আমার আছে নানান রকম সমস্যা। সবগুলোর বর্ণনা দিতে গেলে তো বেশ কয়েক পাতা খরচ হয়ে যাবে। তবে কয়েকটা ঝট ঝট করে বলে ফেলা যায়।
প্রথমত আসি ভীষণ অনুভূতি প্রবন মানুষ। সবচেয়ে বাজে সিনেমার দুঃখের দৃশ্য দেখলেও চোখে এসে যায় জল। আমার শীত লাগে বেশি। খান বাড়ির সবাই হাল্কা জামাকাপড় পরে ফুরফুরে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমি তখন ইনার পরি। সাথে কখনো সোয়েটার বা জ্যাকেটও চড়াই গায়ে।
আমি দুর্যটনা প্রবণ। কথা নেই বার্তা নেই, আমার এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায় যে সবাই অবাক হয়ে আমাকে বকাঝকাও করে। দুর্ঘটনা শুনুন-
বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি, হঠাৎ করে পাতার ঘষায় আঙ্গুল কেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। মনে করেন একটা চেয়ারে বসে গল্প করছি, হঠাৎ দেখা গেল সুস্থ-সবল চেয়ারটা আস্তে আস্তে আমাকে শুদ্ধ চ্যাপ্টা হয়ে শুয়ে পড়লো মাটিতে।
আর একটা ব্যাপার আছে, ওটা না বলাই ভালো। শুনলে আবার আপনারা……। না বলি, বলাটা প্রয়োজন-
রক্ত দেখলে আমার মাথা ঝিমঝিম করে এবং সহসাই জ্ঞান হারানোর সম্ভাবনা দেখা দেয়।
যাকগে নিজের এত গুনগান করে লাভ কী! তারচেয়ে কাজের কথাটা বলা যাক। কিন্তু এওতো আর এক ধরনের প্রবনতা। পথ হারাই আমি কখনো কখনো। মানে হারিয়ে যাই, এবং ঘুরপাক খেতে থাকি গোলক ধাঁধায়। বেশ কয়েকবার এ পর্যন্ত এমন ঘুরপাক খেয়েছি আমি। তার একটি বয়ান করি আজ। সময় সুযোগ পেলে অন্যগুলোও ঝেড়ে দেব কখনো।
সেই ধরেণ ১৯৬০ এর দশকের ঘটনা। আমি তখন ছাত্র বুয়েটের। ছুটিতে চট্টগ্রামে বাবা-মায়ের কাছে যেতাম প্রায়। সেটা কোনো এক শীতকাল ছিল। চট্টগ্রাম গিয়েই প্ল্যান করা হলো আব্বার বন্দুকটা নিয়ে আমরা তিন বন্ধু; আমি, বুলু আর নান্না যাবো হরিণ শিকারে।
আমাদের তিনজনেরই একটু আধটু ছিল শিকারের নেশা।
আমার আব্বা মরহুম আবদুস সালাম ছিলেন শিকার পাগল মানুষ। সেই পঞ্চাশের দশকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ঋন নিয়ে কিনেছিলেন আমেরিকার উইনক্রেস্টার কোম্পানির রিপিটার বন্দুক। (এখনও সেটা আমি তাঁর স্মৃতি স্বরূপ বহন করছি।)
সেই বন্দুক নিয়ে এক সকালে আমরা রওনা হলাম দোহাজারীর উদ্দেশ্যে।
দোহাজারী হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পথের উপর। তখন ট্রেন লাইন ছিল এই দোহাজারী পর্যন্তই। এখনতো লাইন চলে গেছে কক্সবাজার অবধি।
বেলা ১২ টা সাড়ে বারোটার দিকে আমরা দোহাজারী স্টেশনে নেমে কিছু খাওয়া-দাওয়া করে বেরিয়ে পড়লাম স্পটের উদ্দেশ্যে। স্পট মানে হরিণের বিচরণ স্থলটি স্টেশন থেকে বেশ কিছুটা দূরে পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত।
এ সমস্ত খবর আমরা নিয়ে রেখেছি অনেক আগেই। উত্তর দিকে পাহাড়ের অবস্থান। পাহাড়ের পর পাহাড় বহু দূর পর্যন্ত। সেদিকে ঘন জঙ্গলও আছে। তবে আমদের স্পটটি ঢালু জমিতে। সেখানে বেশ কিছু বড় বড় জানা অজানা গাছ পালা এবং তার মধ্যে বড় বড় কয়েকটা সারিবদ্ধ আমলকী গাছ। শীতের মৌসুমে গাছ ভর্তি আমলকী থাকে। আর তারই টানে প্রায়ই সেখানে নেমে আসে হরিণ। ছোট বড় নানান সাইজের। এরা টসটসে আমলকীর ভক্ত।
এসব খবর আব্বার কাছ থেকেই পাওয়া। তিনিও মাঝে মাঝে হরিণের আশায় এদিকে আসেন। তবে তাঁর প্রধান শিকার ছিল ঘুঘু, হরিয়াল, কবুতর, বক, দলপিঁপিঁ এই সব। তবে তার জন্যে তার এতদূর আসার প্রয়োজন ছিল না। তাঁর চট্টগ্রামের কাছেই ভেঙ্গুরা বা কখনো ধলঘাট পর্যন্ত আসতেন।
আজ আব্বাকে বলিনি যে আমরা হরিণের উদ্দেশ্যে এসেছি। বলেছি ধলঘাট যাবো। পাখি শিকারে। নইলে দিতেন না আসতে।
হাঁটা দিলাম স্পটের দিকে। স্টেশনের পেছনের গেইট দিয়ে একটু বেরুতেই লোকালয়ের সমাহার কমতে শুরু করলো। সূর্য প্রখর হওয়াতে বেশ ভারী শীতেও আমরা মোটামুটি সহজে হেঁটে যেতে পারছিলাম।
বেশ কিছু ঘুঘু, বক পথে চোখে পড়লেও আমরা সেগুলোর দিকে নজর না দিয়ে হাঁটা চালাতে থাকলাম। বিকেলের মধ্যেই পৌঁছতে হবে আমাদের স্পটে আর সন্ধে নামার আগেই ফিরতে হবে স্টেশনে, যাতে সাতটার ট্রেনে ফিরতে পারি চট্টগ্রামে।
গ্রামের পথে হাঁটার একটা আলাদা মজা আছে। সেটা না গেলে বোঝা যাবে না। আমি তো গ্রাম ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরে এসেছি তিন বছর বয়সে। সুতরাং গ্রাম সম্বন্ধে ধারনাই ছিল না বলা যায়। কিন্তু আব্বার সাথে মাঝে মাঝে এই সব অঞ্চলে পাখি শিকারে আর মাছ ধরতে আসার কারণে ভালই জানতাম এখানকার গ্রামের সংস্কৃতি ও কথাবার্তা চালচলন ইত্যাদি।
হেঁটে যাবার সময় কত মানুষ জানতে চাইলো আমাদের গন্তব্য। শুনে অনেকে সাবধানও করলো। হরিণ আসার কারণে কখনো কখনো নাকি বাঘও এসেছিল এ সব পাহাড়ে। আর আমরা যেন অন্ধকার হওয়ার আগেই গ্রামে ফিরে আসি সে সাবধান বাণীও শুনিয়ে দিল।
আমরা খুব ফুর্তি নিয়ে চললাম। কিছু দূর যেতেই গ্রামের পথ শেষে পেলাম মাটির আইল। ধানক্ষেতে সবুজ ধানের শীষ বাতাসে দোল খাচ্ছে। মাঝেমাঝে ফিঙে পাখি নাচছে তাদের পাশে ছোটছোট গাছের ডালে। ক্ষেতে দু’একজন কৃষককে দেখা গেল। পথে পেলাম মটরশুটির ক্ষেত। নান্নাতো খুশিতে পকেট ভরে নিল মটরশুটি। তারপর পেলাম খিরা খেত। সেখানে থেকেও নেয়া হলো থলে ভরে। কেউ অবশ্য নেই কোথাও আমাদের কিছু বলার। কী আনন্দ! তবে হঠাৎ এক মটরশুটির ক্ষেত থেকে এক মালিক উদয় হয়ে আমাদের কাণ্ড দেখে হেসেই অস্থির।
নাও, নাও থলে ভরে নাও। শহরের মানুষ এসব তো দেখতে পাও না।
কিছু মটর শুঁটি নিজ হাতে তুলে দেন আমাদের। আমাদের মধ্যে নান্নার ফুর্তি দেখার মত। পারলে সন্ধ্যে পর্যন্ত, সে এই মটরশুটির ক্ষেতেই কাটিয়ে দেয়।
এবার আমার দুই বন্ধুর পরিচয়টা একটু দিতে হয়। বুলু এবং নান্না দুজনই আমাদের কলোনিতে বাস করে। আমার বাবার সাথেই রেলের চাকুরে তাদের বাবারা। বুলু আমার সহপাঠি। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আমরা দুজন একসাথে এইচ এস সি পাশ করেছি। আর নান্নার আব্বা হচ্ছেন বিহারের বাসিন্দা। উর্দু ভাষী। নান্না, বুলু, আমরা সব ছোট্ট বেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি। নান্না এখন বাংলা যেমন বলে তেমনি চট্টগ্রামের ভাষাও বলে চমৎকার। তাদের বাড়ির চালচলন খাওয়া-দাওয়া সব বিহারী স্টাইলে। সে মটরশুটির তরীতরকারী খুব একটা খায় না বোধ করি। তাই মটরশুটির গাছ দেখে সে মহা আনন্দ উপভোগ করছে আর যতটুকু যা পারছে ভক্ষণ করছে।
পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত সবই চাষের ক্ষেত। ছোট ছোট পাখি এসে তাতে দোল খাচ্ছে। সবুজের সোমারহ চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মৃদুমন্দ বাতাসে দোলা খাচ্ছে হালকা চালে। গ্রামের পথটা এতক্ষনে ছাড়িয়ে এসেছি আমরা বেশ দূর। আলের রাস্তায় ছোট ছোট জল সেচের খাল পেরোতে হয়েছে আমাদের। কোন এক উৎস হতে জলের ধারা খাল বেয়ে চলেছে এক একটি জমিতে। কোন কোন আইল ডুবেছে পানিতে। তার কাদায় পা পড়ে জুতোটুতো সব কাদায় মাখামাখিও হয়েছে আমাদের। তবুও আমরা মনের আনন্দে ফুরফুরে মেজাজে এক সময় পৌঁছুলাম সেই কাঙ্খিত স্থানে।
এখানে সাক্ষাত পেলাম এক রাখাল ভাইয়ের। সে মেষ চরাচ্ছিল আপন মনে মাদনকা মনুর গানের সুর।
– এখানে আমলকীর বন কোন দিকে বাপু?
– আপনারা কি হরিণ শিকারে এসেছেন?
– হ্যাঁ! কোন দিকে বলোতো!
– সে দিকে নির্দেশনা দিল আমাদের, যেটা আর একটু উঁচু একটা সমতল ভূমিতে। তার মানে আমাদের আরও গাভীরে উঠে যেতে হবে।
– জিজ্ঞেস করলাম, হরিণ টরিণ আসে কিনা এখন এদিকে।
– বলতে পারবো না। তবে শুনেছি আসে মাঝে মাঝে।
– তুমি কখনো দেখনি?
– দেখেছি, গুলি খাওয়ার পর লাফালাফি করতে দেখেছি। কথার উত্তর দিয়ে সে আবার আমাদের একটু সাবধানও করে দিল।
– মাঝে মধ্যে হাতিও নাকি আসে!
– চলো যাই। এঁহা টাইম পাস করনেকা জরুরৎ কিয়া!
নান্না অস্থির হয়ে উঠলো লোকেশনে যাওয়ার জন্য।
যখন আমরা আমলকী বনে পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় সাড়ে তিনটা কি চারটা হবে।
আমলকীর গাছ দেখে তো আমরা মহা খুশী। গাছ ভরা ফল, টসটসে আমলকী। গাছের তলায়ও পড়ে রয়েছে মেলা। নতুন-পুরোন মিলিয়ে বেশ দারুণ একটা দৃশ্য বটে।
বুলু বললো, তাহলে এখানেই অপেক্ষা করি আমরা। কথাটা বলে নিজেই লুকোবার জায়গা খুঁজতে লাগলো।
কিন্তু কোথায় লুকানো যায়! সবই তো সমান জায়গা। ঝোপ ঝাড়ের চিহ্নও নেই। আরও উত্তরে উপরের দিকে প্রচুর গাছপালা সেগুলো বেশ দূরে। কতদূরে বোঝার উপায় নাই। পেছনের ধানক্ষেতও আর চোখে পড়ছে না এখন।
আমি দাঁড়িয়ে বেশ বড় গাছটার নিচে। বন্দুকটা আমার হাতে। কয়েকটা ব্যাগ এনেছিলাম হরিণের মাংস নিয়ে যাবার জন্যে। সেগুলো সব মটরশুঁটি আর খিরাতে ভর্তি হয়েছে ইতিমধ্যে। সেগুলো গাছের গোঁড়াতেই রাখা। বুলুকে দেখছি না। সে ততক্ষনে লুকাবার জায়গা মানে হাইডিং প্লেস খুঁজতে গেছে। নান্না গেল কোথায়?
আমার চোখ যখন চারদিকে নান্নাকে খুঁজছে তখন দেখি সেই গাছের ওপর থেকে আমাকে ডাকছে নান্না।
– ওখানে কি করছিস। অবাক আমি।
– আমলকী পাড়ছি।
– কেন?
– বাসায় নিয়ে যাবো। জানিস না বাজারে কত দাম। চারটে আমলকী এক আনা। আর এগুলো দেখো কত বড় বড়।
– আগে হরিণ শিকার করি, তারপর নাহয় আমলকী পাড়বে। নেমে আয়।
– রোকো ইয়ার। ইয়ে বহুত উমদা চীজ হায়।
– বলে মনের আনন্দে দেব আনন্দের সোলক গলি সিনেমার গান গাইতে লাগলো। আবার দেখি, আর একটা ব্যাস হাতে কওে নিয়ে উঠে গেল উপরে।
আমি বিরক্ত হয়ে খুঁজতে লাগলাম বুলুকে। আমার চোখে বিরক্তি সাথে একটু শঙ্কাও উঁকি দিচ্ছে। এ নির্জ স্থানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। কখন কী হয় বলা যায় না।
এরমধ্যে রাখালটাকে আর দেখা যায় না। সেও বাড়ির পথ ধরেছে কোনো একসময়।
বুলু বেশ রাজ্য জয়ের আনন্দ নিয়ে হাজির। তার হাতে বিরাট কয়টা ঝোপঝাড়, শটার ডাল পালা।
– ব্যবস্থা হয়েছে
– কিসের?
– হাইডিং প্লেসের।
কথা শেষ করার আগেই সে লেগে গেল কাজে। একটা ছোট খালের মত জায়গা ছিল ঢালুতে। সেখানে ডালগুলো পুঁতে ফেললো কয়েক মিনিটের মধ্যে।
এখানে আমরা বসে হরিণের আসবার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। শুধু একবার গাছ তলায় এলেই হয়। ধুম, ধুম, ধুম। পর পর তিনটি গুলি করবে। ব্যাস খতম। এসো বসি আমরা এখানে। গুলি করার ভারটা আমাকে দিল বুলু।
– বসবো তো। ওদিকে নান্নাকে দেখ।
– কই সে?
– মেয় ইধার হুঁ! (সুর করে বলে নান্না)
– আরে এই বাঁদরটা গাছে কী করে?
– আমলকী তোড়া রাসা হুঁ। আজাও ভাইয়া। বহুৎসা খুবসুরৎ তোফা হঁহা।
বুলু এগিয়ে গেল গাছের গোড়ায়।
গাছের ওপরটা দেখছে। ততক্ষণে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার চোখ দুটো।
আওনা উপর, আও। ইয়া বহুৎসা হায়।
যে উঁচু ডালে প্রচুর আমলকী ঝুলছে সেটা বুলুকে দেখায় নান্না।
এবার আর বুলুকে দেখে কে! ধুমধাম উঠে পড়লো গাছে।
বুলু এসব ব্যাপারে ওস্তাদ। তার যেরকম উদ্ভাবনী ব্রেইন, সেরকম এধরণের কাজ করার শারিরীক ক্ষমতা।
তারপর আর কী হবে? দুই বন্ধুতে মনের সুখে আমলকী গাছ থেকে আমলকীগুলো পেড়ে পেড়ে ফেলতে লাগলো। গাছে যেন দুই বাঁদর উঠেছে। খাচ্ছে আর ছুঁড়ছে।
একগাছ, দুই গাছ, তিন গাছ একটার পর একটা গাছ উজাড় হতে চললো ওদের আক্রমনে।
নীচে আমি কিছুক্ষণ বস্তায় ভরতে ভরতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম সেই হাইডিং প্লেসে।
সময় তো বসে থাকে না। সে চলছে তার মতই। আর বন্ধু দুই জন সব ভুলে গিয়ে আমলকী পিকিং-এ মজে রয়েছে। মহা উৎসবে যেন মেতেছে তারা।
ঘড়িতে দেখি পৌনে পাঁচটা।
সর্বনাশ! এক্ষনি তো সন্ধে হয়ে যাবে। ডিসেম্বর মাস, দিন ছোটো। আমাদের তো সন্ধের আগেই ফিরতে হবে।
আমি ওদের নামতে বললাম চিৎকার করে।
এই নামো। আমাদের যাবার সময় হয়েছে। আর দেরী করা যাবে না।
আজকে তো হরিণ নেই! আয়া জায়গা কিউঁ।
আমি ধমক দিলাম।
তুমি গাছে উঠে নাচছো আর হরিণ আসবে তোমর নাচ দেখতে। নামো তাড়াতাড়ি।
জোর করে দু’জনকে নামালাম। আজকের মত হরিণ শিকারের আশা ত্যাগ করে ব্যাগ সব আমলকী পূর্ণ করে রওয়ানা দিলাম। স্টেশনের পথে। নিরাপদে পৌঁছতে হবে স্টেশনে অন্ধকার নামার আগে।
ওদের ইচ্ছা ছিল কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা হরিণের জন্য। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরছিল, সন্ধ্যা নেমে যাবে যে কোন সময় – অন্ধকারে পথ চিনতে পারবো কিনা ফিরে যাবার।
রওয়ানা হয়েছি। বস্তা নিয়েছে নান্না। বুলুর দুই হাতে ব্যাগ। মটরশুঁটি খিরা আর আমলকীতে পূর্ণ সব। না পাওয়ার কোনো বেদনা নেই কারো মনে। বরং ভারী ব্যাগ নিয়েও আনন্দে পথ চলছে দু’জন।
নান্নার মুখে সেই গান ‘হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা’। আমি চলছি বন্দুকটা হাতে করে। আমার মনে হয়, অন্ধকার যে দ্রুত গতিতে গ্রাস করছে চতুর্দিক, পথ না হারিয়ে ফেলি এই বিশাল ফসলের ক্ষেতে।
যা ভয় করেছিলাম তাই হলো। অন্ধকারটা যেন ঝপাৎ করে নেমে এল। দূরে কোন মসজিদে মাগরিবের আজান শুনতে পাচ্ছি আমরা। সাথে সাথে শিয়ালের কোরাস।
চল ভাইরা আমার, পা চালাও নইলে বিপদ।
বিপদ সত্যিই এসে হাজির। পায়ে হাঁটার আলটা দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে গেছে এখান থেকে।
এখন আমরা যাই কোন দিকে? কোনদিকে স্টেশন?
বুলু বলল- এই দিকেই হবে। দেখ পায়ে চলার চিহ্ন বেশি এপথেই।
চলো তাহলে। বুলুর জ্ঞানী কথাবার্তাকে আমরা সবসময় সম্মান করি। করলাম আজও।
চলছি তো চলছি! এঁকে বেঁকে পথ আমাদের নিয়ে চলছে এগিয়ে। কিন্তু কোথায় চলেছি ধারণা করতে পারছি না আমরা। এত দেরী হওয়ার তো কথা নয়। কোনো গ্রামের দেখা তো পাচ্ছি না।
আকাশের লাল আভাটুকুও এক সময় নিভে গেল। ঘরে ফেরা কাক-বাকর ঝাঁকগুলোও আর পড়ছে না চোখে।
আরে ভাই ইয়ে রাস্তা নেহী স্টেশনকা, চলো ওয়াপাস।
বিজ্ঞ মত দিল নান্না।
ঘুরে চললাম আবার সেই পথেই । আবার হাঁটছি তো হাঁটছি।
ঝিঁকি গাছ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। হঠাৎ করে আর এক ঝাক শিয়াল চেচামেচি কর্ম করে দিল। যেন আমাদের এখনকার অবস্থাটা ওদের পছন্দ হয় নি, তাই প্রতিবাদ।
আমরা ঘামতে শুরু করেছি তখন। ডিসেম্বরের শীত। তার ওপর গ্রামের শীত। মানে কনকনে শীত। সাথে বাতাসের যোগ। হালকা চাঁদ, কিন্তু আলো বড়ই স্বল্প।
হাঁটতে হাঁটতে পেলাম একটা পুকুর পাড়। উল্টোপাড়ে একটি কুড়ে ঘর। মিটিমিটি হারিকেনের সামান্য আলো ছিটকে এসে বাইরে পড়ছে। তাতেই দেখা গেল কেউ চলাফেরা করছে ঘরে।
ছুটলাম আমরা ওই দিকে। পায়ের আওয়াজেই ঘরের মানুষ সন্ত্রস্ত হয়ে চিৎকার দিল!
কে রে?
জ¦ী, আমরা। একটু বাইরে আসবেন।
কী চান? ভেতর থেকেই জিজ্ঞাসা তাঁর।
আমাদের করুণ অবস্থার বর্ণনা শুনে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন, হারিকেন হাতে।
আমাদের চেহারা খুঁটিয়ে দেখলেন সেই হারিকেনের আলোয়।
এইটা তো ভুল রাস্তা। স্টেশন তো ওই দিকে।
আঙ্গুলি নির্দেশ দিলেন। তারপর আমাদের এগিয়ে দিলেন সামান্য পথ। আর ডানে, বাঁয়ে বলে পথ নির্দেশ দিলেন খানিকটা।
নান্না একটা ব্যাগ বৃদ্ধের হাতে দিয়ে বলেছিল- চাচা আমলকী খাবেন? খুব ভালো স্বাস্থ্যের জন্য।
বেটা হাতের ওজন কমালো। হাসলাম আমি মনে মনে।
আবার চলা শুরু। এবার আরও বড় ধাঁধায় পড়া গেল। একবার ডানে, আবার ফিরে এসে বাঁয়ে। আবার পেছনে চলা। আমরাতো শুধু ধান ক্ষেতই দেখছি। ডানে-বায়ে, সামনে-পেছনে সব দিকে। সব দিকেই পথ, কিন্তু যাবো কোন দিকে!
ওই বৃদ্ধ পুকুরে মাছ পাহারা দেন। ওটা কোনো বাড়ি না। গ্রামতো নয়ই। একটা টেক। ঢিবি। সেটাও যে কোনদিকে তাও বুঝতে পারছি না আর আমরা।
বন্দুকের ওজন আমার কাছে মনে হচ্ছিল কয়েক মন। আবার মনে একটা শঙ্কা, যদি ডাকাতের হাতে পড়ি আমরা তাহলে গালে চড় দিয়ে নিয়ে যাবে বন্দুক। আব্বার বড় শখের বন্দুক।
ডাকাতের কথা বলতেই নান্না হাত থেকে ব্যাগ ফেলে দাড়িয়ে গেল।
তো আর কেয়া হোগা? মরেদে হাসলোগ?
বুলু সাহসী।
এমনি মরবো কেন! যুদ্ধ করে মরবো। রবি তুমি গুলি ভরে রাখো বন্দুকে।
ঘড়ি দেখলাম। ইতিমধ্যে আটটা বেজে গেছে। একে শীতকাল, তারওপর গ্রাম। রাত আটটা মানে তো মাঝ রাত এদের। মাথার ওপর দিয়ে মাঝে মধ্যে বাদুড় উড়ে যাচ্ছে। শিয়াল তো থেকে থেকে খ্যাঁক খ্যাঁক করেই চলেছে। সামনে দিয়েও দু-একটা ছুটে গেছে আমাদেরকে রেকি করার জন্য।
শিয়ালের কামড় নাকি বিষাক্ত। তার জন্যে বন্দুক দেখানো হলো কয়েকবার। এভাবেই চলছি পথ। হরিণ শিকারের স্বপ্ন বিলীন হয়ে মনের মধ্যে শঙ্কা। বাড়ি ফিরতে পারবো তো!
বুলু ওসব ফলফলাদি আর সব্জির বস্তা বহণ করে লাভ নেই। ফেলে দাও খেতের মধ্যে। জান নিযে ফিরে যেতে পারলেই হয় এখন। আমি পরামর্শ দিলাম বুলুকে।
না না, সব ফেলবো কেন? কিছু ফেলে হালকা করে নিই ব্যাগ।
তাই করা হলো।
যা; শালা।
নান্নার পা পড়েছে কাদায়। মহা বিরক্ত সে।
আরও দু-চারটে গাল মেরে দিয়ে আবার চলা শুরু বললো।
চলছি আমরা। চলছি, কিন্তু হারানো পথেই চলছি। কপালকুণ্ডলার গল্প মনে পড়ে গেল।
আহা, যদি কোনো সুন্দরী এসে বলতো- পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো।
দূর হোক কপালকুণ্ডলা। মনে মনে যার যা দোয়া দরূদ জানা আছে সেগুলোই আওড়াচ্ছি তখন। মনে হচ্ছে অনন্ত কাল ধরে চলছি আমরা। একবার এদিক আবার ওদিক। কখনো সামনে কখনো আবার পেছনে। কখনো ডাইনে আবার বাঁয়ে কখনো।
সব পথ একই রকম। যেটুকু চাঁদ উঠেছিলো তাও ইতিমধ্যে গত হয়েছে। গাঢ়তর হয়েছে অন্ধকার। শ্রীকান্তের শশান দর্শনের কথা মনে পড়ে গেল। নাহ্ এসব ভেবে লাভ নেই।
আজ বিপদ অবধারিত। বাড়ি আর ফিরতে হবে না । আম্মার মুখটা মনে পড়লো। কী হবে তাঁর যদি- না এ ভাবনা দূর করতে গা ঝাড়া দিলাম।
না! কাঁদ কাঁদ সুরে কথাটা বেরোলো আমার কন্ঠ চিরে।
থামলাম আমরা। শলাপরামর্শ করতে থাকলাম।
এভাবে হেঁটে হেঁটে মারা যাবো তো আমরা। তারচেয়ে চুপ করে এক জায়গায় বসে রাতটা কাটাই।
বুলুর গরমেল।
নেহি ইয়ার। ইয়া কাঁহা চরহেঙ্গে। চলতে রাহো। সুবাহ হোগা। তর হামলোগ রাস্তা ভি ঢুড পায়েঙ্গে।
আমার পা চলছিল না। ওদের দু’জনের তুলনায় আমি দুর্বল। বেশ দুর্বল। তার ওপর বন্দুকরে ওজন কম না। সেটা মাঝে মাঝে হাত বদল করলেও ভীষন কষ্ট হচ্ছিল তখন আমার।
আমরা একেবারে দিশেহারা নাবিকের মত অসহায়। কারও কণ্ঠে আর সরছে না কথা।
হঠাৎ বুলু আমাদের অন্য দু’জনের হাত চেপে ধরে চাপা গলায় সাবধান করলো।
এই চুপ। কেউ এদিকে আসছে।
আমরা তো সেঁটিয়ে গেলাম এ কথায়! সামনে দেখি বেশ দূরে একটা টর্চের আলো এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।
হালকা কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে কি?
ভালো করে খেয়াল করে বুঝতে পারলাম। হ্যাঁ! একের অধিক মানুষ আসছে এদিকেই। ভয়টা আরও চেপে বসলো আমাদের মনের মধ্যে।
আমদের আনন্দ না হয়ে ভয়টা হলো, ডাকাতের ভয়। যেখানে জন মানুষের ছায়াও নেই। সেখানে এত রাতে মানুষ আসবে কেন? নিশ্চয় ডাকাত।
এবার কি হবে বুলু? ফিস ফিস করে আমি বলতে চাইলাম। যদি বন্দুক কেড়ে নিয়ে যায়!
বন্দুকে গুলি ভরা না! রেডি থাকো।
আমরা রেডি অতপর যে কোনো পরিস্থিতির জন্য।
নিশ্চুপ আমরা অন্ধকারে সেঁটে রইলাম। নিশ^াস ফেলাও প্রয় বন্ধ।
কেটে গেল কয়েক মুহূর্ত। কথাবার্তা গুলো স্পষ্ঠহয়ে উঠতে লাগলো। দুজন মানুষ আসছে এদিকে। তারা কোনো কিছু ভাগাভগি নিয়ে কথাবার্তা বলছে। একজন বেশ উত্তেজিত। অন্যজন ঠাণ্ডামাথায় আগেরজনকে বোঝানোর চেষ্টায়। তবে চট্টগ্রামের ভাষা বলে আমরা খুব একটা বুঝতে পারলাম না।
টর্চের আলো এগিয়ে আসছে। একসময় আমাদের গায়ে এসে পড়ায় গর্জন করে ওঠে একজন আগন্তুক।
ওই, কেরে?
আমরা এবার আওয়াজ দিলাম। মানে বুলু কথা বলল প্রথম।
আমরা।
আমরা কারা? এত রাতে এইখানে কী করেন?
টর্চধারী আমাদের আপাদমস্তক আলো ফেলেন। বন্দুক এর ওপর স্থির হয় আলোটা।
জি¦ আমরা পাহাড়ে শিকার করতে এসেছিলাম। চিটাগাং যাবো। অন্ধকারে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি স্টেশনের।
বন্দুক রাখেন।
আমি বন্দুক নামিয়ে রাখলাম হাত থেকে, আলোর ওপর।
ওরা কাছে এলো। মাঝ বয়সী দুই স্থানীয় মানুষ।
আবার ভালো করে পরীক্ষা করে নিলো আমাদের গায়ে আলো ফেলে।
– আপনাদের ভদ্রলোকই মনে হয়।
– জি¦ আমরা কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র। হরিণ শিকারে এসেছিলাম্
– হরিণ কই? একজন জিজ্ঞাসা করে!
– পাই নি কিছু।
– এখন কোথায় যাবেন?
– স্টেশনে। দোহাজারী স্টেশন।
দু’জনেই হেসে উঠলো।
– এই দিকে স্টেশন নেই। আসছেন যে আবার সেই পাহাড়ের গোঁড়ায়।
– এখন কী করি!
– আসেন আমাদের সাথে।
আমরা চোখাচোখি করি। এ আবার কোথায় কোন বিপদে নিয়ে যায় কে জানে।
– ডর নাই আসেন। আমরা এই এলাকায় মাছ চাষ করি। চট্টগ্রাম থেকে ফিরছি।
কথাটা বলেই ওরা হাঁটা শুরু করলো। আমরা যেদিক থেকে এলাম সেদিকে। আমরা স্থানুর মত দাঁড়িয়ে। ভাবছি ওদের সাথে যাবো কি যাবো না।
– কই আসেন। ডর নাই। আসেন।
নিরুপায় আমরা। নির্বাক, চললাম ওদের পিছু পিছু।
ওরা নিজেদের মাঝে কথা চলাচালি করছে। হাসি মষ্করাও চলছে ওদের। হয়তো আমাদের নিয়েই।
আধঘন্টার মত হাঁটার পর পৌঁছলাম আমরা একটা গ্রামে। রাত বাজে প্রায় দশটা।
থামলো ওরা।
– এখান থেকে আধা মাইল হবে স্টেশন। সোজা এই রাস্তা ধরে চলে যাবেন। কোনো এদিক ওদিক না। পেয়ে যাবেন স্টেশন।
আসি।
বলে হাসলো দু’জনেই।
ধন্যবাদ দিতেও ভুলে গেছি আমরা। বুপেটের মত যেন আমরা। চোখে মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই আমাদের। সব ভুলে গেলাম যেন।
চলে গেল লোক দুটো যে পথে এলাম, সে পথেই।
ফেরেশতা হায় জি! নান্না কথা বললো এতক্ষণে।
জিন হতে পারে। বুলুর মতামত।
ওদের ছায়া আছে কিনা খেয়াল করলে হতো। বিজ্ঞের মত অভিমত আমার।
মিনিট পনেরতে পৌঁছলাম স্টেশনে। শেষ ট্রেন আসতে দেরী আরও আধঘন্টার মত। গুটিসুটি হয়ে বেঞ্চে বসলাম। চা দোকানটা আধা বন্ধ। আমাদের অনুরোধে চা বানিয়ে দিল।
আহ্! কী আনন্দ। চায়ের কাপে মনে হলো অমৃতের স্বাদ পেলাম আমরা।
অবসাদে চোখ আমাদের এমনি এমনি বন্ধ হয়ে আসছিল বারবার। তারমধ্যেই ঝমঝমাঝম আওয়াজ তুলে ট্রেন নামক যন্ত্রদানব এল চট্টগ্রাম থেকে। পনের মিনিটের মধ্যে ফিরে যাবে শেষ ট্রেন হয়ে চট্টগ্রামেই।
ফিরলাম ঘরের ছেলেরা নিজেদের ঘরে।