনি এখন যান। আমি হেড স্যারের রুমে গিয়ে বসবো। জরুরি মিটিং আছে।
বিশাল টিচারস কমন রুমের পাশেই। পিন্টু দত্তের ডিপার্টমেন্ট। মাঝারি সাইজের একটা রুমে বল, নেট, হকি স্টিক, জাতীয় পতাকা, চুনের পাত্র, রঙের টিনসহ দুনিয়ার জিনিসপত্র। একপাশে স্টিলের আলমারি। অন্যপাশে কোনার দিকে বড় একটা টেবিল ও চেয়ার। এখানে বসেই পিন্টু কাজ করেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে উনি আর কোথাও যাননি। সোজা তার এই রুমে এসে ঢুকেছেন। খুব বেশি সময় নেই। দেখতে দেখতে ইন্টার স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট এসে যাবে। এখনও অনেক কাজ বাকি। পিন্টু দত্ত এখন এখানে লাঞ্চের আগ পর্যন্ত দু’ আড়াই ঘণ্টা কাজ করবেন। তারপর বাসায় যাবেন খাওয়ার জন্য। বাসা কাছেই। তারপর সোয়া তিনটা নাগাদ আবার স্কুলে আসবেন। থাকবেন স্কুলের শেষ ঘণ্টা না পড়া পর্যন্ত।
ঘণ্টাখানেক কাজ করার পর পিন্টুর মনে পড়ে মিশুক, রঞ্জু, ধীরেন ও খায়েরকে। মনে-মনে বলেন, আরে, আমি তো ভুলেই গেছিলাম! তারপর কলিংবেল টেপেন। কিছুক্ষণের ভেতর পিওন এসে সামনে দাঁড়ায়। পিন্টু দত্ত বলেন, সোহরাব মিয়া, তুমি একটু ক্লাস নাইনে যাবা। নাইন ‘এ’ গিয়ে মিশুক ও খায়ের নামে দুটো ছেলেকে বলবা কাল সেকেন্ড পিরিয়ডের পর আমার সাথে দেখা করতে। তারপর যাবা ক্লাস টেনে। টেন ‘বি’। ওখানে গিয়ে রঞ্জু ও ধীরেনকে বলবা কাল বারোটার আগে আমার সাথে দেখা করতে। নাইন ‘এ’ মিশুক ও খায়ের। টেন ‘বি’ রঞ্জু ও ধীরেন। মনে থাকবে তো? জি স্যার, মনে থাকবে।
পিওন সোহারাব যাওয়ার জন্য তিন/চার কদম এগিয়েছে। আর তক্ষুনি পিন্টু দত্তের মনে হয় ক্লাসরুম দুটো। স্টুডেন্ট চারজন। সোহরাব গুলিয়ে ফেলতে পারে। উনি পিওনকে থামান। বলেন, এক মিনিট দাঁড়াও। কাগজে লিখে দিচ্ছি। তাহলে আর ভুল হওয়ার চান্স থাকবে না।
ছাত্রদের নাম লেখা কাগজের ছোট টুকরোটি নিয়ে সোহরাব মিয়া স্কুলের প্রধান ভবনটির দিকে এগোয়।
আট.
খায়ের মিশুক রতন- এই তিন বন্ধুর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা সবচেয়ে বেশি। এরা কেবল একই মহল্লায় থাকে না, একই ক্লাসে পড়েও। মিশুক ও খায়ের তো ক্লাসমেট। রতন তা নয়। রতন পড়ে রংপুর হাইস্কুলে। ওর বাবা চাকরি করেন রংপুর ডিগ্রি কলেজে, ডেমোনেস্ট্রেটরের পদে। মানে ছাত্র/ছাত্রীদেরকে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করান। রতনরা তিন ভাই। বোন নেই। খায়েররা পাঁচ ভাই। আর মিশুকের আছে দুই ভাই এক বোন। তিন বন্ধুকে বেশির ভাগ সময় একসঙ্গে দেখা যায়। তারা একসঙ্গে খেলাধুলা করে, পুকুরে গোসল করে, বড়শি দিয়ে মাছ ধরে। তারা একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যায়; আড্ডা মারে। সালাদিয়া রেস্টুরেন্টে মিষ্টি-নিমকি খায়। আবার যদি মারামারি লেগেই যায় তাহলে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তারা একসঙ্গে লড়েও। সিনিয়রদের মধ্যে যারা রসিক হন তারা এই তিন বন্ধুর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ‘ত্রিরত্ন’ শব্দটি ব্যবহার করে প্রায়ই। এ বছরের শুরুতেই ‘ওরিয়েন্টাল’ হলে ‘ত্রিরত্ন’ নামে একটা মজার ও দুঃখের ছবি চলেছিল টানা তিন সপ্তাহ। এক টাকা বিশ পয়সা দিয়ে সেকেন্ড ক্লাসের টিকেট ছবিটা দেখেছিল তিন বন্ধু। রাধাবল্লভ ও আশপাশের অনেক মানুষই দেখেছে ওই সিনেমা। তারপর থেকেই, মিশুক খেয়াল করেছে, ওদের সম্বন্ধে ওই ‘ত্রিরত্ন শব্দটা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তিন/চার দিন ধরে ত্রিরতেœর এক রত্ন মানে রতনকে দেখা যাচ্ছে না। কারণ কী? কারণ সে নিলফামারী গেছে। ওটাই ওদের হোম ডিসট্রিক্ট। রতনের দাদাবাড়ি নানাবাড়ি সব ওখানেই।
মিশুক থাকে পাবলিক হেল্থ ইঞ্জিনিয়ারিং দফতরের আবাসিক এলাকায়, সরকারি কোয়ার্টারে। ওর বাবা ওই অফিসের অ্যাকাউন্ট্যান্ট। আবাসিক এলাকাটা রাধাবল্লভ মহল্লার ভেতরেই পড়েছে- এক প্রান্তে, একেবারে ঝিলের ধারে। রতনের বাসাও একই মহল্লায়, চাঁদমারির ওদিকটায়। খায়েরের বাসাটাই একদম সামনে। কাছারি বাজারের দিক থেকে রাধাবল্লভের দিকে তুমি যদি যাও খায়েরদের বাসাটাই আগে পড়বে। পাবলিক হেল্থ ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসগামী ইট বসানো রাস্তাটা ডানে রেখে সোজা বামে দু’/আড়াইশ গজ এগোলেই পাওয়া যায় রুমকি ভিলা- খায়েরদের বাড়ি। ভেতরে-যে এল আকৃতির বিরাট টিনশেড বিল্ডিং আছে, বড় উঠোন আছে, উঠোনের পাশেই ফুলের বাগান, ওই বাগানের এক পাশে খায়েরের আম্মা বেগুন, মরিচ আর পেঁয়াজের চারা লাগান, এসবের কিছুই বোঝা যায় না বাইরে থেকে। কেননা ওইসব কিছু আড়াল করে রেখেছে বৃহৎ এক চৌকোনা টিনের ঘর এবং আশপাশের গাছ-গাছালি। টিনের ঘরটায় দু’জন লজিং মাস্টার থাকেন। দু’জনের জন্য দুটো বিছানা, দুটো আলনা আর বাক্স ছাড়াও বড় সাইজের দুটো টেবিল ও সাত/আটটা চেয়ার আছে ঘরের মাঝখালে। সকালে ও সন্ধ্যায় ঘরটা ভরে যায়। খায়ের ও তার ভাইয়েরা দু’বেলা লজিং মাস্টারের কাছে পড়ে। স্কুল ছুটি থাকলে বিকেলেও এক/দেড় ঘণ্টা পড়ে।
খায়েরদের এত বড় বাড়ি, এতখানি জায়গা জুড়ে, এমনটা তুমি রংপুর শহরে খুব কম দেখতে পাবে। শোনা যায়, খায়েরের বাবা আবুল মোবারক পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে নোয়াখালী থেকে এ অঞ্চলে আসেন। রংপুর শহর তখন ঠিক শহর হয়ে ওঠেনি, বড়জোর একটা উন্নত গ্রাম ছিল। রাধাবল্লভের সবদিকে তখন জলা-জঙ্গল। আবুল মোবারক এ অঞ্চলে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য আরম্ভ করেন। তারপর বেশ কিছু টাকা সঞ্চিত হলে এক শুভাকাক্সক্ষীর পরামর্শে, বেশি ভাবনা-চিন্তা না করে, এই রাধাবল্লভে তেইশ শতক কৃষিজমি কিনে ফেলেন। হ্যাঁ, সে সময় শুধু এই প্লটটিই নয়, এর আশপাশের প্লটগুলোও ছিল কৃষিজমি। ওই জমিটা কেনার বছর দশেকের ভেতর অনেকগুলো বাড়ি উঠে ছিল আশপাশে। আবুল মোবারক তার সাধ্য অনুযায়ী প্রথমে দুই রুমের একটা ছোট টিনশেড ভবন তোলেন। খায়েরের সবচেয়ে বড় ভাই শাইক তখন তিন/চার বছরের শিশু। রংপুরে আসার তেরো/চৌদ্দ বছরের ভেতর আবুল মোবারকের কেবল বাড়িই হয় না, হোটেলের ব্যবসাটির উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটে। পরবর্তী দশ/বারো বছরে মোবারক হয়ে ওঠেন কাছারি বাজার এলাকার শীর্ষস্থানীয় চার/পাঁচ জন ব্যবসায়ীর একজন।
আবুল মোবারক সকালের নাশতা সাধারণত বাসায় খান। তারপর বেলা সোয়া ন’টা নাগাদ মুক্তা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট এর ক্যাশে গিয়ে বসেন। কর্মচারীরা তো চুলা জ¦ালায় সাড়ে ছ’টা বাজতে না বাজতেই। সকাল সাড়ে সাতটার আগেই বড় ছেলে শাইক দোকানে পৌঁছে যায়। ঘণ্টা দুয়েক কাটানোর পর বাবা আসা মাত্র সে বাসার উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়। তারপর ভাত খেয়ে কলেজে যায়। বছর চারেক ধরে এমনই চলছে। কাছারি বাজার থেকে রাধাবল্লভ রিকশায় করে যেতে সাত/আট মিনিট লাগে। আবুল মোবারক সেজন্য দুপুরে বাসায় বসে টিপু- তার দ্বিতীয় ছেলে। মোবারক দুপুরের খাওয়া শেষে ঘণ্টাখানেক বিছানায় গড়িয়ে বিকেল চারটার পর আবার দোকানে গিয়ে বসেন। রাত দশটা পর্যন্ত ওখানেই থাকেন।
আজ ব্যতিক্রম হয়েছে। পৌনে পাঁচটা বাজে। আবুল মোবারক এখনো বাসায়। শরীরটা বেশি ভালো না। জ¦র-জ¦র ভাব। সেজন্য ঝাল ভরা মাছভর্তা বেগুন ভাজা আর মুগ ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে বিছানায় সটান হয়েছেন। অনেকটা সময় এক কাত হয়ে শুয়ে থাকার পর মোবারক এবার চিত হন। বিকেলে যেহেতু দোকানে যেতে হয় সেজন্য দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই তার। আজ একটু ঘুমাতে চাইলেও ঘুম ধরা দেয় না। আবুল মোবারক চিত হয়ে শুয়ে শুয়েই সাত-পাঁচ ভাবেন। ফ্যানের পাখা তিনটি মনে মনে গোনেন। দেয়ালের এক কোনে ঘাপটি মেরে থাকা টিকটিকি লক্ষ করেন। সংসারের কথা মনে হয় তার। ছেলেদের মুখচ্ছবি একে একে তার মাথায় ভেসে ওঠে। তিন নম্বরে আবুল খায়েরের মুখটা আসে। এ মুখটা এসে তার মাথার ভেতর স্থির হয়ে থাকে। আর তৎক্ষণাৎ মোবারক স্ত্রীকে ডাকেন, শামসুন নাহার!
স্ত্রী সাড়া দেন, জ্বে। বলেন!
এদিকে আসো।
শামসুন নাহার ভেজা ডান হাত শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে স্বামীর দিকে এগিয়ে আসেন।
মোবারক কোনো ভূমিকা না করেই সরাসরি বলেন, খায়ের স্কুল থাকি ফেরে নাই?
জে। আইসছে। একটু আগে ভাত খাইলো। এখন মনে হয় ওর ঘরেই আছে।
শাসসুন নাহার স্বামীর অনুমতি চায়, ওকে ডাকবো? আবুল মোবারকের এক হাতের তালু তার মাথার নিচে। কী যেন চিন্তা করেন, তিন/চার সেকেন্ড। তারপর বলেন, না থাউক। রাইতে ওর সাথে কথা বইলবো আমি।
শামসুন নাহার একটু ভয় পান। স্বামীর এমন কণ্ঠস্বর আর মুখের অভিব্যক্তি তার অচেনা লাগে। ভয়ে ভয়ে বলেন, কী করছে খায়ের? কোনো প্রবলেম হইছে?
নিস্পৃহ গলায় আবুল মোবারক বলেন, আমার কোনো প্রবলেম হয় নাই। খায়ের নিজেই ওর প্রবলেম সৃষ্টি করতেছে। জানো, এবারও ইংরেজিতে ডাব্বা মারছে ছেলেটা!
শামসুন নাহার কিছুটা স্বস্তি পান। তিনি ভেবেছিলেন, আবার মহল্লায় মারামারি করেছে ছেলেরা। আর তাতে খায়েরও জড়িত। তবুও বার্ষিক পরীক্ষায় সে রেজাল্ট খারাপ করেছে এটা জেনে তার মনটা দমে যায়। বিহবল মনে মাথা নিচু করে তিনি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান।
আবুল মোবারক মুখে আর কিছু বলেন না। তবে মনে মনে অনেক কিছু বলে চলেন, অনেকক্ষণ পর্যন্ত। ছেলেরা ঠিকমতো পড়ালেখা করতেছে না। শাইক তো ভালো ছাত্র। কিন্তু সে অনুপাতে তার পরীক্ষার ফল তেমন ভালো না। যতো সমস্যা টিপু আর খায়েরকে নিয়া। বেশি সমস্যা খায়েরকে নিয়া। সেভেন থেকে এইটে ওঠার সময় ইংরেজিতে পাইছিল সাঁইত্রিশ। এবার আরও কম- চৌত্রিশ! এ চ্যাংড়ার ভবিষ্যৎ তো দেখতেছি ঝরঝরা! এসএসসির চৌকাঠ পার হইতে পারবো তো?
ম্যাট্রিক পাসের সার্টিফিকেট আছে মোবারকের। ছাত্র খারাপ ছিলেন না। নদী-ভাঙা গ্রামের মানুষ।
তাদের দশ আনা স্থাবর সম্পত্তি গ্রাস করে নেয়ার পর দিশাহারা অবস্থায় পড়ে তার বাবা। রংপুরে পাড়ি জমানোর অবস্থায় পড়ে তার বাবা। রংপুরে পাড়ি জমানোর বছর পাঁচেক আগে মোবারক ভর্তি হয়েছিলেন ক্লাস নাইনে বরিশাল শহরের একটা স্কুলে। লজিং থাকতেন এক নাম করা উকিলের বাড়িতে। এখন তার নিজের বাড়িতেই দু’জন লজিং মাস্টার। ব্যবসা জমে ওঠার পর থেকে মোবারক ছেলে পেলেদের পড়াশোনোর খোঁজ-খবর ভালো করে নিতে পারেন না। আর সব দিকে সমানভাবে চোখ রাখাও সম্ভব না। এইটের বার্ষিক পরীক্ষায় খায়ের ইংরেজিতে ফেল মারতে বসেছিল এটা ভেবে তিনি কেবল তার ছেলের ওপর নয় লজিং মাস্টারদের ওপরেও সমান অসন্তুষ্ট। তোমাদের কাজটা কী এখানে, শুনি? তোমরা খালি পড়াবা। বাচ্চারা তো ফাঁকি দিতে চাবেই। তোমরা যেভাবেই হোক ওদেরকে পড়তে বাধ্য করবা। পড়ালেখা ঠিকমতো হলে কারও রেজাল্ট এমন হয়? সারা বছর তোমাদেরকে ভালো-মন্দ খাওয়াই। হাত-খরচ দেই। উৎসবে পার্বণে জামা-কাপড়ও দেই! আর তার বিনিময়ে ছেলেদের এই রেজাল্ট? আবুল মোবারক সিদ্ধান্ত নেয়, আর বড় জোর ছ’মাস দেখবে। ক্লাস নাইনের হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় যদি উন্নতি না হয়, লজিং মাস্টারদেরকে বিদায় করে দেবে। দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নতুন শিক্ষক পেতে আশা করি অসুবিধা হবে না। মোবারক এও ভাবেন, এবার সামনা সামনি কথা বলতে হবে মাস্টারদের সাথে। অনেক ভদ্রতা দেখাইছি! আর ওরা তার সুযোগ নিছে। আর না। এবার ওদের মুখের ওপর কয়েকটা কড়া কথা বলতেই হবে!
আবুল মোবারক দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ রাখেন। পাঁচটা তেইশ মিনিট। তার রেস্টুরেন্ট ও সেখানে বসে থাকা টিপুর কথা মনে পড়ে। মনে-মনে বলেন, নাহ, উঠি এবার। চ্যাংড়াটা বোধ হয়, ক্যাশে বসি থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়্যা গেল।
নয়.
মিশুক, খায়ের ও রতন সম্বন্ধ ‘ত্রিরত্ন’ কথাটা চালু হয়েছে পরিচিত মহলে। রতনের জায়গায় যদি ফজলু থাকতো তাহলেও তা-ই বলতো লোকজন। ওই তিন বন্ধুর সঙ্গে ফজলুও কম ঘনিষ্ঠ নয়। কিন্তু যে কোনও কারণে হোক ওই তিনজনের সঙ্গে ফজলুকে দেয়া যায় কম। প্রধান কারণ ফজলু জেলা স্কুলের ছাত্র নয়। সে রংপুর হাই স্কুলে পড়ে। তাছাড়া পাশের মহল্লা মুন্সি পাড়ার সঙ্গে ওর যোগাযোগ বেশি। ক্লাস নাইনে ওঠার পর মুন্সিপাড়ার ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের হয়ে সে পাঁচ/ছটি ম্যাচ খেলেছে। চারটা ম্যাচে সে গোল দিতে পেরেছে। তার মধ্যে আবার ব্রাদার্স ইউনিয়ন তিনটা ম্যাচে জিততে পেরেছিল ফজলুর করা শেষ সময়ের গোলের জন্যই। ফজলু, অতএব, এই বয়সেই স্ট্রাইকার হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। এখন তো শহরের অন্য ফুটবল ক্লাবগুলোও অনূর্ধ্ব পনেরো বয়সী ছেলেদের টিমের জন্য ফজলুকে হায়ার করে নিচ্ছে। আর ফজলুও ভাড়াটে ফুটবলার হিসাবে খেলে চলেছে একটার পর একটা ম্যাচ। নিয়মিত পয়সা পাচ্ছে। কিন্তু যে দিনগুলোতে ম্যাচ থাকে সেসব দিনে একালে প্র্যাকটিস করতে হয়। তাতে অনেকটা সময় চলে যায়। সকালবেলা বড়জোর এক/দেড় ঘণ্টা পড়ার টেবিলে থাকতে পারে। আর বিকেলে ফুটবল খেলে আসার পর সন্ধ্যায় পড়ার এনার্জি থাকে না। বাবার বকুনি খাওয়ার ভয়ে ফজলু পড়ার টেবিলে বসে ঠিকই। কিন্তু খোলা বইয়ের পাতা তখন ফুটবল মাঠ। অক্ষরগুলোর দিকে নিরুপায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে নিজেকে দেখতে পায়, বল নিয়ে উড়ে চলেছে প্রতিপক্ষের গোল পোস্টের দিকে। একটু পরেই সমস্ত প্রতিরোধ তছনছ করে সে ঢুকে পড়বে ডি-বক্সের ভেতর। তারপর একটা মোক্ষম শট মারবে গোল পোস্টের জাল বরাবর। আর, হয়তো ঠিক তখনই ফজলুর আম্মা ছেলের পড়ার টেবিলে কাছে এসে দেখতে পায়, ছেলে তার বইয়ের ওপর মাথা রেখে রীতিমতো ঝিমাচ্ছে। তো এভাবেই প্রতি মাসে আট দশ দিন ফজলু পড়তে পারে না। স্টাডিতে বসে বটে। অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে পড়াটা তার হয়ে ওঠে না। শরীর খুব টায়ার্ড থাকার ফলে হোম টাস্ক-এর লেখালেখি কিংবা অঙ্ক কষাও হয় না। এক কথায় খেলার চাপে ফজলুর লেখাপড়া ইদানীং শিকেয় উঠেছে প্রায়।
ইন্টার স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের আর মাত্র সতেরো দিন বাকি। দিন পনেরোর মধ্যে প্রতিযোগী সবগুলো দলের তাঁবু পড়বে তিন নম্বর প্লে-গ্রাউন্ডে। খেলা হবে এক নম্বর ও দু’ নম্বর মাঠে। রংপুর জেলা স্কুল জেলার প্রধানতম স্কুল। তাছাড়া তিন তিনটা খেলার মাঠ আর কোনো স্কুলে নেই। সেজন্য এখানেই টুর্নামেন্ট হয়ে আসছে বেশ ক’বছর ধরে। হেড মাস্টার সাহেব খুব কড়া লোক। সব বিষয়েই তিনি ডিসিপ্লিন চান। আর চান, সব কিছু সময় মতো হোক; সুন্দর মতো হোক। খেলার মাঠ, অতিথিবর্গের বসার জায়গা, যন্ত্রপাতি, ফ্লাগ, কোচ, রেফারি, লাইনম্যানদের বিশ্রাম নেয়ার শেড এই সবকিছু যেন কমপক্ষে একদিন আগে রেডি থাকে। ম্যাচের দিন সকাল বেলা দেখা গেল, ফিল্ডের সীমানা নির্দেশক লাইনের কোনো কোনো জায়গায় ঠিকমতো চুন পড়েনি; ফলে একটু পরেই চুনের বালতি ও ব্রাশ হাতে দৌড়ে আসছে দু’টি ছেলে- এমন দৃশ্য তিনি দেখতে চান না।
ইতোমধ্যে মালপত্র আসা শুরু হয়ে গেছে। আজই দুপুরের পর অভি ডেকোরেটর-এর প্রথম কিস্তি মাল বোঝাই ট্রাক এসেছে। দু’দিন ধরে এসব আসবে। তারপর আরম্ভ হবে সাজানোর কাজ। চারদিকে উৎসবের চিহ্ন। বাতাসে আনন্দের ইশারা। এ সময়টায় খায়ের, মিশুক ও রতন জেলা স্কুলের মাঠে বিকেলবেলা আসবেই। আসে আরও অনেকেই। কোনো দিন হয়তো রতন আসে না, ধীরেন আসে। আবার দেখা গেল; একদিন ধীরেন আসেনি, এসেছে রঞ্জু ও খায়ের। আবার কোনো দিন এ পাঁচ খেলোয়াড় বন্ধুকেই একসঙ্গে দেখা যায়।
এ মুহূর্তে মিশুক ও রতন বসে আছে এক নম্বর প্লে-গ্রাউন্ডের এক কোণে। বটগাছের একটা প্রসারিত ডালের নিচে এক ছটাক বাদাম নিয়ে বসেছে ওরা। অদূরে মাঠের প্রায় মাঝখানে এবং স্কুলের মেইন গেটের কাছে কয়েকটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারা শলাপরামর্শ করছে। একটু পরে একটা সবুজ রঙের জিপ ক্যাম্পাসে ঢুকে দুই মাঠের মাঝখানের পাকা রাস্তা ধরে সোজা ভেতরে ঢুকে গেল। মিশুক খেয়াল করে দেখলো, গাড়িটা হেড স্যারের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আজ খায়েরের যোগ দেয়ার কথা এদের সঙ্গে। খায়ের সাড়ে চারটার দিকে বাসার কী একটা কাজে মেইন শহরে মানে জাহাজ কোম্পানির মোড়ে গেছে। এক ঘণ্টার ভেতর ফিরে আসার কথা। রতন ঘড়ি দ্যাখে। পাঁচটা বিশ। বলে, এক ঘণ্টা তো হয়্যা গেল প্রায়। ও বোধ হয় কাজে আটকে গেছে।
তা হইতে পারে। আমার মনে হয় ও আসবে ঠিকই। দশ/বিশ মিনিট দেরি হইতে পারে এই আর কি। কিছুক্ষণ আলাপহীন বাদাম চিবায় ওরা। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে রতন এখন বলে, ফজলুর খবর কী রে?
মিশুক উত্তর দেয়, ওর খবর তোরই ভালো জানার কথা। তোরা একই স্কুলে এক ক্লাসে পড়িস।
আমার সাথে স্কুলে দেখা হয় কম।
দেখা কম হয় কেন?
রতন উত্তর দেয়, তুই বোধ হয় ভুলি গেছিস। আমরা দুই জন দুই সেকশনে। আমি সায়েন্স গ্রুপে। ফজলু কমার্সে। তাছাড়া ও প্রায়ই টিফিনের পর স্কুলে থাকে না। বাসায় তো শুনি সন্ধ্যার আগে ফেরে না। আল্লাহ জানে কোথায় যায় ও!
খেলতে টেলতে যায় বোধ হয়। আট/নয়টা ফুটবল ক্লাব সারা শহরে। এসব টিমের অনেক প্লেয়ারই ভালো খেলে। তবে দোস্ত, ভালো খেলা আর জালে বল ঢোকানো এক জিনিস না। আসলে গোল করতে পারার মতো প্লেয়ার খুব কম আছে টিমগুলোয়।
আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে ফজলু, রতন বলে। কেন কাজে লাগাবে না বল্? যথেষ্ট ভালো ফুটবল খেলতে শিখছে ও। সবচেয়ে বড় কথা কি জানিস, ডি-বক্সের ভেতর ঢুকে পড়ার পর ও মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে। আর প্রতিপক্ষের প্লেয়ারদেরকে ফাঁকি দেওয়ার কায়দাও চমৎকার রপ্ত করছে ও।
রতন এবার বলে, আচ্ছা ফজলু-যে হায়ারে খেলে টাকা পয়সা কেমন পায়রে, তুই জানিস? মিশুক এ প্রশ্নের কী জবাব দেবে? সে তো নিজেই জানে না। তবু অনুমানের ওপর ভর করে বলে, আমি ঠিক বলতে পারবো না। তবে আমার মনে হয় এক একটা ম্যাচের জন্য ও পঁচিশ টাকার কম পায় না।
রতনের চোখ কপালে ওঠে; পঁচিশ টাকা!
তা তো হইতেই পারে। দুর্বল টিমগুলো জানে, ফজলুকে নিতে পারলে তাদের জেতার সম্ভাবনা ষাট পার্সেন্ট বেড়ে যায়।
রতন এখন বলে, তুই একটা জিনিস খেয়াল করছিস? মিশুক কৌতূহলী হয়, কী?
দুই সপ্তাহ বাদে টুর্নামেন্ট। অথচ ফজলু এদিকে আসেই না! মিশুক বলে, আসবে কেমন করে? ওর খেলা থাকে-না! নিঃশব্দে হাসে মিশুক। নিচু স্বরে বলে, আসবে আসবে। দেখিস, টুর্নামেন্ট আরম্ভ হওয়ার এক/দু’দিন আগে ও ঠিকই এদিকে মাথা ভাসাবে!
নরম মনের ছেলে রতন, কৌতুকপ্রিয় রতন, শুভাকাক্সক্ষী রতন এবার মন্তব্য করে, তুই যা-ই বলিস দোস্ত; এ সময় ফজলুর নানান টিমে খেলে বেড়ানো একদম ঠিক হচ্ছে না। রংপুর হাইস্কুল বড় টিমগুলোর একটা। ওর স্কুল নিশ্চয়ই ভালো কিছু আশা করে ওর কাছ থাকি। ফজলুর এখন দরকার কমপ্লিট রেস্ট। মাঝে-মাঝে এক ঘণ্টা প্র্যাকটিস করবে, ব্যস; আর কিছু না।
মিশুক রতনের কথা সমর্থন করলো, তাই তো হওয়া উচিত। অথচ দ্যাখ, ফজলু টাকার পেছনে ছুটছে, এই বয়সেই!
রতন আর কিছু বলে না। মিশুকের কথা শুনে নিঃশব্দে মাথা দোলায়।
দশ.
মিশুক ও ফজলু ভিন্ন ভিন্ন স্কুলের ছাত্র। তাদের আড্ডা দেবার জায়গাও এক নয়। তবু তারা বন্ধু। বেশ ভালো বন্ধু বলা চলে। মিশুক ক্লাসের সেকেন্ড বয়। ফজলুর রোল নম্বর ঊনত্রিশ। কিন্তু এটা তাদের বন্ধুত্বের পথে বাধা হয়নি। হ্যাঁ, দু’টি ক্ষেত্রে খুব মিল আছে দু’জনের। দু’ বন্ধুই অগ্রণী সংঘের সক্রিয় সদস্য। তারা এক সঙ্গে ফুটবল খেলে কালেক্টরেট মাঠে। আর দু’জনেই বাবা মার সঙ্গে পাবলিক হেল্থ ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসের আবাসিক এলাকায় থাকে। মিশুকের বাবা ওই দফতরের হিসাবরক্ষক। ফজলুর বাবা করেন টেকনিক্যাল বড় বড় মেশিনগুলো মাটির অনেক গভীর থেকে পানি তুলে আনে সেগুলো দেখাশোনা করা এবং ড্রাইভার ও মিস্ত্রিদের কাজের তদারকি করা তার দায়িত্ব।
মিশুকদের বাসা থেকে ফজলুদের বাসা তিনশ গজ দূরে। মিশুকরা থাকে তিন নম্বর রোডে। ফজলুদের বাসাটা পাঁচ নম্বর রোডের শেষ মাথায়। কংক্রিটের এ রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে একটা কাঁচা রাস্তা চলে গেছে মেইন শহরের দিকে। ফজলুর স্কুলে যাওয়ার ওটাই সহজ ও শর্টকাট রাস্তা। পাঁচ নম্বর রোডের শেষ মাথার দিকে যারা থাকে তারা প্রায় সকলেই ওই পথটা ব্যবহার করে। সেজন্য সকালের দিকে ফজলুকে মিশুকদের বাসার এলাকায় দেখা যায় না। তবে বিকেলে ফজলু যখন তার বাসা থেকে রাধাবল্লভ মোড়ের দিকে পা বাড়ায় তখন তাকে চার নম্বর রোড ধরেই এগোতে হয়। আর এ পথ ধরে হাঁটলেই তাকে মিশুকদের বাসার সামন দিয়ে যেতে আসতে হবে। অগ্রণী সংঘের প্র্যাকটিস ম্যাচ থাকলে সে পৌনে পাঁচটা নাগাদ মিশুকদের বাসার সামনে এসে তাকে ডাকবে দু’/তিন বার। হাতে সময় থাকলে কোনো কোনোদিন ভেতরে গিয়ে বসবে। তারপর চা-বিস্কুট খেয়ে দু’বন্ধু বেরোবে কালেক্টরেট ময়দানের উদ্দেশ্যে। খেলা না থাকলেও ফজলুকে কোনো কোনো বিকেলে মিশুকদের বাসার আশপাশে দেখা যায়। একই স্কুলে পড়বার সুবাদে খায়ের ও রতনের সঙ্গে মিশুকের ঘনিষ্ঠতা তুলনামূলক বেশি। তা হলেও ফজলুও তার যথেষ্ট ক্লোজ। সাত বছরের বেশি সময় ধরে এরা একই আবাসিক এলাকার বাসিন্দা। একই ফুটবল ক্লাবের সদস্য। একই ফ্রেন্ড সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত যার ভেতর রতন, খায়ের ছাড়াও আছে রঞ্জু, আনিস, ধীরেনরা।
ফজলুর বাবা আব্দুর রহমান মাটির মানুষ। মাটির দিকে চোখ রেখে তিনি রাস্তা হাঁটেন। কথা বলেন না, মানে খুব কম বলেন। ছেলে মেয়ের লেখাপড়া, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি বেশি উদ্বিগ্ন। চার ছেলে মেয়ে নিয়ে তার সাতজনের সংসার। ফজলুদের সঙ্গে তার ছোট মামাও থাকেন। মামাটা কারমাইকেল কলেজে পড়ে। বাসায় আত্মীয়-স্বজন লেগেই আছে। মেহমানরা ফজলুদের বাসায় এসে ওঠে ডাক্তার দেখাতে, চাকরির ইন্টারভিউ দিতে, কেনাকাটা করতে। এমনকি সন্ধ্যার শোতে সিনেমা দেখে রাত হয়ে যাওয়ায় তারা বাড়ি ফেরে না, বা ফিরতে পারে না। তখন এ বাসায় রাতটা কাটায়। স্বাভাবিকভাবেই রাতে তাদেরকে খাওয়াতে হয়। আবার সকাল বেলা নাশতা না খাইয়ে বিদায়ও দেয়া চলে না। তাছাড়া প্রত্যেক বছর দুই ঈদের আগে গ্রাম থেকে পাঁচ/সাত জন লোক আসবেই। তারা আসে সাহায্যের আশায়। এবং কম-বেশি তারা সেটা পায়। এই যাবতীয় কারণে আব্দুর রহমান বিরক্ত, অসন্তুষ্ট। বেতন তিনি ভালোই পান। পেলে হবে কী? সাত সাতটি মুখের তিন বেলার খাদ্য, বাচ্চাদের স্কুল ও প্রাইভেট টিচারের খরচ, ঔষধ-পত্র, কাপড়-চোপড়, যানবাহন খরচ সব মিলিয়ে অনেক টাকার মামলা। কোনো কোনো মাসের শেষ সপ্তাহে তাই, রহমানের পকেটে টান পড়ে। মাঝে-মধ্যে ধার কর্জও করতে হয়। ফজলু হাত খরচের টাকা ঠিকমতো পায় না। আর তার এ মন স্বভাব, যদি নিজের জন্য ব্যয় করে চার টাকা; বন্ধুদের পেছনে করে ছয় টাকা। তাছাড়া ওর তো চা, বিড়ি-তামাকের পয়সাও লাগে। ও, যে কথাটা বলা হয়নি! মিশুকের বন্ধুদের মধ্যে ফজলুই প্রথম বিদ্রোহী। ক্লাস এইটে থাকতেই, শেষ দিকে, সে সিগারেট খাওয়া শেখে। এখন তো প্রতিদিনিই খাচ্ছে। চার/পাঁচটা খায়। তার বেশি অবশ্য সম্ভব হয় না। উচ্ছন্নে যাওয়া বলতে যা বোঝায় ফজলুর ব্যাপারটা ঠিক সে রকম না। তবে তার জীবন যাপনের ধরনের মধ্যে বখে যাওয়ার একাধিক চিহ্ন ফুটে ওঠে ক্লাস নাইনে উঠতে না উঠতেই। ক্লাস সেভেনের ও এইটের পরপর দু’বছরের বার্ষিক পরীক্ষায় তার ফলাফল অনেক খারাপ। এ নিয়ে ফজলুর বাবার উদ্বেগের শেষ নেই। কিন্তু ছাত্র স্বয়ং নির্বিকার। হ্যাঁ, ফুটবলটা বাঁচিয়ে দিয়েছে ফজলুকে। কিছু পয়সা কড়িরও সংস্থান হয়েছে। না হলে এতদিনে লাফাঙ্গা হয়ে যেত ছেলেটা। মেশিন ঘরের কাজ-কর্ম তদারকির ফাঁকে আব্দুর রহমান ছেলের কথা চিন্তা করে। কই! আগে তো ও কখনো ফেল করে নাই! ফেল করার মতো গাব্বু মার্কা ছাত্র তো ও না! তাহলে…! দু’ বছর ধরে খুব খারাপ করছে ইংরেজি ও অঙ্কে। ফুটবল! ফুটবল! এই খেলাটাই ওর লেখাপড়ার শনি হয়্যা দাঁড়ালো। কিন্তু এ-ও তো মিথ্যা নয়, কিশোর ফুটবলার হিসাবে এক বছরের কম সময়ের ভেতর ফজলু যখন বেশ নাম করে ফেললো, শহরের নানান ক্লাব তাকে হায়ার করে নিতে শুরু করলো, আর ফজলুর হাতে আসতে লাগলো পয়সা তখন কি তিনি এ ব্যাপারে ছেলেকে প্রশ্রয় দেননি? ম্যাচ খেলে উপার্জন করা টাকা থেকে ফজলু বাবাকে কখনো একশ, কখনো পঞ্চাশ দিয়েছে। এরকম অন্তত চার/পাঁচবার দিয়েছে। আব্দুর রহমানের দু’চোখ কি সে মুহূর্তে আবেগে চিকচিক করে ওঠেনি? তার তো এও মনে হয়েছিল, পড়াশোনা ভালো হচ্ছে না। পড়ার দিকে মনোযোগই নেই ছেলেটার! এখন ফুটবল খেলে যদি ছেলেটা আরও নাম করতে পারে! ভবিষ্যতের কথা কে জানে? একদিন খালি রংপুরের না, বাংলাদেশের একজন ফেমাস খেলোয়াড় হয়েও যেতে পারে আমাদের ফজলু!
এগারো.
আর মাত্র এক সপ্তাহ পরেই ইন্টার স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট। রংপুর জেলা স্কুলের তিনটা মাঠই প্রায় রেডি। সাজ-সজ্জার কাজও বারো আনা হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা গাছের গোড়ায় চুন লাগানো হয়েছে। খানাখন্দ ও উঁচু-নিচু জায়গাগুলো মাটি দিয়ে সমান করা হয়েছে। স্কুলের মেইন গেট থেকে দুই মাঠের মাঝখান দিয়ে যে পাকা রাস্তাটা একদম ভেতরে চলে গেছে সেটার মেরামতও সম্পন্ন। পিচ ও মাঝখানে সাদা লাইন দেয়ায় একদম নতুনের মতো দেখাচ্ছে রাস্তাটা।
তিন নম্বর খেলার মাঠটা একটু ভেতরে, ব্যায়ামাগারের পেছনে। ওখানেই জড়ো হয়েছে রংপুর জেলা স্কুল টিমের এগারোজন খেলোয়াড়। আসলে তৈরি আছে পনেরোজন প্লেয়ার। মাঠে খেলবে এগারো জন। বাকি চারজন স্ট্যান্ডবাই। বলা তো যায় না, খেলার আগের দিন বা ওই দিনই সকালে কেউ অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। অথবা প্র্যাকটিস চলার সময়, এমনকি ম্যাচের সময় কেউ আঘাত পেয়ে খেলার অনুপযুক্ত হয়ে পড়তে পারে।
বেলা ঠিক পৌনে চারটায় পিন্টু দত্ত মাঠে এসেছেন। মিশুক, খায়ের, রঞ্জু, ধীরেন, আনিসরাও এসেছে যথাসময়ে। এক মিনিটও দেরি করেনি। কারণ পিন্টু বাবু খুবই সময় সচেতন। কেউ যদি দেরি করে ফেলে তাকে কড়াভাবে বকেন। ইতোমধ্যে মিনিট পঞ্চাশেক অনুশীলন হয়ে গেছে। কর্নার শর্ট, প্রিবলিং, খুব দ্রুত গতির পাস দেয়া বল এক মুহূর্তে থামিয়ে দেয়া প্রভৃতি তীক্ষè দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন পিন্টু।
কর্নার শটটা আনিস ভালো দিতে পারে। ধীরেনের কর্নার শটও মোটামুটি নিখুঁত। সেজন্য পিন্টু এর প্র্যাকটিস করাচ্ছেন এ দু’জনকে দিয়েই। এখন পঁচিশ মিনিটের বিরতি। ছেলেরা এখন হালকা কিছু খাবে। শরবত-টরবত খাবে। তারপর টানা এক ঘণ্টা আবার অনুশীলন। পরের এক ঘণ্টা অন্য বিষয়গুলোর পাশাপাশি গোলকিপার এবং যারা প্যানালটি শট মারবে (যদি দরকার পড়ে) তাদেরকে নিয়ে কাজ করবেন পিন্টু দত্ত।
আপাতত মাঠের মাঝখানে বসেছে সবাই। পিন্টু বাদাম চিবাচ্ছে। অনুশীলনের দিনগুলোতে পিন্টু বাবু তার স্পোর্টিং প্যান্টের ক্রস পকেটে কাঁচা বাদাম রাখেন। মাঝে মাঝে চিবান। ধীরেন বলে, স্যার; আমাদের প্রথম ম্যাচ তো দ্বিতীয় দিন, না?
হ্যাঁ, সেকেন্ড ডে তে।
আনিস জানতে চায়, প্রথম ম্যাচটা কি স্যার কৈলাশরঞ্জনের সাথে?
পিন্টু দত্ত বলেন, খুব সম্ভব কৈলাশরঞ্জন হাই স্কুলের সাথেই। ফিকশ্চারটা আমি এক নজর দেখেছি মাত্র। কাল ভালো করে দেখে তোমাদেরকে জানাবো। কোন কোন দিন কাদের সঙ্গে খেলা হবে, কখন হবে সব জানতে পারবে।
ধীরেন বলে, স্যার; একদিন আমরা পৌনে চারটায় চলে আসবো?
পিন্টু বলেন, অবশ্যই। আজকের দিনটা তো গেলেই। মাঝখানে আর চারটা দিন আছে। চারদিনই ভালোভাবে প্র্যাকটিস করতে হবে। একদিনও অ্যাবসেন্ট থাকা চলবে না। আরেকটা কথা, এ কদিন তোমরা রাত সাড়ে দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বা। উঠবা ভোরে। সবার আগে দরকার শরীরটা ফিট রাখা। না হলে কিন্তু সব গোলমাল হয়ে যাবে। ও কে?
জি স্যার। আমাদের জন্য আশীর্বাদ করবেন স্যার। সে আর বলতে হয় রে, পিন্টু বলেন, তোদেরকে আমি অলওয়েজ গুডউইশ করি।
রঞ্জু আমতা আমতা করে, স্যার একটা কথা বলবো?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
এবার মুলাটোল হাই স্কুল আর লালবাগ হাই স্কুল টিমে একজন করে নতুন প্লেয়ারের ডেবু হবে। পিন্টু বলেন, হবে; তো!
সবাই বলতেছে ওরা নাকি টিমে তুরুপের তাস!
শোনো, এসব উড়ো কথায় কান দিবা না। তুরুপের তাস আমাদেরও আছে। তোমাদের কাজ হচ্ছে এখন ভালো করে প্র্যাকটিস করা। তোমরা সেটাই করে যাও। অন্যদিকে মন দেয়ার প্রয়োজন নেই, কেমন?
ফাইন বিকেল। আকাশ খুব পরিষ্কার। কেরানিপাড়ার দিক থেকে তিন/চারটা পাখি বেশ উঁচু দিয়ে উড়ে এলো। মুলমুল করে হাওয়া বইছে। বিকেল ধীরে ধীরে সন্ধ্যার দিতে এগাচ্ছে। আনিস জিজ্ঞেস করে, সাব-ডিভিশন লেভেলের টিমগুলো সম্বন্ধে কিছু জানেন স্যার?
পিন্টু দত্ত বলেন, দ্যাখো; প্রত্যেক সাব ডিভিশন থেকে দুটো করে টিম আসবে। লোকাল টুর্নামেন্টে যারা ১ম ও ২য় কেবল তারাই এখানে কমপিট করার চান্স পাচ্ছে।
কাজেই কোনো দলকেই দুর্বল ভেবো না। মনে রেখো, সবাই যার যার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করবে। নিজেদের কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়াই এখন মূল বিষয়। আর আমরা যে এবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার টার্গেট করেছি, এই স্পিরিটাকেও আমাদেরকে ধরে রাখতে হবে। ঠিক আছে?
জি স্যার, বুঝতে পারছি।
পিন্টু দত্ত অনেক খোঁজ-খবর রাখেন। কেবল রংপুর সদরের নয়, মহুকুমা পর্যায়ের ভালো স্কুলগুলোর খেলাধুলার কি অবস্থা, ফুটবলে তাদের পজিশন কী এসবও তার মোটামুটি জানা। বামনডাঙা হাই স্কুল গাইবান্ধা পাইলট হাই স্কুলকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে লালমনিরহাট শহরের প্রধান স্কুলটি ৪-২ গোলে হেরে গেছে কালীগঞ্জ হাই স্কুল টিমের কাছে। এই অঘটনসমূহ অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। ওই ধরনের যে কোনো একটা টিম কোয়ার্টার ফাইনালে জেলাস্কুলের প্রতিপক্ষ হতেই পারে। আবার এটাও অসম্ভব নয় যে, রংপুর শহরের একটি স্কুলও সেমি ফাইনালে নেই। কুড়িগ্রাম রিভারভিউ স্কুল তো হুংকার দিয়েই রেখেছে, তারা সেমি-ফাইনাল খেলবে। পিন্টু এ খবরটা পড়েছেন স্থানীয় কাগজ দৈনিক দাবানল-এ। তিনি একবার ভাবলেন, এসব কথা ছেলেদের সঙ্গে শেয়ার করবেন। আবার পরের মুহূর্তেই চিন্তা করলেন, না থাক। এসব তথ্য ওদের মনে খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
ঘড়ি দ্যাখেন পিন্টু দত্ত। পাঁচটা সতের। বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ান তিনি। বলেন, ছেলেরা; উঠে পড়ো উঠে পড়ো। প্র্যাকটিসের সেকেন্ড রাউন্ড শুরু করবো এখনই।
বারো.
মিশুকদের বাসার দু’আড়াইশ গজ দূরেই কুকুটিয়া বিল। পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর এই আবাসিক এলাকা পুরোটাই কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সেই বেড়া কোথাও কোথাও ঝুলে পড়েছে দু’ একটা জায়গায় ফাঁক-ফোকর এতটাই বড় যে, ওদিক দিয়ে যে কেউ অনায়াসে যাতায়াত করতে পারবে। আসলে বিলে যাওয়ার জন্য বা বিলপাড়ের মেঠোপথ ধরে খটখটিয়াগামী পাকা রাস্তায় ওঠার জন্য শর্টকাট পথ হিসাবে এটাকেই ব্যবহার করছে লোকজন। বর্ষাকালে নদীর মতো দেখায় কুকুটিয়া বিলকে। ডিসেম্বরে আবার বিলের চেহারা ধারণ। অগুনতি ডোবা, পুকুর ও ক্যানালে ভরা এই জলাশয়। অশেষ মাছের ভাণ্ডার এই বিল। তুমি যদি নৌকা নিয়ে অগ্রসর হও, সিকি মাইল যাওয়ার পর দেখতে পাবে জলাশয়ের অবিশ^াস্য বৈভব। হাজার হাজার শাপলা, পদ্ম, কাউয়াঠুকরি আর ভ্যাট মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে পানির ওপর। তার ওপর লাল ফড়িং উড়ছে। এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে দিয়ে ঘুরছে-ছিটপোকা। তার ঘোরার গতিপথ ষড়ভুজের মতো। ও-ই দিকে তখন হয়তো হাঁটু পানি আর কাদা ভেঙে এগাচ্ছে এক পাখি শিকারি। তার কাঁধে দোনলা বন্দুক। দূরে ইটের ভাটার চোঙ দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। হালকা সাদা ধোঁয়া উঠছে ভুরভুর ভুর ভুর করে, এমনভাবে যে, মিশুকের মনে হয় ওই ধোঁয়া অনন্তকাল ধরে উঠতে থাকবে। নাইনে ওঠার অল্প ক’দিন পর এক ঝিম ধরা বিকেলে মিশুক দু’টি পদ্য লিখেছিলো ‘সকাল’ ও ‘কুকুটিয়া’ নামে। তার মানে ওই বিল ও আশপাশের পরিবেশ-প্রকৃতি মিশুকের কিশোর মনে বেশ ভালো ছাপ ফেলেছে। ক্লাস টেনে ওঠার পর তার পদ্য লেখার ইচ্ছা ও সামর্থ্য বেড়ে গিয়েছিল অনেকখানি। প্রথমে বিহ্বলতা কাজ করলেও বছর দেড়েক পর ওই আবেগ আর থাকেনি। অবশ্য ইতোমধ্যে ১৬-১৭ টা পদ্য লেখা হয়েছে। সেগুলো একটা সাদা রাফ খাতায় পড়েছিল ওভাবেই। মাঝে-মাঝে খাতাটা বের করে সেগুলো পড়তো মিশুক। ভালো লাগতো না। কেননা ততদিনে ‘দৈনিক বাংলা’য় ছাপা হওয়া নামী কবিদের অনেক কবিতা সে পড়ে ফেলেছে এবং নিজের লেখার তুচ্ছতা ধরতে পেরেছে। তার পরেও মিশুক তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, রতনের পীড়াপীড়িতে সে ‘সকাল’ নামের পদ্যটি শিবু বর্মনের হাতে দিয়ে আসে। শিবু বর্মন দৈনিক দাবানলের সাংবাদিক। ‘সাহিত্য’ অংশটি তিনিই দেখতেন। তারপর তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হলে মিশুক ও তার বন্ধুদেরকে অবাক করে দেয়ার জন্য লেখাটা ‘দাবানল’-এ ছাপা হয়। রতন করে-কি ওই পত্রিকার বিশটা কপি কিনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পরিচিত ছাত্রমহলে বিতরণ করে আর বলে বেড়ায় তার প্রতিভার কথা। প্রতিভা! ভেবে হাসি পায় মিশুকের। তার লজ্জাও পায়। কেননা দেশের নাম কার পত্রিকায় ছাপা হওয়ার মতো লেখা সে লিখতে পারেনি। আদৌ তা পারবে কিনা তা সে জানে না। বাবার কাছ থেকে সে শুনেছে, লেখালেখি- লেখক হওয়া এসব কঠিন সাধনার বিষয়।
আজ বুধবার। কী একটা উপলক্ষে স্কুল বন্ধ। অফিস আদালত খোলা। মিশুকের পড়ার ঘরের পেছন দিকটায় ঘন সবুজ ঘাসের ওপর মাদুর পেতে বসে পড়েছে। এটা পূর্ব দিক। সেজন্য সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়লে এখানটায় বিল্ডিংয়ের ছায়া পড়ে। শীতল একটা ভাব থাকে। উত্তর দিক থেকে বিলের হাওয়া আসে। সেই ঝির ঝির বাতাসে গা জুড়োয়। মিশুক, সুতরাং, গরমের দিন এলেই ওই জায়গায় মাদুর পাতে। ছুটির দিন হলে কখনো কখনো আব্দুস সামাদও সেই মাদুরে এসে বসেন।
আজও বিকেলে প্র্যাকটিস আছে। কিন্তু আজ পৌনে চারটায় নয়, গেমটিচার ওদেরকে ডেকেছেন সাড়ে চারটায়। পিন্টু দত্ত লাঞ্চের পর ঘণ্টা দু’য়েকের জন্য বেরুবেন মধ্যশহরের দিকে। যথাসময়ে মাঠে ফিরবেন। সেজন্য মিশুক রতনরা ঠিক করে রেখেছে, সোয়া চারটা নাগাদ বেরিয়ে পড়বে স্কুলমাঠের উদ্দেশ্যে। এখন তিনটা পাঁচ বাজে। হেঁটে গেলেও এখান থেকে ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে বারো/তেরো মিনিটের বেশি লাগে না। রতন ওয়াশরুমে ঢুকেছে। দক্ষিণ দিকে পিঠ আর বিলের দিকে মুখ রেখে বসে আছে মিশুক। বিলের খটখটিয়া প্রান্ত থেকে উড়ে আসছে কয়েকটা ঝিলপাখি। ছয়/সাতটা তো হবেই। পাখির দল এ প্রান্তের কাছাকাছি এসেই একসঙ্গে ঘুরে গেল। ঘুরে ওরা একসঙ্গে রওয়ানা দিলো চাঁদমারির দিকে। শেষ ভাদ্রের সুন্দর বিকেল। বিলের মাঝখান থেকে ভেজা-ভেজা বাতাস আসছে। রতন ওয়াশ রুমে ঢুকেছে দশ মিনিটের বেশি হলো। মিশুক ভাবে, এতক্ষণ লাগে প্রস্রাব করতে! নাকি প্রস্রাব করতে গিয়ে হাগু করতে বসে গেছে? এরকম তো হয় মানুষের! সে আরও ভাবে, আমাদের বেরুনোর সময় হতে হতে আম্মা জেগে উঠবে। আম্মা তো লঞ্চের পর ঘণ্টা দেড়েকের বেশি ঘুমান না। আর যদি ওই সময় না জাগেন, ডেকে উঠাতে হবে। দরজা খোলা রেখে তো আর বেরিয়ে যাওয়া যাবে না। বিলের দিকে মুখ রেখে বসে ছেলেটা এসব ভাবছিলো। পাণ্ডার দীঘির ওপাশে কয়েকটা গৃহস্থ বাড়ি পাশাপাশি। মনে হয় ওদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। তিনটা বড়-বড় খড়ের গম্বুজ আছে। গম্বুজগুলো এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। মিশুক ভাবে, অতো বড় খড়ের গম্বুজ! ওই বাড়িগুলোর বাহির-উঠোনও নিশ্চয় অনেক বড় হবে। পাণ্ডার দীঘির এ পাশটায়, বিলের বেশ কাছে, দুটো তালগাছ পাশাপাশি। একটা যথেষ্ট উঁচু। অন্যটার ঝাঁকড়া মাথা বড় তাল গাছটার বুক পর্যন্ত উঠেছে বড়জোর। মাছে ভরা এই কুকুটিয়া বিল। মানুষ বছর জুড়ে মাছ ধরে এখানে, ভরা বর্ষায় ঝাঁকি জাল ও বড়শি দিয়ে। আশি^ন মাসে মানুষ নেমে যায় বিলের মাঝখানে। ঝাঁকি জাল ছাড়াও নানান জিনিস দিয়ে মাছ ধরে তারা।
বিলের ওই পাড়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে ওই জোড়া তালগাছ আর খড়ের গম্বুজ তিনটি মিশুকের চোখে পড়বেই। সবার আগে সে দেখতে পায় তালগাছ। তার কারণ, ওই গাছ দু’টিতে পানিভূত থাকে। পানিভূত মাছ ভালোবাসে। ওরা মাছ খায় বলেই বিলের নিকটবর্তী উঁচু গাছে থাকে। গরমের মৌসুমে রাত আটটা/ন’টা পর্যন্ত মানুষ বিলে চরে বেড়ায় মাছ ধরার জন্য। তারপর চার পাশটা একদম নিঝুম হয়ে এলে ভূত পানিতে নামে। তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দৌড়ে যায়। অনেকদূর পর্যন্ত দৌড়ে যায় ওই ভূতের আগুন। মিশুকদের রাতের খাবার খেতে খেতে সাড়ে ন’টা/পৌনে দশটা বেজে যায়। তখন ভূতদের বিল জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানোর সময়। ডিনার শেষে মিশুক ওদের বাসা সংলগ্ন রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। কোনো কোনো দিন ফজলুও আসে হাঁটতে হাঁটতে। ওদের বাসার পেছনে কয়েকটা ভবন আছে। সেজন্য ওখান থেকে বিলের ছবি ভালো করে দেখা যায় না। ভূতের কর্মকাণ্ড দেখার জন্য মিশুকদের বাসার পাশের রাস্তাটাই সবচেয়ে ভালো জায়গা। তো দু’বন্ধু মিলে ভূতের আগুন ওই কেরিকেচার দেখেছে অনেক দিন। ভূত, মানে ভূতের আগুন তো রাত ছাড়া দৃষ্টিগোচর হয় না। এখন বিকেল। কিন্তু বিলপাড়ের বড় তালগাছটার দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিঝুম এই বিকেলেই মিশুক দেখতে পেলো, ভূতের আগুনের গোলা বড় তালগাছের মাথা থেকে নেমে এসেছে ঝিলের আধাপচা পানিতে। কয়েক সেকেন্ড পরেই একটা গোলা থেকে তৈরি হলো চারটা আগুনের গোলা। তাদের একটা পানির ওপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে উঠলো ছোট তাল গাছটার চূড়ায়। বাকি তিনটা ছড়িয়ে পড়লো তিন দিকে। মিশুক এখন দেখতে পাচ্ছে, বিশ/পঁচিশ সেকেন্ড পর ওই তিনটি আগুনের গোলা আবার এগিয়ে এলো বিলের এক দিকে। তারপর তিন আগুনের গোলা একত্র হয়ে পরিণত হলো একটি গোলায়। কিছু সময় পর ছোট তালগাছের মাথায় গিয়ে বসেছিল যে ভূতটি সে নেমে এলো জলাভূমিতে। জলাভূমিতে নামার পর ওই একটি গোলা থেকে জন্ম নিলো আরও দুটি আগুনের গেলো। তারা অনেক দূর পর্যন্ত দৌড়ে গেল। তারপর স্থির হলো। একসময় আগুনের গোলা দু’টি পাশাপাশি অবস্থান নিলো। ওইভাবে অনেকটা সময় পার করার পর তারা আগুনের একটি গোলায় পরিণত হলো। মিশুক দেখতে পাচ্ছে, গোলাটি খুব উজ্জ্বল থেকে ছোট হতে হতে এক পর্যায়ে প্রায় বিন্দুর আকার নিয়েছে। তার কয়েক মুহূর্ত পরেই ভল ভল করে জ¦লে উঠলো ভূতের আগুন।
এরকম দৃশ্য কেবল মিশুক নয় ফজলুও দেখেছে অনেকবার। না, তারা ভয় পায়নি কেননা জলাভূমির ওই পানিভূতের এলাকা থেকে অনকেটা দূরে তাদের অবস্থান। দুই বন্ধু উপভোগ করেছে ওই দৃশ্য, এখনও করে মাঝে মাঝে। কিন্তু ওই অগ্নিদৃশ্যের রহস্যের কোনো কিনারা করতে পারেনি তারা।
তেরো.
ফজলুর আব্বা পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরের পাম্প মেশিন ড্রাইভারদের সর্দার, সোজা কথায় সুপার ভাইজার। তিনি বেতন-যে কম পান তা নয়। সমস্যা হচ্ছে, তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাত। ফজলুরা চার ভাই-বোন, বাবা-মা আর একজন মামা। মামাটা রংপুর ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে পড়ে। বছর খানেক ধরে ফজলুদের পরিবারে আছে। এখন ফ্যামিলি মেম্বারই হয়ে গেছে বলা চলে। দু’বছর আগেও সংসারের খরচ খুব বেশি ছিল না। গত দেড় বছরে জিনিস-পত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। পরিবারের কর্তাকে তাই হিমশিম খেতে হচ্ছে। মাসের চব্বিশ/পঁচিশ তারিখের পর পরবর্তী মাসের বেতন না হওয়া পর্যন্ত সাত/আট দিন বেশ টানাটানি যায়। কয়েক মাস ধরে এমনই চলছে। এ অবস্থায় কিছুটা স্বস্তির ফজলুর বাবা গ্রামের বাড়ি থেকে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, সরিষা আনছেন যতটা সম্ভব।
তো এই যখন পরিস্থিতি তখন অতিরিক্ত খরচ করা বিলাসিতা বৈ কি। আগে ফজলুর মা-বোন প্রতি মাসে একবার সিনেমা দেখতো। গত চার মাসে তারা মাত্র একবার সিনেমা হলে গেছে। ‘রঙবাজ’ ছবিটার সুনাম মুখে মুখে এতদূর ছড়িয়ে গিয়েছিল যে, ওটা না দেখে তারা থাকতে পারেনি। পয়সা অবশ্য ফজলুর আব্বা দেয়নি, দিয়েছিল ফজলু। সেকেন্ড ক্লাসের টিকেটের দাম এক টাকা বিশ পয়সা। দুটি টিকেটের দাম দু’টাকা চল্লিশ পয়সা। রিকশা ভাড়া আপ-ডাউন বারো আনা। দু’আনার বাদাম বা অন্য কিছু। ফজলু দিয়েছিল মোট তিন টাকা আট আনা। ফজলু এখনো স্কুলের ছাত্র। সে টাকা দিলো কিভাবে? ছ’মাস ধরে সে হায়ারে ফুটবল খেলে বেড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে পাঁচটা ক্লাবের হয়ে সে ত্রিশ/বত্রিশটা ম্যাচ খেলেছে। সেখান থেকে আটশ টাকার মতো কামিয়েছে। তিন শ টাকা দিয়েছে বাবার হাতে। মাকে দিয়েছে একশ। ফজলুর পুরনো বুট জোড়া ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এক জোড়া নতুন বুট না হলেই নয়। রংপুর জেলা স্কুল সরকারি প্রতিষ্ঠান। ইন্টার স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট উপলক্ষে প্রতিষ্ঠানটি পনেরো জোড়া বুট কেনে প্রতি বছর। এবারও কিনেছে। সেই জুতা ইতোমধ্যে খেলোয়াড়বৃন্দ পেয়েও গেছে। গত পরশু ফজলু মিশুকদের বাসায় গিয়ে তার বুটজোড়া দেখে এসেছে। নাম কোম্পানির জুতা। দেখতেও অতি চমৎকার। মুহূর্তের জন্য ফজলুর মন খারাপ হয়েছে এটা ভেবে, জেলা স্কুলের ছাত্র হলে আজ সেও স্কুল থেকে বুট পেতো। রংপুর হাই স্কুল বেসরকারি স্কুল। এ প্রতিষ্ঠান খেলোয়াড়দেরকে বুট উপহার দেয় না। খেলোয়াড় ছাত্রদেরকে জুতা কিনতে হয় নিজেদের টাকায়।
অনেকদিন ধরেই ফজলু এক জোড়া বুট কেনার কথা বলে আসছিলো। বাবার সঙ্গে ছেলেটার কথা হয় কম যেমনটা আরও অনেক ছেলের বেলায়ই ঘটে। ফজলু সুতরাং আবদার জানিয়েছিল মায়ের কাছে। এবং ফজলুর আম্মা বিষয়টা দু-তিনবার স্মামীকে বলেওছিলেন। এটা পরিষ্কার, বুট কেনার বিষয়টি তিনি হালকাভাবে নেননি। উদ্বৃত্ত টাকা না থাকার কারণে কিনি কিনি করেও বুট জোড়া কেনা হয়নি আজও। এ নিয়ে ফজলুর মনে অসন্তোষ। আজ বিকেলে তার আম্মা ইন্টার স্কুল ফুটবলের প্রসঙ্গ তোলায় ফজলু সুযোগ বুঝে কথাটা আবার পাড়ে। সে তার আম্মাকে বলে, দুই তারিখ থেকে খেলা। আমাদের ম্যাচ আছে চার তারিখ। দুই/তিন দিন আগে বুট না কিনতে পারলে ওই জুতা পরে খেলতে পারবো না মা। একদম নতুন বুটে ইজি ফিল করা যায় না! ফজলুর আম্মা বলেন, তা আমি কী করবো?
ফজলু যুক্তি দেয়, খুব বেশি তো দাম- না মা! মাঝারি মানের এক জোড়া বুটই না হয় কিনে দাও।
ফজলুর আম্মা বলেন, আমি কিনি দেবো কোথা থাকি?
আমি চাকরি করি? আমার ইনকাম আছে?
ফজলু বলে, ইনকাম নাই ঠিক আছে। কিন্তু আব্বা তো সংসারের খরচের টাকা তোমার হাতেই দেয়। নিজের কাছে রাখে শুধু হাত-খরচের পয়সা।
তুই তো বলেই খালাস! সংসারে কতো খরচ হয় মাসে কোনো আইডিয়া আছে তোর?
মহিলা আর কিছু বলেন না। মুখ গোমরা করে বিছানার ওপর বসে থাকেন। ছেলেটা তার ফুটবল পাগল। তাছাড়া ফুটবল খেলে সে ইদানীং পরিবারকে হেল্প করছে সাধ্যমতো। তার খারাপ লাগে। কিন্তু তিনি কী করতে পারেন? কর্তা পয়সার হিসাব রাখেন কড়ায়-গণ্ডায়। তার অনুমতি ছাড়া তো কিছু করা সম্ভব না তার পক্ষে। সংসারে ঝগড়া-বিবাদ একদম পছন্দ নয় তাঁর।
ফজলু তার আম্মাকে মলিন মুখে অনেকক্ষণ চুপ থাকতে দেখে বলে, প্লিজ মা! কিছু একটা করো। বুট না হলে এবার আমি খেলতেই পারবো না। আমার জুতা জোড়ার যে অবস্থা ওগুলো দিয়ে টুর্নামেন্ট পাড়ি দেওয়া সম্ভব না।
মহিলা খালি শুনেই যান। কিছু বলেন না। বলার মতো অবস্থাও নেই তার। কিন্তু কিশোর পুত্রের আকুতি তাকে ঠিকই মর্মাহত করে।
ফজলু আবার অনুরোধ জানায়, প্লিজ মা! আপাতত একটা ব্যবস্থা করো। না-হয় জুতা কেনার টাকাটা আমাকে ধার হিসাবেই দাও! টুর্নামেন্ট শেষ হলে কিছু পয়সা কড়ি পাবো। তখন ফেরত দিয়া দেবো।
ফজলুর আম্মা এবার রেগে যান, আমার কাছে কী? আমার কাছে কী? ঘ্যান ঘ্যান করবি না! তোর বাপকে বলতে পারিস না?
আব্বা তো রাগ হয়্যা যায়! সেইজন্য তো উনাক কিছু বলি না। কোনো কিছু দরকার হলে তোমাক বলি।
ফজলুর আম্মা বলেন, বেশ! অ্যালা চুপ থাক! ভাইগ্যে থাইকলে খেলার জুতা পাবি।
ফজলু আম্মার সামনে থেকে সরে গেল। তার ভাইগ্যে থাইকলে কথাটা কাঁটার মতো বিঁধছে তাকে। ফজলুর চোখে পানি এসে গেছে। মেঝের দিকে মাথা নিচু করে রেখে বসে আছে ছেলেটা। এবার বোধ হয় আমি খেলতেই পারবো না, এক জোড়া বুটের অভাবে। কেউ বুট ধার দিলে হয়তো খেলা সম্ভব হবে। কিন্তু তার বিনিময়ে সে টাকা চাইবে। তাইলে আর কী লাভ হইলো! দুঃখে-রাগে ফজলু নিজের মাথার কয়েকটা চুল ছিঁড়ে ফেলে। তারপর দ্রুত বেরিয়ে যায় বাসা থেকে।
চৌদ্দ.
আজ রোববার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। ছুটির দিন ঘরে-বাইরে সবখানে একটা ফুরফুরে ভাব থাকে। মাথা হালকা-হালকা লাগে। মিশুকের বাবা আব্দুস সামাদ বলেন, লেট রাইজাররা জীবনে উন্নতি করতে পারে না। উন্নতি বলতে তিনি কেবল টাকা-পয়সায় বড় হওয়া নয়, বিদ্যা-বুদ্ধিতেও সুনাম অর্জন করা বুঝান। সেজন্য তার পরিবারে নিয়ম কড়া- সকাল সকাল উঠতে হবে। সবাই তা করেও। ছেলেমেয়েরা ছয়টা সোয়া ছয়টার ভেতর পড়ার টেবিলে বসে যায়। সকাল নয়টার আগেই নাশতা পর্ব শেষ। কেবল ছুটির দিনগুলো ব্যতিক্রম। তাই বলে সাতটা পর্যন্ত কেউ ঘুমায় না। ছুটির দিনে পড়তে বসার সময় সকাল সাতটা। নাশতা ন’টা থেকে সাড়ে ন’টার ভেতর। সাতটা বাজতে চললো অথচ কেউ তখনও ঘুমিয়ে এরকম দেখলে মিশুকের মা মনোয়ারা খাতুন বলবেন, কোন্ জাগার মানুষ কুতি চলি গেল, তোমরা অ্যালাও ঘুম পাড়বার নাগছেন!… তারপর এই ওঠ ওঠ… ওঠ! বলতে বলতে ধার্কা দিয়ে তুলবেন লিলিকে অথবা বাবুকে। বাবু তো সবার ছোট ন’বছর বয়স। সেজন্য ওকে বেশি চাপ দিতেন না মনোয়ারা খাতুন। উঠতে না চাইলে মনে মনে বলতেন, থাক। ছোট মানুষ। আর একটু ঘুমাক। বছর ছয়েক ধরে এমনটাই দেখে আসছে মিশুক।
অন্যদিনগুলোতে তো সাড়ে ন’টা বাজলে স্কুলের উদ্দেশ্যে ছুটতে হয়। সকাল দশটায় বসে ক্লাস। একটা বিশ থেকে দুইটা পর্যন্ত টিফিন আওয়ার। তারপর আবার বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত টানা ক্লাস। ক্লাস করতে করতেই তো দিন প্রায় শেষ। বন্ধুদের সঙ্গে গুলতানি মারার সময় কোথায়? মিশুক যেটুকু সময় পায় সেটা ওই শুক্রবার। সপ্তাহের এ দিনটায় নাশতা খাওয়ার পর দু’আড়াই ঘণ্টা সে বন্ধুদের সঙ্গে কাটায়। অন্য সময় হলে মিশুক সন্ধ্যার আগে ঘণ্টা দুই আভায় থাকতে পারতো। বেশ কিছুদিন যাবৎ সেটাও বন্ধ। কারণ ওই যে, সামনে ইন্টার স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট। মিশুককে তার ঘনিষ্ঠ তিন বন্ধুসহ সাড়ে চারটার মধ্যে মাঠে হাজির থাকতে হচ্ছে। পিন্টু দত্ত টিমের ছেলেদেরকে প্রতিদিন এক দেড় ঘণ্টা প্র্যাকটিস করাচ্ছেন। আর এখন তো টুর্নামেন্ট দরজায় কড়া নাড়ছে। সময় নষ্ট করার মতো সময় এখন একদমই নেই। রশিদ চৌধুরীর বড় দিঘির পাড়ে লিচু গাছ তলায় বেেসছে চার বন্ধু খায়ের, ফজলু, মিশুক ও রতন। এ মুহূর্তে আছে তিন জন। কেননা একটু আগে রতন শিঙ্গাড়া আনতে গেছে সালাদিয়া রেস্টুরেন্টে। ‘সালাদিয়া’র শিঙ্গাড়া খুব স্বাদু। সকাল সাড়ে দশটা/এগারটার দিকে ওই শিঙ্গাড়ার জন্য লাইন পড়ে যায়। দেরি করলে অনেকেই পায় না, এত ডিম্যান্ড।
রতন ফিরে আসে। হাতে একটা বড় ঠোঙায় আট পিস গরম শিঙ্গাড়া। বন্ধুদের মাঝখানে বসেই সে ঠোঙাটা বাড়িয়ে দেয়। শিঙ্গাড়ার সঙ্গে সালাদও দিয়েছে মইন আলী।
রতন বলে, একদম গরম শিঙ্গাড়া। কড়াই থেকে নামানোর সাথে সাথে নিছি।
ফজলু প্রথমে দুই পিস তুলে নেয়। শিঙ্গাড়ায় প্রথম কামড় বসানোর সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট সরিয়ে ফ্যালে। খায়ের বলে, আস্তে খা ব্যাটা। মুখ পুড়ায়া ফেলবি তো!
চার বন্ধু তৃপ্তির সঙ্গে শিঙ্গাড়া খায়। তারপর রাস্তার পাশের টিউবওয়েল থেকে পানি খেয়ে আসে। ওরা আবার লিচু তলায় গোল হয়ে বসে। মিশুক ঘড়ি দ্যাখে, এগারটা ষোলো। মনে মনে বলে, বারোটা বাজলে উঠতে হবে। দেরি হলে আব্বা বকে।
পনেরো.
যারা উৎসবপ্রিয়, আর যারা নাটক-থিয়েটার ভালোবাসে তারা সবাই রংপুর শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলোর খবর রাখে। শহরে উৎসব লেগে আছে প্রায় সারা বছরই। জানুয়ারি মাসে বসে আনন্দ মেলা। আর্মি আয়োজিত এমেলা চলে পনেরো দিন। আনন্দমেলা হয় কালেক্টরেট সাধে। দশ থেকে একুশ ফেব্রুয়ারি বইমেলা বইমেলা বসে পাবলিক লাইব্রেরির সামনের চত্বরে। এপ্রিলে বৈশাখী মেলা। এ মেলাটাও হয় ওই কালেক্টরেট ময়দানে। মের মাঝামাঝি দু’ সপ্তাহ ধরে চলে ইন্টার সাবডিভিশন ফুটবল টুর্নামেন্ট। প্রত্যেকদিন বিকেলে দর্শকের ঢল নামে রংপুর কলেজের খেলার মাঠে। আগস্টের শেষ দিকে সপ্তাহ জুড়ে চলে ভ্যারাইটি শো। এটা হচ্ছে গান-বাজনা আর নাচের অনুষ্ঠান। ‘টাউন’ হলের ভ্যারাইটি শো মানুষ দ্যাখে টিকেট কেটে। অক্টোবর মাসে শহরে আসে সার্কাস। সার্কাসের তাঁবু পড়ে শহরের মাঝখানে-ঠিকাদার পাড়ায়, যাতে সব প্রাপ্ত থেকে মানুষজনের আসতে সুবিধা হয়। নভেম্বরে নাট্য উৎসব। বিভাগীয় এ উৎসবটাতে রাজশাহী ডিভিশনের সবগুলো জেলা থেকে নাটকের দল আসে। দশ/বারো দিন ধরে দেখানো হয় নাটক। নাটক দেখতে হয় টিকেট কেটে। ডিসেম্বর মাসে জমে ঘুড়ি উৎসব। ঘুড়ি উড়ানোর জন্য যদিও বড় মাঠই বেশি উপযুক্ত, তবু সেটা হয় কাছারিবাজার পুকুরপাড়ের অপরিসর মাঠটাতে। অবশ্য সুতা টেনে নিয়ে গিয়ে ঘুড়ি আকাশে উঠানোর জন্য যতখানি জায়গা দরকার হয় তা ওখানে আছে। তারপর ঘুড়ি ওপরে উঠে গেলে আর সমস্যা নেই। এ উৎসবেও শত শত মানুষ আসে। কিশোর ও যুবকদের সংখ্যাই বেশি। দর্শকে গিজ গিজ করে পুকুর পাড়।
মিশুকের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা সবাই কমবেশি ঘুড়ি উড়ায়। সেজন্য ফুটবল সবচেয়ে প্রিয় হলেও ঘুড়িটাও কম ভালোবাসেনা এ ছেলেরা। ধীরেন তো চার বছর বয়স থেকে ঘুড়ি উড়াচ্ছে। কাছারি বাজারের ঘুড়িউৎসবে সে ঘুড়ি-লাটাইসহ যোগ দিচ্ছে ক্লাস সিক্সে ওঠার পর থেকে। এইটে থাকার সময় প্রতিযোগে ফার্স্ট হয়েছিল। ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড নির্ধারণ হয় সুতা কেটে দিয়ে কে কতটা ঘুড়ি নিচে নামাতে পারবে তার ওপর। দেড় ঘণ্টা ধরে চলে এ কাটাকাটি। ঘুড়ি কাটাকাটি খেলায় ধীরেন পটু তার কারণ সুতায় মাঞ্জা লাগাতে সে ওস্তাদ। কাচের মিহি গুড়ার সঙ্গে আঠা মিশিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো সুতায় লাগানো হয় এবং রোদে শুকিয়ে গেলে ওই সুতা লাটাইয়ে প্যাঁচিয়ে রাখা যায়। একেই বলে মাঞ্জা লাগানো।
রংপুরের ঘুড়ি উৎসব তিন দিন ধরে চলে। ছুটির দিন বলে রোববার আরম্ভ হয় যাতে চাকরিজীবীরাও এ মেলায় আসতে পারে। এবারও শুরু হবে রোববার। দ্বিতীয় দিন মানে সোমবার। তৃতীয় দিনটি থাকবে ছোটদের জন্য যাদের বয়স নয় থেকে বারো। এ বছরেও ধীরেন প্রতিযোগে নাম দেবে। এবারও প্রতি বছরের মতো তার সঙ্গী হবে রতন, খায়ের মিশুক ফজলু, আনিসরা। আনিস থাকে কটকিপাড়ার একদম শেষ মাথায়। অনেকটা রাস্তা। তারপরেও ও হাঁটতে হাঁটতে ঠিকই চলে আসবে। পারলে ওদের মহল্লার দু’চারটি ছেলেকে সাথে নেবে।
ঘুড়ি উৎসবের এখনো দু’মাস বাকি। কিন্তু ধীরেনের মাথায় এখনই ঘুড়ি উড়তে আরম্ভ করেছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছেলেটা দেখতে পাচ্ছে সারা রংপুর শহর জুড়ে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। ধাপের মোড়ে পোস্টার। জেলা স্কুলের দেয়ালে পোস্টার। পাবলিক লাইব্রেরির সামনে পোস্টার। সিনেমা হলে, রেল স্টেশনে, বাস টার্মিন্যালে, টাউন হল… সবখানে ঘুড়ি উৎসবের পোস্টার। দখিনের জানালা দিয়ে চমৎকার শিরশির বাতাস ঢুকছে ঘরে। আবহাওয়া না গরম না শীত। জানালা বরাবর বালিশে মাথা রেখে শুয়েছে ধীরেন। আবেশে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। চোখ বন্ধ অবস্থায়ই সে দেখছে কাছারি বাজারের আকাশে পঁচিশ/ত্রিশটা ঘুড়ি। লাল ঘুড়ি। সবুজ ঘুড়ি। হলুদ ঘুড়ি। নীল ঘুড়ি, খয়েরি ঘুড়ি। কতগুলো ঘুড়ি আবার দোরঙা হলুদ+সবুজ, নীল+খায়েরি, লাল-শাদা…এরকম। ¯্রফে শাদা ঘুড়িও আছে। অনেক উপরে উঠলে সাদা ঘুড়িগুলো সহজে চোখে পড়ে না। ভালো করে চোখ রাখলে দেখা যায়। ধীরেন সাদা ঘুড়ি কেনে না। তার পছন্দ সবুজ রঙের ঘুড়ি। এর একটা সুবিধাও আছে। সবুজ উজ্জ্বল রঙ। যদি কোনো সাদা ঘুড়ি চোরের মতো তার সবুজ ঘুড়ির একদম কাছে চলে আসে তাহলে রডের বৈপরীত্যের কারণে সে তা দ্রুত বুঝতে পারে। এমনকি ঘুড়ি অনেক ওপরে থাকলেও সে টের পায়। তখন সে নিজের ঘুড়ি সরিয়ে নেয়। ঘুড়িটাকে লাট খাওয়ায়। ঘুরতে ঘুরতে নিচে নামে ঘুড়ি। একসময় গোত্তা মেরে ঘুড়ি উপরে তোলে। তারপর সুবিধাজনক জায়গা থেকে আক্রমণ করে, মানে টার্গেট করা ঘুড়ির সুতার সঙ্গে নিজের ঘুড়ির সুতা লাগিয়ে দেয়। এ কৌশল-যে শুধু ধীরেন জানে এমন নয়; অনেক বছর ধরে যারা ঘুড়ি ওড়ায় বিশেষ করে যারা এ উৎসবের প্রতিযোগে নাম লেখায় তারা সবাই কম-বেশি জানে।
তারপরেও প্রতিযোগীরা ফার্স্ট, সেকেন্ড বা থার্ড হয় ব্যক্তিগত দক্ষতার হেরফেরের কারণে। তন্দ্রার ভেতর থাকতে থাকতে কখন-যে ঘুমিয়ে পড়েছিল ধীরেন নিজেই জানে না। ঘুমের মধ্যে যে দ্যাখে, মুন্সিপাড়ার বিদ্যুৎ দাঁত কেলিয়ে হাসছে। গতবার ও দ্বিতীয় হয়েছিল। এবার সে নিশ্চয় ফার্স্ট হতে চাইবে। ধীরেন দ্যাখে, বিদ্যুতের হলুদ ঘুড়িটা আক্রমণ করতে চাইছে তার সবুজ ঘুড়িকে। একটু আগে বেশ কাছে চলে এসেছিল। এখন আবার একটু পিছু হটেছে। এটাও একটা কায়দা, ধীরেন ঠিকই বোঝে। ওদিকে রানার, কেরানিপাড়ার রানার লাল-খয়েরি ঘুড়িটা; এতক্ষণ কোথায় ছিল আল্লাহ জানে, ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে ধীরেনের ‘সবুজ’-এর উপর। সেটাও অনেকটা কাছে এসে গেছে। রানা তো কম সেয়ানা না! কায়দা করে তার ঘুড়িটাকে ‘সবুজ’টার একবার ডানে একবার বামে নিয়ে আসছে। এরকম বার তিনেক করলো। ধীরেন মনে-মনে বলে, দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা তোদের! আমার ঘুড্ডির সুতা তোদের লাটাইতে না, আমার লাটাইয়ে! বলে সুতায় টান মারে ধীরেন। সবুজ ঘুড়িটা গোঁত্তা খেয়ে র্ছ র্ছ করে মুহূর্তেই নিচে চলে আসে। ধীরেন একদম খেয়াল করেনি, ওখানে অন্য একটা ঘুড়ি ছিল, হলদেটে রঙের। তার সুতার প্যাঁচ লেগে যায় এবং ধীরেন কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাটা পড়ে তার সবুজ ঘুড়ির সুতা। একেবারে হতভম্ব হয়ে যায় সে। হতভম্ব ও হতাশ ধীরেনের ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসা বিহ্বল ধীরেন এক কি দু’মিনিট পরেই লক্ষ করে, দেয়াল ঘড়িতে চারটা ছ’মিনিট। ছেলেটা দেরি না করে উঠে পড়ে। মাঠে যেতে হবে। তিন দিন পরেই টুর্নামেন্ট। একটা দিন ফুটবলটা খুব ভালো করে প্র্যাকটিস করতে হবে।
ষোলো.
রাধাবল্লভের পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং এর অফিসটায় কর্মকর্তা কর্মচারী মিলে বিশ/বাইশ জন লোক কাজ করেন। তার মধ্যে অফিস সংলগ্ন কোয়ার্টারগুলোতে থাকেন তেরো/চৌদ্দজন। তারা সবাই যার যার বাসায় চলে যান খেতে। অন ্যকয়েকজন, তাদের বাসা যেহেতু দূরে, খাবার নিয়ে আসেন। তারা লাঞ্চ আওয়ারে অফিসে বসেই খান। এসব কারণে দুপুরবেলা অফিসটা ফাঁকা হয়ে যায়। তার রেশ থাকে। তিনটা/সাড়ে তিনটার দিকেও। কারণ লাঞ্চের পর সবাইতো আর একসঙ্গে অফিসে ফেরেন না। দশ/বিশ মিনিট এদিক-ওদিক হয়ই। এদের বস ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ও দুপুরে তার অফিস সংলগ্ন বাসায় যান। পৌনে চার আগে তিনি চেম্বারে আসেন না। ফলে আবার কাজে মনোযোগ দেয়ার আগে লোকজন একটু খোস-গল্প করে নেয়। যথারীতি আজও তাই হচ্ছে। হেডক্লার্ক আব্দুল কাদের বেশ কিছুক্ষণ ধরে কী যেন খুঁজছিলেন পায়ের কাছের ড্রয়ার হাতড়িয়ে বস্তুটি পাওয়ার পর সেটা টেবিলের ওপর রাখেন। দেখা গেল, ওটা একটা কালির প্যাড। এবার একটু ঝুলে পড়া চশমা নাকের ওপর ঠিক মতো বসিয়ে বিপরীত দিক থেকে আওয়াজ ছাড়েন, সামাদ সা’ব; জেলা স্কুলের ফুটবল টুর্নামেন্ট দেইখতে যাবেন না এবার?
কাদেরের ছেলেটিও জেলা স্কুলের ছাত্র। সেভেন-এ পড়ে। মেয়ে বড়। মেয়েটা পড়ে বেগম রোকেয়া কলেজে। আই এ সেকেন্ড ইয়ারে।
আব্দুস সামাদ বলেন, কাদেও ভাই; অন্য সময়েই যাই। এবার তো যাইতেই হবে। হেড মাস্টার সাহেব ইনভাইট কইরছেন। না গেলে কেমন দেখায়!
কাদের মন্তব্য করেন, তা তো ঠিকই। আপনি স্টুডেন্টের গার্জেন। সেই স্টুডেন্ট আবার স্কুলটিমের প্লেয়ার। আপনার অনারই আলাদা!
সামাদ বলেন, ওরা খালি আমাকে না; টিমের প্রত্যেকটা ছেলের গার্জেনকে দাওয়াত কইরছে। ছেলের কাছ থাকি শুনলাম, প্রত্যেক বছরই নাকি জেলা স্কুল সেটা করে। সেমি ফাইন্যালের দিন তো দুইটা শ্যাচ হয়। সকাল এগারোটায় আর বিকাল সাড়ে তিনটায়। ওই দিন দুপুরে গেস্টদের খাওয়ায়। আব্দুস সামাদের ডান দিকে, এক টেবিল পরেই, বসেন হান্নান প্রামাণিক। লম্বা হান্নান ছাত্রজীবনে ভলিবল খেলোয়াড় ছিলেন। সেজন্য খেলাধুলায় তার উৎসাহ এখনো অটুট। হান্নান হাসিমুখে বলেন, কাদের সাব আপনি মিশুকের খেলা দেইখছেন? কী দুর্দান্ত খ্যালে ছেলেটা! আবার শুনি, ও ছাত্রও বেশ ভালো।
আব্দুস মামাদের বুকটা গর্বে ভরে যায়। বাবা হওয়ার সার্থকতা তিনি বেশ টের পাচ্ছেন এ মুহূর্তে। তার এই ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে সারা মাথায়। সামাদ এবার বলেন, পরশু থাকি তো খেলা; আর বিকালে আপনার তেমন কাজও থাকে না। স্যারকে বললে, উনি আশা করি না করবেন না। চলেন, বিকালটা জেলা স্কুলের মাঠেই কাটাই।
মুচকি হাসির রেখা ঠোঁটে তুলে আব্দুল কাদের বলেন, আমি যাবো না?
সামাদ সঙ্গে সঙ্গে বলেন, কাদের ভাই। চলেন তিনজনেই একসঙ্গে যাই।
এস্টিমেটর হান্নান সময় এদিকে দেখা যায়নি। দুপুরের খাওয়া শেষ করে আশপাশে কোথাও ছিল। সে এবার উদিত হয়। চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট আবু লতিফ তখনো অফিসে ফেরেননি। তার চেয়ারটা খালি। আবু লতিফের বড় টেবিলের পাশ দিয়ে জসিম ওই জায়গায় এসে পড়ে যেখানে কাদের আর সামাদের টেবিল প্রায় মুখোমুখি। এসেই আওয়াজ দেয়, বড় স্যার চ্যাম্বারে বইসছেন। অ্যাকাউন্ট্যান্ট স্যারও দেখলাম আইসতেছে। সবাই নড়ে চড়ে বসেন। এবার তাদেরকে কাজে মন দিতে হবে। চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট আবু লতিফ সাহেব কাজের সময়ে গল্প-গুজব পছন্দ করেন না। তাছাড়া বস অর্থাৎ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব লাঞ্চের পর একবার অফিসের ভেতরটা ঘুরে যান। উনি যে কোনো সময় এদিকে ঢুকে পড়তে পারেন।
সতেরো.
ইন্টার স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট আরম্ভ হয়েছে গত পরশু দিন। দিনটা ছিল রোববার। রোববার ছুটির দিন হওয়ায় সারা শহরের মানুষ ছুটে এসেছিল জেলা স্কুলের দিকে; বিশেষ করে বিকেলে, চারটার পর। কারণ দিনের শেষ ম্যাচটা শুরু হয় সাড়ে চারটায়। শেষ হয় ছ’টায়। বিকেলের প্রথম ম্যাচ ছিল বেলা তিনটায়। এ ম্যাচেও দর্শকের অভাব ছিল না। স্কুলের ছাত্রই তো সাড়ে ছ’শ। তাদের বড় অংশই খেলা দ্যাখে। তাছাড়া আশপাশের পাঁচটা মহল্লা থেকেও প্রচুর লোক আসে। রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এখানে। বর্তমান হেস্যার যেমন পণ্ডিত তেমনি স্ফূর্তিবাজ মানুষ। তার নির্দেশে স্কুলের গেট সাজানো হয়েছে দারুণভাবে। আর কে বল গেট নয়; মেইন গেট থেকে স্কুলের এক নম্বর ভবন, মানে প্রধান ভবন পর্যন্ত সাজানো হয়েছে অসংখ্য বুঁদিয়া বাতি ও মরিচ বাতি দিয়ে। সন্ধ্যা পর্যন্ত লোকজন থাকে। ওই সময় ওই ছোট ছোট বাতিগুলোর সৌন্দর্য বোঝা যায়। একটানা এগারো দিন ধরে চলবে এই ফুটবল উৎসব। মাঝখানের এক রোববার খেলা হবে না। ওইদিন ছেলেরা (যারা বাইরে থেকে আসে) শহরের এখানে-ওখানে ঘুরবে। অনেকেই এটা-ওটা কিনবে। কেউ কেউ একবেলা সিনেমকাও দেখবে হয়তো।
ফুটবল জমে ওঠে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্বে। এই স্তরে ম্যাচ হয় আটটা। তার মানে ষোলটা দল খেলে। এর ভেতর যে চারটা দল জেতে তাদেরকে নিয়ে তৈরি হয় সেমি ফাইনাল পর্ব। সেজন্য এই পর্বে হয় দু’টি ম্যাচ। কোয়ার্টার ফাইনাল পর্বের ম্যাচগুলো হয়ে ওঠে দেখার মতো কেননা এই পর্বে হেরে গেলে আর সুযোগ থাকে না; সোজা বাড়ির পথ ধরতে হয়। তাইতো কোয়ার্টার ফাইনাল পর্বের ম্যাচগুলোতে খেলোয়াড়রা প্রতিপক্ষকে মরণকামড় বসাতে চায়। তারা জেতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। টুর্নামেন্টের সপ্তম, অষ্টম ও নবম এই তিন দিনে আটটা ম্যাচ অর্থাৎ কোয়ার্টার ফাইনালের খেলাগুলো শেষ হয়। দশম দিনটি থাকে সেমি ফাইনালের দুটির ম্যাচের জন্য। আর এগারোতম দিনে (শেষ দিন) বিকাল সাড়ে চারটায় বসে ফাইনাল ম্যাচের আসর।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, প্রথম ছ’দিন ধরে চলে কোয়ার্টার ফাইন্যালে ওঠার লড়াই। আজ মঙ্গলবার-উৎসবের তৃতীয় দিন। সোমবার সকালে ছিল রংপুর জেলা স্কুলের প্রথম ম্যাচ; ঠাকুরগাঁও পাইলট স্কুলের সঙ্গে। জেলা স্কুল ২-১ গোলে জিতেছে। রতন ভাবে, আজ বিকেলে আবার ম্যাচ আছে আমাদের। কৈলাশ রঞ্জন স্কুলের সাথে। ওরা আমাদের সাথে পারবে না। গোটা তিনেক গোল খাবে। তার মানে আমরা কোয়ার্টার ফাইনালের পথে অনেকটা আগায় যাবো আজই। বুধবার কুড়িগ্রাম রিভারভিউ স্কুলের সাথে হবে ফাইট। পিন্টু স্যার বলছেন, এ ম্যাচটা সহজ হবে না। তবে তোমরা যদি স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারো, উইন আমরাই করবো। সেজন্য সবার আগে মনের জোরটা অটুট রাখতে হবে।
রতন প্রথম ম্যাচে খেলেনি। তৃতীয় ম্যাচটাতে সে থাকবে। সেজন্য সকালে বেশি সময় বাইরে থাকেনি। স্কুলের মাঠ থেকে সোজা বাসায় এসেছে। রাধাবল্লভ মোড় পর্যন্ত সঙ্গী ছিল ধীরেন ও খায়ের। খায়ের বিকেলে খেলবে। রতন ভাবে, অন্তত একটা গোল ওর শর্ট থেকে হবে আজ। সে মনে মনে বলে, খায়েরের খেলাটা দেখতেই হবে। কৈলাশ যদিও আমাদের তুলনায় দুর্বল টিম। তাহলেও ওদের ব্যাক বেশ শক্তিশালী। একজন ভালো স্ট্রাইকারও আছে। গত দু’মাসে খায়ের স্কিল কতোটা ডেভেলপ করছে সেটা বোঝা যাবে আজই।
জেলা স্কুলের পিছনের দিকের অর্থাৎ তিন নম্বর মাঠটা কেবল প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে এখন। সামনের দু’টি তে চলছে খেলা। দুই মাঠের উত্তরে-দক্ষিণে এবং পূর্বে অশ^থ ও বটগাছের নিচে খেলোয়াড়দের তাঁবু পড়েছে। অসংখ্য তাঁবু। মোট একুশটা স্কুল এবার যোগ দিয়েছে টুর্নামেন্টে। প্রত্যেক টিমের জন্য দুটো করে টেন্ট, ধীরেন ভাবে, তাহলে কতগুলো দরকার? কমপক্ষে বিয়াল্লিশটা। ধীরেন ও-ই দিকে তাঁবুগুলোর ওপর দৃষ্টিনিক্ষেপ করে সত্যিই অবাক হয়। এত তাঁবু! সাদা-সাদা, ফ্ল্যাগশোভিত, দৃষ্টিননন্দন এক একটা কাপড়ের ঘর। সত্যিই অন্যরকম হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাসের ছবি।
খুব সুন্দর বিকেল। আজ গরমও অনেক কম। ফুটবলারদের জন্য এমন আবহাওয়া একটা আশীর্বাদ। চারটা একুশ বাজে। মিনিট দশেকের মধ্যে ম্যাচ শুরু হবে। রংপুর জেলা স্কুল বনাম কৈলাশরঞ্জন বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়। দুই মাঠের পূর্বদিকে বিশাল আকৃতির দু’টি শামিয়ানা টাঙানো। শামিয়ানার নিচে দুই শতাধিক ফোল্ডিং চেয়ার। সামনের দিকে অবশ্য বিশেষ অতিথি ও বয়স্ক অতিথিদের জন্য রাখা আছে গড়ি লাগানো হাতল চেয়ার। বৃহৎ চারটি টেবিলের প্রত্যেকটার ওপর ফুলের তোড়া। সুদর্শন কাচের জগ ও গ্লাস। এছাড়া প্রয়োজনীয় আরও কিছু জিনিস রাখা আছে ওখানে। ডি.সি সাহেবের জন্য নির্ধারিত সিংহাসন মার্কা বড় চেয়ারটাতে সূর্যমুখীর ছবিঅলা তোয়ালে ঝুলছে। ডি.সি এখনও এসে পৌঁছাননি। হয়তো এসে পড়বেন অল্প সময়ের ভেতর। অবশ্য চিফগেস্টের জন্য দেরি করা হবে না। ম্যাচ ঠিক সময়েই আরম্ভ হবে। কেননা ছ’টা চল্লিশ/বিয়াল্লিশে সন্ধ্যা হয়ে যায়, অন্ধকার নামার আগেই খেলা শেষ করতে হবে।
ইতোমধ্যে দু’দলকেই মাঠে দেখা যাচ্ছে। তারা মাঠের দু’দিকে বল নিয়ে হালকা দৌড়াদৌড়ি করছে। একজন পাস দিচ্ছে আরেকজনকে। আবার গোল কিপারের দিকে বল শট মারছে কেউ। জেলা স্কুলের জার্সির রঙ সবুজ ও কালো। কৈলাশরঞ্জন হাই স্কুলের জার্সি খয়েরি ও নীল রঙের। ইতোমধ্যে শামিয়ানার নিচের সব ফোল্ডিং চেয়ার ভরে গেছে। শুধু অতিথিদের অল্প কিছু চেয়ার খালি। খেলা হয় যে দুটি মাঠে তাদের পূর্ব দিকে মার বেঁধে পোতা হয়েছে একুশটা রঙিন বাঁশ। সেগুলোর মাথায় উড়ছে একুশটা ফ্ল্যাগ-একুশ স্কুলের। পিন্টু দত্তকে দেখা যাচ্ছে। হেড মাস্টার সাহেবের সঙ্গে কী যেন আলাপ করছেন। মাঠের একপাশে ম্যাচরেফারির সঙ্গে কথা বলছেন কৈলাশরঞ্জনের কোচ শাহজাহান বাচ্চু। আবদুল আলিম রংপুর জেলা স্কুলের নামকরা সিনিয়র শিক্ষক। ওপরের ক্লাসগুলোতে ইংরেজি ও গণিত পড়ান। তিনি বসে আছেন হেডমাস্টার সাহেবের বাম দিকে। আর তিন/চার মিনিট পরেই খেলা আরম্ভ হবে। পিন্টু দত্তের বোধ হয় মনে হয়েছে জরুরি কিছু বলা দরকার। তিনি হন হন করে মাঠের মাঝখানে ছুটছেন। একটু পরেই দেখা গেল খায়ের ও রঞ্জুকে কিছু বলছেন তিনি। এই ম্যাচে মিশুক ও ধীরেন খেলবে না। ওরা খেলবে বুধবারের হাই ভোল্টেজ ম্যাচে। ওই খেলায় রংপুর জেলা স্কুলের প্রতিপক্ষ কুড়িগ্রাম বিভারভিউ হাই স্কুল। রিভারভিউ তো আগেই বলে দিয়েছে, তারা কাপ নিতে আসবে রংপুরে। সেই খবর দৈনিক ‘করোতোয়া’য় ফলাও করে ছাপাও হয়েছিল।
লম্বা-লম্বা দড়িতে আঠা দিয়ে লাগানো হয়েছে অসংখ্য তিন কোনা রঙিন কাগজ। সুতা দিয়ে আলগা করে বেঁধে রাখা বেলুন উড়ছে শামিয়ানার সামনের দুই কোনায়। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার সাহেব বসেছেন জেলা পুলিশ সুপার সাহেবের পাশেই। উনি ঝুঁকে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে কি যেন বললেন। বিকেলের হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে নিশান সমূহ। মাঠের চারপাশে জড়ো হয়েছে শত শত মানুষ। দর্শকদের মধ্যে কিশোর ও যুবক আছে প্রচুর। উত্তেজনা সংক্রমিত হয়েছে দর্শক শ্রোতাকুলের ভেতর। ইতোমধ্যে খেলা আরম্ভ হয়ে গেছে।
৩৫+৩৫+২০= মোট নব্বই মিনিট। তার মধ্যে খেলা হবে মোট সত্তর মিনিট। বিরতির জন্য বিশ মিনিট। প্রথমার্ধের দশ মিনিটের মতো কেটেছে। কোনো দলই গোল করতে পারেনি। জেলা স্কুল দলের প্ল্যান ছিল প্রথম পাঁচ মিনিটে ১-০ গোলে এগিয়ে থাকার। সেটা হলো না। অবশ্য তারা চাপ সৃষ্টি করেছে। তিন তিনবার গোলের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। ধীরেনের ডান পায়ের জোরালো কিক গোলবার ঘেঁষে বাইরের দিকে চলে গেছে। বাকি দুটো শট টপকিয়ে দিয়েছে কৈলাশরঞ্জনের গোলকিপার সুজিত। সুজিত যথেষ্ট লম্বা এবং চালাক। অপরদিকে কৈলাশরঞ্জন সুযোগ পেয়েছিল মাত্র একবার। কিন্তু পাস ঠিকমতো দিতে না পারায় তা কাজে লাগেনি। আনিসের দৃঢ়তার কাছে ভেস্তে গেছে তাদের ওই সুযোগ।
কৈলাশরঞ্জনের টিম এমনভাবে খেলছে, মনে হচ্ছে প্রথমার্ধে তারা গোল দিতে না পারলেও দ্বিতীয়ার্ধে আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে। তখন পর্যন্ত জেলা স্কুল যদি কোনো গোল করতে না পারে এবং কৈলাশরঞ্জন একটা গোল দিয়ে দিতে পারে, তাহলে, তাদের কৌশল হবে জেলাস্কুল টিমকে সর্বশক্তি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা। সেক্ষেত্রে তাদের পরিকল্পনা হচ্ছে বাকিটা সময় ডিফেন্সিভ পদ্ধতিতে খেলা। রংপুর জেলা স্কুলের টিম অবশ্য সবসময়ই আক্রমণাত্মক ফুটবলে বিশ^াসী। তাদের হিসাব হচ্ছে যদি এক গোলে এগিয়ে থাকা যায় তাহলে সেটাই বেশি সুবিধাজনক। কেননা তখন প্রতিপক্ষকে প্রতিযোগে ফিরতে হলে প্রথমে সেই গোলটা শোধ দিতে হবে। তারপর এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন। সেটা সহজ কাজ নয়।
প্রথমার্ধের পঁচিশ মিনিট চলে গেছে। দর্শকরা মোটামুটি ধরে নিয়েছে বিরতির আগে ম্যাচ গোলশূন্য থাকবে। কিন্তু আনিসের কর্নার শট থেকে পাওয়া বল সুযোগ বুঝে খায়ের ঢুকিয়ে দেয় প্রতিপক্ষের জালে। ছেলেটা শুরু থেকেই আক্রমণ চালিয়েছে। প্রায় সারা মাঠ দৌড়ে বেড়িয়েছে। আর এখন কাজ হয়ে গেল ছোট্ট এক টোকায়। সুজিত অবশ্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। বলের নাগাল পায়নি। এর মিনিট দু’য়েক পরেই বিরতির বাঁশি বাজে।
আঠারো.
রংপুর জেলা স্কুলের কাছে কৈলাশরঞ্জন হাই স্কুল পরাজিত হয়েছিল ২-০ গোলে। দ্বিতীয়ার্ধে তারা আক্রমণ তো শানাতেই পারেনি, উল্টো আরো এক গোল খেয়েছে। দ্বিতীয় গোলটি করেছিল ধীরেন। বুধবারের ম্যাচে জেলা স্কুল কুড়িগ্রাম রিভারভিউ হাই স্কুলকে হারিয়ে দিয়েছে ৩-২ গোলে। দু’টি গোল করেছে মিশুক। একটি এসেছে আনিসের পা থেকে। অবশ্য ওই বলটা নিখুঁতভাবে আনিসকে পাস দিয়েছিল রতন। জেলা স্কুলের অন্য ম্যাচটি ছিল শ্যামপুর কালিরঞ্জন হাই স্কুলের সঙ্গে। ওই খেলা ড্র হয় ১-১ গোলে। তিনটি ম্যাচে জিতে এবং একটিতে ড্র করে রংপুর জেলা স্কুল পেয়েছিল কোয়ার্টার ফাইন্যালের টিকিট। ওই টিকেট পেয়েছিল কুড়িগ্রাম রিভারভিউও। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইন্যালে এসে তারা বাদ পড়ে যায়, বোনারপাড়া হাই স্কুলের কাছে ৩-২ গোলে হেরে। কোয়ার্টার ফাইন্যাল পর্বে টিকে থাকে নীলফামারী সদর হাই স্কুল। এই পর্বে রংপুর জেলা স্কুলের ম্যাচ ছিল চারটি। প্রত্যেকটিতেই শক্ত প্রতিপক্ষ- ক. ধাপ নীলকুঠি হাই স্কুল, খ. বোনারপাড়া হাই স্কুল, গ. নীলফামারী পাইলট হাই স্কুল, ঘ. রংপুর হাই স্কুল। নীলফামারী পাইল ও ধাপ নীলকুঠিকে হারিয়ে জেলা স্কুল এখন সেমিফাইন্যালে উঠেছে। ধাপের সঙ্গে তো ম্যাচ ড্র হতে বসেছিল। গোলশূন্য ওই খেলার একেবারে শেষ দিকে ধাপ গোলবারের সামনের বক্সের ভেতর ফাউল করে বসে। ফলে তাদের প্যানালটি হয়। আর সেই সুযোগ কাজে লাগায় জেলা স্কুল। আনিস প্যানালটি শট দিতে ওস্তাদ। তাকেই দেয়া হয়েছিল ওই দায়িত্ব। অন্যদিকে রংপুর হাই স্কুল জিতেছে শ্যামপুর কালিরঞ্জন হাই স্কুল ও রবার্টসনগঞ্জ হাই স্কুলের বিপরীতে। ফলে রংপুর হাই স্কুলও পেয়েছে সেমি ফাইন্যালের টিকিট। ফজলু তো আগে থেকেই স্টার। দল সেমিতে ওঠায় সে এখন হিরো। সেমি ফাইন্যাল খেলে তো চারটা দল। তার মানে এই পর্বে দুটো ম্যাচ হবে। বাকি দু’টি দল হচ্ছে কালীগঞ্জ পাইলট হাইস্কুল ও নীলফামারী হাই স্কুল। কালীগঞ্জ এবার দুর্দান্ত ফুটবল খেলছে। ওদের টিমের রশীদ নামের ছেলেটি এ পর্যন্ত দু’টি গোল দিয়েছে। দলের হয়ে ফজলু দিয়েছে সাত গোল। আর মিশুক বরাবরের মতো সবার ওপরে-সে দিয়েছে আটটা গোল। তার মধ্যে একটা ম্যাচেই তিন গোল এসেছিল তার পা থেকে।
সেমি ফাইন্যাল হচ্ছে মরণপণ লড়াইয়ের পর্ব। এক্ষেত্রে একটা ছোট ভুলের জন্য বাদ পড়ে যেতে পারে যে কোনো শক্তিশালী দল। সব টিমই সেটা জানে ও বোঝে। তারপরও রংপুর জেলা স্কুল ফুরফুরে মেজাজে আছে। পয়েন্ট তালিকায় সবার ওপরে তাদের স্থান। দ্বিতীয় স্থানে আছে রংপুর হাই স্কুল। কালীগঞ্জ ও নীলফামারীর পয়েন্ট সমান সমান। তারাও জোসে আছে। এই চার দলের প্রত্যেকটিই আশা করছে ফাইন্যাল খেলার। অতএব বোঝাই যাচ্ছে, কমপিটিশন কেমন হবে। প্রথম সেমিতে এবার কালীগঞ্জ মুখোমুখি হচ্ছে নীলফামারীর। এবং দ্বিতীয় সেমিমে জেলা স্কুল রংপুর হাই স্কুলের। দ্বিতীয় ম্যাচটির বল গড়াবে বিকেলে, যথারীতি সাড়ে চারটায়। তার মানে ছেলেরা ওই দিন সকালে ফ্রি থাকবে। সেজন্য পিন্টু দত্ত তার প্রিয় ছাত্রদেরকে আগেই বলে রেখেছিলেন, দশ তারিখ সকাল সাড়ে ছ’টায় মাঠে থাকতে। গরমের দিন। কড়া রোদ ওঠার আগেই যাতে ছেলেরা অনুশীলনটা সেরে নিতে পারে তাই এই ব্যবস্থা। সবাই যথাসময়ে উপস্থিত। আজ পনেরো জনই এসেছে। যেকোনো ম্যাচে এই পনেরো জনের ভেতর থেকে এগারো জন খেলতে পারে। তবে কথা আছে। খেলা আরম্ভ হওয়ার কমপক্ষে তিন ঘণ্টা আগে সেই এগারোজনের তালিকা জমা দিতে হয় গেম কমিটির কাছে। বাকি চারজনও তৈরি থাকে ‘স্ট্যান্ড বাই’ হিসাবে।
প্র্যাকটিস শুরু করার আগে মাঠের এক পাশে দুই সারিতে বসেছে ছেলেরা। তাদের সামনে বসেছেন তাদের প্রিয় গেম টিচার পিন্টু দত্ত। সামনের সারিতে আছে রতন, মিশুক, খায়ের, আনিস, গোল কিপার সুলতান, রানা, শরীফ ও বাদল। পেছনের সারিতে ধীরেন, রঞ্জু, কায়সার, সমর, রিফাত, কামরুল ও শাহাদাত। রিফাত বরাবরই স্বল্পভাষী। শাহাদাত একটু লাজুক টাইপের। অবশ্য জায়গা মতো, মানে মাঠে দু’জনেই নাছোড় বান্দা। পিন্টু দত্ত গুড মর্নিং বলে সকলের কুশল জিজ্ঞেস করেন। তারপর বলেন, আমরা আমাদের প্রথম টার্গেট ফুলফিল করছি, তাই না?
ছেলেরা একযোগ বলে, জি স্যার।
আমাদের দ্বিতীয় টার্গেট কী?
ছেলেরা উত্তর দেয়, ফাইন্যাল ম্যাচে খেলা, স্যার। পিন্টু বলেন, তাহলে তো আমাদেরকে সেমির বাধা টপকাতেই হবে। এই সময় পিন্টু বাবুর চোখে পড়ে, শাহাদাত মাথা নিচু করে বসে আছে। তার দৃষ্টি ঘাসের ওপর। ছেলেটার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য পিন্টু দত্ত বলেন, আমার মনে হয় শাহাদাত খেলা নিয়ে কিছু ভাবছে।
ছেলেটা নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে। তার চোখ এখন গেমটিচারের দিকে। দত্ত এবার বলেন, তোমার কী মনে হয় শাহাদাত, আমরা ফাইন্যাল খেলতে পারবো?
নিচু কণ্ঠে শাহাদাত জবাব দেয়, ইনশাআল্লাহ আমরা জিতবো।
পিন্টু দত্ত ছেলেদের স্পিরিট জাগিয়ে দিতে চান, গলা এমন নিস্তেজ কেন? বোল্ডলি বলো!
এবার চার/পাঁচজন একসঙ্গে বলে ওঠে, ইয়েস স্যার। আমরা সেমিতে জিতবো।
তার সাথে খায়ের যোগ করে, জেতার জন্য কাল আমরা মাঠে নামবো স্যার। আপনি খালি আমাদেরকে দোয়া করবেন।
পিন্টু বলেন, সিওর! সব সময় আমার আশীর্বাদ আছে তোমাদের জন্য। প্র্যাকটিস যথেষ্ট হয়েছে। শুধু বডি ফিট রাখার জন্য ম্যাচের আগে ওয়ার্ম আপ করলেই চলবে। কিন্তু বাবারা, জয়ের জন্য মনের এই পজিটিভনেসটা ধরে রাখা চাই। আমার বিশ^াস, তোমরা পারবে।
গেমটিচার যখন এসব বলছিলেন তখন অন্য সবাই মন দিয়ে শুনলেও রতনের কানে সবকথা ঠিকমতো ঢোকেনি। তার কারণ সে ওই সময় অন্য কিছু ভাবছিল। ভাবছিল, রংপুর হাই স্কুলের সাথে ম্যাচ। তার মানে প্রতিপক্ষ ফজলু, সেন্টু, হায়দার, অভিজিৎরা! ফজলু ও অভিজিৎ আক্রমণভাগে থাকে। এই দু’জনকে ট্যাকল দেওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ। তা হোক। আমাদেরও মিশুক ও রঞ্জু আছে। আছে ধীরেন, আনিস, কামরুল, রিফাতরা। আমাদের সাথে ওরা শেষ পর্যন্ত পারবে না!
কোয়ার্টার ফাইন্যাল পর্বের দেড়গুণ দর্শক দেখছে সেমি ফাইন্যালের শ্যাচ। অসংখ্য মানুষ ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে প্রথম সেমি দেখেছে। বিকেলের ম্যাচ দেখতেও দর্শকের ঢল নেমেছে। সবাইকে চমকে দিয়ে কালীগঞ্জ পাইলট হাই স্কুল ২-০ গোলে জিতেছে নীলফামারী হাই স্কুলের বিপরীতে। পিন্টু দত্ত চেয়েছিলেন, নীলফামারী জিতুক। কেননা তার স্কুল যদি ফাইন্যালে উঠতে পারে সেক্ষেত্রে নীলফামারীকে মোকাবেলা করা কিছুটা সহজ বলে মনে হয়েছে তার। কালীগঞ্জের বিদ্যুৎ নামের প্লেয়ারটি ভয়ঙ্কর। তার খেলা সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। প্রধানত তার জন্যই জিতেছে কালীগঞ্জ। জেলা স্কুল ও রংপুর হাই স্কুলের মধ্যে যে দল জিতবে তার সঙ্গেই হবে কালীগঞ্জ পাইলটের শেষ লড়াই।
সোয়া চারটা বাজে। সাড়ে চারটায় ম্যাচ। একটু আগেই রংপুর হাই স্কুল ও রংপুর জেলা স্কুলের খেলোয়াড়রা মাঠে ঢুকেছে। তারা ওয়ার্মআপ করছে। হাই স্কুলের জার্সির রঙ সবুজ ও খয়েরি। জেলা স্কুলের যথারীতি সাদা-কালো। প্রচুর দর্শক হাজির হয়েছে পাশর্^বর্তী মহল্লা রাধাবল্লভ থেকে। দুই নম্বর শামিয়ানার নিচে একপাশে বসেছে বিলকিস বানু ও তার বান্ধবীরা। উৎফুল্ল মেজাজে আছে তারা। আজ জেলা স্কুল খেলবে। এই দলের চারজন খেলোয়াড় রাধাবল্লভে থাকে। বিলকিসের এটা ভেবে ভালো লাগছে যে মিশুক খেলবে। সে মনে-মনে প্রার্থনা করে, মিশুক যেন দুটো গোল করতে পারে আর জেলা স্কুল জিতে যায়।
আগের মতোই আজও পিন্টু দত্তের ব্যস্ততা নজর কাড়ছে। মাঠের পশ্চিম কোণে গেম কমিটির দু’জন ব্যক্তির সঙ্গে তিনি আলাপ করছেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার ও গণ্যমান্য অতিথিদের বেশির ভাগই এসে পৌঁছেছেন। হেড মাস্টার সাহেবের চেয়ারটি খালি। উনি এখনও তার চেম্বারে। অল্প সময়ের মধ্যেই এসে পড়বেন। ডি.সি. আজ আসতে পারবেন না। উনি জরুরি কাজে রংপুরের বাইরে। সম্মানিত অতিথিবর্গের মধ্যে কয়েকজন মহিলাকে দেখা যাচ্ছে। একজনের চোখে সানগ্লাস। ক্যাম্পাসের নানা জায়গায় ফ্ল্যাগ উড়ছে। নানা রঙের কাগজ আর বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে অতিথিদের বসবার জায়গা। এক নম্বর শামিয়ানার উত্তর পাশে দশ/বারোটি চেয়ারে বসেছে মুন্সিপাড়া থেকে আগত ছেলেমেয়েরা। ও খানে, দেখা যাচ্ছে, সোমাও আছে। সোমার ডানপাশে তার ক্লাসমেট ও বান্ধবী মেহরিন। মেহরিন শহরের নামকরা টেবিল টেনিস খেলোয়াড়। ফজলু আজ রংপুর হাইস্কুলের পক্ষে মাঠে নেমেছে। সুতরাং দর্শকদের ভেতর সোমা থাকবে এটা স্বাভাবিক। মাঠের দুই পাশের ফ্ল্যাগ ম্যানরা এসে গেছেন। এইমাত্র রেফারি মাঠে ঢুকলেন। খেলা আরম্ভ হতে আর চার মিনিট বাকি। ফজলু কেবল একই মহল্লার বাসিন্দা নয়, খায়ের, মিশুক, রতনদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। মিশুক তো তার প্রতিবেশীও। কিন্তু ভিন্ন স্কুলের ছাত্র হওয়ার কারণে ফজলু আজ এদের প্রতিপক্ষ। অবশ্য প্রতিপক্ষ দলে সে-যে এবারই প্রথম এমন নয়। টাকার বিনিময়ে সে যখন অন্য ক্লাবের হয়ে খেলে তখনও কয়েকবার রাধাবল্লভ অগ্রণী সংঘের বিপরীতে সে মাঠে নেমেছে। আজ মাঠের লড়াইটা হবে প্রধানত মিশুক-ফজলু এবং আনিস-শফিকুলের ভেতর। আলমগীর নামেও ওদের একজন বেশ ভালো প্লেয়ার আছে। সে জেলা স্কুল দলের রঞ্জু বা ধীরেনের চেয়ে খারাপ নয়। মোট কথা যুদ্ধটা হবে হাড্ডাহাড্ডি এটা বলাই যায়। ম্যাচ আরম্ভ হওয়ার প্রাক্কালে চোখাচোখি হলো ফজলু ও মিশুকের। উভয়েই শুধু নিঃশব্দে হাসলো। মাঠের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে কমবয়সী ছেলেদের উপস্থিতি বেশি। তারা সবাই একসঙ্গে স্ফূর্তিবোধক ‘হৈঈ’ দিয়ে উঠলো। দু’ চারজন মুখে আঙুল দিয়ে শিস বাজালো। রেফারি হাতঘড়িতে চোখ রাখলেন। আর এক মিনিট বাকি।
প্রথমার্ধের খেলা শেষ। এখন বিরতি চলছে। প্রথমার্ধে চৌদ্দ মিনিটের মাথায় মিশুক গোল করেছিল। রংপুর হাই স্কুলের গোল কিপার ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বল ঢুকে পড়েছিল তাদের জালে। তিরিশ মিনিট পেরোনোর পর সেই গোল শোধ দেয় ফজলু। কর্নার কিক থেকে আসা বল রিফাতের পা ছুঁয়ে এসে পড়েছিল ফজলুর সামনে। সামনে জটলা ছিল। তার ভেতরেই একটু ফাঁক পাওয়া গিয়েছিল। ফজলু সেটা কাজে লাগায়। বিরতির বাঁশি বাজার আগ পর্যন্ত আর কোনো গোল হলো না।
উনিশ.
প্রথমার্ধের খেলা শেষ। এখন বিরতি চলছে। প্রথমার্ধে চৌদ্দ মিনিটের মাথায় মিশুক গোল করেছিল। রংপুর হাই স্কুলের গোল কিপার ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বল ঢুকে পড়েছিল তাদের জালে। তিরিশ মিনিট পেরোনোর পর সেই গোল শোধ দেয় ফজলু। কর্নার কিক থেকে আসা বল রিফাতের পা ছুঁয়ে এসে পড়েছিল ফজলুর সামনে। সামনে জটলা ছিল। তার ভেতরেই একটু ফাঁক পাওয়া গিয়েছিল। ফজলু সেটা কাজে লাগায়। বিরতির বাঁশি বাজার আগ পর্যন্ত আর কোনো গোল হলো না।
অতিথিবর্গের মধ্যে মিশুকের বাবা আব্দুস সামাদ আছেন। আছেন ফজলুর বাবাও। আব্দুস সামাদের ফুটবলপ্রীতি আছে। রহমান খেলার তেমন ভক্ত নন। কিন্তু ছেলে খেলবে সেই কৌতূহল তাকে টেনে এনেছে মাঠে। গোল শোধ হওয়ার পর তিনি হাসছিলেন। গর্বে তার বুক ভরে গেছে তখন। ছেলেরা মাঠে হাঁটু মুড়ে বসে লেবুর শরবত খাচ্ছে। দু’জন খেলোয়াড় অন্য দু’জন খেলোয়াড়ের পা উপর-নিচ করছে। তাদের একজন ফজলু। তার ওপর চাপ বেশি। সে-ই দলের প্রধান স্ট্রাইকার। তাকে নিয়ে আশা-ভরসাও বেশি।
দ্বিতীয়ার্ধের বাইশ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে। কোনো দলই আর গোল করতে পারেনি। মরিয়া হয়ে উঠেছে। খেলোয়াড়রা। আর মাত্র বারো মিনিট আছে। তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করছে সমর্থকদের ভেতর। খেলাও জমে উঠেছে দুর্দান্ত। একবার আক্রমণ চালাচ্ছে রংপুর জেলা স্কুল। আরেকবার রংপুর হাই স্কুল। একটু পরপরই উভয় দলের গোলের সামনে জটলা হচ্ছে। গোলের সম্ভাবনা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বেশ দূর থেকে কিক করা একটা বল মুহূর্তেই গোলপোস্টের ওপরের দিকে লেগে ফিরে এলো। লক্ষ্য ভ্রষ্ট হওয়ায় শাহাদাত আফসোসে দু’হাত মাথায় রাখে। একটু পরেই বল আবার জেলা স্কুলের গোল পোস্টের সামনে। ডি-বক্সের সামান্য বাইরে বল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে দু’দলের প্লেয়াররা। এ সময় খায়ের বল বের করে এনে পাস দেয় রিফাতকে। মধ্যমাঠে তখন আনিস ও রতন। রিফাতের নিখুঁত পাস রতনের একেবারে পায়ের সামনে পৌঁছে দেয় বল। এখন দেরি করার সময় নেই। এখন এক মুহূর্তের মূল্য অনেক। কেননা ইতোমধ্যে ফজলুসহ তার দলের আরও তিনজন এগিয়ে গেছে। রংপুর হাইস্কুলের গোল কিপারও সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। বল নিয়ে দ্রুত এগাচ্ছে আনিস। বিপজ্জনক এলাকায় ঢুকে পড়ার আগেই প্রতি পক্ষের দু’জন খেলোয়াড় বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আনিস মিশুকের মতোই ড্রিবলিংয়ে পটু। তার ড্রিবলিংয়ের ধোঁকায় পড়ে যায় তারা। আনিস কালবিলম্ব না করে বল পাস দিয়ে দেয় কামরুলকে। কামরুল দীর্ঘদেহী। স্বাস্থ্যও বেশ ভালো। সে এ মুহূর্ত লক্ষ করে নিজ দলের স্ট্রাইকারদের অবস্থান। মিশুক তখন কোথায়? না, সুযোগসন্ধানী মিশুক সুবিধাজনক জায়গাতেই আছে। মধ্যমাঠে আছে হাইস্কুল দলের ফজলু এবং বিদ্যুৎ। চিৎকার-চেঁচামেচিতে ভরে গেছে দর্শকসারি। থেকে থেকে শিস দিচ্ছে অতি উৎসাহী ছেলেরা। চমৎকার বাতাস বইছে। তেমন গরম লাগছে না। বিকেল সন্ধ্যার দিকে হেলে পড়েছে।
কামরুলের পাসটি ঠিকমতো হয়নি। ফলে বল পেয়ে যায় বিদ্যুৎ। সে বিদ্যুতের গতিতে ছোটে বিপরীত দিকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পৌঁছে যায় জেলা স্কুলের গোলের কাছাকাছি। রুদ্র মূর্তিতে এগিয়ে আসা একজনকে কাটিয়ে অভিজিৎ বক্সের ভেতর ঢুকে পড়ে। কিন্তু এখানে আছে ধীরেন ও রঞ্জু যারা ‘ওয়াল’ নামে খ্যাত। ওদের বাধা অতিক্রম করতে পারে না বিদ্যুৎ। রঞ্জুর বিশাল এক কিক বলকে মধ্যমাঠে আছড়ে ফেলে। বল পায় খায়ের। ফজলু বিপদ আঁচ করে তখন এগিয়ে চলেছে। এসময় তার দলের একজনের পায়ে লেগে বল সীমানার বাইরে। থ্রো ইন পায় জেলা স্কুল। রতনের লম্বা হাতের থ্রো বল অনেকটা ভেতরে ছুড়ে দেয়। যাকে দেয় তার কাছ থেকে ফজলু বল কেড়ে নিয়ে কিছুদূর এগোয়। তারপর বিদ্যুৎকে দেয়। বিদ্যুৎ আবার সাধ্যমতো চেষ্টা করে। শাহাদাতের কাছে সে হেরে যায়। শাহাদত পাঁচ/সাত হাত এগিয়ে বল সোজা পৌঁছে দেয় মিশুককে। এ খেলোয়াড়টি প্রতিপক্ষের কাছে সব সময়ই আতঙ্ক। কেননা নিখুঁত ড্রিবলিং তো আছেই। তার আরও দুটি গুণ হলো দৌড়ের অসাধারণ গতি এবং বাঁ পায়ে জোরে কিক দেয়ার ক্ষমতা। ফলে কী ঘটে? মিশুক যখন বল পায়ে বিপজ্জনক এলাকার দিকে ছোটে, তাকে ধরার জন্য পিছে/পিছে ছোটে দু’তিন জন। এক্ষেত্রে ফজলুই অগ্রণী ভূমিকা নেয়। আর মিশুক জানে, ফজলু যদি তাকে ধরে ফেলতে পারে তাহলে বল হাতছাড়া হয়ে যাবে।
এ মুহূর্তে লড়াইটা হচ্ছে মিশুক ও ফজলুর মধ্যে। রাইট-ইন পজিশন থেকে মিশুক বল নিয়ে দৌড়াচ্ছে। সে দৌড়াচ্ছে না যেন উড়ে চলেছে। প্রতিপক্ষের বাধাসৃষ্টিকারী অন্য প্লেয়াররা পিছিয়ে পড়ায় হাল ছেড়ে দিয়েছে। খেলা শেষ হতে আর এক মিনিট বাকি। এখন যারা গোল খাবে তাদের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত। দৌড়াচ্ছে রেফারিও। অন্যরা হতাশ হলেও ফজলু সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। সেও উর্ধ্বশ^াসে দৌড়াচ্ছে। উত্তেজনায় অস্থির দর্শককুল। গোল পোস্ট থেকে মিশুক এখন চৌদ্দ/পনেরো হাত দূরে। গোলকিপার চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ফজলু প্রায় ধরে ফেলেছে মিশুককে। আর এক সেকেন্ড। কিন্তু ওই এক সেকেন্ড সময় আর পায় না সে। এর ভেতর বল ডান পা থেকে বাঁ পায়ে নিয়ে সজোরে কিক করে মিশুক। শেষ মুহূর্তে সামনে এগিয়ে আসা একজনের কানের পাশ দিয়ে, গোলরক্ষকের কাঁধের ওপর দিয়ে বল সাঁ করে ঢুকে পড়ে জালের ভেতর। ততক্ষণে শেষ বাঁশি পড়ে গেছে। উল্লাসে ফেটে পড়েছে সমর্থকবৃন্দ। বন্ধুরা খুশির আমেজে দাঁড়িয়ে পড়েছে চেয়ারের ওপর। পটকা ফুটছে। মিশুক জার্সি খুলে বসে পড়েছে মাঠে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন ভক্ত। এরই মধ্যে মিশুক লক্ষ করে; তার বন্ধু ফজলু স্ট্রাইকার ফজলু দুঃখে-হতাশায় চিত হয়ে শুয়ে পড়েছে ঘাসের ওপর। তার দুই পা দুদিকে। দুই হাত দু’দিকে ছড়ানো। দু’ঠোঁটের মাঝখানে একটুকু ফাঁক।