এক সময় অন্ধকারকে তিতলি খুব ভয় পেত। মা বলতেন ‘ভয় কী! অন্ধকার আছে বলেই তো রাতের পৃথিবী এত সুন্দর। দেখো দেখো তারাগুলো কি সুন্দর জ্বলজ্বল করছে।’
সেই থেকে তিতলি রাতকে খুব বেশি ভালোবাসে। আকাশের দিকে তাকালে মনটা এখন কেমন যেন উদাস উদাস লাগে। তারাগুলো কি সুন্দর জ্বলজ্বল করছে। মনে হয় যেন নানান রঙের হীরের টুকরো আকাশের বুকে কে যেন খোদাই করে রেখেছে।

গরমকালে সন্ধ্যেবেলা ছাদে গিয়ে দাঁড়ালে মনটা তাই কেমন যেন করে ওঠে। একা একাই আপন মনে কথা বলে, গান গায়। গানগুলো যেন বাতাসের মধ্যে দিয়ে ভেসে যায় ওই দূর আকাশের তারাদের কাছে। কখনো বা চাঁদের আলোয় ভেসে যায় আকাশ, বাতাস, এই ছাদের প্রতিটি অংশ। তিতলিদের ছাদটা যেন নতুনরূপে সেজে ওঠে তখন।
শীতকালে ছাদটা যেন আরও সুন্দর। বড় বড় গাঁদাফুলগুলো যেন এক একটা কমলালেবু। বাবা-মায়ের সঙ্গে তিতলি মিরিকের সেই কমলালেবুর বাগানটিতে গিয়েছিল। গাছভর্তি কমলালেবুকে সেখানে মনে হচ্ছিল যেন এক একটা গাঁদাফুল। কখনো কমলালেবুকে গাঁদাফুল, আবার কখনো গাঁদাফুলকে কমলালেবু মনে হয় তিতলির। সহজেই হাত দিয়ে ছুঁয়ে ফেলতে পারছিল। কি সুন্দর কমলা রঙে গাছটি ছেয়ে আছে যেন।
সকাল সন্ধ্যা ছাদে তিতলির যাওয়া চাই-ই চাই। ছাদে সুন্দর একটা দোলনা আছে। সেই দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে তিতলি মহাবিশ্বের অপার রহস্যের মধ্যে কখন যে মিশে যায় তা নিজেই বুঝতে পারে না।
শীতকালে ছুটির দুপুরটা আরো বেশি মজার। সবাই মিলে একসাথে ছাদে বসে কমলালেবু খাওয়ার মজাই আলাদা। দাদীমা ছাদের কার্নিশে আচারের শিশি সাজিয়ে রাখেন। মা, কাকু সবাই মিলে ভিড় করেন ঐ আচারের শিশিগুলোর পাশে। সবাই হাসি ঠাট্টা আর গল্প করলেও তিতলি কিন্তু দাদীমার পাশে বসে মন দিয়ে গল্প শোনে। কোনোদিন আবার দাদীমার ঝুলি, গোপাল ভাঁড় কোনো কিছুই বাদ যায় না। মাঝে মাঝে মহাপুরুষের জীবন কাহিনী দাদীমা এমন ভাবে ব্যাখ্যা করেন যে তিতলির মনের দরজা কখন কিভাবে যেন খুলে যায়। মনের নানা প্রশ্নের উত্তর যেন নিজেই পেয়ে যায়। কী সুন্দর দোলা দেয় ওর হৃদয়ের অন্তরালে। কিন্তু এতো গেল শীতকালের দুপুর। গরম কালে স্কুল থেকে ফিরে স্নান -খাওয়া করে দাদীমার সাথে শুয়ে শুয়ে নানান রকমের গল্প। এক একদিন দাদীমার ছেলেবেলার কাহিনী, সে ভারি মজার।
চোখ বন্ধ করে তিতলি যেন পৌঁছে যায় দাদীমার সেই গ্রামে। দাদীমার ছেলেবেলার গল্পগুলো- ছোট্টবেলার জীবন যাপন অদ্ভুতভাবে ধরা দেয় তিতলির চোখে। পুকুর নিকানো উঠোন, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, রঙবেরঙের পাখি, ফুল আহা! কি সুন্দর ছবির মতো বর্ণনা করেন দাদীমা। কথা বলতে বলতে চোখে জল এসে পড়ে দাদীমার, কখনো আবার তিতলির। কখনো আনন্দে দাদীরমার গলা জড়িয়ে ধরে, কখনো বা চোখে ঘুম এসে পড়ে তিতলির। আবার কখন যে স্বপ্নের মধ্যে পৌঁছে যায় তিতলি দাদীমার ছেলেবেলার দিনগুলোতে।
এভাবেই দুপুরবেলা কেটে যাচ্ছিল তিতলির। একদিন হঠাৎ তিতলির কানে এলো বাসনের টুং টাং আওয়াজ। আওয়াজটা আসছে পাশের বাড়ির কুয়োপাড় থেকে। কি মনে করে চুপিচুপি তিতলি ছাদে গেল। তারপর একটু ঝুঁকে নিচের দিকে তাকাতেই দেখল ওর-ই মতো একটি মেয়ে ঐ বাসনগুলো মাজছে। বুঝতে পারল তিতলি ঐ মেয়েটিকে কাজের জন্য আনা হয়েছে, তার মানে মেয়েটি নতুন এসেছে ওদের বাড়িতে।
আপন মনে মেয়েটি বাসন মাজছিল। তিতলি অবাক হয়ে দেখছিল বাসনের স্তুপ। এতোগুলো বাসন ঐটুকু মেয়ে মাজবে কিভাবে? ভীষণ একটা মন খারাপ নিয়ে ধীরে ধীরে দাদীমার পাশে এসে শুয়ে পড়ল তিতলি।
এরপর দুপুরবেলা দাদীমার গল্পের চাইতেও অনেক বেশি আকর্ষণীয় হলো পাশের বাড়ির ঐ ছোট্ট মেয়েটির কাজকর্ম। ধীরে ধীরে জানা গেল ওর নাম মিতালি। ওর বাড়ি আসামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। কাজের জন্য ওকে এই বাড়িতে আনা হয়েছে। কিন্তু এতো বড় বাড়ির কাজকর্ম ঐটুকু মেয়ে করে কিভাবে? বাসনমাজা, ঘর ঝাড়া, কাপড় কাচা এতোকিছু সম্ভব কিভাবে? তিতলির ভাবের জগতে কখন যে মিতালি এসে জুড়ে বসল তা তিতলি নিজেও বুঝে উঠতে পারল না।

দুই.
প্রতিদিনের মতো তিতলি ছাদের দোলনায় দুলছিল। মিতালি এসেছিল ছাদে শুকিয়ে যাওয়া জামাকাপড় তুলতে। দু’জনের মধ্যে তেমন কোনো কথাবার্তা না থাকলেও মুখের হাসি, চোখে চোখে কথা পরস্পরের মধ্যে হয়েই থাকতো। মিতালির কথা বলা নিষেধ ছিল কারো সাথে। চুপিচুপি ফিসফিস করে তবুও কথা হতো দু’জনের। সকলের অজান্তে এভাবেই চলত ওদের ভাব বিনিময়।
মিতালির জীবনচিত্র তিতলির হৃদয়ের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে বারবার। আসামের একটা প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে মিতালি যার বেড়ে ওঠা একটি দরিদ্র পরিবারে অনেকগুলো ভাইবোনের মধ্যে। তবুও একসাথে সন্ধ্যাবেলা বসে মুড়ি খাওয়া, কিতকিত খেলা, মাটির খেলনাবাটি নিয়ে মিছিমিছি রান্না রান্না খেলা, পুতুলের বিয়ে দেয়া, ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাও তাকে ছোঁ’ এসব ছেড়ে আজ অনেক দূরে, কত দূরে, তাও আবার এই চার দেওয়ালের মাঝে এই বন্দিজীবন, সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। কোনো খেলা নেই, খোলা বাতাস নেই, মাথার ওপর খোলা আকাশ নেই। আছে শুধু ইট, পাথর, সিমেন্ট ঘেরা মস্ত বড় জেলখানার মতো প্রাচীর আর সারা দিনের পরিশ্রম। কিভাবে থাকে ও এভাবে? কষ্ট হয় না মায়ের জন্য? বাবার জন্য? পরিবারের আর সবার জন্য? ওর বন্ধুদের কথা মনে পড়ে না কখনো?
সবার মতো মিতালিও বর্ষাকালে জলে ভিজে বন্ধুদের সাথে বুড়ি ছুট খেলত। দোল খেলার আগের দিন বুড়ির ঘর পোড়াতো। কালবৈশাখী ঝড়ে বন্ধুরা মিলে ‘দে ছুট’ খেলা খেলত। পৌষ সংক্রান্তিতে চালের গুঁড়ো দিয়ে কী সুন্দর পিঠে বানানো হতো বাড়িতে। পুরো গ্রামটা তখন উৎসবের মেজাজ। তখনও তো অবস্থা ভালোই ছিল। কিন্তু বাবার হঠাৎ একটা অসুখে বাড়ির চেহারাটাই পাল্টে গেল। সবকিছু এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল বাবার মৃত্যুতে। দাদীমাও পাগল হয়ে গেল। বড় দুই দিদিও চলে গেল আলাদা আলাদা জায়গায় কাজের জন্য। বাড়িতে পড়ে থাকল মা আর ছোট দুই ভাই। তিন বোনের কাজের টাকা মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে। মা যেন আলোর দেখা পেল।
কিছুটা অভিমানে মিতালি রাজি হয়েছিল সবাইকে ছেড়ে অন্য এক অপরিচিত পরিবেশে চলে আসতে। স্কুলের পড়া বন্ধ হয়ে গেল। মাকে বুঝিয়েছিল মিতালি অনেকবার, কান্নাকাটিও করেছিল মাকে ছেড়ে, ভাইদের ছেড়ে থাকতে পারবে না কিছুতেই। কিন্তু অভাব মাকেও কেমন পাল্টে দিয়েছিল। মায়ের স্নেহ- ভালোবাসা সবকিছুকে উপেক্ষা করে মিতালি শহরের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে ছিল।
একটা মোটা অঙ্কের টাকা পাঠানো হবে মিতালির মাকে। মিতালিকে বাড়িতে লেখাপড়া শেখানো হবে, এই শর্তে মিতালিকে আনা হয়েছিল এই নতুন শহরের এই নতুন পরিবারটিতে। কিন্তু শহরের এই নতুন বাড়িতে এসে মিতালি দেখল অবাঙালি এই পরিবারটির মানুষগুলো কতখানি নির্মম। পড়াশোনা তো দূরে থাক, অন্য একটি যে গ্রহকর্মী ছিল তাকেও ছাড়িয়ে দেয়া হলো। এত বড় বাড়ির সব কাজ মিতালিকে দিয়ে করানো হতো। চারদিকে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা বাড়িটার ভেতরের খবর কেউই রাখত না বিশেষ। শুধুমাত্র ছাদ থেকে তিতলি যেন বুঝতে পারত ওর মনের কথা। চুপ করে মাঝে মাঝে তিতলি সকলের অলক্ষ্যে মিতালিকে চকোলেট ছুড়ে দিত আর সেই চকোলেট কুড়িয়ে এক আত্মতৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে দিত মিতালি তিতলির উদ্দেশ্যে। আবার ইশারায় বলেছে আর যেন তিতলি চকোলেট ওকে না দেয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। দু’জনের এত সুন্দর বন্ধুত্বের কথা ওরা দু’জন ছাড়া আর কেউ জানতেও পারে না।

তিন.
তিতলি যখন দুপুরবেলা দাদীমার পাশে শুয়ে শুয়ে ভাবছে কত কি, ঠিক সেই সময় মিতালি বাসন মাজতে মাজতে ভাবছে ওর ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। কত কথা, কত দৃশ্য, কত স্মৃতি মনের আনাচে কানাচে ঘুরপাক খেতে থাকে। একসাথে সবাই মিলে বসে সন্ধ্যেবেলা ভূতের গল্প, হাড়হিম করা সে সব কাহিনী শোনাতো দাদীমা। ভয়ে তো পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে যেত-ই না কেউ। আবার রথের মেলায় পাড়ার সবার সাথে রথ দেখতে যাওয়া, সেই সঙ্গে জিলিপি, লটকা, পাপড় ভাজা খাওয়া। সেই মেলাতে কত আনন্দ! নাগরদোলা, আরো কত কী! সেই প্রথমবার অতো উঁচু নাগরদোলা দেখে চোখ একেবারে ছানাবড়া। কিভাবে সাঁই সাঁই করে ঘুরছিল সেই নাগরদোলা। মনে মনে ভাবত ‘মানুষগুলোর মাথা ঘোরে না ঐ অতো উঁচুতে!’ কিছুতেই ভয়ে রাজি হয়নি নাগরদোলায় বসতে। তারচেয়ে সেই পয়সায় কাচের চুড়িই ভালো। কিন্তু অত পছন্দ করে কেনা কাচের চুড়ি ভেঙে গিয়েছিল বলে সেই কি কান্না। বাবা আবার এক ডজন কাচের চুড়ি কিনে দিয়েছিল। আর সেগুলো হাতে পরে সেই কি আনন্দ মিতালির। দিদিদের মুখগুলোও খুব মনে পড়ে।
তিতলি বুঝল কিছু একটা হয়েছে। একদিন জামাকাপড় ভালো পরিষ্কার হয়নি বলে ওই দিন মিতালি খাবার পায়নি। আজকেও তেমন কিছু হয়েছে, আজকেও ঠিক খাবার পাবে না। সেদিনের খেতে না পাবার কথা ইশারায় বলেছিল তিতলিকে। তখন সন্ধ্যা হবে হবে, জামা-কাপড় নিতে এসেছিল ছাদ থেকে যা শুকোতে দিয়েছিল দুপুরবেলা। তিতলি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে রান্নাঘর থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট এনে ছুড়তে যাবে যেই, অমনি একটি পায়ের আওয়াজে লুকিয়ে পড়েছিল তিতলি। পরে সেই বিস্কুট আর দেয়া হয়নি। মিতালি ছাদ থেকে নেমে পড়েছিল। তবুও তিতলি ছাদের পাশে ঝুঁকে অপেক্ষা করছিল মিতালির জন্য। পরে দেখল মিতালি একটা ব্যাগ ঝাড়তে ঝাড়তে কী যেন একটা চাটছিল। হয়তো বাড়িতে মিষ্টি এনেছিল, সেই প্যাকেটের গায়ে লেগে থাকা রসটাই ওর পরম পাওয়া, হয়তো ওর খুব ক্ষিদে পেয়েছিল। তিতলির দুচোখ জলে ভরে উঠল। সন্ধ্যাবেলা পড়তে বসে কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না পড়ায়। বাড়িতে সবাইকে এ কথা বলতেই সবাই বলল, ‘তিতলি ওরা কিন্তু মানুষ হিসেবে ভালো নয়, ওদের সাথে কথা বলতে যাওয়া ঠিক হবে না।’ তিতলি চুপ হয়ে গেল ঠিকই কিন্তু মনে মনে ভাবল মিতালি কেন ছুটি পায় না? কেন বাড়িতে যেতে পারে না? মাকে ছেড়ে, ভাইকে ছেড়ে, আপুদের ছেড়ে থাকতে ওর কষ্ট হয় না? কষ্ট তো হয়, খুব কষ্ট হয়। তিতলি মনে মনে ভাবে ‘ইস মিতালির কত কষ্ট। মনের এতো কষ্ট ও কাউকে বলতে পারে না।’

চার.
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। সময় তো আর কারো জন্য বসে থাকে না। হঠাৎ একদিন সকাল থেকে মিতালির কোনো আওয়াজ নেই। বাসনের টুং টাং আওয়াজ, ‘জি আন্টি’- ‘জি আঙ্কেল’ এসব কোনো শব্দ কানে এলো না। ছাদেও মিতালির দেখা নেই। তিতলি অবাক হলেও মনে মনে ভাবলো ‘যাক আজ মিতালির তাহলে হাফ রেস্ট।’ এরপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা, তবুও ওর কোনো দেখা না পাওয়াতে তিতলি ভাবল ‘ভাবা যায়! আজ মিতালির ফুল রেস্ট! সারা দিন মিতালিকে একটাও কাজ করতে হয়নি।’
কিন্তু অবাক কা-! পরের দিন, তার পরের দিনও দেখা নেই মিতালির। তাহলে?
দাদীমাকে বলতেই দাদীমা বললেন, ‘তাহলে আর কি তোমার বন্ধু ছুটি পেয়েছে। বাড়িতে গেছে মায়ের কাছে।’
তিতলি জলভরা চোখে বলল ‘আমাকে একবারও জানালো না সে কথা।’
দাদীমা বললেন ‘ওমা! দেখো কা-! ঐ বাড়ির মিতালির জন্য চোখে জল? বারে ওর বুঝি মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে না?’
দাদীমার কথা শুনে তিতলি বলল, ‘ইস তাই বলে আমায় একবারও বলতে নেই? ও ফিরে আসুক আমি আর কথাই বলব না ওর সাথে, খুব ছুটি কাটানো হচ্ছে তাই না?’ এই কথা বলল বটে কিন্তু মনে মনে বলল, ‘মিতালি তুমি ছুটি কাটাও ভালো করে, আর বাড়িতে রেস্ট করবে কিন্তু, একটাও কাজ করবে না।’
পরের দিন পাড়ার মধ্যে কি ভীষণ উত্তেজনা, চাপা ফিসফিস শব্দ, কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে তিতলির মনে হলো। তিতলির বাবা বাড়িতে এসে জানালেন ‘ওদের বাড়িতে অ্যাম্বুলেন্স এসেছে। কাজের বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে। খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে মনে হয়।’
দাদীমা বললেন ‘সেকি! আমরা তো ভাবলাম হয়তো বাড়িতে গেছে। তিতলির কানে যেন না যায়, ও শুনলে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে।’
দাদীমার কথা শুনে বাবা বললেন ‘কেন? ওর সাথে কথা বলে নাকি?’
তিতলি ততক্ষণে ছুটে ছাদে চলে গেছে। কিভাবে যেন ও সব কথা শুনে ফেলেছে। ছাদে গিয়ে তিতলি দেখছে মিতালিকে ধরাধরি করে ওঠাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সে। তারপর জায়গাটা শূন্য করে চলে গেল সবাই। ডুকরে কেঁদে উঠল তিতলি। মনে মনে চোখ বুজে তিতলি বলল ‘মিতালিকে ভালো করে দাও প্রভু। আমার কথা শুনতে পাচ্ছো তুমি? ওর খুব কষ্ট, ওকে ভালো করে দাও তুমি, প্রভু তুমি আমার কথা শুনবে তো প্রভু?’
পরদিন জানা গেল সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে মিতালি পা পিছলে একেবারে নিচে পড়ে যায়। মাথায় মারাত্মক আঘাত লাগে। এক বালতি কাপড় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল, সেই সময় ওই বাড়ির একজন মহিলা ভীষণ বকাবকি করছিল এতো ধীরে কাজ করার জন্য। ডাক্তার বলেছেন ‘চান্স প্রায় নেই বললেই চলে।’
তিতলি কেমন যেন নির্বাক, চোখের জলটুকুও শুকিয়ে গেছে। মিতালি আর কি ফিরবে কখনো? টুং টাং বাসন মাজার আওয়াজ তিতলির কানে পৌঁছবে কি? আর কি চকোলেট ছোড়াছুড়ি খেলা খেলতে পারবে তিতলি? আর কখনো হেসে মিতালি বলবে ‘তুমি খেয়েছ তিতলি? আজ স্কুলে যাওনি?’
মিতালি কি শুধু স্বপ্নই হয়েই থাকবে? তিতলির জীবনে মিতালি কি শুধুই অতীতের কিছু মুহূর্ত হয়ে বেঁচে থাকা? মিতালির সমস্ত ইচ্ছে, বাড়িতে গিয়ে মায়ের সঙ্গে মান-অভিমান, ভাইকে নিয়ে লুকোচুরি খেলার স্বপ্ন, আপুদের সাথে কালবৈশাখী ঝড়ে ছুটতে ছুটতে বলবে কি ‘দে ছুট দে ছুট।’
হঠাৎ যেন তিতলি পরিষ্কার দেখতে পেল মিতালিকে। ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে ইশারায় তিতলিকে বলছে ‘আমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছি তিতলি। তুমি ভালো থেকো। তুমি আমার কাছে জানতে চাইতে না কবে আমার ছুটি হবে? আমার জানো ছুটি হয়েছে। সত্যি বলছি, আর আমায় কাজ করতে হবে না। আমার সত্যিই ছুটি হয়েছে।’
আকাশ তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। তিতলির সেদিকে খেয়াল নেই। কালবৈশাখীর ঝড় উঠেছে ততক্ষণে। দাদীমা চিৎকার করে ডাকছেন ‘তিতলি কোথায় গেলি…আয়…ঝড় উঠেছে যে!’
তিতলি সেই সময় কখন যেন পৌঁছে গেছে মিতালিদের আসামের প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে আছে আমের মুকুলের গন্ধ। ঝড়ো হাওয়ায় গাছগুলো যেন মাটিতে নুইয়ে পড়েছে। কী ভীষণ ঝড় উঠেছে। গ্রামের সব ছোট ছেলে মেয়েরা ছুটছে, ওরা আনন্দে লাফাচ্ছে মিতালিকে পেয়ে। মিতালিও হাসছে, ছোট ভাইয়ের হাত ধরে ছুটছে; আপুরাও কখন এসে পড়েছে, সবাই মিলে চিৎকার করে বলছে ‘যে ছুট দে ছুট।’ তিতলিও হাসতে হাসতে বলল ‘দে ছুট।’ তিতলি ছুটছে মিতালির পেছনে, সবাই ছুটছে ওরা, সবাই…

Share.

মন্তব্য করুন