সেই দিনগুলো কোথায় কিভাবে হারিয়েছি সে কথা ভাবতে কষ্ট হয় এখন। পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় জীবনের সেই সময়গুলো ছিলো সবচেয়ে সুন্দর এবং আনন্দের। কত যে সুখের দিন ছিলো সেই ছোটবেলার সময়টাতে এখন শুধু মিস করি। অনেক অনেক মিস করি ফেলে আসা জীবনের ছোটকাল অর্থাৎ শৈশব কৈশোরের দিনগুলো।
হঠাৎ হঠাৎ মনে হলে কেমন যেনো স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়। মনে হয় ঘুমের ভেতর দেখা কোনো স্বপ্ন বুঝি মনে মনে দেখতে পাই। কখনও শীতের সাদা সাদা কুয়াশা জড়িয়ে বাংলার মেঠোপথে হাঁটছি। চোখে মুখে কুয়াশার হিমশীতল বাতাস এসে একেবারে ঠাণ্ডা করে বয়ে যায়। সারা গায়ে উলের মোটা কাপড় আর চাদর বা জাম্পার জড়িয়ে চলতাম সবাই।
কখনও শীতের শেষে বসন্তের সুন্দর হালকা ফুরফুরে বাতাস জড়িয়ে খেলতাম। অথবা পাড়ে ঘন গাছ লতাপাতা বিশিষ্ট পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে বসে কোকিলের গান শুনতাম।
কখনও গ্রীষ্মের দুপুরে গরম আর উত্তাপ থেকে বাঁচার জন্য তালপাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হিজল বা কাঁঠাল গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম থেকে জেগে দেখতাম তখন শরীরের একটি অংশে ছায়া। আরেক অংশে রোদের দখলে চলে গেছে ততক্ষণে। আর সারা গায়ে পিঁপড়াদের রাজত্ব চলতো বড় আশ্চর্যরকম। লাল কালো পিঁপড়ারা সারা গায়ে বেশ আনন্দের সাথে ঘুরে বেড়াতো।
বৃষ্টির দিনের কথাও মনে পড়ে অনেক। একেবারে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে খোলা মাঠে ফুটবল খেলতাম। অনেক সময় গাছের জাম্বুরাকে বল বানিয়ে খেলা শুরু করে দিতাম। আবার কখনও এমন প্রবল বৃষ্টির মধ্যে হাডুডু খেলতাম বন্ধুদের বা পাড়ার সহপাঠীদের সাথে।
আষাঢ় শ্রাবণের সেই বৃষ্টির ধারা এখন আর তেমন করে নেই। একাধারে বৃষ্টি ঝরতো আর ঝরতো। মাঠঘাট খাল বিল নদী পুকুর সবই ভরপুর হয়ে যেতো বৃষ্টির পানিতে।
বর্ষা শেষ হতেই সাদা মেঘের পসরা নিয়ে আসতো শরৎকাল। হায় সেকি সুন্দর শরতের শিশির ঝরা সকাল আর সুন্দর নীরব দুপুর।
শরতের সবচেয়ে আনন্দের বিষয় ছিলো শিউলি ফুলের ঘ্রাণ আর শিউলির পাপড়িতে গড়িয়ে পড়া শিশিরের আনন্দ!
তারপরই তো হেমন্তের আগমন। হেমন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে আনন্দময় ঋতু। আনন্দের হওয়ার কারণ অবশ্য আছে। বাংলাদেশের আবহাওয়ার বিষয়ে একটি কথা আছে যে, বাংলাদেশ একটি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ এর আবহাওয়া না গরম না ঠাণ্ডা। তো এখন তো প্রায় নয় মাসই বাংলাদেশে গরম থাকে। বাকি তিন মাস শীতের আবহে থাকে।
এখানেই হলো সমস্যার বিষয়। এখন বাংলাদেশের আবহাওয়া বদলে গেছে অনেক। বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি তেমন হয়ই না। আবার শীতের সময় খুব একটা শীতও পড়ে না। বসন্ত কালে একসময় নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া ছিলো বাংলাদেশে। এখন কিন্তু তা নেই তো নেই। বরং শীতের শেষেই গরম পড়া শুরু হয়ে যায়।
কেন এমন করে পরিবর্তন হলো এদেশের আবহাওয়া?
এর জন্য প্রকৃতি কিন্তু দায়ী নয়। দায়ী হলো বাংলাদেশের মানুষ।
মানুষ কেন দায়ী? কারণ মানুষইতো গাছগাছালি বনবনানী কেটে ছেটে জঙ্গল উজাড় করে দিয়েছে। গাছ লাগানোর কোনো আয়োজন না করে শুধু যদি কাটার ব্যবস্থা করে তাহলে কেমন করে প্রকৃতি তার ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে!
মানুষ যখন বেপরোয়া ভাবে বনবনানী গাছগাছালি জঙ্গল কাটে, কেটে বাড়ি বানায়, দালান কোঠা বানায় রাস্তা ঘাট আর বড় বড় মার্কেট বানায়। তখন প্রকৃতি বিরূপ হবেই। তখন অসময়ে বৃষ্টি হবে আবার সময়ে বৃষ্টি হবে না। ঝড় ঝঞ্ঝা জোয়ার জলোচ্ছ্বাস তুফান সাইক্লোন সুনামি হারিকেন বন্যা এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় হবেই হবে। এতসব ধ্বংসের কারণে প্রকৃতির উপর অনেক বেশি অত্যাচার হয়ে যায়। প্রকৃতি কেমন করে এসব অত্যাচার সহ্য করবে। তাই প্রকৃতি অনেক বদলে গেছে। এখন আমাদের সবাইকে প্রকৃতির বিষয়ে সচেতন হয়ে গাছ লাগাতে হবে।
বলছিলাম হেমন্তের কথা। সেই ছোটবেলার হেমন্তের সকাল খুব মনে পড়ে যায়। মাঠভরা সোনালি ধানের কি বিশাল প্রান্তর। ওপরে গভীর নীল আকাশ আর নিচে সোনালি ধানের জগৎ! আহা কেমন মায়ার বাঁধন জড়ানো ধানের ক্ষেত! হঠাৎ বাতাস এসে দোল দিয়ে ঢেউ তুলে দিতো ধানের মাঠে। তখন হায়রে ফড়িং লাফিয়ে লাফিয়ে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় পড়তো। আর ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই পাখির দল আসতো। শালিক পাখিরাও আসতো ধানের ক্ষেতে।
হেমন্তের রোদগুলোও কেমন যেনো সোনালি রঙ জ্বেলে ছড়িয়ে পড়তো ধানের ক্ষেতে। হেমন্তের বিকেলের রোদ তো একেবারেই সোনার মতো সুন্দর ঝকঝকে পরিষ্কার রোদ। ঝিংগে ফুলে এ রোদ পড়তো আর খেলা করতো নানা রঙের প্রজাতি। আহা কী মনোহর সুন্দর আর মায়ার ছবি যেনো ভেসে থাকতো হেমন্তের ওই সুন্দর বিকেলে।
আমার সঙ্গে যারা ছিলো বন্ধু এবং সহপাঠী তারা আজ সবাই বৃদ্ধ। তাদের নাতি নাতনি এখন তাদের সাথে খেলা করে। তারা গ্রামের সেই খোলা আকাশের নিচে এখনও সময় কাটায়। এখনও হেমন্তের সেই সোনালি রোদ নামে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে। কিন্তু সেই আমার বন্ধুরা আজ কি মনে করে আমাদের বহুকাল আগে ফেলে আসা হেমন্তের সুন্দর দিনে খেলাধুলার কথা। হয়তো মনে করে তাদের কেউ কেউ স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে।
ছোটবেলায় আমরা খেলাধুলা অনেক করেছি। কিন্তু লেখাপড়ার বিষয়ে ফাঁকিবাজি করার চেষ্টা যেমন করিনি ঠিক তেমনই ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগও ছিলো না।
যদি কখনও খেলতে খেলতে দেরি হয়ে যেতো বাড়িতে ফিরে সত্য কথাটা বলে দিতাম। সত্য বলতাম এ কারণে যে আমাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে মিথ্যা বলা বড় পাপ। যে মিথ্যা বলে সে বিপদে পড়ে। আর সত্য বললে বিপদ কেটে যায়। সেই ছোটবেলায় শিখেছি যে- সত্য বাঁচায় আর মিথ্যা ডুবিয়ে দেয়। তাই আমরা মিথ্যা বলতাম না। আসলে মিথ্যা বলা শিখিনি বলে সত্যটাই বলতাম।
হেমন্তের সকালে ঘাসের ডগায় আর ধানের শীষে শিশির ফোঁটা বসে থাকে। সকালের নরম রোদ যখন নামে শিশির ফোঁটায় রোদের হাসি খুব ঝিকমিক করে। দেখতে খুব সুন্দর এই শিশির ফোঁটাগুলো টলটলে। কচু পাতায়ও জমে থাকে শিশিরের ফোঁটাগুলো।
হেমন্তের যত আনন্দ তার একটি বড় আনন্দ হলো কৃষকের ধানে গোলা ভরার আনন্দ। মাঠে মাঠে এসময় ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। সারা বাংলায় তখন চাষি ভাইয়েরা মহা আনন্দে ধান কাটে। কাটার পর সেই ধান মাড়াই করে গোলা ভরে তোলে। এসময় কৃষকের মুখে যেমন হাসি থাকে। তেমন থাকে গলা ভরা বা কণ্ঠ ভরা সুর। তারা ধান কাটতে কাটতে মনের সুখে গলা ছেড়ে গান করতে থাকে। হয়তো ধানের আল ধরে কোনো পথিক হেঁটে যায় আর গান শুনতে শুনতে তাদের দিকে চেয়ে থাকে। আর মনে মনে ভাবতে থাকে হেমন্তের সুন্দর দিনে ধানকাটার আনন্দে তারা গাইছে গান।
এখন জীবনের এইবেলায় এসে ভাবতে থাকি সেই হেমন্তের সোনালি দিন কি আসবে আর! মন বলে ওঠে না আর কখনও ফিরবে না সেই সোনালি দিনগুলো।
Share.