আমরা যে ঈদ উদযাপন করি সেই ঈদ দুইটা। একটা হলো ‘ঈদুল ফিতর’। অন্যটা হলো ‘ঈদুল আযহা’। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা দুটিই আরবি শব্দ। ফিতর শব্দের অর্থ ভঙ্গ করা। আর আযহা শব্দের অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগ করা। ঈদুল আযহা অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগে ফিরে আসা। আর কুরবানি অর্থ আমি উৎসর্গ করি, ত্যাগ করি, নৈকট্য লাভ করি। মূল শব্দ কোরবান। আমরা ঈদুল ফিতর নিয়ে আলোচনা করব। ‘ঈদ’ শব্দের অর্থ বারবার ফিরে আসা। আর ফিতর বা ফেতর শব্দের অর্থ ভেঙে ফেলা। তাহলে ঈদুল ফিতর অর্থ দাঁড়াল বারবার ভেঙে ফেলা। ঈদের আর একটা অর্থ আছে। তা হলো- বারবার ফিরে আসার আনন্দ। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সদাকাতুল ফিতর প্রদান করতে হয়। অর্থাৎ গরিব দরিদ্র দুস্থ মানুষকে অর্থকরী দেওয়াকে সদাকাতুল ফিতর বা জাকাতুল ফিতর বলা হয়। রমজান মাসের রোযা শেষ করে ঈদুল ফিতরের দিন সকালে খাওয়াকেও ফিতর বলা হয়। আবার প্রতিটি রোজা শেষে সন্ধ্যা বেলার খাওয়াকে ইফতার বলা হয়। ইফতার, ফিতর আর ফিতরা শব্দের গুরুত্ব বুঝতে এই ঈদের নাম হয়েছে ঈদুল ফিতর। আর এই ফিতর বারবার বা প্রতি বছরই করতে হয়। এই জন্যই ঈদুল ফিতর। ‘ঈদুল ফিতর’ কে আমরা ‘ঈদুল ফিতর’ এইভাবেও লেখতে পারি।
মুসলিমদের সবচেয়ে বড় আনন্দোৎসব ঈদুল ফিতর। এই ঈদ শুরু হয়েছিল নবী মুহাম্মদ সা:-এর সময়। ঈদের নামাজ প্রথম পড়া হয়েছিল দ্বিতীয় হিজরির সাওয়াল মাসের ১ তারিখে। মদিনায়। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে। মুহাম্মদ সা: ঈদ উদযাপান করার নির্দেশ পেয়েছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে। এই ঈদই ছিল প্রথম উদযাপন করা ঈদ। ঈদের নামাজ মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। ঈদের দিন রাসূল সা:-এর মতো করে প্রস্তুত থাকাটা সুন্নাত। ঈদের প্রস্তুতি ফজর নামজের পর থেকে সম্পন্ন করা উত্তম। যেমন- ভোরে ঘুম থেকে ওঠা। দাঁত মেসওয়াক করা। গোসল সম্পন্ন করা। পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরা। সুগন্ধি ব্যবহার করা। বেশি বিলম্ব না করে, আগে আগে ঈদগাতে যাওয়া। যাওয়ার আগে মিষ্টিদ্রব্য আহার করা। ফিতরা আদায় করা। ঈদগাহে নামাজ পড়া। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না থাকলে ঈদের নামাজ মসজিদে না পড়া। পায়ে হেঁটে এক রাস্তা দিয়ে গিয়ে অন্য রাস্তা ধরে ফিরে আসা। সমস্ত রাস্তায় মৃদুস্বরে তাকবির পড়া।
আমাদের দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপন শুরু হয় ঈদের দিনের প্রায় দু’সপ্তাহ আগে থেকে। উপহার বিনিময় করা হয় প্রিয়জনদের মধ্যে; আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে। গরিব দুস্থদের মধ্যে বিতরণ করা হয় যাকাতের টাকা-পয়সা, শাড়ি-লুঙ্গি সেমাই-চিনিসহ নানান উপকরণ। সদাকাতুল ফেতরার অর্থও বিতরণ করা হয় ঈদগাহে যাবার আগে। আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত দেওয়ার কাজটাও সেরে রাখা হয় আগেভাগে। বাড়িঘর ধোয়ামোছা, বিছানার কাপড়চোপড়, কাঁথাবালিশ ধোয়া ও রোদে শুকানোর কাজ নিয়ে ব্যস্তসময় পার করে বাড়ির বউ-বেটিরা। চাকর-বাকররা। বাড়ির কর্তারা বাজার-ঘাট করা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। পরিবারের ছোটবড় সকলের জন্য নতুন জামাকাপড় কিনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। গরিব দুঃখীদের যথাসাধ্য চেষ্টা থাকে ঈদের দিনে এক সন্ধ্যা ভালো খাবার ও স্বল্প মূল্যের নতুন জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করার। এটিও কারো জোটে কারো জোটেও না। মুখাপেক্ষী হতে হয় বিত্তশালীদের প্রদত্ত দান-সদকার দিকে। ধার করে চেয়েচিন্তে হলেও দুস্থ মানুষ ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে বউ-বাচ্চা নিয়ে ক্ষুদ্র একটু আয়োজন করতে প্রাণপণ চেষ্টা করে। এ আয়োজন হয় নিতান্ত করুণ হালতে। আমাদের দানের হাত ভারি। বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র মানুষকেও ঠকিয়ে পয়সা কামায়। অনেক মুসলমানের এ জাত স্বভাব। রক্তের সাথে মিশে গেছে। সে কারণেও গরিব আরো গরিব হতে থাকে। এই দরিদ্র মুসলমানগুলোও নেহায়েত শিশু সন্তানদের সান্তনা দেবার জন্য একটু আধটু আনন্দের চেষ্টা করে মাত্র। এভাবেই চলে ঈদের আনন্দ।
ঈদুল ফিতর ঘিরে আমরা আনন্দ করি। কেন আনন্দ করি? এই জন্য আনন্দ করি যে, প্রায় এক মাস আমাদের বিদ্যালয় বন্ধ থাকে। এ সময় পড়াশুনার চাপ থাকে না। খেলার সময় বেশি পাওয়া যায়। অবাধে ঘুরাঘুরি করা যায়। ঈদের জন্য আমরা নতুন নতুন জামা-জুতা পাই। বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাই। আত্মীয় স্বজনদের সাথে বছর অন্তে দেখা হয়। নানান ধরনের খাবার-দাবার যেমন- মিষ্টিমিঠাই, গোশত-মাছ, ফলমূলের আয়োজন করা হয়। এই জন্য আমাদের আনন্দ বেড়ে যায়। ঠিক আছে। তবে এই সবই আনন্দের মূল কারণ নয়। আমাদের আনন্দের মূল কারণ হলো- দশ বছর বয়স থেকে আমাদের জন্য রোযা ফরজ হয়। দশ বছর বয়স থেকে আমরা যারা রোযা করি; আমরা এক মাস রোযা করার মাধ্যমে অন্যায় না করার প্রশিক্ষণ নিই। যেমন- মিথ্যা কথা না বলা। বিনা কারণে বেশি কথা না বলা। অকারণে বেশি বেশি কথা বলা একটা খারাপ অভ্যাস। এই অভ্যাস অন্যায় অভ্যাস। কাউকে গালি না দেওয়া। কারো সাথে ঝগড়া না করা। হিংসা বিবাদে না জড়ানো। মানুষের প্রতি সদয় হওয়া; নির্দয় না হওয়া। অযথা সময় নষ্ট না করা। পিতা-মাতার প্রতি বাধ্য থাকা। যা কিছু আছে, সেখান থেকে দান করা। সদকা করা। মানুষের সাথে হাসি মুখে কথা বলা। বড়দের সম্মান করা। ছোটদের আদর স্নেহ করা। দোয়া দরুদ পড়া। এই যে এক মাস যাবৎ আমরা এই সবের প্রশিক্ষণ নিলাম; এই প্রশিক্ষণ নিতে পারাটাই আমাদের আনন্দের। এই এক মাস ধরে নিজেকে সুন্দর করে তোলা যায়। পাপমুক্ত হওয়া যায়। আমাদের বাপ-চাচারা অনেক সময় বিবাদে জড়ায়, মানুষকে হিংসা করে, মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। তারাও রোযার মাসে ওসব না করার চেষ্টা করে। তারাও নিজেকে পাপ থেকে বিরত রাখে। পাপ থেকে এই যে নিজেকে বিরত রাখাটাই আনন্দের।
আমরা দেখি, ঈদের আনন্দ করতে গিয়ে কিছু ছেলে-মেয়ে উচ্চ স্বরে গান করে। খারাপ ভাবে অঙ্গভঙ্গি করে। সাউন্ড বক্স বাজিয়ে ধুম নাচে। এতে উচ্চ শব্দের কারণে মানুষের কষ্ট লাগে। মানুষ বিরক্ত হয়। যারা রোগী তাদের কষ্ট বাড়ে। কেউ আবার পটকা ফাটিয়ে বিকট শব্দ তৈরি করে; দল বেঁধে হৈ হুল্লোড় করে। অযথা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। রাস্তার মোড়ে জটলা পাকায়। এক মহল্লার ছেলেরা অন্য মহল্লার ছেলেদের সাথে বিবাদে জড়িয়ে আনন্দ পায়। অনেক সময় মারামারি করে। এ সবই নিরর্থক। এগুলো করা মানে ঈদের আনন্দ নয়। এ সবের মধ্যে সামান্য আনন্দ থাকতে পারে। তবে এসবের মধ্যে আমাদের অনেক বেশি ক্ষতি হয়। নিচু স্বরে হামদ, নাত, নাশিদ, গজল গেয়ে আনন্দ অনুভব করা যেতে পারে। মৃদু তালে নাচলে শালিনতা রক্ষা হয়। ধুম উচ্চ তালে, উচ্চ ভলিউমে নাচলে মন বিকৃত হয়। শরীরও বিকৃত হয়। এমন ভাবে ঈদের আনন্দ করলে নিজেদেরই ক্ষতি হয়। যে কোনো ভাবে মানুষের ক্ষতি হোক; এটা ঈদের শিক্ষা নয়।
ঈদে উচ্চবিত্তদের আনন্দ হয় চোখ ধাঁধানো। বিশেষ করে যারা অন্যায়ভাবে রোজগার করে। যারা ধর্মের বাধা নিষেধ মানে না। ধর্মকে মনে করে ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাদের পরিবেশে ঈদের আনন্দটা ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। ধর্ম তারা না মানলেও ধর্মীয় উৎসব পালনে তারা আগ্রহী। ঈদ উপলক্ষে তাদের কেনাকাটা হয় দেশ-বিদেশে। পরিবারে খাবার-দাবারের আয়োজন হয় পরিমাণে বিপুল। তারা মানুষকে দান করে অল্প। কিন্তু উচ্চমূল্যের খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহে থাকে সদা ব্যস্ত। আত্মীয়তার সম্পর্ক নাই এমন লোকজন নিয়ে চলে তাদের সপ্তাহব্যাপী ঈদপার্টির আয়োজন। চলে দেশে-বিদেশের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ঘোরাফেরা। যাকাত দেওয়া থেকে বিরত থেকেও তারা অঢেল পয়সা খরচ করে বিত্তবানদের বিনোদনের পেছনে। গরিব আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর না রাখলেও বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনদের নিয়ে চলে সাড়ম্বরে ঈদ উল্লাস। রাতের আঁধারে বারগুলোর আয়োজনে থাকে নিষিদ্ধ মদ জুয়া ও নারী-পুরুষ স্পর্শের হোলি। এমনটাই দেখা যায় বেশির ভাগ উচ্চবিত্ত বাঙালি মুসলিম পরিবারের ঈদ আনন্দে। ধর্ম পালনে অনীহা থাকলেও ধর্মের উৎসবে আনন্দ করতে বাঙালি মুসলিম পরিবারগুলোকে কখনোই বিরত থাকতে দেখা যায়নি। অথচ তাদের এই আনন্দকে ঈদের আনন্দ বলা যাবে না।
Share.