কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে বর্তমান ভারতের পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম । তাঁর নামের আগে কাজী শব্দটি আছে। এর কারণ তাঁর বংশের নাম কাজী বংশ। তবে এই কাজী কিন্তু কেউ তাদের উপাধী দেয়নি বা তারাও উপাধী গ্রহণ করেননি।। বরং এই কাজী হলো বিচারক অর্থে। তাঁর পূর্ব পুরুষেরা কাজী অর্থাৎ বিচারক ছিলেন। সেই বিচারক বা কাজী বংশে জন্মেছেন বলে তাঁর নামের আগে কাজী শব্দটি আছে। কাজী নজরুল ইসলাম নাম শোনেনি এমন বাংলা ভাষায় কেউ আছে? কারণ নজরুল ইসলাম এমন একজন কবি যিনি বাংলা ভাষার মানুষের জন্য প্রাণ খুলে লিখেছেন। মানুষের মুক্তির জন্য মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লিখেছেন।

কাজী নজরুল ইসলাম ছোট বেলা থেকে বেশ ডানপিটে ছিলেন। খেলাধুলা তো করতেন কিন্তু ঘুরে বেড়াতেন পাড়ায় পাড়ায়। ঘুরতেন বনে বাদাড়ে এখানে ওখানে। ঘুরে বেড়াতেন ঠিক কিন্তু লেখাপড়ায় ছিলেন খুব ভালো। অনেক অনেক মেধাবী এবং ব্রেইনি। ছোটবেলা থেকে তাঁর স্মরণ শক্তি ছিলো খুব বেশি। এক বা দুইবার কোনো পড়া পড়লেই কেমন করে যে তাঁর মনে থেকে যেতো এটা বিস্ময়কর ছিলো। মুখস্থ করলে সেটি আর ভুলতেন না। এটা ছোটবেলায় যেমন ছিলো বড়বেলায়ও তেমনই ছিলো।

খুব ছোটবেলায় তিনি মসজিদে মধুর সুরে উচ্চ আওয়াজে আজান দিতেন। পরে তিনি ইমামতিও করেছেন। আবার তিনি মক্তবে শিক্ষকতাও করেছেন অনেকদিন। এইযে ইমামতি করার বিষয়টি খুব একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে হয় আমাদের কাছে। কারণ একজন ব্যক্তি কখন ইমামতি করতে পারেন বলে মনে হয়! তখনই তিনি ইমামতি করতে পারেন যখন তিনি কোরআন মজিদ শুদ্ধ করে এবং সুন্দর করে তেলাওয়াত করতে পারেন। আবার মক্তবের শিক্ষক হওয়ার জন্যেও শুদ্ধ করে আরবি ভাষা জানা দরকার হয়। শুদ্ধ আরবী না জানলে বা সুন্দর সুরে পড়তে না পারলে ইমামতি এবং মক্তবে শিক্ষকতা করা কোনোটাই পারার কথা নয়। কিন্তু নজরুল দুটোই খুব সুন্দর করে করেছেন বলে আমরা সবাই জানি।

আরেকটি মজার বিষয় হলো লেটোর দলে যোগ দিয়ে তিনি যে লেটোর গান লিখেছেন তা আজও অনেক বিস্ময়কর! উপস্থিত ক্ষেত্রে গান বানিয়ে সুর দিয়ে সে গান গাওয়ার শক্তি কজনই বা রাখেন। অথচ কি সহজেই এবং সাবলীল ভাবে কাজী নজরুল ইসলাম এসব করেছেন।
নজরুল বড়দের জন্য কবিতা গান গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নাটক কত কি লিখেছেন। সব মানুষের জন্যই তাঁর লেখা গুরুত্বপূর্ণ বলে সবাই জানে। কিন্তু তিনি কি শুধু বড়দের জন্য লিখেছেন? না শুধু বড়দের জন্য লেখেননি তিনি। ছোটদের জন্যেও লিখেছেন অনেক ছড়া কিশোর কবিতা গান গল্প ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখেছেন খুব মজার মজার অনেক রকম ছড়া এবং কবিতা। একটি কবিতা হয়তো তোমরাও পড়েছো-
বাবুদের তালপুকুরে
হাবুদের ডাল কুকুরে
সেকি বাস করলে তাড়া
বলি থাম একটু দাড়া।
পুকুরে ওই কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না!
সেথা না আস্তে গিয়ে
এব্বড় কাস্তে নিয়ে।
গাছে গে যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি।
ও বাবা মড়াৎ করে
পড়েছি সড়াৎ জোরে।
পড়বি পড় মালির ঘাড়ে
সে ছিলো গাছের আড়ে…।

কী সুন্দর! কী সুন্দর! একটি ছড়া। কী যে তার মজার ছন্দ এবং গতি আর সেই সাথে অন্তমিলের খেলা। বড় আনন্দের এবং সুন্দরের এই ছড়াটি। পুকুর পাড়ে লিচু গাছে লিচু ধরে আছে। সেই লিচু চুরি করতে গিয়ে চোরের অবস্থা কি যে খারাপ হলো সে কথাই এখানে বলেছেন কবি।
আরেকটি ছড়া আছে নজরুলের। এ ছড়াটাও খুব খুব সুন্দর এবং মজাদার-
ভোর হলো দোর খোলো
খুকুমণি ওঠরে
ওই ডাকে জুঁই শাখে
ফুল খুকি ছোটরে।
খুলি হাল তুলি পাল
ওই তরী চললো
এইবার এইবার
খুকু চোখ খুললো।
আলসে নয় সে
ওঠে রোজ সকালে
রোজ তাই চাঁদা ভাই
টিপ দেয় কপালে।

এ ছড়াটি পড়লে মনে হয় ওই তো রাতের আঁধার কেটে ভোরের সূর্য উঠলো। চারিদিকে সূর্যের সেই সুন্দর আলো ছড়িয়ে পড়েছে মাঠে ঘাটে ক্ষেতে খামারে। গাছে গাছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে। তার ভেতর দিয়ে মা তার ছোট্ট সোনামণি খুকুকে আদর মাখা ডাক দিয়ে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে। খুকুটা মায়ের ডাক শুনে নড়ে চড়ে হাত দিয়ে চোখ ডলে উঠে বসার চেষ্টা করছে। মা তখন খুশিতে আনন্দে বলে উঠলো আমার খুকু আলসে মেয়ে নয়। সে প্রতিদিন সকাল সকাল ভোর হলেই ঘুম থেকে উঠে যায়। তাই প্রতিদিন তার কপালে আকাশের চাঁদ চুমু দিয়ে যায়। আহা কী সুন্দর কথার মালা গাঁথলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
এবার একটি কবিতা পড়বো আমরা-
আমি হবো সকালবেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে
উঠবো আমি ডাকি।
সূর্যি মামা জাগার আগে
উঠবো আমি জেগে
হয়নি সকাল ঘুমো এখন
মা বলবেন রেগে।
বলবো আমি আলসে মেয়ে
ঘুমিয়ে তুমি থাকো
হয়নি সকাল তাই বলে কি
সকাল হবে নাকো।
আমরা যদি না জাগি মা
কেমনে সকাল হবে
তোমার ছেলে উঠলে মাগো
রাত পোহাবে তবে।

এই কবিতাটা পড়লে মনে হয় এটা আরও সুন্দর! আরও অনেক অনেক মজার। মা মেয়ের কথার একটা গল্প যেনো। মেয়েটা মাকে কী সুন্দর করে বলে দিচ্ছে তুমি আলসে মেয়ে ঘুমাও। সকাল হয়নি বলে সকাল কি আর হবে না, আসবে না কখনও। কিন্তু আমরা না জাগলে কেমন করে সকাল হবে গো মা! এই কথা তো সত্যিকার স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা। জেগে ওঠার জন্য এই কবিতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে সবাই মনে করে। আর কবিতাটা পড়লেই এ কথা বুঝতে পারা যায় যে একটা মুক্ত স্বাধীন সকাল আনতে হলে যুবক কিশোর কিশোরী সবাইকে জাগতে হবে। সবাইকে সচেতন হয়ে উঠতে হবে স্বাধীনতার জন্য।

তাই নজরুল ইসলাম আরেকটি কবিতায় বলেছেন-
থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগতটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।

বদ্ধ ঘরে না থাকার যে স্বপ্ন এটাই তো হলো সবচেয়ে বড় স্বাধীনতার কথা বা স্বাধীনতার মত প্রকাশ করা। আমাদের জাতীয় কবির মতো এমন সাহসের কথা এবং স্বাধীনতার কথা আর কেউ বলতে পারেনি কিন্তু।

১৯৪২ সালে আমাদের এই প্রিয় কবি অসুস্থ হয়ে গেলে আর তিনি লিখতে পারেননি। এই অসুস্থ অবস্থায় তিনি বহু বছর বেঁচে ছিলেন এটা সত্য। কিন্তু এক কলমও আর লেখার কোনো সুযোগ হয়নি তাঁর। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট এই মহান কবি পৃথিবী থেকে চলে যান চিরদিনের তরে। এই মে মাসে কবির জন্মদিন যা আমরা লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি। আমরা আমাদের এই মহান জাতীয় কবিকে স্মরণ করছি।

Share.

মন্তব্য করুন