বহু দিন আগের কথা। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বাস করতো আদিল নামের এক বালক। দারুণ চালাক আর চটপটে। সব কাজেই পটু। একটু শিখিয়ে দিলে সবকিছুই নির্দ্বিধায় করতে পারতো। কিন্তু এতো গুণের অধিকারী বালকটি একদিকে ছিলো অশিক্ষিত অন্যদিকে খুব গরিব। তার বৃদ্ধ পিতা-মাতার এমন কোনো সামর্থ্য ছিল না তাকে পড়াবার। তাই সাধারণ অর্থে সবাই আদিলকে মূর্খ বলেই জানে।
কপর্দকহীন পিতা-মাতার আদিল হতে পারে মূর্খ, অশিক্ষিত, গরিব। কিন্তু এতো দারিদ্র্যের মাঝেও আল্লাহ্র প্রতি ছিল তার পরম বিশ্বাস। ভাগ্যের ব্যাপারে মর্মাহত না হয়ে সে ঠিক করলো কোনো ধনীর বাড়িতে কাজ করবে। তার বৃদ্ধ পিতা প্রায়ই বলতেন- পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি।
আদিল নিজ গ্রাম ছেড়ে পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে ধনীর বাড়িতে কাজ পেলো। ধনী লোকটি ছিল ভীষণ লোভী। তার শরীর ছিলো মোটা। মাথার চুলগুলো লালচে বর্ণের। চোখ দুটো বিড়ালের মতো ঝলমল তামাটে। দাড়ি-গোঁফ হালকা। সংসারে মাত্র ৩ জন পৌষ্য। স্বামী, স্ত্রী, পুত্র। শত একর জমি। ডজন খানেক চাকর-চাকরানী। অভাবের কোনো বালাই নেই। চারিদিকে অঢেল ধনের প্রাচুর্য। গরিব দুঃখীকে দান করার আবেদন আসলে তার হৃদয় ধন হারানোর ভয়ে আঁতকে উঠতো।
আদিলকে কাজে নিয়োগ করে ধনী লোকটি বললো- ঠিক আছে আদিল; আজ থেকে আমার বাড়িতে কাজ করতে থাকো। অলসতা কিন্তু একটুও করবে না। ওসব আমার এক্কেবারে অপছন্দ। প্রতি মাসে বেতন-ভাতা দিতে পারবো না। খাবার, কাপড়-চোপড় ফ্রি। সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারলে তার আকর্ষণীয় পুরস্কার যথাসময়ে পাবে নিশ্চিত। তুমি হয়তো জানো না; আমার কথা কিন্তু পাথরের মতো শক্ত। একটুও নড়চড় হয় না। এ ব্যাপারে দশ গাঁয়ে আমার জুড়ি নেই। আদিল শান্ত-সুবোধ ছেলের মতো নতশিরে মুনিবের আদেশ-উপদেশ শুনে উত্তর দিলো- জি হুজুর। আপনি যে সুযোগ সুবিধা নির্ধারণ করেছেন সেই আমার ভাগ্য।
নতুন চাকরি। নতুন পরিবেশ। গরিবের ভাঙ্গা ডেরা থেকে ভাগ্য নিয়ে এসেছে ধনীর অট্টালিকায়। কর্মের বিনিময়ে ভবিষ্যৎ লোভনীয় পুরস্কারের মধুময় স্বপ্ন।
আদিল তার কাজ শুরু করে দিলো সুনিপুণভাবে। শ্রান্তিহীন, ক্লান্তিহীন, বিশ্রামহীন গতিতে। এমনি করে কেটে গেলো একদিন, দু’দিন করে পুরো একটি বছর। এর মাঝে একদিনও দর্শন মেলেনি তার ¯েœহময়ী আব্বু-আম্মুর সাথে। ধনী মুনিব একটি বারের জন্যও কাছে ডেকে বলেনি, ‘আদিল তোমার কাজ খুব ভালো হচ্ছে বা খারাপ হচ্ছে।’ মনে মনে ভাবলো- মুনিবের বুঝি এখনো মন জয় করতে পারিনি! এ কথা ভেবে আদিল আরো পরিশ্রমী হয়ে সুচারুরূপে সব কাজ করতে থাকে।
বেশ কিছুদিন পর এক বিকেলে আদিল মাঠ থেকে ফিরছিলো। ধনী লোকটি শাহী দরোজায় বসে টানছিল হুক্কা। লজ্জাবতী লতার মতো জড়োসড়ো হয়ে আদিল মুনিবের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো অন্দর মহলে। হঠাৎ ডাক পড়লো- আদিল! বাবা শোন!
চৈত্রের চৌচির মাঠের কাক্সিক্ষত বৃষ্টির মতো আদিলের প্রাণ প্রবাহে যেন নতুন স্পন্দন সৃষ্টি হলো। অত্যন্ত আদবের সাথে ধনী লোকটির কাছে গিয়ে বললো- জি হুজুর! আপনার কি কিছু লাগবে?
না তা কিছু না; বহুদিন ধরে পর্যবেক্ষণের পর তোমার কাজে সন্তুষ্ট হয়েছি; আদিল এবার আমি তোমাকেও সন্তুষ্ট করতে চাই। তোমার পাওনা চুকিয়ে দিয়ে আমি চাই দায় মুক্ত হতে। হায়াত-মওতের তো হাত পা নেই, কখন কাকে নিয়ে টান দেয়।
আলহামদুলিল্লাহ্! আল্লাহ্র হাজার শুকরিয়া। আপনি আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়েছেন। আনন্দে টগবগিয়ে উঠে আদিল তার অভিমত ব্যক্ত করে।
লালচে চুলোর ধনী লোকটি আদিলকে কাছে টেনে বললো, ‘এই নাও তোমার পাওনা। মানে, আমার সে ওয়াদাকৃত আকর্ষণীয় পুরস্কার।’ এই বলে লোকটি আদিলের হাতে পুরে দিলো একটি তরমুজের বিচি। আদিলের মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রাঘাত পড়লো। রাগে-ক্ষোভে বলে উঠলো- নাউজুবিল্লাহ্; একি তামাশা করছেন আপনি? পুরো এক বছর আপনার গতর খেটেছি। কোনো কাজে তিল পরিমাণ ফাঁকি দেইনি। আপনি বলেছিলেন এর বিনিময়ে উদার হস্তে পুরস্কৃত করবেন। আপনার কথা পাথরের মতো শক্ত। দশ গাঁয়ের লোক জানে। এই আপনার ওয়াদা, আর এই আপনার পুরস্কার?
‘বুদ্ধু কোথাকার! তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। মাথায় আস্ত গোবর।’ -আদিলকে ধমক দিয়ে উঠলো লোকটি। এরপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো- শীতকালে এই বিচিটি উর্বর জমিতে বুনবি। গ্রীষ্মকালে এতে ফল ধরবে। সেই থেকে পাবি মনে কর একশ বিচি। সেই বিচি বুনলে পাবি কয়েকশ তরমুজ। কয়েক হাজার বিচি। তুই তরমুজ বিক্রি করে পাবি অনেক কাঁচা টাকা। আবার ফলাবি তরমুজ। তার মানে, আগামী দশ বছরে তুই হবি দশ গেরামের সেরা ধনপতি।
নাফরমান লোকটির সাথে আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। মনে শত ঘৃণা চেপে রেখে এতো দিনের মুনিবকে কদমবুসি করে ব্যথাহত হৃদয়ে নিজ বাড়িতে চলে এলো। আদিলের পিতা-মাতা পারিশ্রমিক শূন্য পুত্রকে দেখে খুব ব্যথা পেলো। তবুও আদিলের বাবা তাকে উত্তর মাঠের শেষ সম্বল জমিখানায় বিচিটি বুনতে পরামর্শ দিলেন।
পিতার কথা মতো অতি যতেœর সাথে জমি তৈরি করে বিচিটি বুনলো। অপেক্ষা করতে থাকলো কখন বীজ থেকে গাছ উঠবে। বড় হবে। ফুল ধরবে। ফল হবে। সে ফল বাজারে বিক্রি করে পাবে কাঁচা পয়সা। আব্বু-আম্মুর মুখে ফুটে উঠবে হাসির ফোয়ারা।
শীতের হাড় কাঁপানো কুঁড়েমি গেল চলে। এল বসন্ত। খন্ড জমিটি ভরে গেলো তরমুজ গাছটির সবুজ-শ্যামল শাখা-প্রশাখায়। গ্রীষ্মে এসে আদিলের স্বপ্ন সাধের তরমুজ গাছে ধরলো দশটি তরমুজ। এর মধ্যে একটি বেশ বড়-সড়। এর গায়ে হলুদ রঙচ্ছটা। গ্রামবাসী বললো, এটি সুমিষ্টির লক্ষণ।
একদিন কুসুমপুরের হাটে সে বড় তরমুজটি বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে চললো আদিল। বাড়ি থেকে ৫ মাইল দূরে হাট। ৩টি মাঠ পার হতে হয়। অবশ্য মাঝে রয়েছে এক ঘন বন। দিনের বেলায়ও এ বন দিয়ে হাঁটতে লোকদের গা শিউরে ওঠে। জনশ্রুতি আছে যে, মতলব ডাকাত নামে এক দুর্ধর্ষ ডাকাত এ বনে আস্তানা গেড়েছে। চলার পথে লোকজন থেকে নানা ছদ্মাবরণে ডাকাতি করে।
আদিল সে বন দিয়ে যাচ্ছিলো মাথায় তরমুজটি নিয়ে। বনের মাঝামাঝি পথ অতিক্রম করতেই মতলব ডাকাত তার পথ আগলে ধরলো। জোর করে তরমুজটি ছিনিয়ে নিতে চাইলো। ডাকাত আর আদিলের ধস্তা-ধস্তির মাঝে ফেরেস্তার মতো ঘোড়সওয়ার আমান জমিদার এসে দু’জনের সামনে দাঁড়ালো। জমিদারকে দেখে মতলব তীর বেগে ছুটে পালালো।
আদিল এ যাত্রা তার বড় শখের তরমুজটি পারলো রক্ষা করতে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে সবকিছু খুলে বললো আমান জমিদারের কাছে। দুঃখী আদিলের কথায় জমিদারের মনে ¯েœহের উদ্রেক হলো। আদিলকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন- বাবা! তরমুজটি বাজারে নিয়ে আর কত পাবে, বরং আমার কাছে বিক্রি করে দাও। সন্ধ্যা হয়ে এলো কষ্ট করে আর বাজারে যেও না। ডাকাত তোমার পিছু লেগেছে। এই নাও ১০০ স্বর্ণ মুদ্রা।
“শোকর আলহামদুলিল্লাহ্, আমাদের সৌভাগ্য যে আপনার মতো দরদি জমিদার এখনো বেঁচে আছেন। এই নিন হুজুর।”- বলে আদিল তরমুজটি বেঁধে দিলো ঘোড়ার পিঠে। জমিদার তার হাতে পুরে দিলেন স্বর্ণ মুদ্রাগুলো। ‘সুবহানাল্লাহ্’ ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বলে আদিল আকাশের দিকে তাকালো। খুশিতে টগবগিয়ে পিতা-মাতার সাথে দেখা করতে আদিল দ্রুত নিজ বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ির সবাই খুশি। বাপের বেটা। এতো দিনে ভাগ্য খুলেছে। আদিল লাল চুলো মুনিবের কথা স্মরণ করে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালো।
আমান জমিদার বাড়িতে গিয়ে সবাইকে ডেকে দেখালেন ১০০ স্বর্ণ মুদ্রায় কেনা তরমুজটি। সবাই দলবেঁধে দেখতে এলো। কেউ বললো- ‘কত দাম হয়েছে?’ কেউ মন্তব্য করলো, ‘জমিদারের পছন্দ জমিদারের মতোই।’ আবার কেউ আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললো, গত ২০ বছরেও অত বড় তরমুজ দেখিনি। আহ! যদি এক টুকরো খেয়ে হৃদয়টা ঠান্ডা করতে পারতাম!’ নানা বাদানুবাদের মাঝে জমিদার সিদ্ধান্ত দিলেন কাল রোদেলা দুপুরে তরমুজটি কাটা হবে। জমিদার তার অতি আদরের ছোট মেয়েকে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠালেন।
জমিদার বাড়ির সবার মনে আনন্দের বন্যা বইলেও জমিদার তার প্রহরীকে ডেকে মতলব ডাকাতের সম্ভাব্য হামলা থেকে সাবধান থাকার কথা বলে ঘুমোতে যান। রাত প্রায় শেষ। বাইরে সুবহে সাদিকের আভা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ পর মুয়াজ্জিন সুরেলা কণ্ঠে আযান দেবেন। ঠিক সে মুহূর্তে প্রহরী চিৎকার দিয়ে উঠলো ‘মাগো’ শেষ হয়ে গেলাম যে। ডাকাত… ডাকাত…। তড়িঘড়ি সবাই ছুটে এলো। জানতে পারলো লাল চুলো, স্বল্প গোঁফ-দাড়ি, মোটাসোটা এক লোক প্রহরীর মাথা ফাটিয়ে তরমুজটি নিয়ে গেছে। জমিদারের লোকজন ধরমার করে ডাকাতের পিছু ছুটলো। ডাকাতও বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে পালাতে লাগলো।
আদিলের গাঁয়ে খোশালাপের প্লাবন। ১০০ স্বর্ণ মুদ্রায় অবিশ্বাস্য তরমুজ বিক্রি। পথে ডাকাতের হামলা, উদ্ধার; প্রভৃতি মুখরোচক কথাবার্তা এক দুই করে ধনী লোকটির কানে গিয়ে পৌঁছলো। ধনীলোক পরদিন আদিলকে তার বাড়িতে ডেকে পাঠালো। আদিল এলে ধনী লোকটি বললো- তোর সৌভাগ্যের কথা শুনে আমি যারপরনাই আনন্দিত হয়েছি। আল্লাহ্ চাইলে কার ভাগ্য না এভাবে ফেরাতে পরেন। জবাবে আদিল বলল, সে আপনার দোয়া হুজুর। লোকটি আবার বললো- এখন কথা হলো, তোমার পাওনাতো তুমি পেয়ে খুব খুশি, কিন্তু আমার ভাগটা যে এখনো শুধলে না।
আস্তাগফিরুল্লাহ্! এ আবার আপনি কী বলছেন? আদিল অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। লোকটি ধমক দিয়ে বলে- আমিই তো তোকে তরমুজের বিচিটা দিয়েছিলাম। তার উপর সেটি তুই লাগিয়েছিস আমার জমিনে; মানে তোর দাদাকে যা আমি চাষ করতে দিয়েছিলাম। ঐ সোনাফলা তরমুজটি তো ঐ জমিতেই ফলেছে। কাজেই জমির খাজনা বাবদ তুই আমাকে দিবি ৫০টি স্বর্ণমুদ্রা।
লোভী লোকটির সাথে আর কোনো কথা বলতে আদিলের ঘৃণা হলো। সে লোকটির সামনে মুদ্রা কয়টি ছুড়ে মেরে চিৎকার দিয়ে বললো- এই নিন আপনার খাজনা। কিন্তু শুনে রাখুন, এ লোভের জন্য আপনার গলায় একদিন ফাঁস পড়বে। যে দিন কেউ তা খন্ডাতে পারবে না। আল্লাহ্ তো হক্কের কাজী। দাঁড়িপাল্লা নিয়ে তিনি বসে আছেন। তার কাছ থেকে রেহাই পাওয়ার কোন জো নেই।
কথাগুলো লোকটির মুখের উপর ছুড়ে মেরে সে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। এমন সময় একদল লোক এসে তাকে জিজ্ঞেস করলো, ডাকাত দেখেছো, ডাকাত? সে আমাদের জমিদারের ১০০ স্বর্ণ মুদ্রার তরমুজটি ডাকাতি করে নিয়ে গেছে।
লোকটি কেমন? -আদিল প্রশ্ন করে। লোকেরা প্রায় সমস্বরে বলে ওঠে- মোটাসোটা লালচুলো। আদিলের শরীরে আগুন ধরে যায়। সে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে- হ্যাঁ দেখেছি ঐ তো; ঐ বাড়িতে। “শালা, এখন আমার স্বর্ণ মুদ্রাও কৌশলে নিয়ে গেছে, রাতে আবার ডাকাতিও করেছে।” মনে মনে স্বগতোক্তি করে আদিল।
লোকজন আর দেরি না করে তিন লাফে ধনী লোকটিকে টেনে বের করে আনলো। শুরু হলো উত্তম মধ্যম। লোকটি যতই চিৎকার করে বললো- আমি ডাকাতি করিনি। লোকজন কিছুতেই তাকে ছাড়লো না। গলায় রশি বেঁধে হেঁচকা টানে নিয়ে এলো রাস্তায়।
দূর থেকে আমান জমিদার ‘ডাকাত ধরেছি, ডাকাত ধরেছি’, বলে সদলবলে মতলব ডাকাতকে নিয়ে এলো। মার খেয়ে ছদ্মবেশী মতলবের আসল চেহারা ফুটে উঠলো। মুক্তি পেলো আধমরা ধনী লোকটি।
এক লোভী ও এক ডাকাতের আর্তচিৎকারে গোটা গাঁয়ের লোক এসে জড়ো হলো। ছোটরা চিমটি কাটলো। বড়রা হাসাহাসি করলো। আবার কেউ কেউ টিপ্পনী কেটে বললো- “পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। লোভে পাপ-পাপে মৃত্যু।”
Share.