একদা বসরা নগরীতে বাস করতেন একজন ব্যবসায়ী। হাসান বসরী ছিল ওই ব্যবসায়ীর নাম। ব্যবসার সুবাদে তিনি প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হয়ে যান। তাঁর ব্যবসা ছিল মণি মানিক্যসহ সোনাদানার। ব্যবসার জন্য তিনি এ দেশ সে দেশ যেতেন। ব্যবসার কাজে একবার তিনি রোমে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি ছিলেন সদালাপী ও বন্ধুভাবাপন্ন। সেই সুবাদে রোমীয় এক উজিরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। উজিরের সঙ্গে গল্পগুজব করে আর বেড়িয়ে সময় কাটান হাসান বসরী।
একদিন ব্যবসায়ী হাসান বসরী উজিরের সাথে ঘোড়ায় করে বেড়াতে বের হলেন। তিনি সেখান থেকে অনেক জায়গায় ঘুরাঘুরির পর একটি জায়গায় এসে থমকে গেলেন। দেখতে পেলেন একটি তাঁবু। তাঁবুটি রেশমি কাপড় ও চোখধাঁধানো মণিমানিক্য সোনাদানা দিয়ে সাজানো। হাসান বসরী তাঁবুটি দেখে মুগ্ধ হলেন। সেই সঙ্গে আরো অবাক হলেন সেই তাঁবুটিকে ঘিরে যে সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছিল তা দেখে।
প্রথমে তিনি দেখলেন তাঁবুটির চারিদিক প্রদক্ষিণ করছে সেখানকার একদল সৈন্য। তারা একবার প্রদক্ষিণ শেষে কী যেন বলছে ওদের মাতৃভাষায়। তিনি তা কিছুই বুঝতে পারলেন না। তার মনে কৌতূহল হলো কি বলে গেল সৈন্যরা। আর তাঁবু ঘিরে কেনই বা ওরা প্রদক্ষিণ করে গেল! তিনি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন সৈন্যদের চলে যাওয়ার দৃশ্য দিকে।
ব্যবসায়ী হাসান বসরীর বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতে আবারও দেখতে পেলেন প্রায় চার শতাধিক পন্ডিত ব্যক্তি এলেন তাঁবুটির কাছে। তারাও একই ভাবে সৈন্যদের মতো তাঁবুটির চারিপাশে প্রদক্ষিণ করে আবারও কি যেন বলতে বলতে বিদায় নিলেন। অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন হাসান বসরী তাঁবুটির রহস্য।
এবার এলো অতি সুন্দরী একদল মেয়ে। তারাও ঠিক একই ভাবে তাঁবু প্রদক্ষিণ করে কী যেন বলতে বলতে চলে গেল। তিনি এবার দেখলেন একদল সাধু। তারাও আগের মতো তাঁবু প্রদক্ষিণ করে কিছু বলতে বলতে চলে গেল।
হাসান বসরী উজিরকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করতে যাবেন, ঠিক সেই সময় এলেন স্বয়ং রোমের সম্রাট। সঙ্গে তার সেনা সামন্তসহ উজির নাজির। তারা সরাসরি তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং কিছুক্ষণ কাটিয়ে বেরিয়ে এলেন। এমন অবাক করা দৃশ্য দেখে এর কোনো কূলকিনারা বুঝতে না পেরে এবার উজিরকে জিজ্ঞাসা করলেন এসব ঘটনার কারণ।
বন্ধু উজির এবার ব্যবসায়ীকে জানালেন পুরো ঘটনার আসল কাহিনী। রোম সম্রাটের ছিল অতি সুদর্শন সুঠাম দেহের অধিকারী এক রাজকুমার। তিনি ছিলেন দেখতে যেমন সুন্দর তেমনই সাহসী ও জ্ঞানী। সম্রাট তাকে খুব ভালোবাসতেন। সম্রাটের সেই ভালোবাসা স্নেহ আদরের রাজকুমার এক কঠিন রোগে ভুগে একদিন মৃত্যু বরণ করেন। দেশ বিদেশের বহু হেকিম বৈদ্য বহু চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেনি। এই তাঁবুর ভিতরেই প্রাণপ্রিয় পুত্রকে সমাহিত করেন সম্রাট। প্রতি বছর একবার করে পুত্রের সমাধিতে আসেন সম্রাট আর সৈন্যরা। আর যাদের দেখলেন ওরা সবাই। আজ ছিল সেই দিন। আপনি যা দেখলেন তাহলে শুনুন সেই মর্মান্তিক কাহিনী।
কি সেই কাহিনী। জিজ্ঞাসা করলেন ব্যবসায়ী উজিরের বন্ধু হাসান বসরী। আর ওরা সবাই কী বলছিল তাঁবু প্রদক্ষিণ করার সময়। উজির এবার বলতে শুরু করলেন। প্রথমে সৈন্যদল তাঁবু প্রদক্ষিণ করার সময় বলে গেল হে সম্রাট পুত্র রাজকুমার আমাদের যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে আমরা আমাদের প্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করেও আপনাকে বাঁচিয়ে তুলতাম। কিন্তু আমাদের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। কারণ যিনি আপনাকে পৃথিবীর থেকে নিয়ে গেছেন। তাঁর কাজে বাধা দেওয়ার কারো কোন শক্তি নেই। তিনি সর্বশক্তিমান।
তারপর পণ্ডিতগণ এসে তাঁবুকে ঘিরে বলে গেলেন। হে সম্রাট পুত্র রাজকুমার যদি আমাদের মেধা পান্ডিত্য দর্শন বিজ্ঞান দিয়ে এই মৃত্যুকে ঠেকানো যেত, তবে আমরা তাই করতাম। কিন্তু কোনো ভাবেই মহান ¯্রষ্টার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদের সকল কিছুই তুচ্ছ। মৃত্যুকে ঠেকানো আমাদের কেন, কারো কোনো শক্তি সামর্থ্য নেই। সেই মহান শক্তির কাছে আমরা সবাই পরাভূত।
পণ্ডিতরা এসে চলে যাওয়ার পর এসেছিল রোমের সেরা নারী। তারা বলে গেল হে রোম স¤্রাটপুত্র রাজকুমার, আমাদের রূপ সৌন্দর্য লাবণ্য দিয়ে আপনাকে ধরে রাখা যদি সম্ভব হতো তাহলে আপনাকে আমরা ছেড়ে দিতাম না। আপনাকে আমরা ধরে রাখতাম। কিন্তু তা সম্ভব নয়। মৃত্যুকে কোনো ভাবে ঠেকানো যায় না। যিনি সর্বশক্তিমান এমনটি করেছেনে তাঁর নিকট আমাদের রূপ সৌন্দর্য লাবণ্যের কোনো মূল্যই নেই। তাঁর ইচ্ছাই প্রধান ইচ্ছা।
এরপর সাধু সন্তরা এসেও একই কথা বললেন যে, মহান স্রষ্টার নিকট যদি আমরা কান্নাকাটি করেও মৃত্যুকে রোধ করা সম্ভব হতো আমরা তাই করতাম। কিন্তু মহান স্রষ্টার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার শক্তি পৃথিবীর কেন সৃষ্টি জগতের কারো পক্ষে কোনো সম্ভব নয়।
সম্রাট এসে সবার শেষে বললেন, হে প্রাণ-প্রিয় আমার কলিজার টুকরা রাজকুমার, এখানে তোমার পিতার রাজ্যের কাছে অসীম ক্ষমতার শক্তি থাকলেও তোমার পিতার হাতে এমন কোনো শক্তি নেই যার দ্বারা তোমাকে ধরে রাখতে পারতাম। এর জন্য দেশের সৈন্যবাহিনী, পণ্ডিত, সুন্দরী, সাধু সবাইকে পাঠিয়েছি। কিন্তু কারো কোন শক্তি নেই তোমাকে বাঁচানোর। কারণ আমরা মহান শক্তিমান স্রষ্টার কাছে অত্যন্ত তুচ্ছ ও দুর্বল। আমিও এলাম উজির নাজিরসহ সবার সাথে। আমিও তাঁর কাছে অতি ক্ষুদ্র ও নগণ্য। বলতে বলতে চোখ ভরে পানি চলে এলো স¤্রাটের। তাঁর কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে এলো। চোখ মুছতে মুছতে তিনি ফিরে গেলেন রাজপ্রাসাদে।
ব্যবসায়ী হাসান বসরী উজিরের মুখে সব ঘটনা শুনে বিস্মিত হলেন। তার মনের মধ্যে তোলপাড় হওয়া শুরু করলো। মহান ¯্রষ্টা আল্লাহর ভয়ে তিনি ভীত হয়ে উঠলেন। ধন লিপ্সার জন্য তিনি যে দূর-দূরান্তে ছুটতেন ব্যবসার জন্য, তা আর করবেন না বলে মনস্থির করলেন। এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর মোহে পড়ে থেকে আর সময় নষ্ট করবেন না। ফিরে এলেন তিনি আপন গৃহে বসরায়। ফিরে এবার বেরিয়ে পড়লেন আল্লাহর রাস্তায় আল্লাহর নামে। মণিমানিক্যের ব্যবসায়ী হাসান বসরী ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন একজন খ্যাতিমান আল্লাহপ্রেমিক দরবেশ। জীবনের গতিধারা পাল্টে তিনি হলেন এক বুজুর্গ দরবেশ।
Share.