ধর্মীয় জ্ঞানই সর্বোচ্চ সম্পদ। টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ, জায়গা-জমি ও অন্যান্য সম্পদ পার্থিব জীবনের উপকরণ মাত্র। তবে তা হতে পারে কল্যাণকর পরকালের জন্য, যখন তা সৎভাবে আয় করা হয় এবং তা যথাযথভাবে পরকালের কল্যাণের জন্য ব্যয় করা হয়। যেমনি দান সাদকা করা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়। যথা- লোক দেখানো, ভোট পাওয়া, দানশীল হিসেবে পরিচিতি পাওয়া অথবা পার্থিব কোনো স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ইত্যাদি।
মানুষের শৈশবকালটা কাদামাটির ন্যায়। কুমার যেমন কাদামাটি দ্বারা বিভিন্ন ব্যবহার সামগ্রী তৈরি করে যথা- কলসি, হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন ইত্যাদি। তেমনি সন্তানগণের শৈশবকালে সন্তানগণের পিতা-মাতা তাদেরকে আদর্শবান সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন যদি তাদের প্রতি সচেতন হন। কিন্তু উদাসীন পিতা-মাতা তাদেরকে আদর্শ সন্তান হিসেবে পাওয়ার কথা নয় কারণ যেখানে বয়স্ক মানুষ পরিবেশের দাস তথায় অল্প বয়স্ক শৈশবকালের সন্তান সঙ্গ দোষে পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তানে পরিণত হতে পারে। প্রবাদ আছে “সৎসঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।” এ কথাটিকে ফার্সি ভাষায় বলে- “সোহবাতে সালেহ তোরা সালেহ কুনাদ, সোহবাতে তালেহ তোরা তালেহ কুনাদ।” এ বিষয়ে আমার মাকে যিনি কথায় কথায় শ্লোক বাক্য শুনাতেন যথা তার শ্লোক- “ভালোর সাথে হাটে খায় বাটার পান, কু-মানুষের সাথে হাটে কাটা যায় দু’কান (অসম্মান)। অন্য দিকে ইংরেজিতে বলে- “A man is known by the company he keeps.” অর্থ: ‘একজন লোক তার সাথী দ্বারা পরিচিত।’ সাথীগণ ভালো হলে সে ভালো সাথীগণ মন্দ হলে সে মন্দ।
আমি যখন সাত বছরে পা দিলাম ১৪-ই অক্টোবর ১৯৪৫ সালে (২য় শ্রেণীতে পড়াশোনা করি) আমাকে আমার ধার্মিক পিতা (১৯৩২ সালে মক্কা-মদিনায় পাঁচ মাস কাটিয়ে ছিলেন এবং ১৯৫৭ সালে দ্বিতীয়বার হজে যান) তার সালাত বা নামাজের নিয়মিত সাথী করে ফেললেন ধর্মীয় বিধান পালনার্থে। আমি সেই যে সালাত আদায় করা শুরু করছি অদ্যাবধি আল্লাহর রহমতে তা নিয়মিত আদায় হচ্ছে বিরতিহীনভাবে। ঢাকা শহরে মা-বাবা আমাদের মেহমান ছিলেন যথাক্রমে ১৮ ও ৯ বছর। দু’জন চিরবিদায় নিলেন ধানমন্ডি ৫ নাম্বার রোডের বাড়ি থেকে। ঢাকায় তাদের পুরোজীবনটা আমার অফিস ও ব্যক্তিগত গাড়িতে ঘুরেছেন যা ছিল আমার ছাত্র জীবনের স্বপ্ন এবং পূরণ করেছেন শতভাগ রহমান রাহিম আল্লাহ তায়ালা। আমি মাতা-পিতার একমাত্র পুত্রসন্তান তাই আল্লাহর নিকট সর্বদা দোয়া করতাম ‘পিতা-মাতার আগে যেন আল্লাহ আমাকে তার কাছে না নিয়ে যান।’ আল্লাহ দয়া করে আমার ফরিয়াদ কবুল করেছেন। ১৯৭৮ সালে পিতার মৃত্যুর ৯ বছর পর, মায়ের মৃত্যু হয় ১৯৮৭ সালে। আল্লাহ রহম করুন, আমি আজও জীবিত আছি সক্রিয় ও সুস্থাবস্থায় এবং সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করছি পিতা -মাতার দোয়ার বরকত ও আল্লাহর বিশেষ রহমতে।
আল্লাহ দোয়া কবুল করেন বিশেষ করে ১. সন্তানের জন্য পিতা-মাতার-দোয়া। ২. মুসাফিরগণের দোয়া ৩. মাজলুমের দোয়া ৪. রোগীগণের দোয়া। আমরা দোয়া কেন করি? দোয়া করি আল্লাহর আদেশ পালনার্থে এবং তার প্রতিশ্রুতিতে অনুপ্রাণিত ও আশাবাদী হয়ে। আল্লাহর বাণী- “উদয়ুনি আসতাজিবলাকুম” অর্থ- “হে গোলামগণ! তোমরা আমাকে ডাক বা আমার কাছে ফরিয়াদ কর আমি (আল্লাহ) তোমাদের ডাকে সাড়া দিব।” (সূরা আল-মু‘মিন, আয়াত: ৬০)। আমাদের আল্লাহ অসীম উদার তাই তিনি স্বয়ং আমাদেরকে অনেক দোয়া কুরআন-হাদিসের মাধ্যমে শিখিয়ে দিয়েছেন। যিনি দোয়া কবুল করবেন তিনি দোয়া লিখে দিলেন। উদাহরণস্বরূপ-১. পিতা-মাতার জন্য দোয়া- “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা।” অর্থ: হে আমাদের প্রতিপালক! মেহেরবানি করে আমাদের পিতা-মাতাকে দয়া কর যেমনি করে তারা আমাদেরকে স্বস্নেহে-স্বযত্নে লালন পালন করেছেন আমাদের শৈশবে। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৪)।
২. জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দোয়া। “রাব্বি জিদনি ইলমা।” অর্থ: “হে আমার প্রতিপালক! দয়া করে আমার ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।” (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত : ১১)। এমনি করে বিরাজমান আছে মহা পবিত্র কুরআনে অনেক দোয়া (আল্লাহর উদারতা কাকে বলে)। যিনি দরখাস্ত মঞ্জুর করবেন তিনি আপনাকে দরখাস্ত লিখে দিলেন। এ দরখাস্ত সঠিকভাবে ও সময় মতো দাখিল করতে পারলে মঞ্জুর হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ কি আছে! বাস্তব উদাহরণ হযরত যাকারিয়া (আ:) -এর দোয়া। তিনি অতি বৃদ্ধ বয়সে আশাতীতভাবে সন্তান লাভ ইয়াহিয়া (আ:) কে যা কুরআনের সূরা আলে-ইমরানে উল্লেখ আছে।
মাছের উদরে নদীর তলদেশে অবস্থিত থাকা হযরত ইউনুস (আ:) -এর দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন ও তিনি মুক্তি পেয়েছেন অপ্রত্যাশিতভাবে। সর্বক্ষণ সিজদারত অবস্থায় রাসূল (সা.) -এর দোয়া আল্লাহ কবুল করলেন ফলে ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংঘটিত ‘বদর’ যুদ্ধে অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে মুমিনদের বিজয় অর্জিত হলো। অস্ত্রহীন ৩১৩ জন মুমিন যুদ্ধ করলেন অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত এক হাজার কাফের সৈন্যের বিরুদ্ধে এবং জয়লাভ করলেন মহান রবের সাহায্যে। এ যুদ্ধে আবু জাহেল নিহত হলো অলৌকিকভাবে। এ যুদ্ধে আল্লাহ তার রাসূল (সা.) -এর দোয়া কবুল করলেন এবং ফেরেশতা অবতরণ করিয়ে যুদ্ধে সাহায্য করলেন। আমরা আল্লাহর রহমত হতে কখনো নিরাশ হবো না। সদাসর্বদা বিশেষ করে সালাতে আল্লাহকে স্মরণ করতে এবং সালাতান্তে দোয়া করতে থাকব। বিশেষ করে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও মুমিন ভাই-বোনগণের উভয় জগতের কল্যাণের জন্য দোয়া করব। মুমিন মুসলিমগণের প্রাথমিক শিক্ষা হওয়া উচিত চার থেকে পাঁচ বছর বয়সে সূরা ক্বিরায়াত মুখস্থ, সালাত আদায়, কুরআন শিক্ষা যাতে করে সাত বছরে পৌঁছামাত্র পিতা বা মাতার সাথে প্রত্যেক বেলা সালাত আদায় করতে পারে যা পিতা-মাতার ধর্মীয় দায়িত। আমার পিতা-মাতা আমাদের ভাই-বোনগণকে নিয়ে এ ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমরা দু’ভাই ও এক বোন সাত বছর বয়স থেকে এক ভাই এক বোনের আমরণ এবং অদ্যাবধি আমার সালাত আদায় বাদ যায়নি আল্লাহর রহমতে। পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা আমাকে দিয়ে রমজান মাসে ১২-১৩ দিন মসজিদে নববী এবং মাসজিদুল হারামে উর্দু ভাষায় কুরআন আলোচনা করালেন। সময়কাল মাগরিব সালাতান্তে শুরু করে এশার নামাজের আযান শুরু হওয়া পর্যন্ত।
প্রায়ই পিতা-মাতার জন্য দোয়া করি আল্লাহর শিখানো দোয়া দিয়ে। রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা। অর্থ: “হে আমাদের প্রতিপালক! মেহেরবানি করে আমাদের পিতা-মাতাকে দয়া করুন যেমনি করে তারা আমাদেরকে স্ব¯েœহে-স্বযতেœ লালন পালন করেছেন আমাদের শৈশবে।” (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৪)।
মুমিন পিতা-মাতাগণকে অনুরোধ করব দয়া করে সন্তানগণকে প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিকভাবে সালাত আদায় ও ধর্মীয় যথাযথ জ্ঞানটুকু অর্জন করার ব্যবস্থা করুন। অতঃপর পাশাপাশি জাগতিক শিক্ষা দিন। সাধারণত অসচ্ছল পরিবারের ছেলে মেয়েরা হাফিজিয়া, আলিয়া বা কওমি মাদরাসায় পড়াশোনা করতে যায়। প্রসঙ্গত বলতে চাই আমার মতে ধর্মীয় জ্ঞান সর্বোচ্চ সম্পদ। প্রমাণ আল্লাহর বাণী- “যাদের ধর্মীয় জ্ঞান আছে এবং যাদের ধর্মীয় জ্ঞান নেই তারা কি সমকক্ষ? (নিশ্চয়ই নয়) বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। (সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৯)। যাদের ধর্মীয় জ্ঞান আছে তারা আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ জাতি। প্রমাণ আল্লাহর বাণী- “তোমরাই সর্বোত্তম উম্মাত, মানবজাতির (সর্বাত্মক কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভূত করা হয়েছে (পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে), তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজ হতে নিষেধ কর ও আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চল।” (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১১০)। যথাযথ ধর্মীয় জ্ঞান ব্যতীত আল্লাহর এ আদেশ পালন করা সম্ভব নয় কাজেই শ্রেষ্ঠজাতি হতে হলে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা অত্যাবশ্যক।
আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যক্তি যাদের অনেকেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এবং মসজিদ মাদরাসার যথাক্রমে খতিব বা ঈমাম ও শিক্ষক। অনেকেই বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় মজলিসে ওয়াজ নসিহত করেন। মানুষকে সৎকাজের আদেশ, উপদেশ ও অসৎ কাজে থেকে বিরত রাখার জন্য কুরআন হাদিস অবলম্বনে বক্তৃতা করে থাকেন এবং ধর্মীয় জ্ঞান অবলম্বনে জ্ঞানী করার লক্ষ্যে। ডা: জাকির নায়েক একজন অসাধারণ ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, তার বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে অনেকেই ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেছেন। আমাদের দেশে একজন হাফেজে কুরআন নাম সালেহ আহমেদ তাকরিম, সত্যি তিনি আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দা যিনি বাংলাদেশকে বিশ্বে নতুন করে পরিচিত করেছেন। বর্তমান ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীগণের পক্ষ থেকে যে উপহার তাকে প্রদান করা হয়েছে তা তাকে আল্লাহর রহমতে ধনাঢ্য করেছে। তিনি আল্লাহর বিশেষ রহমতপ্রাপ্ত। আল্লাহর বাণী- আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তার বিশেষ রহমতে ভূষিত করেন এবং আল্লাহ মহা করুণাময়। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১০৫)।
রাসূল (সা.) বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ; কারণ তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন স্বয়ং আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহর বাণী- “দয়াময় আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন (রাসূলুল্লাহ সা.কে)।” (সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ১-২)। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন ব্যতীত আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা পালন করা সম্ভব নয় যথাযথ পালন তো দূরের কথা। ফলে পরকালে তাদের পরিণাম হবে ভয়াবহ অর্থাৎ জাহান্নাম যা কঠোর শাস্তির স্থান।
হে মহাজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালা! দয়া করে আপনার গোলামগণকে ধর্মীয় জ্ঞান দান করে ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী করুন। আমিন।

Share.

মন্তব্য করুন