স্বপ্ন। ডিকশনারির পাতায় অতি ছোট্ট একটা শব্দ। পৃথিবীর সব মানুষই কম বেশি স্বপ্ন দেখে। ঘুমের ঘোরে আমরা কত স্বপ্নই না দেখি, তাই না? ঘোড়া হাঁকিয়ে ছুটে যাওয়া, আকাশের বুক চিরে নীল আকাশে হারিয়ে যাওয়া। অথই সাগরে হঠাৎ ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাওয়া। কুঁড়েঘরে শুয়ে হোয়াইট হাউজে ঘুরে বেড়ানো, পরীক্ষায় ‘এ প্লাস’ পেয়ে চরম উল্লাসে মেতে ওঠা এরকম হাজারো স্বপ্ন আমাদের নিত্য সঙ্গী।
একদিন স্বপ্নে দেখলাম শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে বাংলাদেশ আর শ্রীলংকার ক্রিকেট খেলা দেখছি। আর একদিন দেখলাম বাবার হাত ধরে কাবা শরিফ তাওয়াফ করছি। আহা সে কি রোমান্সকর অনুভূতি! বাবার হাত ধরে কাবাকে দেখতে পাচ্ছি! এরই মাঝে হঠাৎ যেন কার কোমল স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল। জেগে দেখি শিয়রে মা দাঁড়িয়ে আছেন। এমনটা আমাদের প্রায়ই হয়; তাই না?
এসব স্বপ্ন ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্ন। স্বপ্ন মানুষ দুইভাবে দেখে থাকে। জেগে এবং ঘুমে। ঘুম মৃত্যুর বন্ধু। তাই ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা আর মৃত্যুর কোলে বসে স্বপ্ন দেখা একই কথা। তারপরও পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই ভালোবাসে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে। কিন্তু আমি যে স্বপ্নের কথা বলছি তা জেগে দেখার স্বপ্ন। এখন হয়তো বলবে জেগে জেগে দেখা স্বপ্ন আবার স্বপ্ন হলো নাকি? জি, হ্যাঁ- স্বপ্ন জেগে দেখাই ভালো। সহজ কথায় এটাকে বলা যায়-আশা।
এই তো আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাবেক সফল রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম আজাদ। পৃথিবীর খ্যাতিমান বিজ্ঞানী এবং স্বপ্ন জাগানিয়া প্রবাদ পুরুষ। একবার বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছিলেন, মানুষ ঘুমে যে স্বপ্ন দেখে সেটা কোনো স্বপ্নই নয়। স্বপ্ন সেটাই যা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।’ আসলেই তাই, স্বপ্নবাজদের এতো ঘুমাবার সুযোগ কোথায়? এখন নিশ্চয়ই ঠোঁট ফুলিয়ে আমার উপর অভিমান করছো। তাই না? এমনিতেই আম্মুর জ্বালায় ঠিক মতো ঘুমাতে পারিনে, এখন আবার আপনি বলছেন ঘুমানোর দরকার নেই। না আমি কিন্তু তোমাকে ঘুমাতে ১৪৪ ধারা জারি করছি না। আমি শুধু বলছি পরিমাণ মতো ঘুমাতে। আধুনিক মেডিক্যাল সায়েন্সের মতে, একজন মানুষের সুস্থ ও সবল থাকার জন্য দৈনিক ছয় ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট। আমাদের হৃদয়ের গভীরে অনেক অনেক আশা। এসব আশা স্বপ্ন হয়ে ডানা মেলতে থাকে কল্পনার রাজ্যে। কল্পনার স্বপ্নরাই এক সময় বাস্তব বর্তমানে রূপ নেয়। ধরা দেয় হাতের মুঠোয়। এভাবেই আমাদের আশা, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের ভালোবাসা, সব মিলিয়ে ভরে ওঠে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী। বাংলা সাহিত্যের এক খ্যাতিমান কবি গোলাম মোস্তফা খুব মজা করে এই কথাটি বলেছেন-
লক্ষ আশা অন্তরে ঘুমিয়ে আছে মন্তরে
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।
আসলেই তাই। আজ যারা পিতা-মাতা, শিক্ষক, সমাজপতি সবাই কিন্তু এক সময় তোমাদের মতোই শিশু ছিল, কিশোর ছিল। এতটুকুন থাকতে যাকে সবাই আদরে আদরে আর চুমুতে চুমুতে দু’গাল ভরে দিয়েছিল, আজ তিনিই প্যাজেরো গাড়িতে ছুটে চলেছেন দিগদিগন্তে। আজ তাকেই স্যালুট করছি, স্যার স্যার বলে ছোাঁছুটি করছি।
গ্রামের কুঁড়েঘরে শুয়ে, কৃষকের ঘরে কাদা মাখামাখি করে যে শিশুটি বড় হয়েছে সেই-ই হয়তো আজ দেশবরেণ্য মন্ত্রী, খ্যাতিমান আমলা, দেশসেরা কবি, সাহিত্যিক, ডাক্তার, বিখ্যাত প্রকৌশলী, নামজাদা শিল্পী, রাষ্ট্রনায়ক, আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিজ্ঞানী, নামকরা শিক্ষক, বিশ্ববরেণ্য বক্তা, তুখোড় হাফেজ, বড়মাপের ধনী, বিলিয়োনিয়ার, অগাধ সম্পত্তির মালিক।
সব মানুষকেই স্বপ্ন দেখতে হয়। এ জন্য তোমাকেও স্বপ্ন দেখতে হবে। স্বপ্ন না দেখলে বড় হওয়া যায় না। খ্যাতিমান হওয়া যায় না। পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব আলো ছড়ানো বড় বড় মানুষ, মাথা উঁচু করা বড় বড় দেশ দেখতে পাও তারা কিন্তু সবাই স্বপ্ন দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। যারা নিজেরা স্বপ্ন দেখে না, অন্যকেও স্বপ্ন দেখাতে পারে না তারা বড় হতে পারে না, শীর্ষে যেতে পারে না।
স্বপ্ন। ছোট্ট একটা শব্দ হলেও এই শব্দটাই পাল্টে দিতে পারে আমাদের জীবনকে। প্রতিকূলতাকে জয় করতে, নিজের জীবনের মোড় ঘোরাতে হলে দেখতে হবে স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখাতে পারাাঁ মানুষের মানবিকতার একটা বড় অংশ। রোবট, কম্পিউটার এদের সাথে আমাদের বড় পার্থক্য এটাই। ভীষণ প্রতিকূলতার মাঝেও জীবনকে পাল্টে দিতে পারে স্বপ্ন। আপনিও পারবেন। সারা বিশ্বে বহু মানুষ তা পেরেছে। জীবনের নানা সমস্যা, নানা জটিলতায় পিছিয়ে গিয়ে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েও তারা পেরেছে।
আমাদেরকে স্বপ্নের ভেতর বাঁচতে হবে। আমাদেরকে অনেক স্বপ্ন দেখতে হবে। প্রতিটি শিশু কিশোরের দুচোখ ভরে দিতে হবে রাশি রাশি স্বপ্নে। প্রতিটি মানুষের বুকের উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে দিতে হবে হাজার আশা। আমাদের স্বপ্ন হবে নিজেকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে, দেশের মানুষকে নিয়ে। আমাদের স্বপ্ন হবে এই পৃথিবীকে সুন্দর করে সাজানোর স্বপ্ন। হতাশা ও দুঃখ কষ্টের মাঝেও আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে। বাঁচতে শিখতে হবে। কারণ যারা স্বপ্ন দেখে না তারা বাঁচতে পারে না। আমরা শুধুমাত্র, কেবলমাত্র স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত হবো না। মানুষের মনের জমিনে আমাদেরকে স্বপ্নের মজবুত ফাউন্ডেশন গড়ে দিতে হবে। ১৯৬৭ সালের দুর্গত ও নিঃশ্ব সিঙ্গাপুর আজ পৃথিবীতে একটি ক্ষুদ্র অথচ উন্নত দেশ। তাদের সভ্যতা সেদিনের। আজ তারা সারা পৃথিবীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। সিঙ্গাপুর পৃথিবীর সুপার পাওয়ার অর্থনৈতিক পরাশক্তি। স্বপ্ন তাদের বড় করেছে।
এক সময় দুবাই ছিল একটা জেলে পল্লী মাত্র। কিছু গরিব জেলে বাস করত, মাছ ধরেই যারা কোনমতে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো প্রকৃতির প্রচণ্ড বৈরি আবহাওয়ার সাথে নিত্য যুদ্ধ করে। এদের আর একটা পেশা ছিল এরা ব্যবসা করতো, নৌকা বানানো, সমুদ্রে ঝিনুক ও মুক্তা কুড়াতো আর সেটা ভারতের বোম্বাইসহ আরবের বিভিন্ন দেশে তা সরবরাহ করতো। দুবাইয়ের আরবরা ছিল একেবারে হতদরিদ্র শ্রমিক শ্রেণির অভাবী মানুষ। যারা তিনবেলা কখনোই পেটপুরে খাবার পেত না। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চম, যষ্ঠ এবং সপ্তম দশকের এমন অবস্থা যেখানে বিরাজ করত। এখন তাদের দেখলে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে রাস্তাঘাঁ বানিয়েছে। আকাশছুঁয়া ভবন বানিয়েছে, দৃষ্টিনন্দন হোটেল বানিয়েছে। আর দুবাই শহরটার চেহারাতো প্রতিদিনই পাল্টাচ্ছে। যিনি এক বছরে এ শহরে আসেননি বা দেখেননি, তিনি এক বছর পরে এলে এ শহরকে চিনতেই পারবেন না যেন। পুরনো সব ভেঙে গড়া হচ্ছে নতুন নতুন চোখ ধাঁধানো ভবন। রাস্তাঘাট চওড়া করা হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের একজন মানুষের পক্ষে কল্পনাও করা সম্ভব নয় যে, এরা কতটা অর্থ খরচ করছে তাদের দেশটাকে সাজাতে। অফিস, আদালত, সরকারি, বেসরকারি ভবন সব যেন মর্মর পাথর দিয়ে বাঁধানো হচ্ছে! সমুদ্রের মধ্যে মাটি, পাথর আর কংক্রিট ফেলে সমুদ্রের স্রোতকে থামিয়ে দিয়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানচিত্র আকারে কৃত্রিম দ্বীপ বানানো হচ্ছে। কল্পনা করা যায় যে, সমুদ্রের স্রোতকে থামিয়ে দিয়ে বিশাল খেজুর গাছ আকৃতির কৃত্রিম দ্বীপ, আকাশ যাপন কেন্দ্র বানিয়েছে। বিশ্বের একমাত্র সেভেন স্টার হোটেল বানানো হয়েছে এই দুবাই শহরে। যার একটি কক্ষে মাত্র একটি রাতের জন্য ঘুমাতে গেলেও গুনতে হবে প্রায় পৌনে তিন লাখ বাংলাদেশি টাকার।
সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। দেশটির শতকরা আশি ভাগই পাহাড়ি এলাকা অনাবাদি বা আবাদের অযোগ্য। অথচ এই দেশটিই বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। বিশ্ব বাণিজ্য, কূটনীতি বা রাজনীতি কোন ক্ষেত্রেই তাকে আর যাই করা হোক অন্তত অবজ্ঞা করা যায় না। পুরো দেশটিই যেন একটা ফ্যাক্টরি, ভাসমান ফ্যাক্টরি। জাপানের প্রযুক্তি সারা বিশ্বে তাদের একক প্রাধান্য দিয়ে রেখেছে। অথচ আজ হতে মাত্র একটি শতাব্দী আগেও জাপানিদের আর্থিক দুরবস্থার কল্পনাও করা যেত না, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তো দেশটা প্রকৃত অর্থেই একটা ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে সুপার পাওয়ার হয়ে বেরিয়ে এসেছে। স্বপ্ন তাদেরকে দেশ গঠনে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
মালয়েশিয়া তার দেশের প্রতিটি মানুষের চোখে স্বপ্ন জাগিয়ে দিয়েছে, বুকে আশার দোলা দিয়েছে।মালয়েশিয়ার মানুষেরা সর্বত্র হইচই করছে তাদের নতুন স্বপ্ন নিয়ে। স্বপ্ন ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের সঙ্কল্প ইতোমধ্যেই তাদেরকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। এখনও তারা স্বপ্ন দেখে। আগামীর পৃথিবীতে শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে তারা পৃথিবীর নেতৃত্ব নিয়ে নিতে চায়। গায়ের জোরে নয়, অসির বলে নয়, মেধা ও মসির বলে তারা পৃথিবীকে সামনে এগিয়ে নিতে চায়। আমরাও কি এমন একটা তরতাজা সবুজ সতেজ আলোকিত স্বপ্ন দেখতে পারি না?
এই যে স্বপ্ন, এই যে বড় হওয়ার হাই অ্যাম্বিশন এটিই আমাদের চলার পথের মূল সম্বল। প্রিয় তরুণেরা এসো আমরাও স্বপ্ন দেখি। যে স্বপ্ন আমাদের জন্য বয়ে আনবে এক নতুন সকালের বার্তা। এক নতুন জীবনের সন্ধান। আমাদের স্বপ্ন-আত্ম গঠনের স্বপ্ন, নিজেকে গড়ার স্বপ্ন। আমাদের স্বপ্ন পরিবার গঠনের স্বপ্ন। আমাদের স্বপ্ন -সমাজ গঠনের, সমাজ বদলের স্বপ্ন। ক্ষয়িষ্ণু সমাজকে ভেঙে চুরমার করে নতুন এক সমাজ গঠনের স্বপ্ন। আমাদের স্বপ্ন একটি দেশ ও রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন।
আমরা সবাই পড়ালেখা করব। কেউ মূর্খ হয়ে থাকব না। কাউকে শিক্ষার আলো হতে দূরে রাখবো না। আমরা সবাই হাজী শরীয়তুল্লাহ আর তিতুমীরের মতো দেশপ্রেমিক হব, দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিকে ভালোবাসবো। দেশের যাবতীয় সম্পদের হেফাজত করব। আমরা বুকটান করে হক ও সত্যের পক্ষে হিমালয়ের মতো অটল থাকবো। গুম, খুন, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, ইভটিজিং, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা জাতিভেদে রুখে দাঁড়াবো।
আমরা একা বড় হব না, গোটা জাতিকে বড় করব। আমরা নন্দলালের মতো অলস থাকব না, আমরা একটা স্বপ্নের জন্য রাতদিন খাটবো। পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ব, আল্লাহর সব গাইডলাইন মেনে চলব, প্রিয় রাসূলের (সা:) দেখানো পথে চলব। তবুও কি আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না? হবে, হবে অবশ্যই হবে। এসো সেই স্বপ্নের পৃথিবীটা গড়ে তুলি। আর মুখে মুখে কোরাস তুলি
ছোট থাকব না মোরা চিরদিন
বড় হব নিশ্চয় একদিন।

Share.

মন্তব্য করুন