বহু বহু কাল আগের কথা। এক চাষির অদ্ভুত একটা গুণ ছিল। কোনো মানুষের এমন গুণ থাকার কথা শোনা যায়নি। সেই গুণটা সত্যিই বিশেষ ধরনের। কখনো কোনো মানুষের এই প্রতিভা ছিল, এমনটা জানা যায়নি। কী সেই অসামান্য গুণ? কী তার বিশেষত্ব? গুণটা হলো: ওই চাষি জীব-জন্তুর ভাষা বুঝতে পারেন। কে কী বলছে, সেটা তিনি পানির মতো পরিষ্কার বোঝেন। তিনি নিজে অবশ্য জীব-জন্তুর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারেন না। না বলতে পারলে কী, ওরা কী বলছে না বলছে স্পষ্ট সব বুঝতে পারেন। বিরল এই ক্ষমতা যার কাছ থেকে চাষি পেয়েছেন, তিনি একজন দরবেশ। অলৌকিক অনেক ক্ষমতা ছিল তার। দরবেশ যখন এই কায়দা-কৌশলটি চাষিকে শেখান, একটা শর্ত দিয়েছিলেন তখন। সেই শর্তটা অত্যন্ত কঠিন। ব্যাপারটি যদি চাষি কাউকে বলে দেন, তক্ষুনি তার মৃত্যু ঘটবে। সে কারণে জীবজন্তু পশুপাখিদের কথাবার্তার বিষয় অন্য কোনো মানুষকে বলা একেবারেই বারণ। বলে ফেললে তৎক্ষণাৎ মরণ।
চাষি সেই অসম্ভব ধরনের কঠিন শর্ত মেনেই ব্যাপারটি শিখেছিলেন। কাউকেই তিনি বিষয়টা সম্পর্কে বলেন না। বললেই মহাবিপদ। সঙ্গে সঙ্গেই ঢলে পড়তে হবে মরণের কোলে। এমন বিপজ্জনক ঝুঁকি ভুলেও নেয়া যায় না। এ কারণে চাষি সব সময়েই সচেতন। এই বিরল গুণ দুনিয়ার অন্য কোনো মানুষের নেই। একমাত্র ওই দরবেশের ছিল। তিনি আর বেঁচে নেই।
জীব-জন্তু পশু-পাখির ভাষা বুঝতে পারলে খুব মজা। কিন্তু কাউকে বলে ফেললেই সর্বনাশ। মাঝে মাঝে অন্যকে বলতে যে ইচ্ছা করে না, তা নয়। চাষি এই কথাও ভালো করে জানেন যে, ক্ষণিকের ভুল মহা সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। নিজের বিশেষ বিদ্যা তিনি কখনোই প্রকাশ করেন না। চিরদিন কি সমান যায়? না, যায় না। একবার চাষি পড়লেন মহাবিপদে। সত্যি সত্যিই গুরুতর বিপদ। একেবারে জান নিয়েই টানাটানি। অকালে মারা পড়ার জোগাড়। আকস্মিকভাবে সেই বিপদ থেকে বেঁচেও গেলেন। বাঁচার অবশ্য কথা ছিল না তার। জীব-জন্তু, পশু-পাখির ভাষা জানা থাকায় মহাবিপদে পড়তে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি বেঁচেও গেলেন তাদেরই কল্যাণে। সে এক অদ্ভুত, রহস্যঘন জমজমাট গল্প। সেই গল্পের নানান দিক, খুঁটিনাটি জানা যাক এবার।
একদিন সন্ধ্যাবেলার ঘটনা। গোয়ালঘরের সামনে কী এক কাজে গিয়েছিলেন চাষি। গোয়াল ঘরে চাষির গাধা ও ষাঁড়ের বসবাস। দুই প্রাণীর মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল। চাষি কান পেতে শুনলেন তাদের সেই আলাপচারিতা। মন দিয়ে শুনতে হলো। ব্যাপার অত্যন্ত গুরুতর। শিউরে ওঠার মতো। অতএব না শুনে উপায় নেই।
খেতখামারে সারাদিন খাটা খাটুনির পর ষাঁড় ফিরে এসেছে। লাঙল টেনে টেনে ভীষণ ক্লান্ত সে। এখনো হাঁপাচ্ছে। ষাঁড় তাগড়া জোয়ান হলে কী হবে, সেই ভোর থেকে প্রচণ্ড কাজের চাপ গেছে। সে কারণে বেশ কাহিল অবস্থা। সারা গায়ে ভীষণ ব্যথা। ঘাড় ফেরানো যাচ্ছে না। এই যন্ত্রণা সহ্য করার মতো নয়। গাধার কাছে সেই দুঃখ কষ্টের করুণ বর্ণনা দিচ্ছিল ষাঁড়। আর কাকেই বা বলবে। সঙ্গী বলতে এই গাধাই। ষাঁড় বলছে,
আর পারি না রে ভাই। প্রতিদিন হাড়ভাঙা খাটুনি করতে হয়। একটা দিনও ছুটি পাই না। মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো, এর চেয়ে মরে যাওয়াই বোধ হয় ভালো। কী করা যায় বলো তো? ভালো একটা পরামর্শ দাও না বন্ধু!
গাধার বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারে খারাপ না। যদিও সে গাধা, তারপরেও এই জাতের অন্যদের মতো হাবাগোবা ভ্যাবলা নয়। সে বন্ধুকে বলে,
হুম ভায়া, তুমি ঠিকই বলেছো। এভাবে চলতে পারে না। অনেক কাল ধরে দেখে আসছি তো। আর কত দিন? খোদার তিরিশ দিন এই জোয়াল টানতে টানতেই তোমার জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। শান্তি স্বস্তি কোনোদিনই পাবে না। এই বিশ্রী অবস্থা থেকে বাঁচার উপায় অবশ্য একটা আছে। যদি শুনতে চাও তো বলতে পারি।
কী, কী উপায়? বলো বন্ধু। এই বিপদে তুমিই আমার একমাত্র ভরসা। তোমার চিকন বুদ্ধির উছিলায় হয়তো এ যাত্রা বেঁচেও যেতে পারি। বলো, ঝটপট বলো, কী সেই উপায়? অবশ্যই মেনে চলবো তোমার কথা।
গাধা ভারিক্কি চালে বলে,
কাল সকালবেলা এমন ভান করো যে, তুমি ভয়ানক অসুস্থ। কোনো খাবার-দাবারই ছোঁবে না এখন থেকে। না খেলে তোমার শরীর দুর্বল হয়ে যাবে। যে ব্যাটা তোমাকে দিয়ে রোজ লাঙল টানায়, সেই রাখালকে বোকা বানাতে হবে। বোকা বানানো গেলেই তোমার কাজ হাসিল হবে। জোয়াল টানার ধকল আর সইতে হবে না।
সেটা কী রকম? না খেয়ে থাকলে কেমন করে সমস্যার সমাধান হবে? একটু খোলাসা করে বলো শুনি। আমি তো আগামাথা কিছু বুঝতে পারছি না।
গাধা বিজ্ঞের মত বলে,
আহা হা। অত অধৈর্য হচ্ছো কেন বাপু। পুরো প্ল্যানটার খুঁটিনাটি তোমাকে বলে দিচ্ছি। শুনলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমার বিশ্বাস, এই কৌশলটা ঠিক ঠিক কাজে দেবে। মানুষরা অত চালাক নয়। তারা ধরতেই পারবে না, কোথা থেকে কী ঘটেছে।
বেশ তো বলো শুনি। কী কী কাজ আমাকে করতে হবে। কাল ভোর থেকে গুরুতর ধরনের অসুস্থ হওয়ার ভান করতে বলছিলে তুমি। আর হ্যাঁ, ঘাস-বিচালি, খড়-ভূষি খেতে আমাকে মানা করছিলে বোধহয়।
হ্যাঁ হ্যাঁ। মানা করছিলাম ঠিকই। না খেলে ক্রমেই তুমি কমজোরি হতে থাকবে। রাখাল ছোকরা তোমাকে লাঙল টানতে আর মাঠে নেবে না। রোগা দুবলা ষাঁড় দিয়ে কী করবে সে? তাকে দিয়ে লাঙল টানানোর মতো এমন কঠিন কাজ করানো যায়? যায় না। অতএব বিশ্রাম পাবে তুমি। দিনভর খাটনি থেকে রেহাই পাবে। আরামে থাকবে।
আচ্ছা বেশ। তাই হবে। তুমি যেমন যেমন বললে, তাই করবো আমি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ভাই। চমৎকার একটা উপকার করলে আমার।
চাষি মন দিয়ে শুনলেন ষাঁড় ও গাধার এই বিচিত্র ধরনের কথোপকথন। রাতে চিন্তা করে নিলেন কেমন করে নতুন এই পরিস্থিতি সামাল দেবেন। যেমন অবস্থা, তেমন ব্যবস্থা। পরদিন সকালবেলা তিনি রাখালকে ডেকে বললেন,
এক কাজ করো বাপু। আমাদের ষাঁড়টা বোধ হয় অসুস্থ। আজ অন্য ব্যবস্থা করো। ষাঁড়টাকে আজকের মত বিশ্রাম নিতে দাও। ও যখন সুস্থ হয়ে উঠবে, তখন আবার মাঠে নিয়ে যেয়ো। আজ ওই নাদুস নুদুস গাধাটাকে নিয়ে মাঠে নিয়ে কাজ চালাও। ওকে দিয়েই লাঙল টানানোর কাজ করাবে।। রুগ্ণ ষাঁড়টা আপাতত বিশ্রামে থাকুক।
রাখাল তাই করে। মনিবের হুকুম। মানতে সে বাধ্য। ষাঁড়ের বদলে হঠাৎ এই গাধার কাঁধে কেন যে জোয়াল দিতে হবে, সে রহস্য তার জানা নেই। জানার কথাও না। মনিবের কথামত রাখাল গাধাকে নিয়েই মাঠে গেল। লাঙল টানতে হলো চতুর গর্দভকে। দিনভর। বিরতি বলে কিছু নেই। উঃ মাগো, সে যে কী খাটুনি! মাঝে মধ্যে বেধড়ক পিটুনিও খেতে হলো। একটু আলসেমি করলেই ব্যস। বেদম পিটুনি। পাঁচনের নির্মম বাড়ি। উহ, সে যে কী যন্ত্রণা। গায়ে দাগ হয়ে যায়। রক্ত জমাট বেঁধে থাকে।
সন্ধ্যার পর মহা শ্রান্ত হয়ে গাধা ফিরল বাড়িতে। মরো মরো অবস্থা তার। একদিনেই যেন পাঁচ দিনের খাটনি খাটানো হয়েছে তাকে দিয়ে। সারা শরীরে অসহ্য টনটনে ব্যথা। দাঁড়াতে পারছে না সে। টলে পড়ে যাচ্ছে। বড্ড মুশকিল হলো। ষাঁড়কে দুষ্টবুদ্ধি সে-ই দিয়েছিল। এখন তার মাশুল দিতে হচ্ছে। এই-ই বুঝি নিয়ম। দুষ্টুমির খেসারত দেওয়া লাগছে। উল্টা তার ঘাড়েই জোয়াল এসে পড়বে, সেটা কল্পনাও করেনি গাধা।
সন্ধ্যার পর চাষি গেলেন গোয়ালঘরের সামনে। উদ্দেশ্য, গাধা ও ষাঁড়ের কথাবার্তা শোনা।। তাদের নতুন ফন্দি ফিকির, কৌশল কী বিস্তারিত জানা দরকার। দুষ্টু জন্তুগুলোর গোপন মতলব আগেভাগে জানা থাকলে অনেক সুবিধা। সে অনুযায়ী তাড়াতাড়ি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। উটকো কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় না।
গাধা এখনো হাঁপাচ্ছে রীতিমত। ষাঁড় জিজ্ঞেস করছে তাকে,
তারপর বলো কী খবরাখবর? কেমন কাটলো তোমার আজকের দিন? লাঙল টানার কাজকম্ম জীবনে এই প্রথমবার করলে তুমি। অভিজ্ঞতাটা একেবারেই নতুন। একই সঙ্গে দামিও বটে। বলো তো শুনি, সারাটা দিন কেমন গেল তোমার?
জোয়াল টানতে টানতে গাধা দিনভর ভেবেছে পরবর্তী কর্মকৌশল নিয়ে। বন্ধু ষাঁড়কে যা যা বলবে, মোটামুটি ঠিকঠাকও করে নিয়েছে।
ষাঁড়ের প্রশ্নের জবাবে সে বলে,
আগে তোমার খবর শুনি। লাঙল টানা যে কত মেহনতের কাজ, তুমি তা ভালোই জানো। এতে নতুন কিছু তো নেই।
ষাঁড় ধন্যবাদ জানায় গাধাকে,
তোমার দেয়া বুদ্ধিটা আসলেই চমৎকার। দারুণ কাজে লেগেছে আমার। দিনভর বিশ্রাম করতে পেরেছি। এমন সুযোগ তো জীবনে মেলেই না। তোমরা যখন মাঠে ছিলে, সে সময় লুকিয়ে চুরিয়ে খেয়েও নিয়েছি কিছুটা। চমৎকার কেটেছে আজকের দিন। আগামীকালও একই কায়দা করতে চাই। তা তুমি কী বলো?
শুনে গাধা চেঁচিয়ে উঠে। ষাঁড়কে সাবধান করে দেয় সে,
খবরদার বন্ধু। ওই কাজ ভুলেও করতে যেয়ো না। এমনিতেই তোমার জন্য খুব খারাপ খবর আছে। আজকের মতো কালকেও যদি ভান টান করতে যাও, আরো বেশি ঝামেলায় পড়বে। জান বাঁচানোই মুশকিল হয়ে যাবে।
ষাঁড় মহাচিন্তিত। গাধা এসব কী বলছে? খারাপ খবর আবার কোন্টা? এমনিতেই ঝুট ঝামেলার অন্ত নেই। তার ওপর নতুন সমস্যা এসে পড়লে কেমন লাগে!
গাধাকে শুধায় সে,
খারাপ খবর কিসের? জোয়াল টানতে হলো দিনভর। নতুন আবার কী ঘটলো?
গাধার উত্তর :
আমার পরামর্শ হলো, তুমি কাল থেকে আর অসুস্থ হওয়ার ভান করবে না। আগামীকাল থেকে যথারীতি মাঠে যাবে। জমিতে লাঙল টানবে দিনভর। এর মানে হলো আগেকার রুটিন যেমন ছিল, তেমনটাই চলতে থাকবে। বুঝতে পারছো, কী বলতে চাইছি?
ষাঁড় ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মুখ বেজার করে জানতে চায়,
না রে ভাই, তোমার কথা স্পষ্ট বুঝলাম না আমি। অসুস্থতার ভান করতে তো তুমিই বলেছিলে। এখন আবার উল্টা কথা কইছ কেন?
হাঁপাতে হাঁপাতে গাধা বলে,
সাধে কী আর উল্টা কথা কইছি রে ভাই। কারণ আছে তার। ব্যাপার অত্যন্ত গুরুতর।
এটুকু বলে গাধা চুপ করে। ইচ্ছে করেই থেমে থাকে সে। ওদিকে ষাঁড়ের তর সয় না। কী ঘটেছে, সেটা জানবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
বন্ধুকে তোয়াজ করে বলে,
গুরুতর ব্যাপারটা কী ভাই? শুনেই আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে।
গাধা করুণ কণ্ঠে জানায়,
সত্যি, ভয় পাওয়ার মতোই ব্যাপার। আমাদের মনিব আজ রাখালকে বলেছে, দ্যাখো হে বাপু, ষাঁড়টা কেমন যেন রোগা হয়ে যাচ্ছে। আগামীকালই এটাকে কসাইয়ের কাছে বেচে দাও। বলা তো যায় না,কখন না কখন মরে যায়। ষাঁড় মরে গেলে বড়ো বেশি লোকসান হয়ে যাবে। তারচেয়ে সময় থাকতে থাকতেই কিছু একটা করে ফেলা ভালো।
ষাঁড় হাহাকার করে ওঠে। প্রাণের ভয়ে, আতঙ্কে মুহূর্তের মধ্যে তার চোখ ভিজে যায় পানিতে। গাধার কাছে মিনতি জানায় সে,
আমাকে বাঁচাও বন্ধু। এই মহাবিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করো। ভালো একটা বুদ্ধি দাও। কসাইয়ের কোপে এমন অকালে মরতে চাই না আমি। আরো কিছু দিন এই দুনিয়ায় বাঁচতে চাই। তুমি আমাকে রক্ষা করো। তোমার দু’টি পায়ে পড়ি।
গাধা বিজ্ঞের মতো হেসে বলে,
সে জন্যই তো বলছি, এখন থেকে আগের মত স্বাভাবিকভাবে খাবার-দাবার খাও। যতো দ্রুত পারো, সুস্থ হয়ে ওঠো। তুমি যদি সুস্থ হও, রুটিন কাজকর্ম করো, তাহলে আর কোনো সমস্যা নেই। কসাইয়ের কাছে ওরা তোমাকে তাহলে আর বেচবে না।
ষাঁড় আশ্বস্ত হয়। প্রাণ ফিরে পায় যেন। একটু ধাতস্থ হয়ে বলে,
আচ্ছা বেশ। তোমার কথা মানলাম। যা যা বললে, আমি তাই তাই করবো।
খাঁড়ের কথা শুনে চাষি ফিক করে হেসে ফেলেন। সহজে থামে না সেই হাসি। এই হাসিই যে তার কাল হবে, কে জানতো! হয়েছে কী, চাষির বৌ কী একটা কাজে তখন আসছিল গোয়ালঘরের দিকে। স্বামীকে হঠাৎই ফিকফিক করে হাসতে দেখে থমকে দাঁড়ায় বৌ। অবাক হয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করে,
কী ব্যাপার? একা একা হাসছো কেন তুমি? এখানে তো কেউ নেই। হাসির মত কী ব্যাপার ঘটলো বলো তো। রহস্যটা কী?
স্বামী চুপ। কোনো কথা জোগায় না তার মুখে। সত্যি কথা বললে বিপদ। মহাবিপদ যাকে বলে। নির্ঘাত মৃত্যু। সুতরাং এখন এই মুহূর্তে বৌয়ের প্রশ্নের কোনো জবাব না দেয়াই উত্তম। সেটাই বুদ্ধিমানের মতো কাজ।
বৌ আবার জানতে চায়,
কই বললে না তো, কেন একা একা হাসলে তুমি? আসলে কী ঘটেছে, বলো না।
স্বামী এবারো নিরুত্তর।
বৌ রেগে যায়। স্বামী তাকে কোনো পাত্তা দিচ্ছে না। জবাবই দিচ্ছে না প্রশ্নের। রেগে ওঠে সে মুহূর্তেই। মুখ ঝামটা দিয়ে বলে,
হাবলার মতো চুপ করে আছো কেন? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
চাষি তারপরও কিছু বলেন না। বৌ আরো ক্ষিপ্ত হয়।
আমার কথা কী একেবারেই কানে যাচ্ছে না তোমার? এই আমি এখনই চললাম বাপের বাড়ি। থাকো তুমি তোমার ছাতার সংসার নিয়ে।
চাষি দেখেন পরিস্থিতি গুরুতর। ক্রমেই জটিলতর হয়ে উঠছে। বৌকে তিনি খুবই ভালোবাসেন। তাকে হারানোর কথা চিন্তাও করা যায় না। কখনোই বৌয়ের কাছে কোনো কথা গোপন করেন না চাষি। এবারই ব্যতিক্রম হলো। বৌ এ কারণেই বেশিমাত্রায় রাগ করেছে। তাই তাকে দোষ দেওয়াও চলে না।
কয়েক মিনিট ধরে কী যেন ভাবলেন চাষি। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন, সত্যি কথাটাই বলবেন বৌকে। মরণ যদি কপালে থেকেই থাকে, থাকলো। একদিন না একদিন তো মরতে হবেই। ভয় করে লাভ কী! চাষি তখন বললেন বৌকে,
এখন কেন আমি হাসলাম, সেই ব্যাপারটা তোমাকে আগামীকাল বলবো, কেমন। একটা মজার ব্যাপার ঘটেছে। সেটা জানতে পেরেই হেসেছি আমি। কালকে সেই ঘটনাটা তোমাকে বলবো, কেমন? আজকের রাতটা কোনোমতে সবুর করো।
মৃত্যুর প্রস্তুতি নেয়া দরকার। তাই অনেক রাত পর্যন্ত জাগতে হলো চাষিকে। মহা জরুরি কাজকর্মগুলো সেরে নিতে হয়। জীবনের শেষ রাত বলে কথা। আগামীকালই সব শেষ হয়ে যাবে। ভোর হওয়ার আগেই ঘুম ভেঙে গেল চাষির। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। দুঃস্বপ্ন দেখেছেন অনেক। মনটা ভার ভার।
ভোর হওয়ার আগে মোরগের ডাক শোনা গেল। কোঁকর কোঁ, কোঁকর কোঁ। পুবের আকাশ আস্তে আস্তে ফরসা হতে শুরু করেছে।
অস্থির মনে পায়চারি করছেন চাষি।
পোষা প্রাণীগুলো কে কী বলছে, শোনার বড়ো আগ্রহ চাষির। আজই তার জীবনের শেষ দিন কিনা। আর তো কখনো শুনতে পাবেন না। শেষবারের মতো শোনা। তিনি শুনতে পেলেন মুরগির দলকে আচ্ছাসে ধমকাচ্ছে মোরগ। বাড়ির পোষা কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠলো এসময়। কুকুর মোরগকে বলছে,
আহা থামোই না বাপু। অত চেঁচামেচি করছো কেন তুমি। এই বাড়িতে চরম দুঃখের একটা দিন আজ। আমাদের মনিব আজকেই মারা যাবে।
মোরগ একথা শুনে ভীষণ অবাক। বলে,
কেন, কী হয়েছে? আজ কেন দুঃখের দিন? আমি তো কিছু শুনিনি।
শোনো তাহলে। ঘটনা গুরুতর।
কুকুর পুরো ঘটনা জানায় মোরগকে। দু’জনেই দুঃখিত হয়। মনিব বড়োই ভালোমানুষ। মনিবকে তারা ভীষণ পছন্দ করে। মোরগ বলে,
আমাদের মনিব না আসলেই একটা এক নম্বরের বোকা।
কুকুর একথা শুনে অবাক। বলে,
কেন একথা বলছো? বোকামির কী দেখলে তুমি?
বৌকে তিনি শাসনে রাখতে পারেন না।
কুকুর ভেবে দেখে কুকুর ঠিক কথাই বলেছে। সে জানতে চায়,
আমাদের যিনি মালিক, তার এখন কী করা উচিত বলে মনে হয় তোমার? কী করলে তিনি বাঁচতে পারেন?
মোরগ কোঁকর কোঁ বলে ডাক ছাড়ে। তারপর হাসতে হাসতে বলে,
উনাকে যা করতে হবে, সেই কাজটা খুবই সহজ। বৌকে আচ্ছামতো পিটুনি দিলেই মামলা ডিসমিস হয়ে যাবে। বৌয়ের আলগা কৌতূহল তখন আর থাকবে না। একদম চুপচাপ থাকবে। থাকতে বাধ্য। জানো না, মারপিটের চেয়ে ভালো কোনো ওষুধ নেই দুনিয়ায়। তুমি বুঝতে পারছো ব্যাপারটা?
হুম, বুঝলাম। আহা রে, আমাদের মনিব যদি আজকে সেই কাজটাই করতেন। কী যে ভালো হতো তাহলে। ভয়ঙ্কর একটা বিপর্যয় থেকে আমরা সবাই বাঁচতে পারতাম। তিনি নিজেও বাঁচতেন। আমরাও খুশি হতাম। উনার এখনই সে কাজটা করে ফেলা উচিত। নাহলে বৌটা নতুন কোনো ঝামেলা পাকিয়ে ফেলতে পারে।
কুকুর ও মোরগের কথা শুনে চাষি ভরসা পান। মনে জোর আসে। তার মনে হতাশার যে কালো মেঘ ছিল, সেটা দ্রুত কেটে যায়। একটা লাঠি হাতে বৌকে তখুনি তাড়া করেন তিনি। বলা নেই, কওয়া নেই, বৌকে বেদম পিটুনি দেন। একটানা, অনেকক্ষণ ধরে।
ঘটনার আকস্মিকতায় বৌ হতভম্ব। স্বামীকে কোনো প্রশ্ন করা দূরে থাক, আত্মরক্ষায়ই ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে।
জীবনে আর কখনো কোনো বিষয়ে চাষিকে জোরজবরদস্তি করেনি বৌ।
স্বামীর হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে উচিত শিক্ষা হয়েছে তার।
Share.