‘মানুষ হও। অনেক বড় মানুষ।’
গুরুজনের এমন উপদেশ আমরা এবং তোমরা প্রায়ই শোনি। কখনো কি তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, ‘আমরা তো মানুষই তারপরও কেন, তারা আসলে মানুষ হওয়ার কথা বলেন?’
জানি জাগে না। কারণ তোমরা বুঝতে পারো, তারা আসলে কি বলতে চাচ্ছেন। এই মানুষ হওয়ার অর্থ হলো। আমাদের ভিতরের মানবিক শক্তিকে জাগ্রত করা। মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ জীব, আশরাফুল মাখলুকাত। এই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের গুণাবলি অর্জন করার কথাই আসলে গুরুজনরা মানুষ হওয়ার কথা বলে আমাদের বুঝাতে চান।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়,
বল বীর,
বল উন্নত মম শির।
শির নেহারি আমারি নত শির
ওই শিখর হীমাদ্রির।’

সুউচ্চ পাহাড় কিংবা পর্বতমালা সবকিছুর চেয়ে উঁচু একজন প্রকৃত মানুষ। এই উচ্চতা দৈর্ঘ্য বা প্রস্থের নয়। চেষ্টা সাধনার মাধ্যমে নিজের মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটিয়ে নিজেকে উচ্চতর আসনে বসানো। এখন নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে, ‘কিভাবে মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো সম্ভব। এক কথায় এর উত্তর, ‘জ্ঞানের আলোয় নিজেকে আলোকিত করার মাধ্যমে।’ বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জ্ঞানকে তুলনা করেছেন নূর বা আলোর সাথে। আলোকিত করার মতো জ্ঞান তিনিই আমাদেরকে দিয়েছেন। যুগে যুগে নবী ও রাসূল আঃদের কাছে পাঠানো তাঁর ওহি বা তাঁর প্রত্যাদেশের মাধ্যমে। এই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী ও রাসূল হলেন, হজরত মুহাম্মদ সা:। তাঁকে আল্লাহ দিয়েছেন মহা গ্রন্থ আল কুরআন।
এই আমরা মাত্র কিছু দিন আগে পবিত্র মাস রমজানে এক মাস সিয়াম বা রোজা পালন করলাম। এই রমজান মাসেরই পবিত্র কদর রাতে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন নাজিল করেছেন। পবিত্র কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো মানব জাতির জন্য শেষ জ্ঞানের ভা-ার, এক মহা গ্রন্থ।
এই মহা গ্রন্থ নাজিলের মাসে আল্লাহতায়ালা আমাদের জন্য দীর্ঘ এক মাস সিয়াম বা রোজার মতো এক কঠিন ইবাদত ফরজ বা অবশ্য-পালনীয় করেছেন। এই সাধনা আমাদের জন্য কঠিন মনে হয় কারণ এই সময় পানাহার থেকে নিয়ে অনেক হালাল বা বৈধ কাজ আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন। অবশ্য আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তিনি আমাদের ওপর কঠোরতা চাপিয়ে দেননি। এই কঠিন সাধনার মাধ্যমে আমরা তাকওয়ার বা আল্লাহভীতির গুণ অর্জন করবো। যা আমাদের মানবিক গুণাবলি বিকশিত করবে। আমরা পরিণত হবো মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষে।
অবশ্য আধুনিককালের বিজ্ঞানীরা বলছেন, সিয়াম বা রোজার মাধ্যমে শোধু আমাদের মন বা আত্মাই পরিশোদ্ধ হয় না, দেহও পরিশোদ্ধ হয়। আমাদের শরীরের কোষে কোষে জমে থাকা বিষাক্ত উপাদান ধ্বংস হয়। ক্যান্সারসহ অনেক মারাত্মক রোগ জীবাণু মরে যায়। শরীরে নতুন নতুন কোষ তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন অটোফ্যাজি। এটি দেহের জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে দেহের অপ্রয়োজনীয় কোষগুলো ধ্বংস ও পরিচ্ছন্ন হয়। অর্থাৎ একে কোষের আবর্জনা পরিচ্ছন্নকরণ প্রক্রিয়া এটি। কোষের কার্যক্ষমতা ঠিক রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। আর এই অটোফ্যাজি হয়ে থাকে রোজা থাকার মাধ্যমেই। ২০১৬ সালে জাপানি বিজ্ঞানী ইউশিনোরি ওশোমি অটোফ্যাজি নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পাবার পর বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা শোরু হয়। এর আগে বিজ্ঞানে অটোফ্যাজি শব্দটি খুব একটা প্রচলিত ছিল না। এসব কঠিন বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো তোমরা যত বড় হবে ততই জানতে পারবে।
এবার আসো দেখি এক মাস রোজা পালনের পর ঈদুল ফিতরের উৎসবের দিন আমাদের কী করা উচিত। নিশ্চয় এমন কিছূ করা ঠিক হবে না, যার মাধ্যমে আমাদের মানবিক বোধ দুর্বল হয়ে যাবে এবং দানবিক আত্মা জেগে উঠে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব। হ্যাঁ, আমরা মাহে রমজানে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জনের সাধনা করেছি। আল্লাহ দেখছেন, এই ভয়ে হালাল খাদ্যও খাইনি। মানুষের সাথে প্রতারণা করিনি। কাউকে ঠকানোর চিন্তা কিরনি, এমন কি ঝগড়া বিবাদ পর্যন্ত করা থেকে বিরত ছিলাম। আর বড়রা ঘুষ, দুর্নীতি থেকে দূরে থেকেছেন। বছরের বাকি এগারো মাস আমাদের অন্তরে তাকওয়ার এই আলো জাগ্রত রাখতে হবে। তবেই আমরা মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন উন্নত মানুষ হতো পারবো। আমাদের ভিতর লুকিয়ে থাকা দানবিক শক্তি পরাজিত হবে। জয় হবে মানবিকতার। ভয় হবে মানবতার।

Share.

মন্তব্য করুন