তারার জন্ম হয় নেবুলা থেকে। ঘবনঁষধ-কে বাংলায় বলে নীহারিকা। নেবুলা বা নীহারিকা হলো গ্যাস এবং ধুলার মেঘ। এমন বিশাল বিশাল দৈত্যাকার মেঘের কুণ্ডলী মহাকাশে ভেসে বেড়ায়। গ্যাসের মধ্যে প্রধান থাকে হাইড্রোজেন বেশির ভাগ এবং হিলিয়াম। এই গ্যাস আর ধুলার মেঘ থেকে জন্ম হয় তারার।
মহাকাশে ভেসে বেড়ান ধুলা আর গ্যাস পরস্পরের সাথে মিশে ধীরে ধীরে মেঘের কুণ্ডলী হতে থাকে। ধুলা আর গ্যাসগুলো একে ওপরের কাছাকাছি এলে পরস্পরের মধ্যে থাকা ফোর্স একে অপরকে টানে। এতে মেঘের কুণ্ডলীর মধ্যে শক্তিশালী গ্র্যাভিটির জন্ম হয়, এতে আশপাশে ভেসে বেড়ান মেঘগুলোকে আরও সজোরে কাছে টানে। এমন করে মেঘগুলো জড়ো হতে হতে তাদের কেন্দ্রে থাকা শক্তিশালী আকর্ষণটি ঘন হতে হতে এতো শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, মেঘের কুণ্ডলী এক বিস্ফোরণে ভেঙে পড়ে এবং এই ভেঙে পড়ার সময় থেকে পরবর্তীতে তার কেন্দ্রে থাকা গ্যাস এবং পদার্থ ধীরে ধীরে একে অপরের সাথে মিশে, আরও বেশি ঘন হয়ে তে গ্যাসগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে একটি বলের জন্ম দেয়, যাকে বলে প্রোটোস্টার। এই প্রোটোস্টার থেকে জন্ম হয় স্টার বা তারার। এরকম তারার জন্মের ভ্রƒণ তৈরি হতে সময় লাগে এক লক্ষ থেকে এক শ’ লক্ষ বছর সময় ধরে।
স্টারগুলোর মাঝে যে শূন্য জায়গাটিকে দেখি আমরা মহাকাশে, এই শূন্য স্থানটি থেকেও স্টারগুলোর উৎপত্তি। যদিও জায়গাটি শূন্য নয়, এমন স্পেসকে বলে ইন্টারস্টেলার স্পেস। এই স্পেসে থাকা উপাদান গ্যাস আর ধূলিকণাই সকল নক্ষত্রের উৎস। আবার স্টারগুলো মিলিয়ন মিলিয়ন বছর জ্বলার পর ধ্বংস হয়ে ভেঙে পড়লে তা তার উপাদানগুলো আবার সেই ইন্টারস্টেলার স্পেসে ফিরে আসে এবং পরবর্তী তারার জন্ম দিতে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর নেয়। এমন করে তারার জন্ম যেখান থেকে, তারাই সেখানে তার পরবর্তী তারার জন্ম দিতে কাঁচামালের জোগান দেয়।
তারারা মিটিমিটি করে জ্বলে। আর তা থেকে মহাকাশে আলো ছড়িয়ে পড়ে। সেই আলো আমরা দেখতে পাই। তাই তারাদের দেখি আকাশে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বল করে। তবে তারাদের থেকে আমাদের চোখে এসে পড়া এই আলো থেকে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারে- তারাগুলো কী কী দিয়ে তৈরি, আমাদের থেকে কত দূরে, তারাগুলো একে অপর থেকে কতটা কাছে। কারণ, বিজ্ঞানীরা জানেন যে- কোনো একটি পদার্থের পরমাণু যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠে, তখন তা আলোর শক্তি আকারে ছড়িয়ে দেয়। আবার যখন পরমাণু ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তখন তা শোষণ করে নেয়। এতে বস্তু থেকে ঠিকরে পড়া আলোর এক একটি বর্ণালি তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, এক একটি পদার্থের এমন আলোর বিকিরণ অথবা শোষণের কারণে যে ধরনের আলোর বর্ণালি তৈরি হয়, তা এক একটির একেক ধরন ।
কোনো একটি পদার্থ থেকে আলো বের হওয়া, শোষণ হওয়া অথবা বিক্ষিপ্তভাবে বেরিয়ে এসে যে আলোর বর্ণালি তৈরি করে, তাকে নিয়ে অধ্যয়ন করাকে বলা হয় স্পেকট্রোস্কোপি বা বর্ণালি বিজ্ঞান। তারা থেকে শুরু করে গ্যালাক্সি, ব্ল্যাকহোল থেকে শুরু করে সুপারনোভা, এমন অনেক কিছুই সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা ধারণা লাভ করেছেন এই বর্ণালি বিজ্ঞান থেকে ।
স্পেকট্রোস্কোপি বিজ্ঞানের কৌশলের মাধ্যমে পদার্থ এবং আলোর বা ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক বিকিরণের ক্রিয়াকে বোঝার চেষ্টা করা হয়।
তারাগুলোকে বিশ্লেষণ করবার অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা এই ব্যাপারটি জানতেন। পৃথিবীতে বসেই বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদার্থকে বিশ্লেষণ করে তার থেকে ঠিকরে পড়া আলোর সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। বিভিন্ন পদার্থকে বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীদের সে তথ্যের সমাবেশ থেকে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে স্পেকট্রোস্কোপি বিজ্ঞান।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্পেকট্রোস্কোপি ধারণাটির উদ্ভব হয়েছিল। ব্রিটিশ পদার্থবিদ উইলিয়াম ওলাস্টন ১৮০২ সালে সূর্যের আলোকে বিশ্লেষণ করে দেখতে পান যে, যখন একটি বর্ণালি তৈরির জন্য একটি প্রিজমের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো যায়, তখন অনেকগুলো স্বতন্ত্র রেখা দেখা যায় তাতে। তবে তিনি তখন এর চেয়ে বেশি কিছু জানতেন না এবং সেই রেখাগুলো সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। পরবর্তীতে ১৮১৪ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ফন ফ্রাউনহোফার প্রিজমের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলোকে বিশ্লেষণ করে যে বর্ণালির সৃষ্টি করেছিলেন, তার মধ্যে ৫৪টি রেখা খুঁজে পান । এমন করে বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় স্পেকট্রোস্কোপি বিজ্ঞান গড়ে উঠতে থাকে ।
১৮৬৮ সালে মজার একটি ঘটনা ঘটে। সেবার পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। সেই সোলার এক্লিপস পর্যবেক্ষণ করতে পিয়েরি জনসন নামের এক বিজ্ঞানী ভারতে যান। তিনি সেখানে অবস্থান করে সূর্যগ্রহণের সময় সূর্য থেকে আসা আলোকে প্রিজমের রাখলে একটি নতুন ধরনের হলুদ রঙের রেখা দেখতে পান। একই সময়ে লন্ডনে বসে আরেক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জোসেফ নরম্যান সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করে একই ধরনের নতুন একটি রেখার সন্ধান পান। নরম্যান বুঝতে পারেন যে- সূর্যের মধ্যে এমন একটি নতুন উপাদান নিশ্চয়ই আছে, যার কারণে এই রেখাটি দেখা দিয়েছে এবং এই উপাদানটি হয়তো পৃথিবীতে নেই। তিনি তার নাম দেন হিলিয়াম। এটি তিনি নিয়েছিলেন গ্রিক শব্দ হেলিয়াস থেকে। এর অর্থ সূর্য। তখনো পর্যন্ত মনে করা হতো হিলিয়াম বলে যে পদার্থটি আছে, তা কেবল সূর্যতে পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ১৮৯৫ সালে পৃথিবীতেও হিলিয়াম উপাদানটি আবিষ্কৃত হয়। শুধু সেটাই নয়, পরবর্তীতে জানা যায় যে, মহাবিশ্বের যে দুটি উপাদান দিয়ে বিশাল অংশ তৈরি, একটি তার হাইড্রোজেন এবং আরেকটি হিলিয়াম।
তারাগুলো থেকে ঠিকরে পড়া আলোর অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীরা একদিকে যেমন বুঝতে পেরেছেন তারাগুলো কী দিয়ে তৈরি, তেমনি আলোর রেখাগুলোকে বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বের করেছেন- তারাগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, নাকি আমাদের আরও নিকটে চলে আসছে।
বিজ্ঞানীরা প্রথমে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যে, একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে পদার্থরা একই ধরনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে আলোর রেখা তৈরি করে। কিন্তু যেখানে পদার্থটি থাকে, তা থেকে যদি দূরে সরে যায় অথবা আরও নিকটে চলে আসে বা তার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন করে, তাহলে সেই আলোর রেখাগুলোর ধরনেরও পরিবর্তন হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা দেখলেন যে, বস্তুটি যদি আমাদের আরও কাছে চলে আসে, তাহলে তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ছোট হতে থাকে। বিজ্ঞানীরা এটাও জানেন যে- নীল রঙের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ছোট হয়। বিজ্ঞানীরা এর নাম দেন ব্লু শিফট। আবার বস্তু যদি আমাদের থেকে দূরে সরে যায়, তাহলে তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য দীর্ঘ হতে থাকে। বিজ্ঞানীরা এটাও জানেন যে লাল রঙের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য দীর্ঘ হয়। এটার নাম দেন বিজ্ঞানীরা রেড শিফট। এমন করে তারা থেকে আসা আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য মেপে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে- তারাগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, নাকি আরও কাছে চলে আসে। কেবল শুধু তারা নয়, মহাকাশে থাকা অনেক বস্তুর দূরত্ব এবং তার মুভমেন্ট এই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে বিভিন্ন শিফটের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারে।
আলো থেকে তারা চেনার উপায়টি এখন এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে- বিজ্ঞানীরা আলোর গঠনের বিশ্লেষণ করে তারাগুলো গঠনে বিভিন্ন উপাদান, তার ভর, কেমন কওে তৈরি হলো, কতটুকু দূরত্বে, আয়তনে কত, দূরে সরে যাচ্ছে নাকি কাছে চলে আসছে, এমন অনেক কিছুই এখন বিজ্ঞানীরা সহজে জানতে পারেন।
Share.