শীতের দিনে ভ্রমণ খুবই আনন্দময়। আর এই আবহাওয়ায় যদি সাজেক যাওয়া যায় তাহলে তো কোনো কথাই নেই। তাই ঠিক করলাম আমরা আট বন্ধু মিলে সাজেক যাবো। আমাদের কথা আর কাজে আবার কোনো ভেজাল নাই। আজকাল শুনা যায় ট্যুরের প্ল্যান করা আর যাওয়ার মাঝে না-কি কয়েক বছরের গ্যাপ থাকে। তবে আমাদের আবার সেসব নাই। আমরা ভ্রমণের আলোচনা করে বেশি সময়ও নিইনি। দিন দুয়েকের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
সাজেক যেতে হলে খুব ভোরে খাগড়াছড়ি পৌঁছাতে হবে। তাই আমরা ঠিক করলাম সন্ধ্যায় খাগড়াছড়ি রওনা দিব। রাতে সেখানে কোনো এক হোটেলে থাকবো। এরপর সকাল সকাল রওনা দিব। আমরা ঠিক তা-ই করলাম। যেহেতু আমাদের সবার অফিস আছে তাই আমরা সবাই অফিস করে নিলাম।
অবশ্য ভ্রমণের আলোচনা করে এই দু’দিন ব্যাগটাও গুছিয়ে নিয়েছিলাম। মনে রাখবেন, ভ্রমণে যাওয়ার সময় যদি ব্যাগ গুছিয়ে না রাখেন তাহলে পরে ভ্রমণের আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। আমি আগের দিন রাতেই গুছিয়ে রেখেছিলাম, কারণ একবারে অফিস থেকেই রওনা দিব খাগড়াছড়ির বাসে। আমাদের সবার অফিস ৪টা থেকে ৬টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। সময়টা ছিলো ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি। আমরা সন্ধ্যা ৭টায় সবাই মিলে অক্সিজেন মোড়ে এক হলাম। সেখান থেকেই আমরা খাগড়াছড়ির গাড়িতে উঠবো। সাড়ে সাতটায় আমাদের গাড়ি।
গাড়িতে উঠেই যে যার মতো মোবাইল চালাচ্ছে। আমি আর আমার বন্ধু আবেদ একসাথে বসেছিলাম। তার আবার গান শুনার প্রচন্ড অভ্যাস। তবে দু’জনের রুচি ভিন্ন। সে যতটা আধুনিক গান শুনে আমি ততটা না। আমার গানে আবার দুঃখ বেশি। তবে সেদিন কেন জানি আমি আমার হেডফোন নিতে ভুলে গেছি। এজন্য ভ্রমণের আগে মনোযোগ দিয়ে ব্যাগ গুছানো উচিত। আমি সেটা পারিনি। বাকিরাও যে শতভাগ সফল তা নয়। তবে এই হেডফোনের আক্ষেপটা আমার কাছে গুরুতর নয়।
আমি যখন জানালার পাশে বসে বাইরের দৃশ্য দেখছি আবেদ বলে গান শুনবি?
আমি তাকে বলি, দে একটা। শুনে দেখি তুই কেমন গান শুনিস।
আবেদ আমাকে হেডফোনের এক অংশ দিলো। আমিও সেটা কানের মধ্যে গুঁজে দিলাম। আরেকটা অংশ তার কানে। এভাবে তার কাছে হেডফোন শেয়ার করে গান শুনতে বেশ মজাই লাগছিলো। তবে তার পছন্দের গানগুলো মোটেও মজার ছিলো না।
একটু পরই আবেদকে বললাম, এইসব গান আমার ভালো লাগে না।
আবেদ বললো, তাহলে কি গান শুনবি?
আমি বললাম, পিরান খানের গান।
আবেদ বললো, আমার কাছে নাই।
আমি আমার মোবাইলে আছে বলার পর দেখি সে তার মোবাইল থেকে হেডফোন খুলে নিয়ে আমার মোবাইলে লাগাতে বলে। আমি খানিকটা অবাক। সে প্রায় সময় এমন মানবিক হয়ে ওঠে আমাদের বন্ধুদের অবাক করে দেয়। হয়তো আমার হেডফোন নেই তাই এমনটা করছে। তবে সেদিন আমার মোবাইল থেকে পিরান খানের গান শুনিয়ে তাকেও পিরান খানের ভক্ত বানিয়ে দিলাম।
যাইহোক এভাবে করে আমরা পৌঁছালাম খাগড়াছড়ির শাপলা চত্বরে। খাগড়াছড়ির রাস্তার আঁকাবাঁকা পথ সত্যিই বেশ সুন্দর। তবে সামান্য ভয়ও লাগবে। বিশেষ করে প্রথমবার গেলে ভয় লাগবে একটু। তবে এটা যে সবার ক্ষেত্রে তা নয়। আমরা খাগড়াছড়ি পৌঁছেই সবাই মিলে হোটেল খুঁজলাম। হোটেল খুঁজতে বেশি সমস্যা পেতে হয়নি। খাগড়াছড়ির শাপলা চত্বরে বেশকিছু হোটেল আছে। সেখান থেকে একটা হোটেলে রুম বুক করে ফেললাম। আট বন্ধু মিলে থাকা যায় এমন আদর্শ একটা রুম আমরা পেয়েছিলাম খাগড়াছড়ি সদরে। যেহেতু আমরা এখান থেকে সকালেই চলে যাবো তাই কোনো রকম রাত কাটানোর জন্যই রুম নেওয়া। এজন্য আর বেশি রুম নেইনি। আপনারা চাইলে ভোরে ভোরে এসেও সাজেক যেতে পারেন খাগড়াছড়ি অবস্থান না করে।
আমরা হোটেলে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেতে গেলাম। খাগড়াছড়ি সদরে বেশ কিছু খাবারের হোটেল রয়েছে। মোটামুটি মানের খাবার পাওয়া যায়। সেখান থেকে সবাই রাতের খাবার সেরে নিলাম। এরপর আমরা বাইরে বেশি সময় ব্যয় করলাম না। কারণ আমাদের সকাল সকাল উঠতে হবে।
সকালে ৬টায় সবাই ঘুম থেকে উঠে গেলাম। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে হোটেলের চাবি ম্যানেজারকে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাজেকে যাওয়ার জন্য খাগড়াছড়ির শাপলা চত্বরে বেশ সুন্দর সিস্টেম চালু হয়েছে। এখন আর ড্রাইভারদের সাথে কথা বলে গাড়ি ঠিক করতে হবে না। নির্ধারিত গাড়ি ভাড়ার রেট দিয়ে কাউন্টার রয়েছে। তাদের কাছে রেট ভাড়া দিয়ে টিকিট কাটলেই হবে। তারা আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে মিট করিয়ে দিবে।
আমি আরেকটু পরিষ্কার করে বলছি। সাজেক গিয়ে একদিন থাকবেন পরের দিন সকালে রওনা দিবেন। এই আনা নেওয়ার ভাড়া হচ্ছে ৭৭০০ টাকা। এইরকম চার্ট সহকারে একটা কাউন্টার আছে খাগড়াছড়ি সদরে। সেখান থেকে আপনার পছন্দমতো সিলেক্ট করে আপনি সেই টাকা দিয়ে টিকিট কেটে নিতে পারেন। আপনাকে সাথে সাথে ওরা গাড়ির ড্রাইভার দিয়ে দিবে। ড্রাইভার আপনাদের নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রওনা দিবেন। আমরাও একই পন্থা অবলম্বন করেছি। ৭৭০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটেছি। আজকে সকালে রওয়া দিচ্ছি। আজ সারাদিন এবং রাত থেকে পরদিন সকাল ১০টায় ফিরবো। আমাদের প্যাকেজটা এমন। এর কম সময় এবং বেশি সময়ের প্যাকেজও আছে। আমাদের চান্দের গাড়ি এবং গাড়ির ড্রাইভার হাজির। এখন আমাদের সকালের নাশতা করার পালা। একটা হোটেলে প্রবেশ করে হালকা নাশতা করে নিলাম। তবে হোটেলগুলোর খাবার মান তেমন উন্নত নয় খাগড়াছড়িতে। তবুও মন্দের ভালো যতটুকু সম্ভব আমরা খেয়ে রওনা দিলাম।
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত সাজেক ইউনিয়নের একটি উপত্যকা সাজেক ভ্যালি। মাটির পাহাড় বেশি বৈচিত্র্যময়। তাই সাজেক ভ্যালি যেমন সবুজ তেমনি মেঘ মোড়ানো এক ঊর্বশী। জনপ্রিয় এই ভ্রমণ গন্তব্যটি তাই অন্য সব পর্যটন স্পট থেকে আলাদা। সাজেকের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙ্গামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা অবস্থিত। বলা যায় আমরা খাগড়াছড়ি থেকে রাঙ্গামাটির দিকে প্রবেশ করছি। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। সোজা রাস্তার হিসাব করলে প্রায় দুই ঘণ্টার পথ। কিন্তু এখানকার পাহাড়ি ভয়ঙ্কর পথ অনুযায়ী আরও বেশি লাগবে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভারও তেমনটাই বললেন।
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যাত্রায় অনুমতিপত্র নেওয়ার জন্য প্রথমে থামতে হবে দীঘিনালায়। সেখানে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প আছে। মূলত সেনাবাহিনী পর্যটকদের নিরাপত্তায় দিনে দুবার পর্যটকদের গাড়ি সাজেকে পৌঁছে দেয়। আমরা প্রায় সাড়ে ৯টার মধ্যেই পৌঁছে যাই দীঘিনালা ক্যাম্পে। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাছে তথ্য দিতে হয় এবং একটা অনুমতিপত্র নিতে হয়। সেই অনুমতিপত্র নিয়েছি আমি। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাটা যে কত বিরক্তির সেদিন দেখলাম। তবে এই নিরাপত্তার সিস্টেমটা খুবই সুন্দর। সেনাবাহিনী বলেই হয়তো সবাই লাইন মেন্টইন করেছে। আমি লাইনে দাঁড়িয়ে কাজটি সম্পন্ন করায় আমাকে বন্ধুরা একটা কোকাকোলা গিফট করে। সেইসাথে দীঘিনালা যেন ছোটখাটো একটা বাজার। এখানে নানা রকমের ফল, খাবার সবই পাওয়া যাচ্ছে। দেখতেও বেশ ভালো লাগছে।
এভাবে একসময় সকল গাড়ির কাজ সম্পন্ন হলে তারপর একসাথে সবাইকে ছাড়ে। আমাদের গাড়ি প্রায় ১১টার দিকে ছাড়লো। আমরা গান শুরু করলাম সবাই মিলে। সবুজে ঘেরা পাহাড়ি রাস্তায় সে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। দুদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। একবার গাড়ি উপরে উঠে আবার অনেক নিচে নামে। পাহাড়ি উঁচু-নিচু, আঁকা-বাঁকা পথ, তার সাথে কিছু ভয়ঙ্কর ওভারটেক মাঝে মাঝে বুকে কাঁপুনিও ধরিয়ে দেয়। কারণ রাস্তার দু পাশেই খাদ। এই খাদগুলো কত নিচে গেছে সেটা অনুমান করা যাবে না। তাই এসব ভাবলেই অনেকের ভয় লাগতে পারে। তবে ভয়ঙ্কর এবং মজার একসাথে কিছু চাইলে এই অ্যাডভেঞ্চরটা জীবনে একবার হলেও করবেন। এটা না গেলে কাউকে লিখে কিংবা বলে বুঝানো যাবে না। আপনি কিছুক্ষণ প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিমোহিত হতে থাকবেন। আবার উঁচু-নিচু পথে পরক্ষণেই চমকে উঠবেন।
আমরা অবশ্য ভয়ের চাইতে আনন্দই বেশি পেয়েছি। আমাদের কিছু কিছু বন্ধুর দিকে তাকালে মনে হয় তাদের হার্ট বলতে কিচ্ছু নাই। তারা চান্দের গাড়ির বাইরে ঝুলতে ঝুলতে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। আর গান তো চলছেই। আমিও কম যাইনি। মাঝে মাঝে আমিও সাহস করে বাইরে দাঁড়িয়েছি।
এভাবে একসময় আমরা পৌঁছালাম স্বপ্নের সাজেকে। মজার বিষয় হচ্ছে প্রথম এসেছি তাই নেমেই ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারিনি। চান্দের গাড়ি থেকে নেমে রিসোর্ট ঠিক না করেই ছবি তুলছি শুধু। পরক্ষণে রিসোর্ট খোঁজা শুরু করলাম। অনেক কষ্টে মোটামুটি মানের একটা রিসোর্ট পেলাম। এই রিসোর্টের অন্যতম সুন্দর আকর্ষণ ছিলো বারান্দা থেকে বাইরের ভিউটা উপভোগ করা যায়। ৫০০০ টাকা দিয়ে তিন বেডের একটা রুম বুক দিলাম। দাম বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে এই সময় সাজেকে পর্যটকে হিমশিম খায়। যাইহোক আমরা মোটামুটি টেনশনমুক্ত।
আপাতত পাহাড়ে দুচোখে ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করার মিশনে নামলাম। রিসোর্টের ঠান্ডা পানিতে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম দুপুরের খাবার খেতে। এখানকার কিছু ট্র্যাডিশনাল খাবার আছে। যদিও এখন ক্লান্ত। তাই ট্র্রাডিশনাল খাবারের অপেক্ষা করতে পারবো না। সবাই ক্ষুধার্ত। আমরা সাদা ভাত, আলুর ভর্তা, ডাল আর মুরগি দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।
কংলাক ঝরনা

খাবার খেয়ে আমাদের ভেতর দেখা দিলো মতানৈক্য! কেউ বলছে রেস্ট নিবে, কেউ বলছে ঝরনায় যাবে। অবশেষে আমরা আটজনের পাঁচজন ঝরনায় যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। নাহিদ, আবেদ, ফয়সাল ঘুমাবে। সাজেকে বেড়াতে এসে অনেকেই কংলাক ঝরনায় যেতে ভুলে যায়। আবার অনেকেই বিশ্রাম ও সময় স্বল্পতার কারণে যেতে পারে না। আমরা সেই ভুলটা করলাম না। বিশ্রামকে দূরে রেখে পা বাড়ালাম কংলাক ট্রেইলে।
সাজেকের রুইলুই পাড়ার দুই নম্বর হ্যালিপ্যাড থেকে সোজা নেমে গেলাম ট্রেইল ধরে। পুরো পথটা গহিন বনের মতো! সরু পথটা ক্রমাগত জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। কোনো রকমে পা ফেলে ফেলে পথ শেষ করতে হচ্ছে। শরীরটাও সামান্য ক্লান্ত। পুরোটা পথ ঘন জঙ্গল আর বড় বড় গাছে ভরা। পাহাড়ের গায়ে সবুজ আর হলুদ জুমক্ষেতের দৃশ্য দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। সেইসাথে আকাশের সাদা মেঘের দৃশ্যতো আছেই।
অনেক কষ্টে হাঁটতে হাঁটতে নিচে আসার পর মিলল শীতল জলের ঝিরি পথ। অন্যসব ঝিরির মতো এটাও পাথরে ঠাসা। দীর্ঘ পথ পাহাড় বেয়ে নামার পর ঝিরিটা দেখে মন্দ লাগলো না। দুটো পাহাড়ের মাঝখানে বয়ে যাওয়া ঝিরির পথে ধরে কিছুদূর হেঁটে গেলাম। আরও সামনে ছোট-বড় পাথর ডিঙিয়ে পানির স্রােত বয়ে যাচ্ছে উপর থেকে অনবরত। দু’পাশে জঙ্গলঘেরা গভীর খাড়া পথ বেয়ে উঠছি। কিছুদূর যেতেই কানে আসল ঝরনার তীব্র আওয়াজ। সেই শব্দ হাঁটার গতি যেন বেড়ে গেল আমাদের। উঁচু-নিচু পাহাড় বেয়ে নামতেই বড় পাথর ডিঙিয়ে চোখ পড়ে দীর্ঘ ঝরনার দিকে।
উঁচু পাহাড়ে খাঁজ বেয়ে উপর থেকে দু’ভাগে পড়ছে ঝরনা। তীব্র শব্দ ঘিরে রেখেছে এই অচেনা পরিবেশ। সুনসান নীরব পাহাড়ের মধ্যে একমাত্র শব্দ যেন এই জলের ধারা। অনবরত উপর থেকে বয়ে আসা এই পানির স্রােত বন্দি করে নিলো সবার নজর। পুরোটা পথের ক্লান্তি দূর করলাম এই জলের স্রােতে। নিচ থেকে উপরের দিকে তাকাতে ঝরনাটাকে বড়ই বিস্ময় মনে হলো। মেঘে ঢাকা এমন একটা বিস্তৃত ভ্যালির বুকে এমন ঝরনা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। পৃথিবীর আলো এখানে খুব কমই পড়ে বলে মনে হয়। বিকেল হতে হতে আলো যেন বিদায় জানাতে থাকলো ঝরনার উপর থেকে। পাহাড়ের দেয়াল আটকে দিচ্ছে সূর্যের আলোকরশ্মি। আলোর সময় ফুরাবার আগে আগেই এই দীর্ঘ ঝরনাকে পেছনে ফেলে রওনা হলাম। ফিরতে ফিরতে মনে প্রশ্ন জাগলো, আরও কত কত এমন ঝরনা আছে দেশে।
সাজেকের রাত

ফিরতে ফিরতে সূর্য বিদায় নিয়েছে। সূর্য অস্ত যাওয়াটাও দেখতে পেয়েছি। বেশ সুন্দর একটা দৃশ্য। এরপর আমরা সাজেকের এক নম্বর হ্যালিপ্যাডে বসলাম। বাকি তিনজনও আসলো। আমরা সবাই মিলে সন্ধ্যায় সেখানে বসে কিছু সময় কাটালাম। সময় যত গড়ায় হ্যালিপ্যাডে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। সেইসাথে মশার পরিমাণও বাড়তে থাকে।
ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় হ্যালিপ্যাডে বসে থাকতে বেশ ভালো লাগছে। তবে অল্প সময় পর আমরা সবাই মিলে চা পান করলাম। বাঁশের চা বলে এটাকে। পান করলাম, তবে খুব একটা যে স্বাদ পেয়েছি তা নয়। এরপর আমরা ঠিক করলাম আমরা ব্যাম্বু চিকেন খাবো। তাই অর্ডার দিলাম একটা হোটেলে। ঘণ্টা দুয়েক পর বোধ হয় আমরা খাবারটা পেয়েছিলাম। অসাধারণ একটা খাবার ছিলো। এখনও মুখে লেগে আছে সেটা।
এরপর আমরা আবারও হ্যালিপ্যাডে গিয়ে বসলাম। প্রায় রাত ৯টা বাজে। হ্যালিপ্যাডে মানুষ অনেক। সবাই গোল করে বসে বসে আড্ডা দেয় আর গান গায়। আমরাও কিছু সময় বসে ছিলাম। যারা গান গাইছে তাদের গান শুনছিলাম। এটাও এক অন্যরকম অনুভূতি। আমরা আড্ডা দিতে দিতে রাত ১২টা পেরিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকজন বলছে ডিনার করবে। ব্যাম্বু চিকেন খেয়ে আমার ক্ষুধা মিটে গেছে। তবে সবাই যখন খাবে অগত্যা আমিও অল্প করে খেলাম। রাতেও সেই দুপুরের খাবার খেলাম। এখানকার খাবার আবার প্যাকেজ সিস্টেম। মাংস, ভাত, ডাল, সবজি ১৬০ টাকা। ডিম, ভাত, ডাল, সবজি ১২০ টাকা। ভাত, ডাল, সবজি ৯০ টাকা। একেক দোকানে আবার একেক রেট।
এরপর আমরা আবারও চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছি। আর রাতের সাজেক উপভোগ করছি। রাতের সাজেক এক অন্যরকম সৌন্দর্য। সব ভ্রমণপ্রিয়রা রাতে একে একে বেরিয়ে আসছে রুম থেকে। কারও হাতে গিটার, কেউ আবার প্রিয় জনের হাত ধরে হাঁটছে। কেউ হইচই, কেউ গান, কেউ আড্ডা দিচ্ছে। হ্যালিপ্যাডে দাঁড়িয়ে আনমনে পাহাড়ের গভীর খাদের দিক তাকিয়ে থাকতেও অদ্ভুত একটা সুন্দর লাগছে।
কিছু বন্ধু ঘুমাতে গিয়েছে। আমরা কয়েকজন আর ঘুমাচ্ছি না। একবারে সাজেকের ভোর উপভোগ করে ঘুমাবো। সাজেকের ভোর যারা মিস করবেন তারা মূলত সাজেকের মূল সৌন্দর্যটাই উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হবে। আমরা কয়েকজন তাই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আড্ডা দিতে লাগলাম। আস্তে আস্তে রাত ২টার পর সবকিছু নিস্তব্ধ হতে লাগলো। আমরা তিনজন বাইরে বসে বসে আড্ডা দিই, আর ছবি তুলি।
সাজেকের সকাল

আগেই বলেছি সাজেকের ভোর মিস করা যাবে না। সাজেকের ভোরের সাথে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। সারারাত আড্ডা দিয়ে ভোর সাড়ে চারটার দিকে হ্যালিপ্যাডে গিয়ে অবস্থান করছিলাম। সেখানে গিয়ে তো অবাক। অনেকেই এখানেই রাত পার করে দিয়েছে! আমরা রুমে যেসব বন্ধু আছে তাদের ফোন করে জাগিয়ে দিলাম। ঘুম ঘুম চোখে তারাও চলে এলো।
হ্যালিপ্যাডে দাঁড়ানোর সাথে সাথে হিমশীতল একরাশ বাতাস এসে ছুঁয়ে যায় শরীর, স্নিগ্ধ করে মন। কুয়াশার চাদরে পাহাড় যেন নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পাহাড় পারে না তার সৌন্দর্য লুকাতে। কুয়াশা ভেদ করে চোখ খুঁজে নেয় তার সৌন্দর্য। সেইসাথে মেঘের সাদা ভেলা যেন আমাদের হাতের কাছে চলে আসবে। নিজ চোখে না দেখলে সেটা বুঝানো মুশকিল। সূর্য উদিত হওয়ার দৃশ্যটাও সুন্দর। তাই দাঁড়িয়ে রইলাম তার অপেক্ষায়। আর চারদিকে দেখতে থাকলাম প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। এভাবে কেটে গেলো বেশ কিছুক্ষণ। সূর্যিমামা উঠে পড়লো। তার রক্তিম আলো পাহাড়ের গায়ে পড়তেই আড়মোড়া ভাঙে সবুজ পাহাড়। হেসে ওঠে সূর্যের সঙ্গে। কি অদ্ভুত দৃশ্য। ভাবতেই অবাক লাগে! সৃষ্টিকর্তা কি সুন্দর করে সাজিয়েছেন এই পৃথিবী।
আমরা ভোর সাতটার দিকে রুমে গিয়ে রেস্ট নিলাম। আমি রেস্ট নিতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি আমিও বলতে পারি না। এদিকে সবাই চলে যাওয়ার জন্য আমাকে ডাকছে। ঘুম থেকে উঠে দেখি সবাই রেডি। সকাল দশটা বেজে গেছে। আমিও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম।

ফেরার পালা

সাজেকে আসার চেয়ে যাওয়ার যাত্রাটা বেশ সুন্দর। ফেরার সময় এখানকার ছোট ছোট শিশুরা হাত নেড়ে অভিবাদন জানায় পর্যটকদের। কী দারুণ যে দেখতে লাগে। পাহাড়ি এই অঞ্চলে ঘনবসতি নেই। কিছুদূর পর পর রাস্তার পাশে চোখে পড়ে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দাদের বাড়ি। এই রাজ্য শুধু তাদেরই। এখানে নেই কোলাহল, নেই যানজট, নেই আধুনিকতা। আছে শুধু শান্তি। চিন্তা অবশ্য একটা আছে, সেটা হচ্ছে টিকে থাকার।
ফেরার পথে ছোট ছোট শিশুরা যখন অভিবাদন জানায়, তখন পর্যটকরা চকোলেট, চিপসের মতো সামান্য উপহার ছুড়ে মারেন। এটাই সৌন্দর্য। এই ছোট ছোট আদিবাসীর সন্তানরা এসব পেয়ে দারুণ খুশি হয়। আর পর্যটকরাও তাদের হতাশ করেন না। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিক থেকে শিশুদের এসব উপহার দেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। কারণ এসব উপহার কুড়াতে গিয়ে দ্রুতগতির গাড়িতে শিশুদের দুর্ঘটনায় পড়ার আশঙ্কা থাকে। এর আগে দুর্ঘটনা ঘটায় এমন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। সেইসাথে পাহাড়ের এই রাস্তা বেয়ে আমাদের গাড়ি যেন আগের চেয়ে আরও বেশি গতিতে নামছে। এভাবে পথের অ্যাডভেঞ্চার শেষ করে দুপুরে পৌঁছালাম খাগড়াছড়ি। সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাজেককে বিদায় দিয়ে আসতেই ইচ্ছে করছে না।
খাগড়াছড়ি নেমেই আমি খাবারের জন্য তাড়া দিতে থাকলাম বন্ধুদের। আমি সকালে নাশতাও করিনি। সবাই মিলে দুপুরের খাবার খেয়ে গাড়িতে উঠলাম। আর ফিরে এলাম চট্টগ্রামে।

কিভাবে যাবেন?

প্রথমে খাগড়াছড়ি : আপনি যদি ঢাকা হতে আসেন তাহলে শান্তি, হানিফ, এস আলম, শ্যামলী, ইকোনো এবং ঈগল পরিবহনের এসি/নন-এসি বাসে চড়ে সরাসরি খাগড়াছড়ি আসতে পারবেন। বাস ভেদে জনপ্রতি ভাড়ার পরিমাণ নন এসি ৫২০ টাকা এবং এসি ৮৫০ থেকে ১২০০ টাকা।
এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে যেতে চাইলে চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় থেকে বিআর টিসি ও শান্তি পরিবহনের বাস খাগড়াছড়ি ছেড়ে যায়। সকাল ৭টা থেকে শান্তি পরিবহনের বাস ১-২ ঘণ্টা পরপর ছেড়ে যায়। এছাড়া বেশ কিছু লোকাল বাসও খাগড়াছড়ি যায়। নন-এসি এইসব বাসের ভাড়া ১৮০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে। চট্টগ্রাম থেকে যেতে সময় লাগবে ৪-৫ ঘণ্টা।

খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক : জিপ সমিতি ও পার্বত্য যানবাহন মালিক কল্যাণ সমিতি কর্তৃক খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যাওয়ার ভাড়ার তালিকা করেছে। সেখানে সাজেক দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসার গাড়ি ভাড়া নিচ্ছে ৬,০০০ টাকা। পিকআপ ও চান্দের গাড়ি উভয়ের ভাড়া একই এক্ষেত্রে। তবে সাজেকে এক রাত্রি যাপন করে ফিরতে গেলে পিক আপের ভাড়া ৮,৩০০ টাকা এবং চান্দের গাড়ির ভাড়া ৭,৭০০ টাকা। সাজেক দুই রাত্রি যাপন করে ফিরতে গেলে পিক আপের ভাড়া ১১,১০০ টাকা এবং চান্দের গাড়ির ভাড়া ৯,৬০০ টাকা।
এছাড়া আপনি যদি একা বা ২-৩ জন হন তাহলে খাগড়াছড়ি শাপলা চত্বর থেকে অনেক গ্রুপ পাওয়া যায়, সেখানে অন্য গ্রুপের সাথে কথা বলে তাদের সাথে শেয়ার করে যেতে পারবেন অথবা জিপ সমিতির অফিসে গেলে ওরা ম্যানেজ করে দিবে অন্য কোনো গ্রুপের সাথে।

কোথায় খাবেন
সাজেকে এখন ভালো ভালো খাবারের হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট আছে। আদিবাসীদের পরিচালিত বিভিন্ন দোকানও আছে। প্রায় সবধরনের খাবার সেখানে পাবেন। তবে মান ভেদে দামের তারতম্য আছে।

কোথায় থাকবেন
সাজেকে থাকার কটেজ, রিসোর্ট সহজেই পাওয়া যায়। তবে আপনি যদি শীতের সময় এবং ছুটির সময় যান তখন আগে থেকে বুকিং করে যেতে হবে। অনেক সময় বুকিং করে না গেলে রুম পাওয়া যায় না। কদচিৎ একটা পেলেও দাম যা হাঁকাবে তা আপনার পুরো ভ্রমণের বাজেটেও হবে না। তাই হিসাব করে যেতে হবে। সাধারণ সময়ে ৫০০ টাকা থেকে রুম পাওয়া যায়। আর দামি রিসোর্ট যতটুকু খুঁজতে চান ততটুকুই পাবেন।

Share.

মন্তব্য করুন