বাংলায় এবারও নাম্বার কম পেয়েছে হৃদি। কম মানে খুবই কম, টেনে টুনে পাস। অথচ ইংরেজি অঙ্কসহ অন্য বিষয়ে নাম্বার অনেক বেশি। সালমা বুঝে উঠতে পারে না, কী করলে মেয়ের বাংলার অবস্থা উন্নতি হবে। নিজেই মেয়েকে পড়ায়। ইংরেজি অঙ্ক যেমন সহজে রপ্ত করতে পারে হৃদি, বাংলা তা পারে না। বাংলা পড়ার ব্যাপারে তেমন আগ্রহও নেই মেয়ের। পড়াতে গেলে একটুতেই ক্লান্ত হয়ে ওঠে। বলে, ‘বাংলা খুব কঠিন মা। আমি বাংলা পড়তে চাই না। তুমি কেন জোর করো। আমি অন্য বিষয় আরও ভালো করে বাংলার ব্যাপারটা পুষিয়ে দেব।’ সালমা হাল ছাড়ে না। মেয়ের আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে ধৈর্যের সাথে পড়ায় প্রতিদিন, কিন্তু কোনোই লাভ হয় না। তাই এবারও টেনে টুনে পাস।
গুম হয়ে বসে থাকে সালমা। কারো সাথে কথা বলে না। হৃদি স্কুল থেকে এলে সালমা বরাবর ভাত বেড়ে দেয়। এটা ওটা পাতে তুলে খাওয়ায়। মাঝে মাঝে বিরক্তও হয় হৃদি। আর না মা, আর কত দেবে। না না মা, সবজি আমার ভালো লাগে না। আর দিও না।
আজ সালমা ওঠে না। খাবার দেয় না মেয়েকে। হৃদি কাপড় ছেড়ে হাত ধুয়ে খাবার টেবিলে এসে দেখে মা নেই। মাকে খুঁজতে গিয়ে দেখে ড্রইংরুমের সোফায় গুম মেরে বসে আছে মা। হৃদি ডাকে,
: ক্ষুধা লেগেছে মা। খাবার দাও।
: খাবার দেয়া আছে, নিয়ে খাও।
খাও শব্দটা চট করে কানে লাগে হৃদির। মা তাকে বরাবর তুই করে বলে। আজ কেন হঠাৎ তুমি?
হৃদি আবারও ডাকে
: তুমি না দিলে আমার ভালো লাগে মা, পেট ভরে না।
: তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছ, নিজেই নিয়ে খেতে পারো। নিজে নিয়ে খাও।
এবার হৃদি সত্যিই অবাক হয়। সে বারবার খাবার চাচ্ছে অথচ মা আসছে না এমন ঘটনা কখনই ঘটে না। হৃদি মার কাছে যায়।
: কী হয়েছে মা, তোমার কি শরীর খারাপ? মুখ শুকনো লাগছে কেন?
: বললাম তো কিছু হয়নি।
: তাহলে চলো আমাকে ভাত দেবে।
: বিরক্ত করছ কেন? বললাম না নিয়ে খেতে।
রীতিমতো ধমকে ওঠেন মা। এমন ধমকের সাথে মোটেও পরিচিত নয় হৃদি। সে বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। বড়ই আদরের। সবসময় আদর পেয়েই সে অভ্যস্ত। ঠোঁট ফুলে উঠল তার। চোখ দিয়ে পানি নামে। ফোঁফাতে ফোঁফাতে দৌড় দিয়ে ঘরে চলে যায়।
সালমা দেখল কিন্তু কিছুই বলল না। মেয়েকে ডেকে আনার প্রবৃত্তিও তার হলো না। সে বুঝে উঠতে পারে না আজকালের বাচ্চাদের মাতৃভাষার উপর কোনো আগ্রহ নেই কেন! সে নিজে তো কোন ছেলেবেলাতেই গড়গড় করে রবীন্দ্রনাথ নজরুল সুকুমারের রায়ের কবিতা/ ছড়া বলতে পারত। ছড়া কবিতা পড়ে বড়ই আনন্দ পেত। শুধু সে কেন, তার সময়ের সব ছেলে মেয়েই একরকম ছিল। তারা প্রচুর বই পড়ত। এখনকার মতো তখন এত লাইব্রেরি ছিল না। কোনো বাড়িতে একটা বইয়ের খোঁজ পেলে নিজে এনে পড়ত, বন্ধুবান্ধবকে দিতো। দেখা যেত একটা বই পুরো গ্রামের মানুষ পড়ছে। তার মেয়ে না জানে একটা ছড়া না একটা কবিতা। অসংখ্য রাইম মুখস্থ। পড়–ক, বলুক, আপত্তি নেই সালমার কিন্তু বাংলা ছড়া কবিতাই বা বলতে পারবে না কেন!
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। সালমা ওঠে না, হৃদিও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে না, খায় না। বিকেলে হৃদির আব্বা তৌফিক বাড়িতে এসে সালমার মুড দেখে অবাক হন। এদিক ওদিক তাকিয়ে হৃদিকে দেখতে পান না। টেবিলের উপর ভাত তরকারি পড়ে আছে। কেউ খেয়েছে বলে মনে হয় না। বলেন,
: হৃদি কোথায়?
সালমা জবাব দেয় না। তৌফিক ঘাবড়ে যায়। নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কিছু হয়েছে! হৃদি কি পরীক্ষায় খুবই খারাপ করেছে!
: আজ হৃদির হাফইয়ারলি পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ার কথা ছিল না?
: মনে আছে তাহলে!
: রেজাল্ট কী খুব খারাপ হয়েছে?
: না, সেকেন্ড হয়েছে।
: তাহলে তোমার মুড অফ কেন? গতবার তো ও ফোর্থ হয়েছিল।
: এক সাবজেক্টে ফেল করে যদি কেউ দ্বিতীয় হয় তাতেও কি মুড ভালো থাকার কোনো কারণ আছে?
: এক সাবজেক্টে ফেল করলে কেউ দ্বিতীয় হয় না।
: ওই একই কথা। তোমার মেয়ে বাংলায় পঁয়ত্রিশ পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছে।
: এটা অবশ্য খুবই খারাপ কথা! তবে এখন এ বিষয়টা নিয়ে অশান্তি করো না। বরং ও বাংলায় যাতে আরও ভালো করে সেই চেষ্টা করো।
: আমার সব চেষ্টা শেষ। অশান্তিও করব না, চেষ্টাও করব না। বুঝেছ?
তৌফিকের জোরাজুরিতে এবার উঠে সালমা। মেয়েকে ডাকে। ওকে নিয়ে খেতে বসে। এটা ওটা ওর পাতে তুলে দেয়। তবে বারবার ঝাপসা হয়ে ওঠে সালমার চোখ।
মুখে যাইই বলুক মেয়েকে ভালোভাবে বাংলা শেখাবার জন্য এবার মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে সালমা। বাংলার ব্যাপারে মেয়ের আগ্রহ বাড়াবার জন্য নানান ধরনের বই কেনে। মেয়েকে পড়ে পড়ে শোনায়। মেয়ে যাতে নিজেই লিখতে পারে সেজন্য বলে,
: দেখ সব ব্যাপারে নোট বই এর সাহায্য নিস না। নিজে নিজে লেখার চেষ্টা কর। তুই এক কাজ করবি প্রতিদিন যে কোনো বিষয়ে পনেরো লাইন করে লিখবি। একদম নিজে নিজে। কারো সাহায্য নিবি না। না কোনো বই, না অন্য কিছু। আজকে তোর লেখার বিষয় একুশে ফেব্রুয়ারি।
সালমা মেয়েকে একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে ধারণা দেয়। সালাম রফিক বরকত জব্বার আর অন্যান্য ভাষা শহিদদের বীরত্বের কথা বলতে গিয়ে তার গলা ধরে আসে। এক পর্যায়ে একুশের কাহিনি শেষ করে সালমা হৃদিকে বলে,
: এবার লেখ। মন দিয়ে লিখবি কেমন? তোকে সময় দিলাম এক ঘণ্টা। পনেরো লাইন লেখার জন্য এক ঘণ্টা অনেক সময়।
এক ঘণ্টা পর হৃদি যা লিখে দেয় তা পড়ে সালমার চোখে পানি আসে। একি লেখার ছিরি! না হয়েছে বাক্যগঠন, না বানান, না আছে বিষয়বস্তু! একুশে ফেব্রুয়ারি শব্দ দুটো পর্যন্ত সঠিকভাবে লিখতে পারেনি। লেখা পড়ে আবারও গুম হয় সালমা। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে নেয় হৃদি। ভয়ে মায়ের কাছে ঘেঁষে না।
অনেকক্ষণ বসে থেকে সালমা ঘরে যায়। ড্রয়ার টেনে খোলে। একটা ছবি বের করে ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। আঁচল দিয়ে ছবি মোছে, বারবার চোখ মোছে। রাত বাড়ে।
আজ বাড়িতে হৃদি আর তার মা। আব্বা অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গেছেন। আব্বা বাড়িতে না থাকলে হৃদি মায়ের কাছে ঘুমায়। মাকে ডাকতে সাহস হয় না হৃদির। একাই খেয়ে নেয়। তারপর ভয়ে ভয়ে মায়ের ঘরে ঢোকে। ঘুমে ঢুলছে সে। সকালেই মাকে বলে রেখেছিল, তার সাথে ঘুমাবে। মাও খুশি মুখে বলেছিলেন, অবশ্য অবশ্যই তুই আমার সাথে ঘুমাবি। তারপর রচনা লেখাকে কেন্দ্র করে আবহাওয়া বদলে গেছে। হৃদি গুটি গুটি পায়ে মায়ের ঘরে ঢুকে দেখে মা টেবিলের উপর চোখ রেখে অপলকে একটা ছবি দেখছেন আর বারবার চোখের পানি মুছছেন। হৃদি মায়ের চোখে পানি দেখে ভয় ভীতি ভুলে যায়। দৌড়ে মার কাছে যায় সে। মার হাত ধরে বলে,
: কী হয়েছে মা, কাঁদছ কেন, এটা কার ছবি?
মেয়ের উৎকণ্ঠা আর দরদি হাতের স্পর্শে সালমাও ভেঙে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
: এটা তোর নানাভাই-এর ছবি। তোর নানাভাই একজন ভাষাসৈনিক। ভাষাসৈনিক বুঝলি না তাই না? ভাষার জন্য যারা লড়াই করেছিলেন তাঁদের বলে ভাষাসৈনিক। আর যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন তাদের বলে ভাষাশহিদ। তোর নানা মানে আমার আব্বা তেমন একজন ভাষাশহিদ। ’৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঘোষণা করল, ‘উর্দু অনলি উর্দু উইল বি দি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান’ তখন গর্জে উঠেছিল ভাষাপ্রেমী বাঙালিরা। এ কী ধরনের নির্যাতন! জন্মের পর প্রথম যে ভাষায় মাকে ডেকেছে সে ভাষা হবে না তার মাতৃভাষা! মাতৃভাষা হবে দেড় হাজার মাইল দূরের অবাঙালিদের মুখের ভাষা! শুরু হয় মিটিং মিছিল সংগ্রাম। আর তারই ধারাবাহিকতায় একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে পাকিস্তানিদের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করল ছাত্ররা। গুলি চলল ছাত্রদের উপর। ঝরে পড়ল অনেকগুলো তাজা প্রাণ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সালাম বরকত রফিক জব্বার। ছিলেন আরও কত নাম না জানা সৈনিক। সেই সব মিটিং মিছিলের শীর্ষে থাকতেন তোর নানা শহিদ মফিজুর রহমান। ২১ ফেব্রুয়ারি অন্য ভাষাসৈনিকদের সাথে শহিদ হন তিনিও। গ্রামের ছেলে ছিলেন আমার আব্বা। দাদা দাদির ইচ্ছেয় অল্পবয়সে বিয়ে করেছিলেন। আমি তখন মায়ের গর্ভে। আব্বাকে দেখিনি। তবে আব্বার বীরত্বের কাহিনি শুনে বড় হয়েছি। গ্রামের মানুষ আলাদা চোখে দেখত আমাদের, সম্মান করত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার মাকে ডেকে মালা দিতো। আব্বার সম্পর্কে বক্তৃতা হতো।
তারপর একসময় দেশ স্বাধীন হলো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর আমার বিয়ে হয়। মা অনেক কষ্টে আমাকে মানুষ করেছেন। তার সবসময় গর্ব ছিল তিনি একজন ভাষাসৈনিকের স্ত্রী। আমিও গর্বিত এজন্য যে, আমি একজন ভাষাসৈনিকের সন্তান। আর সেই আমার মেয়ে তুই যার নানা বাহান্নর মহান ভাষা আন্দোলনে জীবন দিয়েছেন, সে বাংলায় পঁয়ত্রিশ পায়। বাংলা পড়তে চায় না। এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে! মা চোখ মুছে দ্রুত ছবিটি ড্রয়ারে রেখে বিছানার দিকে এগোয়। হৃদি বলে,
: মা আমি নানার ছবিটা দেখতে পাইনি, দেখব। আমাকে একটু দেখাও।
: না, এ ছবি তারাই দেখতে পাবে যারা বাংলায় ভালো করবে।
সালমা শুয়ে পড়ে। হৃদি নানার মুখটা দেখতে পায়নি। ওর ইচ্ছে ছিল হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ছবিটা দেখার। মা দেখতে দিলো না ছবিটা!
হৃদি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এতক্ষণে তার সব ঘুম কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সে মার পাশে শোয়, কিন্তু ঘুম আসে না।
ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। সালমা নিশ্চিত জানে এবারও বাংলায় খারাপ করবে হৃদি। হয়ত পাসই করবে না। স্কুল থেকে ফেরে হৃদি। পায়ে পায়ে মার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সালমা কথা বলে না। কাজের অছিলায় সরে যায়।
: মা নানাভাই-এর ছবিটা একটু দেখাবে আমায়?
: ওই ছবি তুই সেদিনই দেখতে পাবি যেদিন বাংলায় ভালো করবি।
: দেখাও না মা!
: বলছি তো, না।
চিৎকার করে ওঠেন মা।
হৃদি রেজাল্ট শিট মেলে ধরে। বাংলা লেখা কলামটার উপর চোখ আটকে যায় সালমার, ৮৪।
সালমা হৃদিকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে ড্রয়ার থেকে টেনে বের করে ভাষাশহিদ বাবার ছবিটা!
Share.