লিপু কিডনাপ হয়ে গেল।
লিপু, সজিব আর হুমায়ুন পরস্পর বন্ধু। ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এক সঙ্গে স্কুলে আসা-যাওয়া করে। এক সঙ্গে খেলাধুলা করে, গল্প করে।
স্কুল ছুটির পর লিপু আর সজিব দাঁড়িয়েছিল রাস্তার পাশে। হুমায়ুন একটু দূরে অটোরিকশা ভাড়া করছিল। আচানক নীল রঙের একটা মাইক্রোবাস এসে থামল লিপু আর হুমায়ুনের সামনে। মাইক্রোবাসের দরজা খুলে দু’জন লোক বের হলো। লিপুকে ছোঁ মেরে তুলে সাঁ করে চলে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় সজিব হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। মুহূর্তে সম্বিত ফিরে পেয়ে গলা ছেড়ে ডাকল হুমায়ুনকে। হুমায়ুনও ব্যাপারটা দেখেছিল। সামনে একটা ট্যাক্সিক্যাব দাঁড়িয়ে ছিল। হুমায়ুন দৌড়ে এসে ট্যাক্সিক্যাবের দরজা খুলে সজিবকে এক টানে ক্যাবে তুলে ড্রাইভারকে বলল- ‘ঐ যে, ঐ নীল মাইক্রোবাসটাকে ফলো করুন।’
ট্যাক্সি ড্রাইভার কোনো প্রশ্ন না তুলে মাইক্রোবাসকে ফলো করতে লাগল।
গাড়ি যখন সাভারের দিকে ঢাকা-আরিচা হাইওয়ে ধরল তখন সজিবে মনের মধ্যে খচ করে উঠল। এভাবে ওদের মাইক্রোবাস ফলো করে লাভ কী? সে বলল-লিপুর বাসায় ফোন করে দিলে হতো না?
হুমায়ুন বলল-বাসায় জানালে তারা থানায় যোগাযোগ করবে। পুলিশের লিপুর হদিস করতে করতে একটা কিছু ঘটে যেতে পারে। আমাদের পুলিশ সাধারণ পাবলিকের ক্ষেত্রে লুস আর ক্ষমতাবানদের ব্যাপারে…।
– আমরা ওদের ফলো করে কী করবো?
– সময় হলেই সব বুঝতে পারবি।
এতক্ষণে ট্যাক্সি ড্রাইভারেরও যেন হুঁশ হলো। বলল- তোমরা কি কোনো গু-া-পা-া ফলো করতে আমার গাড়িতে উঠছো? কি ড্যাঞ্জারাস ব্যাপার!
হুমায়ুন বলল-আঙ্কেল, ভয় নেই। ওরা বুঝতে পারেনি যে আমরা ওদের ফলো করছি।
– তুমি কইলা আর আমি মানলাম। ওরা এই লাইনে আইছে আদা খাইয়া?
– আহ! একটা ছেলে কিডনাপ হয়ে গেল, তার জন্য কিছু করতে হবে না?
– এইডা কি তুমার-আমার কাম? থানায় যাও, যাগো কাম তারা করবো।
– আঙ্কেল, প্লিজ সামনে তাকান। ঐ যে ডানে মোড় নিলো।
– হায়রে! আইজ গুল্লি খাইয়া মরতে হইবো…..।
প্রায় ঘণ্টা খানেক চলার পর ওরা হাইওয়ে ছেড়ে একটা ছোট রাস্তা ধরল। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মাইক্রোবাসটা জঙ্গলাকীর্ণ একটা বাড়িতে ঢুকে গেল। হুমায়ুন ড্রাইভারকে বলল-এবার ঢাকা চলুন। কিছুক্ষণ পর আমরা আবার এখানে ফিরে আসবো।
ড্রাইভার বলল-আমি আর এই মরণ ফাঁদে আসুম না।
– আপনাকেই আসতে হবে। আপনি পথটা চিনেছেন। অন্য কোনো ড্রাইভারকে আমরা চিনিয়ে আনতে পারবো না।
– পুলিশকে খবর দ্যাও, তারা ঠিকঠিক সব বার কইর‌্যাা ফালাইবো।
– পুলিশ পরে, আগে আমরা। ওদেরকে দেখিয়ে দিতে চাই কত গমে কত আটা, কত আটায় কত রুটি।
– আমার কপালে আইজ মউতই আছে।
– এত মউত মউত করছেন কেন? জানেন না জন্মিলে মরিতে হবে?
– জানি, কিন্তু গুল্লি খাইয়া মরিতে চাই না।
গাড়ি চলছে ঢাকার উদ্দেশে। কিছুক্ষণ পর হুমায়ুন বলল-রাওলিকংস-এর হ্যারিপটার পড়েছিস?
সাহিত্য নিয়ে কথা বলার মতো মনের অবস্থা তখন সজিবের ছিল না। তবু বলল-পড়েছি।
– সেখানে মানুষের অদৃশ্য হবার কথা জেনেছিস?
– হু।
– সেটা সায়েন্স ফিকশন গল্প। লেখকরা কল্পনায় যেটা প্রকাশ করে পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা সেটাকে বাস্তবে রূপ দেয়। আমার গুল্লু মামা এমন একটা পোশাক আবিষ্কার করেছে যেটা পরে অদৃশ্য হওয়া যায়।
– তোর গুল্লু মামা না তিন বছর ধরে বিএসসি পাস করতে পারছে না।
– তাতে কী? পরীক্ষায় পাসের সাথে বৃহৎ কিছু অর্জনের সম্পর্ক নেই। রূপার সুতা আর এক ধরনের ধাতব দিয়ে গুল্লু মামা যে পোশাক বানিয়েছে সেটা পরলে অদৃশ্য হওয়া যায়। কেননা, সে পোশাক থেকে কোনো আলোর প্রতিফলন ঘটে না।
– সে গল্প করে এখন কী লাভ? এখন লিপুকে নিয়ে ভাবার সময়।
– সেই পোশাক পরে কিছুক্ষণ পর তুই আর আমি গু-াদের আস্তানায় যাব। গিয়ে ওদের হালুয়া টাইট করে দেব। লিপুকে নিয়ে আসবো।
– তুই কি সে পোশাকের কার্যকারিতা প্রমাণ করে দেখেছিস?
– তা না করেই বলছি? সেদিন গুল্লু মামা আমাকে পোশাকটা পরিয়ে দিল। আমি বাবার পাশে বসে ভাত খাচ্ছি, বাবা আমাকে দেখছে না। শুধু দেখছে প্লেটের ভাত শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভূত ভূত করে বাবা-মা বাড়ি মাথায় করে ফেললো।
ড্রাইভার মৃদু স্বরে বলল-গুল! সব গুল।
হুমায়ুন বলল-আঙ্কেল, কিছু বললেন?
– না, কিছু কইনাই। কওনের ভাষা আছে যে কমু? ব্যাটা গুলবাজ!
বাসায় ফিরে হুমায়ুন তার রুমে গিয়ে অদৃশ্য হবার পোশাক পরল। সজিব বসে ছিল ড্রয়িং রুমে। হুমায়ুন ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় ঠিক সজিবের পাশে বসল। টেবিল থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে সজিবের চোখের সামনে দোলাতে লাগল। সজিবের চোখ ছানাবড়া। আশপাশে কেউ নেই, ম্যাগাজিনটা শূন্যে ভাসছে কিভাবে? হুমায়ুন বলল-এবার প্রমাণ পেলি? আমি কিন্তু তোর পাশে বসে আছি।
পরে সজিবও আরেক সেট পোশাক পরল। ওরা যখন হুমায়ুনের মায়ের সামনে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল তখন সে বলল-ছেলে দু’টি মাত্রই এল। আবার বের হয়ে গেল কোন ফাঁকে?
ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে গেটে বসে ছিল। ওরা গিয়ে দরজা খুলে গাড়িতে বসতেই ড্রাইভারের চোখ কপালে উঠে গেল। ড্রাইভার জ্ঞান হারাবার আগেই হুমায়ুন বলল-আঙ্কেল, তখন তো বলেছিলেন সব গুল-ব্যাটা গুলবাজ। এখন ভয় পান কেন? ভয় নেই আমরা সেই পাবলিক। আপনি গাড়ি চালিয়ে চলে যান গু-াদের সেই আস্তানায়। ওদের সব টাইট করে দেব। বুঝিয়ে দেব কত আটায় কত রুটি।
বাড়িটার ভেতর নিকশ কালো অন্ধকার। অন্ধকার হাতড়ে ওরা খুঁজতে লাগলো কোথায় গু-ারা আছে, কোথায় রেখেছে লিপুকে। কিন্তু কোনো ঘরেই মানুষের কোনো অস্তিত্ব মেলে না। শুধু দেখা মেলে বাদুড়, চামচিকা, তেলাপোকা আরও সব প্রাণী। এঘর-ওঘর করতে করতে ওরা একটা ঘরে মৃদু আলো দেখতে পেল। ওরা আলো লক্ষ্য করে সে ঘরে যেতেই দেখতে পেল গু-াদের। ঘরের এক কোনায় লিপু মাথা নিচু করে বসে আছে। একজন গু-া বলল-তোর বাপ কি দশ লাখ দিতে পারবো?
লিপু চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল-না।
– তাইলে পাঁচ লাখ চাই?
– আমার বাবার সর্বসাকুল্যে বেতন বিশ হাজার টাকা। আমরা কোনো মতে….।
– তাইলে দুই লাখ চাই?
– বাবার কাছে কোনো জমানো টাকা নাই।
– ঐ সব আমরা বুঝি না। তাইলে গাড়ির তেল খরচ কইরা, জীবনের রিস্ক নিয়া তোরে আনলাম কি রূপ দেখনের লাইগা?
এমন সময় দূরে বসা একজন বলল-ঐ কাওলা, অত কথা কইতোছোস ক্যান? টাকা না থাকলে ধার কইরা দিব। শ্বশুরবাড়ি থিক্যা আইনা দিব। কথা হইল ছাওয়াল ফেরত পাইতে অইলে টাকা দেওন লাগবো। ঐ তোর বাপের নাম্বার ক’।
লিপু ওর বাবার নাম্বার বললো। লোকটা সেই নাম্বার টিপতে যাবে অমনি হুমায়ুন সজোরে লাথি মারলো লোকটার হাতে। তার হাত থেকে সেলফোনটা ছিটকে পড়ে ভেঙে গেল। তখন দূরে বসা সেই লোকটা বলল-কিরে, কারেন্ট-এর শট খাইলি নাকি?
– ওস্তাদ, কে যেন হাতে লাত্থি মারল।
লাত্থি মারলো! আজাইরা কথা কইস না।
ঠিক তখন সজিব সর্বশক্তি দিয়ে ওস্তাদের গালে মারলো এক চড়। ওস্তাদ বলল-আরে চড় মারল কে?
– ওস্তাদ, ভূতে পাইছে আমাগো।
– কস কী? এতদিন ধইরা এই আস্তানায় আছি কোনোদিন তো এমুন হয় নাই।
হুমায়ুন ওস্তাদের নাকে ধুমধাম কয়েকটা ঘুষি মারল। তার নাক ফেটে রক্ত বের হয়ে গেল। তারপর তার মাথা সজোরে দেয়ালে ঠুকে দিলো। তৃতীয় গু-া বলল-ওস্তাদ, দোয়া-দরুদ পড়েন।
হুমায়ুন বলল-তোদের দোয়া-দরুদে কোনো কাজ হবে না। কারণ তোরা তো মানুষ না, তোরা হলি হিংস্র পশু।
তখন সজিব একটা কাঠের টুকরো তুলে নিয়ে তৃতীয়টার পিঠে মারল এক বাড়ি। ওরা কোনো মানুষ দেখল না। শুধু দেখল এক টুকরো কাঠ শূন্যে উড়ে এসে পিঠে সজোরে আঘাত করল। ওস্তাদ কেঁদে কেঁদে বলল-গুরু, আপনারা কে?
হুমায়ুন বলল-আমরা যেই হই, মনে রাখিস তোরা আর কখনো কোনো অপরাধ করতে পারবি না। যখনই নিরপরাধ মানুষের ওপর অত্যাচার করবি তখনই তোদের এভাবে কুত্তা ধোলাই দেব।
– এই শিক্ষার পর আবার অপরাধ? আইজ প্রাণে বাঁচতে পারলে রেল স্টেশনে কুলিগিরি করুম তবু কোনো অপরাধে যামু না। ওস্তাদ আমাগো মাফ করেন।
সজিব এগিয়ে গিয়ে বলল-তিনটা লাইন ধরে দাঁড়া। ১৫১ বার কান ধরে উঠবস কর। তারপর ৫৭ বার নাকে খত দিয়ে ঘরের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যা। তারপর থুথু ফেলে চেটে খা।
প্রাণের মায়ায় ওরা সজিবের সব কথা শুনল। সজিব বলল-শোন, তোদের শরীরে শক্তি আছে। মাথায়ও মগজ আছে। সেই শক্তি আর মগজ ব্যবহার করে তোরা অনায়াসে ভালো কিছু করতে পারিস। সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকতে পারিস। তা না করে তোরা অপরাধ করে বেড়াস। ভালো মানুষদের ক্ষতি করিস। তোরা এই দেশ ও জাতির শত্রু।
-ওস্তাদ, আজ থিক্যা আমরা আর কোনো অপরাধ করুম না। আমাগো হালুয়া টাইট হইয়া গেছে। আমরা বুইঝা গেছি কত গমে কত আটা, আর কত আটায় কত রুটি।
হুমায়ুন আর সজিব লিপুর হাত ধরে টেনে নিয়ে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে এল। লিপু তখন ভয়ে কাঁপছিল। গাড়িতে এসে হুমায়ুন আর সজিব ওদের পোশাক খুলে ফেলল। লিপুকে বলল অদৃশ্য হবার পোশাকের কথা।
লিপু বলল-এমন একটা আবিষ্কারের কথা তোর গুল্লু মামা সবাইকে জানাচ্ছে না কেন? তাহলে তো বিখ্যাত হয়ে যেতে পারে।
হুমায়ুন বলল-এই পোশাক পরে যেমন অপরাধ দমন করা যেতে পারে, তেমন অপরাধ করাও যেতে পারে। আর এই পোশাক যত্র-তত্র পাওয়া গেলে অপরাধীরাই বেশি কিনবে। তাই গুল্লু মামা এমন কিছু করার কথা ভাবছে যাতে এই পোশাক পরে কোনো অপরাধ করা সম্ভব না হয়।
গাড়ি এসে ভিড়ল লিপুদের বাসার সামনে। লিপু বলল-আঙ্কেল, বলুন সারা দিনের জন্য আপনাকে কত ভাড়া দিতে হবে?
ড্রাইভার বলল-আমি কোনো ভাড়া নিমু না।
-ভাড়া নেবেন না কেন?
-তুমি যে বাঁইচ্যা আইছো এইটাই আমার বড় ভাড়া। যাও, তোমরা যার যার বাসায় যাও।
ড্রাইভার কিছুতেই ভাড়া নিলো না।

Share.

মন্তব্য করুন