বাংলাদেশের প্রকৃতির রাজ্যে আবির্ভাব ঘটে মধু বসন্তের। বসন্তের আগমনে উদ্ভিদ জগতে নতুন প্রাণের স্পন্দন জাগে। নিষ্পত্র বৃক্ষরাজি হেসে ওঠে নতুন সাজে। উদম গায়ে নতুন পোশাক পরে ছড়িয়ে দেয় শীতল বাতাস, ঋতুর আবর্তনের মাধ্যমে বিচিত্র রূপসুষমায় আখ্যায়িত হয় রূপসী বাংলা।
বসন্ত এলে রঙে রঙে মাতে
পলাশ শিমুল ডালে
আমের বাগান পুলকিত হয়
পাখির গানের তালে।
বসন্ত এলে ফুলে ফুলে ভরে যায় বাগান। সকাল হলে ফুলের মৌ, মৌ গন্ধে ভরে যায়। গাছে গাছে ফোটে আমের মুকুল। পাখিরা আনন্দে গান গায়, এ ডাল থেকে ওডালে উড়ে বেড়ায়। সে কি যে মধুময় তা একবার উপভোগ না করলে বুঝাই যাবে না, তোমরা একবার গায়ে গিয়েই দেখোনা বসন্তের সকাল কত সুন্দর, মধুময়। শীতে সকল গাছের পাতা ঝরে যায়, এক পায়ের ওপর হাত পা মেলে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বস এলেই আসে তাদের পরিবর্তন। নতুন পাতা গজাতে থাকে। তখন বাগানে বাগানে হাসি ফোটে বয়সী গাছ গাছালির। যেমন ধরো গগন শিরীষ, দেবদারু, রেইনট্রি, রক্ত কাঞ্চন, হিজল, কদম আরো কত কী। তখন ঝুমকো লতা, মধু মঞ্জুরি শোভা পায় বাগানে। ছোটবেলায় কত দেখেছি বসন্তের সকাল, ঘুম থেকে ওঠেই বের হতাম ফুল লতা গুল্মের দর্শনে। তখন সোনালু গাছের হলুদ ঝলকের, দুলানি দেখে মন উদাস হয়ে যেতো।
ভেসে এসে হাওয়ায় হাওয়ায় দূর হতে ঐ দূর
প্রাণ ভরে দেয় রাখালিয়ার করুণ বাঁশির সুর
সজনে গাছে পিক পাপিয়ার সুরের গুঞ্জরণ
হনাল ফুলের হলদে রঙে জুড়ায় সবার মন।
বাগানে গেলে দেখবে মৌমাছির গুনগুন শব্দ এ ফুল থেকে ও ফুলে ওরা নাচানাচি করছে। করছে ফুলের সাথে মিতালি। তখন প্রজাপতিরাও বসে থাকে না। তারাও ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায়। বাগানে হাসি ছড়ায় রক্তকরবী কবি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘রক্তকরবী’ নায়িকা নন্দিনীর মতো যেন ছোট্ট টুনটুনিটি ফুলের গন্ধ নিচ্ছে। রক্তকরবীর ফোটে উঁচু ঝোপালো গাছে। সুগন্ধি সুন্দর দর্শন। গাছে গাছে ফুটে গোলাপ, জবা, কাঠালচাঁপা, অদ্ভুত কড়া গন্ধে ভরে যায় সারা বাগান। এই নিয়েই কবি লিখেন-
আব্বু বলেন পড়রে সোনা
আম্মু বলেন মন দে
পাঠে আমার মন বসেনা
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
কাঁঠালচাঁপার গন্ধ কেমন জানো? অনেকটা পাকা আতা আর পাকা মাঝামাঝি একটা মাদকতাময় গন্ধ। বসন্ত না এলে এসব মোটেও বুঝা যাবে না। সবুজের ছায়া ঘেরা আমাদের এই সোনার দেশ। গাছপালা, পশুপাখি আর নানা রকম প্রজাপতি আমাদের দেশকে দান করেছে অপূর্ব মায়াময় রূপ। ফুলে ফলে কেমন সাজানো বাগান। বসন্ত এলে সবার চোখ আটকে থাকে ফুলের গায়ে। তখন পুকুরে পদ্মফুলেরা কি মমতায় আকাশ দেখে। শান্ত পুকুরে মাছরাঙারা টুপ করে খাবার ধরে লুকিয়ে যায় গাছের কোঠরে। আকাশে আকাশে উড়ে বেড়ায় গাংচিল। গান গায় টুনটুনি। বসন্তের অজস্র দুপুর কেটেছে পশ্চিম দিকের খোলা মাঠে। দুপুরে পুকুরে সাঁতার কাটা, টকটকে লাল চোখে বাড়ি ফিরে আব্বার অধিকতর রক্তচক্ষুর ভয় দাদুর শৌখিন আলতো করা লাঠির ঘা পিঠে পড়েছে। বিকেল হওয়ার অনেক আগেই মায়ের পাশ থেকে বিছানা ছেড়ে চুপি চুপি উঠে এসে অপেক্ষমাণ দুষ্ট ছেলেদের সাথে মেশা, সে যে কতো স্মৃতি, কতো কথাই না মনে পড়ে। চোখ বুজলেই নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা নিয়ে ওসব স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। বুকের ভেতর বেদনার বিউগল বেজে ওঠে- স্মৃতির সাগরে ঢেউ ওঠে বারবার সেই দুরন্তপনার। এখনো দূরের কোনো এক গাঁয়ের মাঠ থেকে বসন্তের দুপুরের সেই বাঁশির সুর, আর কুটুমপাখির ডাক কেবলই ডাকে। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই গান-
পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়
ওসে চোখের দেখা প্রাণের দেখা সে কি ভোলা যায়।
বসন্তের পড়ন্ত বিকেল। সূর্য তার রশ্মিকে সোনালি চাদরে মুড়িয়ে দেয় রূপসী বাংলাকে। এ সময় কখনো শরীরে রোদ লাগিয়ে দেখেছো কেমন লাগে? খুব মজা তাই না? বিকেলে রোদের আলতো উষ্ণতা বড়ই আরামদায়ক। তখন প্রকৃতি যেন সূর্যের আলোতে মিশে একাকার হয়ে যায়। আলতো রোদের রেশমি চাদর সারা গায়ে আরামের পরশ ভুলিয়ে দে, তখন নিজেকে স্বপ্নপুরীর বাসিন্দা বলে মনে হয়। উদার আকাশ তখন নীল টুপি পরে দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে হাসতে হাসতে বিদায় নেই সূর্য।
কাশের বনে চাঁদনী রাতে নাড়ায় মাথার চুল
নীল আকাশে আলোর জোয়ার নিঝুম নদীর কূল।
বসন্তে জোছনা রাত দেখেছ কখনো? একবার গ্রামে গিয়ে উপভোগ করেই আসো না। দেখবে কত মধুর জোছনা রাত। চারপাশে শব্দহীনতা জুড়ে আছে। তখন একটা অস্পষ্ট মায়ালোকে ডুবে যায় প্রকৃতি। এক অনাবিল সৌন্দর্য সর্বত্র বুলিয়ে যায় কোমল স্পর্শ। নদীতে উত্তাল তরঙ্গ নেই। নেই উদাম স্রোত। হালকা বাতাস কাশের বনে ঢেউ ফেলে যায়। মাঝরাতে মাথার ওপর চাঁদের আলো খাড়াভাবে নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। যেন বিশাল আসমানের গায়ে গোলাকার একটা বৈদ্যুতিক বাল্ব ঝুলে আছে। পুকুরের পানিতে হালকা ঢেউয়ের কুচি, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে অবাধ চন্দ্রলোক। তখন ফুরফুরে বাতাস প্রকৃতির উপর জোছনার আলো বুলিয়ে দেয়া যেন অতিরিক্ত পাওনা। বসন্তের রাত জোছনার আলোয় হালকা শিশিরে মিশে তৈরি হওয়া রহস্যের এক সূক্ষ্ম আবরণ।
বসন্ত হলো রঙিন স্বপ্ন নতুন দিনের চিঠি
হাওয়ায় হাওয়ায় খুলে দেয়া দ্বার অনাদি মনের চিঠি।
Share.