পৃথিবীর মানচিত্রে পূর্ব এশিয়ান দেশ হিসেবে যে ছোট উপদ্বীপটি মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটির নাম কোরিয়া। দেশটি ছোট্ট হলেও বৈচিত্র্যময়। এর রয়েছে সবুজ বন-বনানী, চেরিগাছের সমাহার, বিশাল পাহাড়ি অঞ্চল, শতাব্দীপ্রচীন বৌদ্ধমন্দির ও উপকূলীয় মৎস্যজীবীদের গ্রাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে মূল কোরিয়া ভাগ হয়ে এর ছোট যে অংশটি দক্ষিণ কোরিয়া হিসেবে বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে, আমি সেই কোরিয়ার কথা বলছি। এই দেশটির রাজধানী সউল, লোকসংখ্যা প্রায় ৫ কোটি, আর মুদ্রার নাম কোরিয়ান ওয়ান।
দেশটির তেমন প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলেও মেধাবী জনসম্পদ রয়েছে। এই দেশে বেশ কিছু মনীষীর জন্ম হয়েছিল, তাদের অনুপ্রেরণায় পরবর্তী সময়ে দেশটি ভালো ভালো নেতা পায়। এই সব নেতার ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় কোরিয়া মাত্র দুই দশকে একটি দরিদ্র দেশ থেকে ধনী দেশে উন্নীত হয়। এই উন্নত দেশটি এখন অনেক দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার জন্য বৃত্তি বা আর্থিক সাহায্য প্রদান করে থাকে। কোরিয়ান সরকারের এ রকমই একটি বৃত্তি নিয়ে ২০০১ সালে আমি সেই দেশে গমন করি। ঐ দেশে এক বছর উচ্চ শ্রেণীতে অধ্যয়ন করে জানতে পারি কোরিয়া এতোটাই দরিদ্র দেশ ছিলো যে, খাবারের অভাবে সেই দেশের শিশুরা ভাতের মাড় খেয়েই স্কুলে গমন করতো। তা ছাড়া ঐ দেশের মানুষ সয়াবিন তেল প্রস্তুত করার পর যে ভুসি উচ্ছিষ্ট থাকতো তা-ই ভক্ষণ করতো, এমনকি তারা ভক্ষণ করতো পাইন গাছের বাকল, আজালিয়া ফুল ইত্যাদি। একদিন আমাদের কেডিআই স্কুলে অতিথি হয়ে এসেছিলেন প্রেসিডেণ্ট কিম দে জুং-এর সচিব ডক্টর জং নাম ওহ্। তিনি আমাদের উদ্দেশে এক বক্তৃতায় বললেন, আমি ছেলেবেলায় কোনোদিন স্কুল কামাই করিনি, যদিও আমি খুব ভালো ছাত্র ছিলাম না। প্রতিদিন স্কুলে উপস্থিত হতাম এ জন্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যে গুঁড়ো দুধ বিতরণ করা হতো, তা যেন মিস না হয়ে যায়। কিন্তু পরে দেশটি দারিদ্র্যমুক্ত হয়ে গেলে এই সব গল্প কেবল কোরিয়ানদের কাছেই রূপকথা মনে হতো না, আমাদের মতো বিদেশীদের কাছেও মনে হতো অলীক কল্পকাহিনী।
আমাদের আন্তর্জাতিক মানের এই স্কুলটি ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিল কোরিয়া ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট, এজন্য এটিকে সংক্ষেপে বলা হয় কেডিআই স্কুল। ২০০১ সালে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে লেখাপড়া করার জন্য কোরিয়ায় গমন ছাড়াও আমার আলমা ম্যাটার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে ২০০৩, ২০১৭ এবং ২০২২ সালে (স্কুলের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে) কোরিয়া ভ্রমণ করি। শেষ দু’টি ভ্রমণে যে চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা লাভ করি সেগুলোই আজ তোমাদের উদ্দেশে নিবেদন করবো। কিন্তু তার আগে আমাকে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। কোরিয়ানরা গণতন্ত্রের প্রতি অতিশয় আস্থাশীল বলে ঐ সময় দেখেছিলাম আমার স্কুলের লিংকন হলের দেয়ালে আব্রাহাম লিংকনের বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতার পুরোটাই লিখে রাখা হয়েছিল। তোমরা নিশ্চয় জানো আব্রাহাম লিংকন ছিলেন আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট যাঁর প্রচেষ্টায় ঐ দেশ থেকে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছিল। এই লিংকন হলের পাশাপাশি আর একটি হল ছিল ‘সেজং হল’, যা মনীষী সেজং-এর নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কোরিয়ানরা বলে ‘সেজং দ্য গ্রেট’। ১৪৫০ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া এই কোরিয়ান শাসক তার ৫৩ বছরের স্বল্প জীবনে কোরিয়াকে একটি পরিচয় দিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার বিস্ময়কর অবদান ছিল হানগুল (কোরিয়ান) বর্ণ বা অক্ষরের উদ্ভাবন, যে অক্ষরগুলো আজও তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও সাহিত্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের ভাবতে অবাক লাগে যে, এই মহৎ কর্মটি একজন শাসক ৮০০ বছর আগে সম্পন্ন করে গিয়েছিলেন। কোরিয়ানরা তাদের ইতিহাসে মাত্র দু’জন ব্যক্তিকে গ্রেট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাঁদের আর একজন হচ্ছেন অ্যাডমিরাল লি দ্য গ্রেট, যিনি ১৫৯৮ সালে জাপানি নেভির বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে জীবন দান করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, কোরিয়া একাধিকবার জাপান ও চীনের উপনিবেশ ছিল। কিন্তু কোরিয়া নিজে কখনো অন্যের ভূমি দখল করেনি। এতটাই শান্তিপ্রিয় দেশ কোরিয়া। এ জন্য করিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোরিয়ার একটি নাম দিয়েছিলেন, Land of Morning Calm (ল্যান্ড অব মর্নিং কাম), অর্থাৎ ‘প্রভাতশান্ত’ কিংবা প্রভাতের মতো শান্ত দেশ।
যে সেজং মনীষীর কথা বললাম তাঁর নামে কোরিয়াতে ২০০৭ সালে একটি আধুনিক শহরের পত্তন হয়েছে। তারপর আমাদের কেডিআই স্কুলের ক্যাম্পাসও স্থানান্তরিত হয় ঐ শহরে, যে শহরটিতে আমি দুইবার গমন করেছি। যতবার যাই ততবারই মনে হয়েছে এটি আমার জন্য এক তীর্থস্থানের মতো, কারণ শহরটি যাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত তিনি স্বজাতির বিদ্যাশিক্ষার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন, আর তাঁর নামের শহরেই রয়েছে আমার বিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস। কেডিআই স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের সাথে মেলামেশার মাধ্যমে কোরিয়ার সরকারি চাকরিজীবী, পেশাজীবী ও যুবকদের ইংরেজি ভাষার জ্ঞান ও সার্বিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সামাজিকীকরণ। এ জন্য তখন আমাদের শ্লোগান ছিল ট্রিপল ‘ই’, অর্থাৎ ইংলিশ, এথিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিক।
এই সেজং ছিলেন জোসন রাজত্বকালের চতুর্থ শাসক। তাঁর ডাকনাম ছিল ই দো (Yi Do). শাসনকার্যের পাশাপাশি তিনি স্বজাতিকে আলোকিত করার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপর জোর দিয়েছিলেন। কোরিয়ান বর্ণ উদ্ভাবন ছাড়াও তিনি সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অবদান রেখে গিয়েছেন। আমরা জানি সঙ্গীত চর্চার মূলভিত্তি হলো Notation (নোটেশন) বা স্বরলিপি। তিনিই কোরিয়ান ও চীনা মিউজিকের জন্য স্বরলিপি তৈরি করে গিয়েছিলেন, নানা বাদ্যযন্ত্রের গঠনগত উন্নয়নসহ দলীয় সঙ্গীত (Orchestral Music) রচনার জন্য উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। মনীষী সেজং-এর হাজার অবদানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কৃষির জন্য তার অবদান। ৮০০ বছর আগেও তিনি বিজ্ঞান গবেষণার বড়ো পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টাতেই সম্ভব হয়েছিল কোরিয়ার কৃষকদের জন্য একটি হ্যান্ডবুক প্রণয়ন করা। তিনিই কোরিয়ানদের দ্বারা আর্মিলারি (Armillary) গোলক, জলঘড়ি ও সূর্যঘড়ির মাধ্যমে সময় নির্ধারণের জনক। এতো বছর আগে তিনি কোরিয়াতে মুদ্রণ পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন। তিনি কোরিয়ান পঞ্জিকার সংস্কার সাধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং কয়েক হাজার বছরের পুরাতন চীনা চিকিৎসাপদ্ধতির বাইরে কোরিয়ানদের জন্য নিজস্ব চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। চীনাদের সাথে এই পার্থক্য তিনি সূচনা করেছিলেন ভাষার ক্ষেত্রেও, উভয় ভাষার যথাযথ উচ্চারণের অভিধান রচনা করে। বৈজ্ঞানিক চিন্তায় তিনি ছিলেন এক অগ্রসর মানব যিনি যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে তখনই রকেটের কথা চিন্তা করেছিলেন। এই মনীষীর বিশ্বব্যাপী প্রভাব এখন আমরা অনুধাবন করছি। কোরিয়া বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে অনেক ছোট হলেও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ হিসেবে পৃথিবীতে বর্তমানে দশম স্থান অধিকার করে আছে। তাই বাংলাদেশসহ অন্যান্য স্বল্পোন্নত ও দরিদ্র দেশের মানুষ সেখানে কর্মসংস্থানের উদ্দেশে গমন করছে। আর তখন তাদের আবশ্যিকভাবে শিখতে হচ্ছে হান্গুগমাল বা কোরিয়ান ভাষা। এই ভাষা শিক্ষার প্রথম ছবকই হচ্ছে সেজং-এর নাম।
বারবার কোরিয়া ভ্রমণ করতে গিয়ে দেখেছি যে, সেজং দ্য গ্রেট-এর নামে বহু প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে- সেজং বিশ্ববিদ্যালয়, সেজং সিটি হল, সেজং কনসার্ট হল, সেজং চেম্বার হল ইত্যাদি। ঐ শহরে স্থাপিত সেজং সিটি হলো আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন। এটির নিচতলায় রয়েছে মনীষী সেজং-এর এক বিশাল ধাতব ভাস্কর্য। জানতে পারি এটি এক পরিবেশবান্ধব স্থাপনা। এই হলটি পরিচালনায় জৈব পদ্ধতি ও সৌরশক্তির বিরাট ভূমিকা থাকার কারণে এটিকে বলা হচ্ছে টেকসই সবুজ ভবন। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য এই হলটি স্থাপিত হয়েছে যা প্রকৃতির সাথে মানুষের আদান-প্রদানের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তারা আশা করছেন এই মিলনায়তনের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ স্বাস্থ্যকর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ লাভ করবে।
কেরিয়ানরা দাবি করে থাকে যে, তাদের রাজনীতিতে দেশপ্রেমিক প্রেসিডেন্টদের ভূমিকা বা অবদান অপরিসীম। মূলত তাদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার কারণেই দক্ষিণ কোরিয়া আজ এ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। তাই সেজং শহরেই তারা নির্মাণ করেছেন প্রেসিডেন্সিয়াল আর্কাইভস অ্যান্ড এক্সিবিশন হল। সেখানে গিয়ে তো আমাদের বিস্ময় আর কাটেই না। কারণ অতীতের সকল প্রেসিডেন্টের জীবন্ত ছবি, তাদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি ও সারা জীবনের কীর্তির বহু নিদর্শন আমরা দেখতে পাই। তাদের দেশের উন্নয়ন ও সংস্কারে যার নাম বারবার শুনেছি তিনি হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট পার্ক জং হি। এই সংগ্রহশালায় তাঁরও বহু নিদর্শন দেখে আপ্লুত হই।
মনীষী সেজং কোরিয়ান ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য যে অবদান রেখেছিলেন তারই পথ ধরে বিগত কয়েক বছরে কোরিয়ান সংস্কৃতি অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। বিশ্ব সংস্কৃতিতে কোরিয়ান সংস্কৃতি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। কোরিয়ান প্রভিশনাল সরকারের প্রেসিডেন্ট কিম গু (১৮৭৬-১৯৪৯) এটা আন্দাজ করতে পেরেই বলেছিলেন, আমার দেশ ছোট বা দুর্বল হতে পারে, কিন্তু আমি প্রত্যাশা করি আমাদের সংস্কৃতি একদিন হয়ে উঠবে পৃথিবীর এক উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি। বিগত কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমরা কী দেখেছি? কোরিয়ান গায়ক জং গুক গেয়েছিল ‘ড্রিমারস’ গানটি যা ছিল এক অফিসিয়াল সংগীত। এখন আমরা ভেবেও বসতে পারি যে, এ সবই কি ছিল আট শতাব্দী আগের শাসক ও মনীষী সেজং-এর স্বপ্ন?

Share.

মন্তব্য করুন