হঠাৎ একদিন মুশিদপুর গ্রামে হইচই পড়ে গেল। কেউ বলে এটা ভূতের কাজ। কেউ বলে জিনের। কেউ আবার বলে, এটা নেংটি ইঁদুরের কাজ। যারা ইঁদুরের কথা বলল, তাদের ধারণা শেষ পর্যন্ত টিকল না। কারণ ইঁদুর করলে একজনের জাল কাটবে। না হয় দুইজনের কাটবে। তক্কের খাতিরে না হয় ধরেই নিলাম, তিন বা চারজনের জাল কাটবে। কিন্তু সবার জাল একই দিনে কাটা পড়বে এটা তো হতে পারে না?
শিব নদের ধারে মুশিদপুর গ্রাম। কোন বড় শিল্পীর তুলিতে জলরঙে আঁকা এক ছবি যেন। একটা গ্রাম, গ্রামে ছোট বড় অনেক বাড়ি। উঁচু নিচু নানা পদের গাছ। কোথাও নারকেল গাছের সারি তো কোথাও তালগাছের। একটু পরেই আবার ছোট গাছের ঝুপড়ি। পাশ দিয়ে বয়ে চলা শিব নদ। নদে চলা পালতোলা নৌকা। ঘাটে বাঁধা অনেক ডিঙি। ঠিক এমন এক ছবি। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে চারুকারুর ক্লাসে প্রাকৃতিক দৃশ্যের যেমন ছবি আঁকে; ঠিক তেমনই।
গ্রামের পূবধারে নদ। আর এই ধার ঘেঁষেই জেলে পাড়া। এরা সবাই মুসলমান। এই পাড়াকে কেউ বলে ব্যাবসিদার পাড়া, কেউ বলে ধাওয়া পাড়া। এই জেলেরা শিব নদে মাছ ধরে আর চৌবাড়িয়া হাটে বেচে। বড় হাট। এই হাটও শিব নদের ধারেই। শুক্র ও সোমবার হাট বসলেও প্রতিদিন বিকালে বসে বাজার। বিশেষ করে মাছের বাজার। নদীর তাজা মাছ কিনতে অনেকেই আসে এই বাজারে। দুর থেকেও আসে। প্রতিদিনের সেই মাছের বাজার হঠাৎ একদিন বসল না। বাজারে একটা হইচই পড়ে গেল। নিরাশ হয়ে ফিরে গেল ক্রেতারা সব । মাছ আসবে কী করে, সবার জাল যে কাটা পড়েছে গেল রাতে।
এই জাল কাটা নিয়েই হইচই পড়ল। জেলে পাড়ার হইচই নিমিষেই ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রাম জুড়ে। গ্রামের অনেকেই সমবেদনা জানাতে আসে জেলে পাড়াতে। কেউ কষ্ট পায় জেলেদের কষ্ট দেখে, কেউ আবার কষ্ট পায় ক’দিন তাজা মাছ খেতে পাবে না বলে। কিন্তু কেউ ভেবে পায় না, এক সাথে সবার জাল কাটা পড়ল কীভাবে? আর যে কাটল, তার রাগ এক সাথে কেনই বা সব জেলেদের ওপর হলো? নানাভাবেই ভাবে মানুষ। কিন্তু কোন হিসাবই মিলাতে পারে না। যেনতেনো করে কাটা নয়, ফালি ফালি করে কাটা। জোড়াতালি দিয়েও কাজ চালানো যাবে না। এখন সবার মাথায় হাত।
এই হইচইয়ের মধ্যেই জেলেদের মাথায় হঠাৎ এক বুদ্ধি এল। একজোট হলো সারা পাড়া। যাদের মধ্যে এতদিন রেশারেশি ছিল, শত্রুতা ছিল, তারাও এক হলো। কারো কারো বাড়িতে কিছু পুরাতন জালও ছিল। সেই জালগুলো এক করে তারা মিলে মিশে মাছ মারতে লাগল। কিন্তু এতে অভাব মিটে না। তবে টাকা পয়সার অভাব আর বুদ্ধির অভাব এক জিনিস নয়। জেলেদের বুদ্ধি চিরকালই বেশি। এক নতুন বুদ্ধি এল তাদের মাথায়। দিনের বদলে তারা রাতের বেলা জাল শুকাতে লাগল। রাতের বেলা জাল বাহিরে আড়ে ঝুলিয়ে রেখে পালাক্রমে পাহারা দিতে লাগল তারা। তাদের ধারণা আবার জাল কাটতে কেউ না কেউ আসবেই। এইভাবে সপ্তাহ পার হলো। কিন্তু কেউ আর জাল কাটতে এল না।
এই হইচই কিছুটা থিতু হতেই আর একটা হইচই বাধল নতুন করে। হুচেন ধাওয়ার নাতি ইছুপ এবার হইচই ফেলল। ইছুপের বয়স আর কতটুকুই হবে? বড় জোড় সাত কি আট। বেশ রোগা পাতলা। বুকের কাঠি গনা যায়। ঐ জিরজিরে শরীর নিয়েই সে দাদার সাথে বিলে নদীতে মাছ ধরতে যায়। লঘা ঠেলতে পারে বৈঠাও মারতে পারে। তবে সেই সময় বুকটা তার খুবই ওঠানামা করে কামারের হাপরের মত। দাদার তখন দয়া হয়। মনে মনে ভাবে, কাল থেকে আর নিয়ে আসবে না। কিন্তু পরেরদিন ভোরে ঠিকই ঘুম থেকে ডেকে তোলে। আবার সাথে নিয়ে বের হয়। উপায় নেই। ইছুপই তার একমাত্র অবলম্বন। ইছুপের বাবা মা নেই। বিলে মাছ মারতে গিয়ে সাপে কেটে মরেছে ইছুপের বাবা। ইছুপ তখন মায়ের কোলে। ইছুপ বড় হতেই মায়ের আবার বিয়ে হল। অবশ্য ইছুপের দাদাই এই বিয়ে জোর করে দিয়েছিল। এখন ইছুপের বাপ মা বলতে গেলে তারা দাদা দাদিই।
উছুপকে এক ভোরে ডাকতে গিয়ে তার দাদা দেখে সে বিছানাতে নেই। দাদা প্রথমে ভেবেছিল ইছুপ ঝোপের ধারে পেচ্ছাপ বা পায়খানা করতে গেছে। প্রতিদিন যেমন যায়। কিন্তু না, পরে সেটা মিথ্যা হল। সারা পাড়া খুঁজলো তার দাদা-দাদি। ইছুপকে কোথাও পাওয়া গেল না। একটা হইচই পড়ে গেল জেলে পাড়াতে। নদের ওপারে পূব আকাশে তখন সূর্য উঠছে। এমন সময় গ্রামের দক্ষিণপাড়া থেকে বৃদ্ধ মুবারক হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল- এই হুচেন, তুর লাতির কী হোচে? সে তো মুনে হয় পাগল হোচে?
ক্যান দাদা, তুমি তাক কুনটে দেকলেন? আমরা তো খুঁইজা হয়রান? মুবারকের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ে হুচেন।
তুর লাতি লাটির আগাত কাপড় বাইন্দ্যা ঘুরোচে। তার কাঁধে একটা দাঁড়িপাল্লাও আচে।
ও খুদা, কী সব্বনাশে কতা বুলোচেন? এ আবার কেমুন কতা?
সত্যি কতারে হুচেন। তুরা গিয়া ওকে ধরেক। না হোলে বড় বিপদ হোতে পারে। মুবারকের কথা শুনে হুচেন আর দাঁড়াল না। সে ঝেড়ে দৌড় দিল দক্ষিণপাড়া বলে। তার সাথে আরও দু’দশজন দৌড় দিল।
গ্রামের দক্ষিণপাড়াতে গিয়ে সবার চোখ কপালে উঠল। এই হাড়জিরজিরে পুচকে ইছুপের শরীরে এত শক্তি এল কোথা থেকে? এ যে গোখরো সাপের মত ফোঁপায়। নিঃশ^াস তোলাফেলার সময় দুই ঠোঁট এক জায়গাতে করে থুরথুরি বাজায়। হাতে একটা মোটা কঞ্চি। তার মাথায় সাদা কাপড় বাঁধা। কাঁধে তার দাদার মাছ বেচার দাঁড়িপাল্লা। দৌড়ানোর সময় হাতের কঞ্চি ওপরে তুলে বলছে- সবাই চোর সবাই চোর। দাঁড়ি চোর দাঁড়ি চোর। কথাগুলো মিছিলের শ্লোগানের মত শোনায়। তার কথাতে আজ ভদ্দলোকের ভাষা। কথা শুনে মনেই হয় না, সে হুচেন জেলের নাতি। তার এই ভদ্দলোকী কথা শুনে মানুষের সন্দেহ হয়। কেউ কেউ বলে- এটা হুচেনের লাতি লয়, অন্য কেউ। কালো ইছুপকে এখন আরও কালো দেখায়। দিনে বলেই যা একটু চেনা যায়। রাতের বেলা সে আন্ধারের সাথে মিশে থাকবে। তার কাছে একা যেতে সবাই ভয় পাচ্ছে। এমন কি হুচেন নিজেও নাতির কাছে যেতে ভয় পায়। ইছুপ ধরা দিতে চায় না। যে যায় তার দিকেই তেড়ে আসে। থুতু মারে, আবার কামড়াতেও চায়। অবশেষে চার পাঁচজন এক সাথে গিয়ে ইছুপকে চেপে ধরল। তবুও তাকে আটকানো মুস্কিল। তার গায়ে যেন টারজানের শক্তি। আরও কয়েকজন লেগে পাঁজা করে ইছুপকে নিয়ে আনা হলো। খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হলো হুচেনের বারান্দায়। উপায় নেই, ছেড়ে দিলেই দৌড় মারে।
এভাবে সারাদিন গেল। হুচেনের বাড়িতে লোক ধরে না। গোটা গ্রামের মানুষ যেন তার বাড়িতে। হুচেনের মেয়ের বিয়েতেও এত মানুষ আসেনি। কেউ বলে একে জিনে ধরেছে। কেউ আবার বলে ভূতে। মাজা ভাঙা এক বুড়ি বলে- এই ছোঁড়া দুনিয়ার বজ্জাত। দুপুর-তেপুর নাই। সারা মুল্লুক ঘুরে বেড়ায়। কালির থানে একদিন মুতিচোলো। লে একন বুঝ? ওক কালিতে ধরিচে। আরও কত লোকে কত কথা বলল। ইছুপ সবার দিকে শুধু কড়মড়িয়ে তাকায়। তার দাদা-দাদি হাপুস হয়ে কাঁদে। অবশেষে পাড়ার কয়েকজন মুরুব্বি মিলে দুই ক্রোশ দূর থেকে এক মওলানাকে ডেকে আনলেন। সে ভূত-জিন ছাড়াতে ওস্তাদ। এলাকাতে তার বেশ সুনাম আছে। বড় আলেম। জিন নাকি তাকে সালাম করে। তার সাথেও নাকি কয়েকটা জিন থাকে। এমন কথাই চারিদিকে ছড়িয়ে আছে ঐ মওলানা সম্পর্কে।
মওলানা এসে ইছুপকে দেখেই কেমন জানি রেগে গেলেন। তার রাগ, ইছুপ তাকে সালাম দেয়নি বলে। ইছুপ তো এখন ইছুপ নয়, সে এখন জিন। তবে মওলানাও বলতে ছাড়লেন না। তিনি সবাইকে ডেকে বললেন- এই জিন যেন তেন জিন নয়; এটা বড় বজ্জাত জিন। ছোট ছোঁড়াকে ধরেছে বলেই সে এতক্ষণ বেঁচে আছে, বড়কে ধরলে কবেই পটল তুলত। মওলানার কথা শুনে নতুন করে শোরগোল পড়ে গেল। কান্না আরও বেড়ে হেল ইছুপের দাদা-দাদীর। ছোট ছেলে মেয়েরা যারা সেখানে ছিল তারা নিজ নিজ বাবা, কাকা বা মাকে জড়িয়ে ধরল। কেউ কেউ বলল- বাড়িত লিয়ে চল।
রাত একটু গভীর হতেই আসন পাতা হলো। জায়নামাজের সমান একটা আসন। সেখানেই বসানো হলো ইছুপকে। ইছুপ ততক্ষণে কিছুটা নিস্তেজ হয়েছে। তবুও মাঝে মাঝে একটা করে ঝাকানি মারে। তার দুই বাহু ধরে আছে জেলে পাড়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দুইজন। ইছুপ বড় বড় করে তাকায় মওলানার দিকে। তাকে ছাড়লেই মওলানাকে যেন গিলে খাবে। মওলানা জিনের দিকে তাকায় আর মুচকি মুচকি হাসে। পাতা আসনের সামনে পাঁচহাতী নতুন গামছা ভাঁজ করে রাখা আছে। নতুন মাটির পাত্রে সাত পদের মিষ্টি। এক বোতল খাঁটি সরিষার তেল। কলার একটা কচি পাতাও রাখা আছে সামনে।
এবার শুরু হলো জিন তাড়াবার মূলপর্ব। হুজুর মাথার পাগড়ি খুললেন। সেই পাগড়ি পাকিয়ে মোটা একটা রশি বানালেন। সেটাই হাতে ধরলেন চাবুকের মত করে। এবার শুরু করলেন মন্ত্র বলা। অবশ্য মন্ত্র না বলে দোয়া বলাই ভালো। কারণ তিনি পড়ছেন কুরআন থেকে। ঝড়ের গতিতে পাঠ করছেন কুরআনের বিভিন্ন আয়াত। সুরা জিন থেকেই বেশি। উপচে পড়া মানুষ তখন হুজুরের কেরাতে বিভোর। সবাই যেন টলছে। এরই মধ্যে দোয়া পাঠ হঠাৎ থামিয়ে হাতের পাগড়ি পাকানো রশি দিয়ে মাটিতে জোরে একটা বাড়ি দিলেন। বললেন- বল তুই কে? হঠাৎ এমন কাণ্ড করাতে উপস্থিত সবাই কেমন চকমে উঠল। যেন ইছুপের গায়ের জিন সবাইকে বড়সড় ধাক্কা দিল। তবে সবাই চমকালেও ইছুপ চমকালো না। সে বরং খিলখিল করে হাসতে লাগল। এতে আরও চমকালো সবাই। এই ঘটনায় হুজুর ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে আগুন। কারণ তার কেরামতি যেন ফেলনা হতে চলেছে সবার কাছে। হুজুর আবার শুরু করলেন দোয়া পাঠ। এবার হাতের রশি দিয়ে বাড়ি মারলেন ইছুপের পিঠে। না, ইছুপ নয়; জিনের পিঠে। কারণ ইছুপ এখন জিনের কায়া।- এবার বল তুই কে? হুজুরের প্রশ্নে প্রচণ্ড রাগ প্রকাশ পেল। কিন্তু তার রাগ প্রকাশ পেলে কী হবে- ইছুপ এবারও খিলখিল করে হাসে। আর হাসতে হাসতে বলে- তুই নাকি বড় হুজুর, আর এটা জানিস না আমি কে? তাহলে শোন, আমি হলাম ধলা জিন। উপস্থিত সবাই আবার নড়েচড়ে বসল।
তা তুই ধলায় হোস আর কালায় হোস, এই মাসুম বাচ্চার কাছে এসেছিস কেন? একে কষ্ট দেবার মানে কী?
কই, কষ্ট তো দেয়নি? তাকে আমার ভালোলাগে তাই তার কাছে এসেছি।
কেন এসেছিস?
এসেছি দাঁড়িচোরদের শাস্তি দিতে।
এ কেমন কথা? দাঁড়ি চোর তো তুই? সকালে তো তুই-ই দাঁড়ি চুরি করে ছুটে বেড়ালি। আর এখন বলছিস অন্যকে দাঁড়ি চোর? সবাই হুজরের কথাতে সাঁই দিল। কিন্তু জোরে হেসে উঠল ইছুপ। না, হাসল ধলা জিন । এতে সবাই আবার চুপ মারল।
আমি ভেবেছিলাম তুই খুব জ্ঞানী। আসলে তুই মাথা মোটা হুজুর। আমি এই দাঁড়ি চোরের কথা বলছি না। আমি বলছি দাঁড়িতে যারা ওজন কম দেয় তাদের কথা। আমি সেই খারাপ মানুষদের শাস্তি দিতে এসেছি।
তাহলে কি তুমি খারাপ জ¦ীন? এবার হুজুর ধলাকে তুমি করে বললেন। কারণ, রাধানগরের হাট থেকে গতকাল এক কেজির একটা বোয়াল মাছ কিনেছিলেন হুজুর। বাড়িতে ওজন করে দেখেন দুইশো গ্রাম কম। অথচ দাঁড়ির পাল্লাটা মাছের দিকে কতই না হিলে দিয়েছিল।- কী হলো, কথা বলছ না কেন?
কী বলব। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। এবার ধলা জ¦ীনও তুমি করে বলল।
কেন, তুমি খারাপ জ¦ীন নও?
তুমি আসলেই মাথামোটা। তোমার সাথে কথা বলতে আমার ভাললাগছে না। আরে মাথামোটা আমি খারাপ জ¦ীন হলে তো ভালো মানুষদের বাড়িতে যেতাম? তাদের ক্ষতি করবার চেষ্টা করতাম। এই খারাপ পাড়াতে থাকতাম না।
একে খারাপ পাড়া বলছ কেন? এরা জেলে। আমাদের মাছের যোগান দেয়।
মাছের যোগান দেয়-ই তো, তবে এক কেজিতে দুই তিনশ গ্রাম কম দেয়। অনেকদিন ধরে দেখছি। এবার এদের শাস্তি দিতে হবে। আর এ জন্যই তো সেদিন রাতে জালগুলো কেটে দিয়েছি। ওদের শাস্তির এটা প্রথম ধাপ। কথাটা শুনেই সবাই চমকে উঠল। একটা শোরগোল উঠল সারা উঠোন জুড়ে। যারা আগে বলেছিল এটা জিনের কাজ, তারা বুক ফুলালো। যাদের জাল কাটা পড়েছে তারা কেউ কেউ দু’ধাপ এগিয়ে এল ধলার দিকে। যে যার মত করে মারতে চায়লো। আবার একইভাবে তারা থেমেও গেল হুজুরের ইশারাতে।
তা এতগুলো লোকের জাল কাটলে, তুমি কি জান এদের কত বড় ক্ষতিটা করেছ? তাছাড়া সবাই তো আর দাঁড়িচোর নয়?
কে বলেছে চোর নয়? বেশির ভাগই করে। আমি এক এক করে নাম বলতে পারি। এখানে সবাই আছে। বলব? ধলা জিনের এ কথা শুনেই কয়েকজন বিভিন্ন অছিলায় বাইরে যেতে চায়। কয়েকজন এর মধ্যেই চলেও গেছে।
থাক, নাম বলতে হবে না। কিন্তু তুমি কী চাও?
কী আর চাইব আমি? অনেকদিন ধরে দেখছি এদের কুকর্ম। ওজনে কম দিতে পারলেই যেন এরা আনন্দ পায়। ভাবে মানুষকে বোকা বানালাম। কিন্তু এরা জানে না। এরা কত বড় ক্ষতি করছে নিজের। এদের অভাব কোনদিনই ঘুচবে না। ধলার কথা শুনে একটা নিরবতা নেমে এল উঠোন জুড়ে। কেউ কেউ আবার কানাকানি করছে। তবে খুব আস্তে।
আচ্ছা সেটা না হয় বুঝলাম কিন্তু আসলে কী চাচ্ছ?
আমি চাই এই জেলে পাড়ার সবাই সৎ ব্যবসা করুক। এখন থেকে কেউ যেন ওজনে কম না দেয়। দরকার হলে দাম বেশি নিবে।
আচ্ছা তারা আর ওজনে কম দিবে না। এই সবাই ওজন ঠিক দিবে তো? উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে হুজুর জিজ্ঞাসা করলেন। উপস্থিত সবাই হাত উঁচিয়ে সমস্বরে বলল- এখন থেকে ঠিক ওজন দিবে।
এভাবে হবে না হুজুর। ওরা হলো কুকুরের লেজ। ইট বাঁধলেও সোজা হবে না। আজ তাদের সবাইকে হাত উঁচিয়ে শপথ করতে হবে- আর কখনও এমন কাজ করবে না।
শপথ তাহলে তুমিই করাও ধলা মিয়া। হুজুরের কথা শুনে মুচকি হাসলো ধলা।
ঠিক আছে। এবার যত জেলে আছো সবাই ডান হাত সামনে তুলে ধর। আর আমি যা বলব তা উচ্চস্বরে সবাই বল। ধলা জিনের কথা শেষ হতে যা দেরি। হাত তুলতে কেউ দেরি করল না। মনে হলো কোন বিদ্যালয়ে দৈনিক সমাবেশ চলছে। শিক্ষার্থীরা এবার শপথবাক্য পাঠ করবে। তবে হাত শুধু জেলেরাই তুলল না, অন্যপাড়া থেকে আসা লোকজনও হাত তুলল। ধলা সেটা দেখেও হাসে। ধলা জিন নিজেও তার ডান হাত উঁচু করে শপথ পাঠ শুরু করল। এবার সবাই বল- আমি শপথ করছি যে, আর কখনও ভুল করেও কাউকে ওজনে কম দেব না। আর দিলে যেন মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মারা যায়। যত শয়তান জিন যেন আমার ঘাড়ে চাপে। ডিঙি উল্টে নদীতে ডুবে মরি। ধলা শপথ বাক্য বলছে আর তার সাথে সাথে সবাই উচ্চস্বরে শপথ পড়ছে। কিন্তু এটুকু বলেই মালু ধাওয়া হাত উঁচিয়ে কিছু বলার অনুমতি চায়লো। যে মালু ওজনে কম দেবার দায়ে কয়েকবার গণপিটনিও খেয়েছে। মালুর মনের কথা ধলা বুঝতে পেরে তাকে বলবার অনুমতি দিল। মালু অনুমতি পেয়ে ভয়ে ভয়ে বলে- আচ্ছা জিন বাবা, আপনি যে শপত করালিন, ভুল করেও কাউকে ওজনে কম দিমু না। এই ভুল করেও কতাটা বাদ দেয়া যায় না? না মানে জান থাকতে তো দিমু না কো, কিন্তু ভুল করে যুদি হয়া যায়, তাই বুলচি আরকি। মালুর কথা শুনে ধলা শব্দ করেই হেসে উঠল। সেই সাথে উপস্থিত সবাই বোধহয় হাসল। তাবে তাদের হাসিতে শব্দ হলো না। ধলা জিন শপথবাক্য আরও কয়েকবার পাঠ করাল। কিন্তু প্রতিবার নতুন ও কঠিক শর্ত জুড়ে দিল তার শপথবাক্যে। এক সময় শপথ পাঠ শেষ হলো। সব জেলেদের মুখ এখন বেশ শুকনা আর কালো। যেন বৈশাখের রোদে পুড়ে মাছ ধরে এইমাত্র তারা ফিরে এল। মৌলবি সাহেব নতুন একটা দোয় পাঠ করে ধলাকে প্রশ্ন করলেন- আচ্ছা ধলা মিয়া তুমি থাক কোথায়?
আমি এই গ্রামেই থাকি। কোন এক জেলের বাড়িতে থাকি।
কোন জেলের বাড়িতে থাক?
সেটা বলা যাবে না। তবে এটা ঠিক, আমি এক জেলের বাড়িতে থাকি না। মাঝে মাঝে বাড়ি বদলায়। ঘুরে ফিরে বিভিন্ন জেলের বাড়ির সামনের কোন এক গাছে থাকি।
তা ধলা মিয়া, তোমাকে যে এবার মুশিদপুর ছাড়তে হবে?
অসম্ভভ! কথাটা এমনভাবে ধলা উচ্চারণ করল, যেন অনেক বড় মানুষ দরাজ গলায় বলল। ইছুপের কণ্ঠ কখনই এমন হতে পারে না। জেলেদের হাত-পা এখন কাঁপছে। ধলা আবার বলে- আমি কখনই এই গ্রাম ছেড়ে যাব না। আমি জেলেদের ভালো হওয়া না দেখে যাব না। আর আপনি ক’জন জিনকেই বা তাড়াবেন। এই গ্রামে তো শতশত জিন থাকে। মৌলবি আর কথা বাড়ালেন না। মৌলবি জানেন, মানুষের থেকে জিনের সংখ্যা অনেক বেশি। জিন আর মানুষের অনুপাত হলো নয় অনুপাত এক।
কিন্তু তোমাকে যে মুশিদপুর থেকে যেতেই হবে।
কী সব মুশিদপুর মুশিদপুর করছেন? কথাটা শুনতে শুনতে কান ঝালাফালা হয়ে গেল।
মুশিদপুরকে তো মুশিদপুরই বলব?
না বলবেন না। মুশিদপুর আপনারা কোথা থেকে পেলেন? এটা মুর্শিদপুর।
মুর্শিদপুর! হুজুরের সাথে সাথে যেন সবাই চমকালো। উপস্থিত সবাই একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওই করতে লাগল।
হ্যাঁ মুর্শিদপুর। এখন থেকে মুর্শিদপুরই বলবেন।
কিন্তু বিভিন্ন কাগজ-পত্রে, দলিলে আমরা তো মুশিদপুরই পড়ি বা লিখি?
ওভাবেই তো একটা ভালো নামের বারোটা বাজালেন। যেমন মকসেদকে ডাকেন মকো আর তোজাম্মেলকে তোজা বলে। তোজা আর মকো সেখানেই ছিল। তাদের ইচ্ছা হলো ধলার পা ছুঁয়ে সালাম করতে। কিন্তু সাহসে কুলালো না। যারা তোজা, মকো বলে ডাকে তাদেরকে মনে মনে গালি দিল। – শোনেন, এখন থেকে শত শত বছর আগে কোন কিছু সুফি সাধক এসেছিলেন এই এলাকায়। তারা এসেছিলেন শান্তির বাণী নিয়ে। মানুষের মাঝে বয়েছিল শান্তির বাতাস। অনেক শিষ্য হয়েছিল তাদের। আস্তে আস্তে শিব নদের ধারে গড়ে উঠে জনপদ। সেই মুর্শিদদের কারণেই এই জনপদের নাম হল মুর্শিদ নগর। মুর্শিদ নগরই এখন মুর্শিদপুর। আর আপনারা বানালেন মুশিদপুর। এতদিন যা ভুল করেছেন তা করেছেন। এখন শুধরে নিন। এখন থেকে এই গ্রামকে ডাকবেন মুর্শিদপুর বলে। আপনাদের কেউ যদি বলে, আপনার বাড়ি কোথায়? তখন গর্ব করে বলবেন- আমার বাড়ি মুর্শিদপুর। সবাই এতক্ষণ যেন কোন এক জনসভায় ছিল। যেখানে প্রধান বক্তা ধলা জিন। সবাই অবাক হয়ে শুনছিল ধলার বক্তব্য। ধলার কথা শুনে সবার মন ভরে গেল। গর্ব হলো নিজের গ্রামের ইতিহাস শুনে। ধলার বক্তব্য শেষে হাততালি দিতে ইচ্ছা করল সবার। সবাই না দিলেও তোজা আর মকো কিন্তু দিল।
আচ্ছা এখন থেকে আমরা মুর্শিদপুরই বলব। কিন্তু ধলা মিয়া তোমাকে যে এবার মুর্শিদপুর ছাড়তে হবে।
আপনার সব কথা শুনব কিন্তু এই কথা শুনব না। দয়া করে আর অনুরোধ করবেন না। আপনি খুব ভালোমানুষ। মৌলবি আর এ বিষয়ে কথা বাড়ালেন না। তিনিও মন থেকে চান, জিন এ গ্রামেই থাকুক। কারণ তার মনের মধ্যে গেল হাটে মাছ কিনে ঠকবার কথা তখনও খচখচ করছিল।
তাহলে তুমি কী চাও?
আমি কিছুই চাই না। আর যা চায় তা তো বলেই দিয়েছি। তবে হুজুর আপনার মাধ্যমে আমি সকল জেলেকে বলছি। আমি কিন্তু তাদের খুব কাছাকাছি থাকব। ওজন-চুরি আমি সহ্য করব না। এরপরেও তারা যদি ওজন-চুরি করে তবে সুযোগ বুঝে ভরদুপুরে তাদের ডিঙিতেই ঠেসে মারব। মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে। নদীর পানি লাল হবে। সেদিন আমাকে দোষ দিতে পারবেন না কিন্তু। আবার সারা বাড়ি জুড়ে নিরবতা নেমে এল। বাড়ল বুকের ধুকপুকানি। মালু ধাওয়া, কানু ধাওয়া, হাচেন ধাওয়া সবার মুখ শুকিয়ে আমচুর। তারপরেও সবাই ধলা জিনের কথা মেনে নিল। না মেনে উপায় নেই। এই উঠানে আজ যেন জেলেদের চেয়ে অন্যরাই বেশি; যারা এদের কাছে মাছ কিনে। এবার মৌলবি সাহেব কলার পাতায় সাত রকমের মিষ্টি সাজিয়ে ধলার সামনে এগিয়ে দিল। আর অনুরোধ করে বলল- ধলা সাহেব তোমার জন্য আপ্যায়নের কিঞ্চিৎ ব্যবস্থা করেছি। তুমি এই আতিথেয়তা গ্রহণ করলে আমরা খুশি হব। মৌলবির কথা শুনে ধলার হাসি থামে না। সে হাসে আর মিষ্টির দিকে তাকায়।
কী হলো তুমি হাসছ কেন?
তোমাদের অতিথি সেবা দেখে। ফেচ্চু ময়রার মিষ্টি এনে আমার সেবা করবে? ফেচ্চু তো মিষ্টিতে ছানার থেকে ময়দাই বেশি দেয়। ওই মিষ্টি আমি খাই না। আমি ভাবছি ফেচ্চুর ঘাড়েও একবার চাপব। ওর মিষ্টি ওকেই গিলাবো। আর একটা কথা বলি। আমাকে কেউ যদি কিছু খাওয়াতে চায় তবে হাটের দিনে শিশুদের জন্য তারা যেন কিছু কিনে আনে। এই যেমন বাতাসা, মিষ্টি কিংবা বাদাম। বিকালে নদীর ধারে অনেক ছেলে মেয়ে খেলা করে। তারা ওগুলো এনে যেন তাদেরকে খেতে দেয়। তাহলেই আমার খাওয়া হয়ে যাবে। আমি খুশি হবো। সকল শিশুর মাঝেই থাকব আমি।
আর কথা বলল না ধলা। তবে দুই হাত এক করে সবাইকে সালাম দিল। হুজুরও আর কথা বাড়ালেন না। ধলা জিন চলে যাবার অনুমতি চায়লো হুজুরের কাছে। হুজুর এবার মিনমিনিয়ে দোয়া পাঠ শুরু করলেন। আর এই দোয়া চলাকলীন বারান্দার শেষ মাথার এক খুঁটি হঠাৎ মড়াস করে ভেঙে গেল। এই ভেঙে যাবার শব্দে সবাই চমকে সেদিকেই তাকাল। আর এরই মধ্যে চিৎপটাং দিয়ে পড়ে গেল ইছুপ। তবে ইছুপের পড়া কেউ দেখতে পেল না। সবাই তাকিয়ে আছে ভাঙা খুঁটিটার দিকে।
শুনুন সবাই। এবার সবাই মৌলবির দিকে তাকাল।- জিন আর নেই। সে যে চলে গেছে তার প্রমাণ ঐ খুঁটি। সে বারান্দার ঐ খুঁটি ভেঙে দিয়ে বলে গেল, আমি চললাম। আর এই দেখুন ইছুপ এখন পড়ে আছে। সবাই ইছুপের দিকে তাকালো। ইছুপের জন্য সবার মায়া উথলে উঠল। হুজুর এবার এক ঘটি পানিতে ফুঁ দিয়ে সেই পানির ঝাপটা ইছুপের চোখে মুখে দিল। আর তখনই ইছুপ আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসল। খুব নিস্তেজ দেখাল ইছুপকে। হুজুর তার দাদা দাদিকে ডেকে বলল- আজ রাতে ও আগামী তিনদিন কী কী ইছুপকে খাওয়াবে। আর সবার উদ্দেশ্যে মৌলবি সাহেব বললেন- সবাই শুনুন, আপনাদেরকে কোন প্রকার নসিয়ত করবার নেই। যা বলবার তা ধলা জিন নিজেই বলে গেছে। আপনারা তার কথাগুলো মানবেন। না হলে খারাপ কিছুু ঘটতেই পারে। হয়তো বড় কিছু ঘটবে। তখন আমাকে ডেকেও কাজ হবে না।
মৌলবি সাহেব রাতের খাবার খেয়ে বিদায় হলেন। তবে নতুন গামছাটা তিনি আর নিলেন না। সেটা হুচেনের কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন- এই নাও তোমার নাতির গামছা। এটা তোমার কাজে বেশি লাগবে।
না না হুজুর, এ কেমুন সব্বনাশের কতা। গামছা আমি নিমু ক্যান? গামছা আপনার। কথাটা বলেই খুব দ্রুত গামছাটা তুলে হুজুরের কাঁধে দিলেন। হুচেন এমনভাবে গামছাটা দ্রুত তার কাঁধ থেকে হুজুরের কাঁধে দিল, যেন এটা গামছা নয়, ধলা জিন। হুজুর যতই জোর করেন গামছাটা নিতে, হুচেন তার চেয়ে বেশি জোর দেখায় তা ফিরিয়ে দিতে। অবশেষে হুচেন বলে- ঠিক আছে গামছাটা আমার ছুটো ভাই অশিদুলকে দেন। কথাটা বলতেই রশিদুল ঝেড়ে দৌড় মারে বাহিরে। গামছাটা অবশ্য আরও কয়েকজনকে দিতে চায়লেন হুজুর। কিন্তু সবাই পালিয়ে বাঁচতে চায়। সবাই যেন ভাবে, ওটা গামছা নয়, ধলার ছায়া। অবশেষে গামছাটা হুজুরের কাছেই থাকল।
কয়েকদিন যেতেই আস্তে আস্তে ইছুপ স্বাভাবিক হয়ে উঠল। আবার আগের মত দাদার সাথে মাছ ধরতে যায়। সারা পাড়া লাফায়। বন্ধুদের সাথে ডানগুলি খেলে। তবে আগের চেয়ে বন্ধু কমেছে ইছুপের। কেউ কেউ এখনও ভয় করে ইছুপকে। তারা এখনও ভাবে, ওটা ধলা জিন। তারপরেও ইছুপকে এখন স্বাভাবিক লাগে। শুধু স্বাভাবিক হতে পারল না মুর্শিদপুর জেলেপাড়া। তারা হঠাৎ কেমন জানি গোছাল হয়ে উঠল। জেলেপাড়ার সেই চিরচেনা পরিবেশ, কোলাহোল, এ বাড়ি ও বাড়ি ঝগড়া সব উবে গেল। সবার মধ্যে খুব ভাব এখন। শুধু জেলেপাড়া নয়, অন্যপাড়াতেও এর প্রভাব কিছুটা পড়েছে। ছেলে মেয়েদের দুষ্টুমী কমেছে। বাপ মায়ের কথা শোনে। রাতে বা দুপুরে না ঘুমালে বাবা-মা ধলা জিনের কথা বলে ঘুম পাড়ায়। দুরন্তরাও মায়ের গলা ধরে ঘুমায়। ধারে কাছের মাছের বাজারেও একটা পরিবর্তন দেখা গেল। সেখানে ক্রেতারা মুর্শিদপুরের জেলেদের খুঁজে খুঁজে মাছ কিনে। দশ টাকা বেশি দিয়ে কিনে। তারা দাঁড়িতে আর কম দেয় না। দুই একজনের মাথাতে সেই চিন্তা যে আসে না, তা নয়। ওজনে কম দেবার কথা ভাবলেই সে যেন দেখতে পায়, সামনে ধলার ছায়া। গলার কাছে কী যেন গুলটি পাকায়। মনে হয়, এই বুঝি মুখ দিয়ে রক্ত ওঠে।
মুর্শিদপুর জেলে পাড়াতে নতুন একটা চল শুরু হয়েছে। শিব নদের ধারে জুম্মা মসজিদ। তার নিচে বিশাল বটগাছ। বটগাছ থেকে বেশ দূরে শিব নদের পানি। সামনের ফাঁকা মাঠে পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা খেলে। গোল্লাছুট, ডানগুলি, বউগুডু, বদন ইত্যাদি খেলা। সেখালে ছেলে মেয়েরা প্রায় প্রতিদিন সিন্নি পেতে লাগল। জেলেরা হাট থেকে কিছু না কিছু কিনে এনে বাচ্চাদের দেয়। কেউ বাদাম, কেউ বাতাসা, কেউ আবার খাগড়াই। মাঝে মাঝে কেউ আবার চিনির জাম বা গোল্লাও আনে। তখন তারা গোটা দিয়ে ওড়াতে পারে না। ভেঙে ভেঙে দিতে হয়। সেখানে ক্রমশ ছেলে-মেয়েদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। এখন অন্যপাড়া থেকেও আসে। আগে একশ গ্রাম বাদাম আনলে অন্তত একটা করে দেওয়া যেত। এখন হয় না। তাই তাকে এসে বসে থাকতে হয়; পরের জনের আশায়। পরের জন এলে তার সাথে মিশিয়ে বিলি করে সবার মাঝে। তারা প্রাণভরে দেখে এক সাথে অনেক ধলা জিন।
শীত মৌসুম আসার আগ দিয়ে গ্রামের সবাই মিলে যা করল, তা অবাক হবার মতই ঘটনা। অবাক হলো পরের গ্রামের মানুষও। গ্রামের উত্তর মাথায় একটা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলো। বিদ্যালয়ের নাম দেওয়া হলো মুর্শিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়। এ যেন ধলা জিনের প্রতি এক শ্রদ্ধা স্মারক। বিদ্যালয়ের নাম ফলকের দিকে তাকালেই মনে আসে ধলা জিনের কথা। এ যেন ধলা জিনের প্রতি শ্রদ্ধা-স্মারক। নাম ফলকের দিকে তাকালেই মনে আসে ধলা জিনের কথা।

দ্বিতীয় কাণ্ড
বগা মাস্টার হঠাৎ একদিন চেয়ার থেকে পড়ে গেল। পড়ার ঘটনা বলবার আগে বগা মাস্টারের কথা একটু বলা যাক। বগা মুর্শিদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। অবসরে যেতে আর তিন বছর বাকি। একবার অবশ্য প্রধান শিক্ষক হবার ডাক তিনি পেয়েছিলেন। তিনি হন নি। ও নাকি বড় ঝামেলার কাজ। সহকারী শিক্ষকই থেকে গেলেন।
বগা মাস্টারের আসল নাম বদের আলী দেওয়ান। দেখতে ধবধবে সাদা। বকের মত। পাতলা ঠিনঠিনে। লম্বাতে ছয় ফিটের ওপরে। তার শরীরের দিকে এক ধেয়ানে তাকালে মনে হবে, এই লঘা দিয়ে আম পাড়া যাবে। হাঁটেনও কেমন ঠকাশ্ ঠকাশ্ করে। যেন জাঠ্যা বক হাঁটছে। এই হাঁটনটাই একদিন নাম বদলে দিল। বদের আলী বকটাই হয়ে গেল বগা মাস্টার। এখন ছাত্ররাও বগা মাস্টার বলেই চেনে। পাড়ার লোকজনও ডাকে। কেউ ডাকে বগা স্যার কেউ ডাকে বগা মাস্টার।
সেই বগা মাস্টার একদিন শ্রেণিকক্ষে চেয়ার থেকে পড়ে গেলন। তিনি ধর্ম পড়ান। তার পড়ানোর ধরণটা ভিন্ন। তিনি ছাত্রদের পড়তে দিয়ে বা কোন কেছু লিখতে দিয়ে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে যান। সেদিন অবশ্য ঘুমিয়ে ছিলেন চেয়ারের পিছন দিকে মাথা ঠেকিয়ে। সেদিন নাকও শব্দ করছিল। মুখের হা এত বড় হয়েছিল যে, মশা মাছি অনায়াসেই যাওয়া আসা করতে পারবে। বোলতা কিংবা টুনটুনি ইচ্ছা করলে বাসাও করতে পারবে সেই ফোঁকরে। তবে তার ঘুমটা কিন্তু আজব ঘুম। যেন এলার্ম দেওয়া। ঘণ্টা পড়বার পাঁচ মিনিট আগেই ঘুম ভেঙে যায়। তখনই উঠে দু’চারটে ধমক-টমক দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন। পড়া হয় বদলিয়ে দেন অথবা সেটাই রাখেন। কিন্তু সেদিন বগা মাস্টারের এলার্ম ঘড়িটা কাজ করল না। একেবারে ক্লাস শেষ হবার ঘণ্টা সেই এলার্ম হয়ে বেজে উঠল। অ¤িœ ধড়মড়িয়ে লাফ দিয়ে উঠলেন বগা মাস্টার। কীভাবে উঠলেন কে জানে, একইভাবে পড়ে গেলেন চেয়ার আর টেবিলের ফাঁকে। মাথা লাগল টেবিলের পায়াতে। প্রথমে ছাত্ররা হোহো করে হেসে উঠলেও পরক্ষণেই চুপ মারল। কারণ তখন বগা মাস্টারের নড়ন চড়ন বন্ধ। ছাত্রদের হইচই শুনে পাশের শ্রেণি থেকে যখন অন্য শিক্ষক ছুটে এল তখন দেখে বগা জ্ঞানশূন্য পড়ে আছেন।
কয়েক জগ পানি ঢেলে বগা মাস্টারের জ্ঞান এক সময় ফিরলেও মুখে কিছু বলতে পারলেন না। ওদিকে চোখ পলকহীন। চোখের দির্ষি আকাশের দিকে। যেন দিনের বেলা আকাশে কত তারা। এক এক করে গুণছেন তারাগুলো। ঘটনা বেগতিক দেখে ভ্যান ডেকে বগাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
রাতটা যেন-তেন করে কাটলে বিপত্তি ঘটল সকালে। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে তার সেন্ডেলটা হাতে নিলেন। গবার বউ পাশেই ছিল। সে মনে করেছি বগা তাকে সেন্ডেল পেটা করবে। সে দৌড় দিয়ে উঠানের মধ্যে গেল। কিন্তু মারলেন না। সবাইকে অবাক করে সে সেন্ডল দিয়ে বারান্দার দেয়াল মুছতে লাগলেন। দেওয়ালে লিখতে লাগলেন বারান্দায় চালে গুঁজে রাখা একটা দাঁতন টেনে নিয়ে । লিখছেন আর জোরে জোরে বলছেন- ক তে কলা, খ তে খই. গ তে গরু। এবার সবার বুঝতে বাঁকি থাকে না বগা মাস্টার কী করছেন। সেন্ডেল হলো ডাস্টার আর দাঁতন হলো চক। সেই শুরু, আর থামেন না। কেউ নিষেধ করতে এলে তেড়ে মারতে আসেন। নাওয়া থাওয়া বন্ধ। ঘুম নেই একতিল। যেই মানুষটার চোখে এত ঘুম, সেই ঘুম হঠাৎ উধাও। শুধু ক্লাস আর ক্লাস। কখনো ওয়ান তো কখনো টু। কখনো আবার ফাইভ। ক্লাস নেন, ধমক দেন আবার মাটিমাটি করে বুঝান। তার ক্লাস নেওয়া থামে না। দু’দিন যেতেই মানুষ বুঝল, এটা জিনের কাজ। নিশ্চয় ধলা জিন। সে বলেছিল, এ গ্রাম থেকে নড়বে না। কিন্তু ধলা এও বলেছিল, সে যদি চাপে তবে দুষ্টু লোকের কাঁধেই চাপবে। বগা মাস্টার তো দুষ্টু নন। কারও সাতেপাঁচেও থাকেন না। তার পিছনে জিন লাগতে যাবে কেন? এমনই নানান ভাবনা ভাবতে লাগল সবাই। অবশেষে তারা সবাই মিলে আবার ঐ হুজুরকেই আনলো।
আগের মতই বসানো হলো জিনের আসর; যেমনভাবে বসানো হয়েছিল ইছুপের বেলা। এবার অবশ্য আগের মত ধকল পোহাতে হয়নি মৌলবিকে। খুব সহজেই বগা মস্টারের জবান খুলে গেল। আর বলল, সে ধলা জিন। সবার সন্দেহ সঠিক হলো। পাতা আসনে বসে থাকলেও মাঝে মাঝে গর্জায় বগা। বগা মাস্টারের ওপর যেন ধলা জিনের চরম রাগ। তাকে যখন হুজুর প্রশ্ন করলেন- আচ্ছা ধলা মিয়া, তুমি এই নিরীহ মানুষটাকে ধরলে কেন?
কে নিরীহ, এই বগা? এটা একটা বজ্জাতের ধাড়ি।
এ আবার কেমন কথা? এর আগেরবার তুমি জাল কাটলে তারা দাঁড়ি চুরি করে বলে, ওজনে ফাঁকি দেয় বলে। কিন্তু বগা মাস্টার তো ভালো মানুষ। কারও সাতে-পাঁচে থাকে না। এবার হুজুরের কথা শুনে বড় রেগে গেল ধলা।
কে ভালো মানুষ, বগা? সে সবচেয়ে বড় চোর, বড় ফাঁকিবাজ। সে পুরো জাতিকে ফাঁকি দেয়। একটা গুঞ্জরণ শুরু হলো বগার উঠোনে। সবাই চোরই সায়বস্ত করল বগাকে। কিন্তু বগা কী চুরি করে তা ঠাহর করতে পারল না। কেউ আবার বলে- তলে তলে এতকিছু? গ্রামের বৃদ্ধরা মনে মনে ভাবে- যাকে সবাই ভালা মানুষ ভাবত, সেই বগা চোর। তাইতো বলি, তার সংসারে অভাব হয় না কেন। সে বেতন আর ক’টাকা পায়? এমন কথাই বৃদ্ধরা আলোচনা করতে লাগল এক অন্যের সাথে। হুজুর এই গুঞ্জরণ থামিয়ে দিয়ে ধলাকে প্রশ্ন করে- বগা মাস্টার কী চুরি করেছে সেটা বল। সবাই সেটা জানতে চায়। আমরা তো জানি সে চুরি করবার মানুষ নয়।
বগা বড় ধরণের চোর। সে শিক্ষা চোর। ছোট ছোট শিশুদের ফাঁকি দেয়। পড়াতে ফাঁকি দেয়। ক্লাসে গিয়ে শুধু ঘুমায়। এর চেয়ে বড় চোর কি আছে? ধলার কথা শুনে আবার সবাই নড়ে চড়ে বসল। আগের ধারণা সবার ভুল হলো। তবে বগাকে চোরই বলল সবাই। সবাই যেন তাদের ছেলে-মেয়ের মুখ দেখতে পেল। ভাবল- তাই তো বলি, আমার ছেলেটা ভালো করে পড়তে পারে না কেন?
তুমি ঠিকই বলেছ ধলা মিয়া। বগা বড় চোর। তবে এবারের মত তাকে মাফ করে দাও। তার বয়স হয়েছে। চাকরি আর বছর তিনেক আছে। সে আর এমনটি করবে না।
ঠিক আছে। তবে এটাই শুরু এটাই শেষ। বারেক হলে কিন্তু ক্ষমা হবে না। আবার এমনটি করলে মুখ দিয়ে রক্ত তুলে মারব।
আচ্ছা আর এমটি হবে না। তুমি তাকে ক্ষমা কর। আমরাও করলাম।
ঠিক আছে তবে। আর হ্যাঁ, আর একটি কথা বলতে ভুলে গেছি। এ গ্রামে সকল দুষ্টু ছেলেদের বলছি, তারা যেন নিয়মতি স্কুলে যায়। পড়াশোনা করে আর বাবা-মায়ের কথা শোনে। না হলেও তাদের ঘাড়েও আমি চেপে বসব।
অত বাহাদুরি দেখাতে হবে না। ছেলেরা এমনিতেই ভয়ে ভয়ে থাকে। তারা আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। তুমি এবার যাও।
আচ্ছা যাব। তার আগে মিষ্টি কিছু খাই। আজকের মিষ্টি বোধহয় ভালো।
আজকেও কিন্তু ফেচ্চুর দোকানের মিষ্টি। আজকে সে দাম নেয়নি।
জানি সে দাম নিবে না। তবে মিষ্টি সে আগের চেয়ে ভালই বানায়। ধলা মিয়া কথাটা বলেই হাসতে হাসতে কয়েকটা মিষ্টি পর পর খেয়ে নিল।
সাবাই বারান্দার খুঁটির দিকে তাকিয়ে থাকলেও ধলা আজ যাবার সময় খুঁটি ভাঙল না। বগা মাস্টারের উঠোনে কাপড় শুকাবার একটা আড় ছিল। সেটাই হুড়মুড়িয়ে ফেলে দিল। সবাই লাফ দিয়ে সেদিকে তাকাতেই বগা মস্টার জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে গেল বারন্দার নিচে। তাকে এখন সুস্থ করবার চেষ্টা করছে মৌলবি।
বগা মাস্টার সুস্থ হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগলো। তবে ক্লাসে যখন ফিরলেন, তখন ঘুম তার চিরতরে পালালো। বরং কোন ছাত্রের চোখে ঘুম এলে তাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। বগা বাড়িতেও খুব একটা ঘুমান না। সুযোগ পেলেই শিক্ষাপোকরণ বানান। গাছের পাতা, তেঁতুলের বিচি, কাঠি ইত্যাদি নিয়ে যান ক্লাসে। তার স্লাস করতে সকল ছাত্র এখন মরিয়া। অন্য ক্লাসের ছাত্রও বগা মাস্টারের শ্রেণিকক্ষের জানালায় উঁকি দেয়। পরের বছর বগা মাস্টার তার উপজেলাতে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আর একটা কাণ্ডও ঘটেছিল মুর্শিদপুরে। সকল শিশুরা যেন সোনাবাবু হয়ে গেল। তারা নিয়মিত স্কুলে যায়। সাঁঝ হলেই পড়তে বসে। খরানি দিনে দুপুরে ঘুমায়। হঠাৎ বিদ্যালয়ে বেড়ে গেল উপস্থিতির হারও।

তৃতীয় কাণ্ড
একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে মুর্শিদপুরে। মুর্শিদপুর হয়ে উঠল ঘটনাপুর। সবাই যেন তাকিয়ে থাকে নতুন ঘটনা কখন ঘটবে, সেদিকে। কিন্তু এবার যে ঘটনা ঘটল বা যার সাথে ঘটল সেটা নিয়ে ভেবে কেউ কোন কূল পেল না। এবারের ঘটনাটা ঘটল ‘মুর্শিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি’র সভাপতি তোজামের সাথে। এই সমিতির একটা পাঠাগার আছে। পাঠাগারের নাম ‘মুর্শিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন পাঠাগার’। পাঠাগারের সভাপতিও তোজাম। তোজাম মাঝ রাতে কাণ্ডটা করল। বউ দেখতে পেয়েছে আরও পরে। সে তার নাতির বর্ণশিখি বইটা নিয়ে ছড়া পড়ছে। বউ স্বামীতে রাতেই কিছুটা ঝগড়া হলো এই নিয়ে। তবে সকালে উঠে আর একটা কাণ্ড করল তোজাম। সে শিক্ষা উন্নয়ন পাঠাগার থেকে শিশুতোষ একটা ছড়ার বই বগলদাবা করে সারা পাড়া ঘুরে আর ছড়া পড়ে। কখনও আগডুম বাগডুম, কখনও খোকন খোকন ডাক পাড়ি। শীতের সময় তোজাম পড়ে বর্ষার ছড়া। কখনও আবার বানিয়ে বানিয়ে বলে- কোলা ব্যাঙের বিয়ে হবে এবার আষাঢ় মাসে; তাই তো ব্যাঙা মহাখুশি কথায় কথায় হাসে। ব্যাঙের বদলে তোজাম নিজেই হেসে কুটিকুটি। মানুষ ব্যাঙের হাসি না দেখলেও গাল ফুলিয়ে ঘ্যাঙর ঘ্যাং ডাক শুনেছে। তোজাম হাসবার সময় একই ঢঙে হাসে। গাল ফুলায় আর ঘ্যাং ঘ্যাং করে। তাই তারা তোজামের এই হাসিকেই ব্যাঙের হাসি মনে করল। খেতের আলে গেলেও বইটা বগলে করে নিয়ে যায়। আবার পাড়ার কোন ছেলে-মেয়েকে দেখতে পেলে তাকে পড়াতে যায়। ছেলেরা দৌড়ে পালায়।
অবশেষে সবার বুঝতে বাকি থাকে না এটা ধলা জিনের কাণ্ড। কিন্তু এটা ভেবে পায় না, তোজামকে কেন? তোজাম তো ভালো মানুষ। তাছাড়া সে কোন স্কুলে মাস্টারীও করে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। কপালে নামাজের দাগ ঝকঝক করে জ¦লে। অথচ তাকে ধরল ধলা জিন। নিশ্চয় গোপন কোন ব্যাপার আছে। এমনই ভাবতে লাগল সবাই।
অবশেষে আনা হলো মৌলানাকে। মৌলানা এখন বাঁধা, বিপদের বন্ধু। মৌলানার খ্যাতি এখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কারও যদি পাতলা পায়খানা হয়েছে তো স্যালাইন খাবার আগে হুজুরের পানিপড়া খায়। ছোট বাচ্চা নিয়মিত বিছানা ভিজালে কিংবা অধিক কাঁদলেও হুজুরের কাছে নিয়ে যায় ফুঁ দিয়ে নিতে।
তোজামকে নিয়ে আজকের এই জিনের আসরে তেমন কোন সাজসজ্জা নেই। তবে সাত পদের মিষ্টি আছে। কিছু দোয়া আর মন্ত্র পাঠের পর কোন ভূমিকা ছাড়াই সরাসরি প্রশ্ন উত্তর পর্ব শুরু হলো। হুজুর কী প্রশ্ন করল তা কেউ শুনতে পেল না। তবে তোজান কোন উচ্চবাচ্য না করে সরাসরি বলল- শোনেন হুজুর। আমি ধলা। আমি তোজামের কাঁধে চেপেছি অন্য কারণে। এবারের বিষয় আগের মত নয়। ধলা জিনের কথা শুনে একটা গুঞ্জন শুরু হলো তোজামের পুরো উঠোন জুড়ে। সবাই খুঁজতে থাকে তোজামের শত অপরাধ। কিন্তু যা পায় তা তেমন কোন বড় অপরাধ নয়। গেল শনিবার ফতে বুড়ির একটা ছাগল সারাদিন বেঁধে রেখেছিল। সে তো ফলের গাছ খাবার অপরাধে। ফতে বুড়ি অনেক শাপ-শাপান্ত করেছিল। যদিও দিনটা শনিবারই ছিল। সে তো ভূতের দিন। কিন্তু জিনের দিন তো শনিবার মঙ্গলবার নয়। জিনের দিন প্রতিদিন। এটাও ভাবল ফতে বুড়ি। হুজুর সবাইকে ইশারায় থামতে বলে ধলাকে প্রশ্ন করে- তা ধলা মিয়া, আসল ঘটনা খুলে বললেই তো হয়। সাবাই তোমার কথা শুনতে চায়। হুজুরের কথা শেষ হতেই সকলে তোজামরূপী ধলা জিনের দিকে তাকালো।
অবশ্যই বলব। তার আগে বলি, তোজাম তো বড় চাকরি করত? এখন অবসরে। অনেক টাকা কামিয়েছে। কিন্তু এলাকার মানুষের জন্য কিছু কি করেছে?
ম্যালাই করিচেন। তিনি আমাদের বিপদে আপদে পাশে থাকেন। এক জেলে লাফ দিয়ে বলল।
করেছে ভালো কথা। কিন্তু তাকে যে একটা বড় পাঠাগারের দায়িত্ব তোমরা দিয়েছ, সে কি তা সঠিকভাবে পালন করে?
অবশ্যই করে। আর একজন বলল।
ঘণ্টা করে। সেখানে পড়াশোনার কোন পরিবেশ নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো সেখানে ছোটদের পড়বার মত তেমন কোন বই নেই। এই কথা তার মোটা মাথাতে আসেনি কেন?
ও তাহলে এটাই তার অপরাধ। কথাটা এমনভাবে হুজুর বললেন, যেন এটা কোন অপরাধই নয়।
আপনিও একটা মাথা মোটা। ধলার এই কথা শুনে চমকে উঠলেন হুজুর। শব্দ করে হেসে উঠল সবাই। হুজুর গলা খেঁকারি দিয়ে আবার প্রশ্ন করে।
তাহলে এখন কী করতে হবে?
আমি চাই ঐ পাঠাগারে অনেক বই আসুক ছোটদের জন্য। তাদের পড়ার একটা সুন্দর পরিবেশ করে দিক সবাই মিলে। আর আপনিও কিছু বই কিনে দিবেন। কথাটা বলেই খিকখিক করে হেসে উঠল ধলা। এই হাঁসিটা ব্যাঙের হাসি ছিল না। কেমন যেন কিনকিনে। তোজামের সামনের দুটো দাঁত নেই। এতে লালা গড়িয়ে পড়ল।
আচ্ছা তাই হবে। তুমি এবার গ্রাম ছেড়ে যাও।
হ্যাঁ এবার যাব। তবে এটাও ঠিক , আশপাশেই থাকব। দূর থেকে দেখব সব।
আর বেশি কথা হলো না। আজ তবে ধলা জিন বারান্দার খুঁটি বা উঠোনের আড় ভাঙল না। সে ভাঙল উঠানের পিয়ারা গাছের ডাল। পিয়ারার ডাল ভাঙার শব্দ জোরে হবার কথা নয় কিন্তু আজ হলো। যেন ডাল নয়, পুরো গাছই ভেঙে গেল।
এরপর পুরো মুর্শিদপুর কিছুদিন বেশ শুনশান থাকল। গাছ থেকে একটা পাতা পড়লেও যেন সবাই শুনতে পায়। সেদিকেই ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। শিশুরা এখন পড়াশোনাতে ব্যস্ত। স্কুল কামায় করে না। বরং বিশেষ কোন কারণে বাপ-মা স্কুলে যেতে নিষেধ করলে তারা মানে না। বলে- সামনে পরীক্ষা। যেতেই হবে। কেউ বলে- আজ বগা মাস্টারের মজার ক্লাস আছে। বিকালে সবাই দল বেঁধে পাঠাগারে যায়। নানা রঙের আর নানা বিষয়ের বই এসেছে পাঠাগারে। সব বই তোজাম নিজেই এনেছে। কেউ চাঁদা দিতে চাইলেও সে নেয়নি। শুধু তাই নয়। মাসে একবার করে ক্ষুদে পাঠকদের মধ্যে প্রাইজ দেয়। তাদের পড়া বিষয়ের ওপর প্রশ্ন করে পরীক্ষা নেয় তোজাম। তার ভিত্তিতেই প্রাইজ।
বাজারে মুর্শিদপুরের জেলেদের খুব সুনাম। তাদের মাছ সবার আগে শেষ হয়। অথচ দাম আর পাঁচজনের চেয়ে দশ টাকা বেশি। শিব নদের ধারে মসজিদের পাশে বিকালে ছেলে-মেয়ের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। জেলেরা প্রায় সবাই হাট থেকে বিভিন্ন জিনিস আনে। ছেলেরা হইচই করে খায়। জেলেরা হা করে দেখে তাদের আনন্দ। মনে মনে বলে, খা ধলা মিয়া খা।
বগা মাস্টার অবসরে গেছে কয়েক বছর হলো। তিনি এখন প াঠাগারে ওঠা-বসা করেন। ছেলে-মেয়েদের সাথে মিশেন। হাসেন মজা করেন। সুযোগ পেলে পড়ান। বাড়ির বাহির বারান্দায় বগা মাস্টার একটা কোচিং সেন্টারও খুলেছেন। সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেরা পড়ে। একদম ফ্রি কোচিং। ইছুপের দাদা মারা গেছে কয়েক বছর হলো। ইছুপ নিজেই এখন বড় জেলে। আজকের দিনে তার তিন তিনটে জাল। ডিঙি সেই আগেরটাই আছে। ইচ্ছা করেই সেটা বদলায়নি। হুচেন নৌকার যেখানটাই বসত, ইছুপ ঠিক সেখানটাই বসে জাল ফেলে, বৈঠা ধরে। দূর থেকে লোকজন হুচেন ভেবে ভুল করে। গায়ের রংও দাদার মতই পাকা। রোদ পড়লে পিছলে যায়।

Share.

মন্তব্য করুন