এক বছরে বারোটা মাস। অথচ কেমন করে কিভাবে যেনো দৌড়ে দৌড়ে নীরবে নিভৃতে পার হয়ে যায়। কিভাবে পার হয়ে যায় বছর বোঝা যায় না। সময়ের সাথে কেউ তেমন করে চলতে পারে না। কোনো কিছুতেই সময়কে বেঁধে রাখা যায় না। তাই সময় তার নিজের গতিতেই চলতে চলতে হারিয়ে যায় অতীতের বুকে। কেউ তাকে আর ফিরিয়ে আনতে পারে না।
দিন দিন করে এক সপ্তাহ, সপ্তাহ সপ্তাহ করে এক মাস, আর মাস মাস করে এক বছর। ঠিক পেছনের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, এইতো গেলো বছরটি বেশ আনন্দের সাথে এসেছিলো আমাদের মাঝে। এসেছিলো বৈশাখ। সেই বৈশাখ এসেই তো শুরু হলো নববর্ষের যাত্রা। বৈশাখে কতরকম মেলা কতরকম আনন্দের জমজমাট আসর সারাদেশে! মনে হচ্ছে এইতো অল্প কয়দিন আগে মাত্র শুরু হলো একটি নতুন বছর। শুরু হলো নববর্ষের প্রথম মাস বৈশাখ। অথচ বছরটি ফুড়ুত ফাড়ুত চলে গেলো চুপিচুপি। সামনে এসে গেলো আরেকটি নতুন বছর নতুন বৈশাখ। একসময় এ বৈশাখও শেষ হয়ে যাবে। আবার আরেক নতুন বৈশাখ আসবে।
নতুন জামা কাপড়ের বা নতুন পোশাকের যে আনন্দ আছে তা সবাই জানে। বিশেষ করে নতুন পোশাকে ছোটরা আনন্দ পায় অনেক বেশি। বড়রাও আনন্দের সাথে গ্রহণ করে যদি তা পছন্দের পোশাক হয়।
নতুন জায়গায় বেড়াতে গেলেও অন্যরকম আনন্দ জাগে মনের ভেতর। নতুন পরিবেশ দেখা, পাখপাখালি আর গাছগাছালির রূপ দেখে মন ভরে ওঠার গল্প হয়তো সবার আছে। সবাই এমন নতুন জায়গার প্রশংসা করে যদি জায়গাটি সুন্দর হয়। ভালোও লাগে বেশ। মন খুশি হয়ে ওঠে আনন্দের সাথে।
এতসব নতুন ভালোলাগার সাথে নতুন বছরের নতুন আনন্দও মন ভরে তোলে। নতুন বছর নতুন দিন নিয়ে আসে। নতুন স্বপ্নের পাখা ছড়ানোর বিষয়টি আমরা মনে করতে পারি।
হয়তো সময় কখনো পুরনো হয় না। সময় সবসময় নতুন আর নতুনই থাকে। যে দিনটি বা যে ক্ষণটি চলে যায়, তাকে ফেরানোর ক্ষমতা কারো নেই। নিজেও ফেরে না সে। সময় চিরকাল এসে চলে যায় অতীতের দিকে। কিন্তু আসে নতুন সময়। নতুন দিনের বার্তা নিয়ে।
আমরা সবাই জানি ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম মাস – জানুয়ারি। আরবি নতুন বছরের প্রথম মাস- মহররম। আর বাংলা সালের প্রথম মাস- বৈশাখ। বৈশাখ থেকে বাংলা সাল গণনা শুরু হয়।
আমাদের এখানে এই বাংলাদেশে সাধারণত তিনটি সাল ব্যবহার করা হয়। প্রথমত ইংরেজি সাল। দ্বিতীয় হলো বাংলা সাল। আর তৃতীয় হলো আরবি বা হিজরি সাল। একটি ক্যালেন্ডারের পাতায় এই তিনটি সালের তারিখ উল্লেখ থাকে। যদিও সবাই ইংরেজি সালটিই অনুসরণ করে।
ইংরেজি নতুন বছরের নাম হলো নিউ ইয়ার। বাংলা সালের নতুন বছর হলো বাংলা নববর্ষ। আর আরবি নতুন বছরের নাম হলো- হিজরি সাল।
বাংলা নববর্ষ শুরু হয় বৈশাখ থেকে। এই বাংলা সন শুরু হয় সম্রাট আকবরের সময় থেকে। সম্রাট আকবরের নির্দেশে বাংলা নববর্ষের যাত্রা শুরু হয়েছে। মূলত চাষি থেকে খাজনা আদায়ের জন্য এ সালের জন্ম হয়। সম্রাট আকবর বিশিষ্ট জোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ্ সিরাজীকে ডেকে এমন একটি সাল প্রবর্তনের নির্দেশ দেন। সম্রাটের নির্দেশে বাংলা সনের ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা তৈরি করেন ফতেহ উল্লাহ সিরাজী।
এখানে একটি বিষয় জানার আছে। তা হলো- বাংলা সালটি বানানো হয়েছে আরবি হিজরি সালের সাথে মিল রেখে। আর হিজরি সাল শুরু হয়েছে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় থেকে। ইংরেজি সালটি গণনা করা হয় সূর্যের সাথে মিল রেখে। আর আরবি সাল গণনা করা হয় চাঁদের সাথে মিল রেখে। এ কারণে আরবি ১২ মাসের ৬ মাস ৩০ দিনের। বাকি ৬ মাস ২৯ দিনের। গণনার বিষয়ে সহজ আছে আরও। আগের মাস ৩০ দিন হলে পরের মাস ২৯ দিন। আরবি মাসে কোনো মাসই ৩১ অথবা ২৮ দিন হয় না। কিন্তু ইংরেজি মাস ৩০ এবং ৩১ দিন হয়। আবার ফেব্রুয়ারি ২৮ দিনেও হয়। শুধু প্রতি চার বছর পর লিপইয়ার হলে ফেব্রুয়ারি হয় ২৯ দিনে। বাংলা সনের মাসগুলো ৩০ দিন এবং ৩১ দিন হয়।
তো নতুন বছর শুরু হলে একটি নতুন আনন্দ কাজ করে সবার মাঝে। সবাই নতুন বছরের নতুন দিনটি বেশ আনন্দের সাথে দেখে। পালনও করে খুব তোড়জোড় করে। কেউ কেউ বৈশাখের জন্য আলাদা জামা কাপড় জুতা সবই কেন। নিজেদের জন্য, সন্তানের জন্য সবার জন্য কেনাকাটা হয়। দেখে মনে হয় এটিও তাদের একটি ঈদ। মার্কেটগুলো জমে ওঠে বেশ।
বৈশাখের প্রথম দিন থেকে দেশের বিভন্ন জায়গায় মেলা বসে। সারা মাস চলতে থাকে এ মেলা। তবে কোনো কোনোটি চলে এক সপ্তাহ। কোনোটি পনেরো দিন। কোনোটি আবার বিশ দিন চলে। নদীর কূলে কোনো সুন্দর জায়গায় মেলা বসে। গ্রামে খোলা মাঠে বসে এসব মেলা। শহরেও মাঠেই মেলার আয়োজন হয়। কোথাও আবার স্কুল ও কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। বাজার এবং বড় কোনো রাস্তায়ও মেলা বসে। এসব মেলা খুব জমে। বিশেষ করে নারী আর শিশুরা মেলায় বেশ ঘুরে বেড়ায়। আনন্দ পায় খুব। পছন্দের জিনিস পেলে কেনাকাটা করে। শিশুরা খেলনা এবং খেলনা জাতীয় জিনিস কিনে নেয় খুব আনন্দের সাথে। মেলায় পাওয়া যায় যেসব জিনিস তার মধ্যে তালপাতার বাঁশি খুব জনপ্রিয়। বাঁশের বাঁশি তো আছেই সবসময়। কিন্তু তালপাতার বাঁশি ছেলে বুড়ো সবাইকে আকর্ষণ করে নানাভাবে।
হাতে ভাজা মুড়ি মুড়কি, চিঁড়া এবং খৈ অনেকে পছন্দ করে। খাওয়ার আরও গ্রামীণ জিনিস থাকে অনেক। যে যার পছন্দ অনুযায়ী কেনে। কিনে কিনে কেউ বাসায় নিয়ে খায়। কেউবা মেলার জায়গায় বসেই খেতে থাকে।
এসব মেলায় স্থানীয় কিছু মজার বিষয় থাকে। খাওয়া দাওয়া থেকে জিনিসপত্র পর্যন্ত সবকিছুতেই থাকে। একে বলে স্থানীয় সংস্কৃতি। একেক এলাকায় একেকরকম সংস্কৃতি আছে। মানুষের মধ্যে যেমন নানান রকম মানুষ আছে, এসব নানান মানুষের নানান পছন্দের কারণে খাওয়া দাওয়ার কতরকম পরিবর্তন হয়ে যায়।
বৈশাখের সবচেয়ে বড় আয়োজন হয় রাজধানী ঢাকার রমনা পার্কে। এখানে ভোরবেলা অনেক মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে চলে আসে। বিছানা চাদর এবং সকালের নাস্তা নিয়ে হাজির হয় এখানে। কতরকম মানুষের আগমন ঘটে তার কোনো হিসাব নেই। ছোট বড় নারী-পুরুষ সবাই আসে এখানে। এখানে এই রমনায়ও বসে নানারকম মেলা। সেই সাথে জমে কবিতা ও ছড়া পাঠের আসর। বৈশাখ ও নতুন বছর নিয়ে কবিরা পাঠ করেন স্বরচিত কবিতা ও মজার মজার ছড়া। বিভিন্ন রকম সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনও নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কত কত লোক জমা হয় এসব অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে।
লোকসঙ্গীতের শিল্পীরা খুব মজার মজার করে গান করে।
বৈশাখে বা নববর্ষে আনন্দ হবে, হোক ভালো আয়োজনে। কিন্তু সে আনন্দ যেনো সুন্দর ও নির্মল হয়। যেনো অপসংস্কৃতির আনন্দ না হয়। তবেই নতুন বছর নতুন আনন্দে উজ্জ্বল হবে। এ বিষয়ে অবশ্যই আমাদের নজর রাখতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে সুস্থতায় রয়েছে ভালো দিক। অসুস্থতা খারাপ। আমরা লাগামহীন কোনো দিকে ছুটবো না। যা করবো ভালোটাই করবো। মন্দ থেকে দূরে থাকবো। এই হোক আমাদের নববর্ষের অঙ্গীকার।