নূর আহমদ

বদ্বীপের একগুচ্ছ ভূমি লোনা জল বিধৌত উর্বর দ্বীপরাজ সন্দ্বীপ। তার কুল ঘেঁষে আছে তটিনীর কুলু কুলু ধ্বনি, আছে সমুদ্রের উঁচু নিচু নান্দনিক ঊর্মিমালা। আবার তা কখনো পাহাড় সম বিক্ষিপ্ত উঁচু নিচু টাল মাটাল ঢেউয়ের তরঙ্গ কূলে আছাড় মারে সে রহস্যময় স্থানটির নাম সন্দ্বীপ। যাকে সম্ভাবনার রাজ তোরণ বলা চলে। নাতিদীর্ঘ সম্যক আলোচনায় তা দিগন্তের বলিরেখার মতো উন্মোচিত হবে ইনশাআল্লাহ।

অবস্থান :
চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই ও সীতাকুন্ডের পশ্চিম পাশে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিম কোল ঘেঁষে যে সমুদ্র তার অপর প্রান্তে সন্দ্বীপ। উত্তরে গিরিশৃঙ্গ থেকে নেমে এসে সাগর জলে মিশেছে কালিপাল পাহালিকা, সিলোনিয়া, মুহুরী ও ফেনী নদী। (এ সবের উজানে আমাদের কৃষিজ স্বর্ণালির দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প মুহুরী সেচ প্রকল্প। যার যাত্রা শুরু হয়ে ছিল ১৯৭৭-১৯৭৮ অর্থবছরে, শেষ হয় ১৯৮৫-১৯৮৬ অর্থবছরে। ঐ প্রকল্পে তৎকালীন ব্যয় ১৬৮ কোটি টাকা এবং সেচসুবিধা পায় প্রায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার একর জমি। রক্ষা পায় এ চার নদীর উজানে লবণাক্ততা থেকে এবং ফসলহানি থেকে। সমুদ্রের জোয়ারের তাণ্ডবে বিলীন হয়ে যায় অনেক বাড়িঘর, ফসলি মাঠ, রাস্তাঘাট, ধর্মীয় উপাসনালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরো কত কী। এ তাণ্ডবে পিছু নেই সোনাগাজী উপজেলা হয়ে নোয়াখালী কোম্পানীগঞ্জ ঘেঁষে ছোট ফেনী নদী। কত তিক্ত স্মৃতি এ ছোট ফেনী নদী! একেক সময় মুহূর্তে কত বাড়িঘর স্মৃতিময় স্থান কবরস্থান ও শ্মশান আজ ধূধূ বালুচর আর দীর্ঘশ্বাস।)
দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের রাক্ষুসী মুখ শুধু নয় বিশেষ এক অপার নেয়ামতের স্বর্ণ দুয়ার হরেক রকম সুস্বাদু মাছ। যদিও দাম দরিদ্রদের
নাগালের বাইরে তবুও জেলেরা যখন মাছ ধরে কুলে নিয়ে আসে তখন একটু উঁকি মেরে দেখে আনন্দের তৃপ্তি আনে তারা ।
পূর্ব প্রান্তে সমুদ্রের মুখ আর উক্ত চার নদীর স্রোতধারা জোয়ার ভাটা। সন্দ্বীপ আসার প্রধান কুমিরা ঘাট, পাড়ি দিতেই প্রথমমে খরস্রোত ধারা থাকে স্থানীয়রা যাকে স্থানীয় ভাষায় ফেনীর ধাইর বলে থাকে। সন্দ্বীপের কূলে ভিড়ে সে পূর্ব প্রান্তে তাকালেই স্বচ্ছ আকাশে দেখা যায় সীতাকুন্ডের গগনসম পাহাড় হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান। আর রাতের স্বচ্ছ আকাশে দেখা যায় চট্টগ্রামেরে মিটি মিটি বিজলি বাতি। পূর্ব পাশ ঘেঁষে আছে সীতাকুন্ড শিপইয়ার্ড যা কুমিরা পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের লৌহের জোগান এখান থেকেই। পুরাতন জাহাজ কেটে লৌহ স্টিল মিলে এবং অন্যান্য জিনিস স্থানীয় মার্কেটে বেচাকেনা হয়। কুমিরা থেকে চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে তা দেখতে পাওয়া যায়।
পশ্চিম সীমান্তে বহমান বাংলার খরস্রোত ও গভীরতম নদী মেঘনা। সন্দ্বীপের কত গ্রাম ইউনিয়ন স্থাপনা গত শত বছরে বিলীন হয়ে গেছে সর্বনাশা মেঘনার কবলে তা এখানকার স্থানীয়দের সাথে না মিশলে জানা যাবে না। কোন এক সময় ভাঙার এক করুণ বিলাপের জনপদ সন্দ্বীপ।
সন্দ্বীপের ইতিহাস থেকে জানা যায় চার হাজার বছরের ঐতিহ্যের এ নন্দিত জনপদ। যে সব নাম জানা অজানা আউলিয়া সাধক দ্বীন প্রচারক চট্টগ্রামে ইসলামের গোড়াপত্তন করেছিলেন সকলেই সন্দ্বীপে যাত্রাবিরতি করেছিলেন। কোন কোন ঐতিহাসিক রাসূল সা:-এর সাহাবী আবু ওয়াক্কাস রা:-এর আগমনের কথাও উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয় আন্দামান ও নিকোবর দীপপুঞ্জ হয়ে যে সকল সাহাবি, দ্বীন প্রচারক, অলি-সাধক এবং আরব বণিকগণ চীন ইন্দোনেশিয়াসহ পৃথিবীর পূর্বাঞ্চলে গিয়েছেন তারা এ সন্দ্বীপে যাত্রাবিরতি করেছেন। আবার এ অঞ্চলে কেহবা স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছেন। সে নমুনা এখানকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাওয়া যেত। সে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেলেও বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেক স্মৃতিকথা সন্দ্বীপের ইতিহাস গ্রন্থে গ্রন্থিত।
সন্দ্বীপের ইতিহাস থেকে জানা যায় এখানে ছিল জাহাজ নির্মাণ শিল্প, তুর্কি সম্রাটরা এখান থেকে জাহাজ কিনে নিয়ে যেতেন। ছিল লবণ উৎপাদন ও এ শিল্পের জয়জয়কার। কালের বিবর্তনে সে ঐতিহ্য শুধু ইতিহাসই রয়ে গেল। আর সন্দ্বীপের অনেক অংশ নদী ও সমুদ্রে ডুবে গেল হারিয়ে গেল। এক কালে যার আয়তন ছিল ৬৩০ বর্গমাইল আজ তা দাঁডিয়ে এবং অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য হারিয়ে বাকি রইল মাত্র ৮০ বর্গমাইল। এখানকার জমিন অনেক উর্বর এবং বেশির ভাগ সমতল, যা ধান চাষের উপযোগী। ধান ছাড়াও সব ধরনের সবজি মরিচ চীনাবাদামসহ বাংলাদেশে উৎপাদিত সব রকমের খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। এখানকার আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৫৬,৫০০ একর এবং অনাবাদি ২২,৯১১ একর।
যাতায়াত ব্যবস্থা : পূর্ব প্রান্তের অনেক পথ দিয়ে নৌরুটে স্পিডবোট, মালের বোট, সার্ভিস বোট এবং স্টিমারে সন্দ্বীপ যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। প্রধান রুট কুমিরা থেকে গুপ্তছড়া সন্দ্বীপ। স্পিডবোটে সময় লাগে সর্বোচ্চ পঁচিশ মিনিট। অন্যান্য যানে এক ঘণ্টার মধ্যে যাওয়া যায়। যাতায়াত-কাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত। বৈরী আবহাওয়ায় যাতায়াত বন্ধ থাকে।
পশ্চিম দিক দিয়ে নৌরুটে যাতায়াত চলে উড়িরচর হয়ে নোয়াখালী লক্ষ্মীপুর। এসব এলাকার যাত্রীরা উত্তর সন্দ্বীপ কালাপানিয়া ঘাট দিয়ে চলাচল করে থাকেন। তবে এ চলাচল শুধু জোয়ারকালীন সময়।
বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ : পুরাতন কাল থেকে এ অঞ্চলে অনেক জ্ঞানী গুণী শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, আলেমদের সুখ্যাতি সর্বজন স্বীকৃত। মধ্যযুগের কবির ‘বঙ্গবাণী’ কবিতা কতনা জনপ্রিয় কবিতা। সে কবি আবদুল হাকিমের বাড়ি কিন্তু সন্দ্বীপ। কলকাতা আলিয়া মাদরাসার একমাত্র বাঙালি অধ্যক্ষ মাওলানা জিয়া উল হক যার নেতৃত্বে দেশ বিভাগের পর কলকাতা আলিয়া মাদরাসা ঢাকা স্থানান্তরিত হয়, যার বর্তমান নাম সরকারি মাদরাসায়ে আলিয়া (বখশিবাজার) ঢাকা।
দর্শনীয় স্থান : সকাল বিকাল কোন কোন সময় দেখতে পাওয়া যায় সমুদ্রের রকমারি তাজা মাছ, উপজেলা অফিস, দক্ষিণ সন্দ্বীপ বাংলা বাজারে মাছ ধরার রকমারি বোট, টলার, গাছুয়াঘাট, ছোয়াখালি ঘাট, কালাপানিয়া ঘাট, উত্তর সন্দ্বীপে আকবর হাট ও দক্ষিণে শিবের হাট প্রসিদ্ধ। দক্ষিণ সন্দ্বীপের শিবের হাটের মিষ্টির জুড়ি নাই। এখানে আসলে কেউ মিষ্টি না খেয়ে না নিয়ে যাবে না। আরো যে কারণে দর্শনার্থীদের মন কাড়ে তা হলো বহমান নদী ও সমুদ্রের জোয়ার ভাটার গড়াগড়ি লাফালাফি। পূর্ব প্রান্তে ম্যানগ্রোভ সবুজ বেষ্টনী। আরো আছে চারিদিকে উঁচু বেড়িবাঁধ, এ বাঁধে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় জোয়ারের নান্দনিক এবং তাণ্ডবীয় ঢেউ। বছরের নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মার্চ পর্যন্ত সমুদ্র অতীব শান্ত থাকলেও বাকি মাসগুলোর বেশির ভাগ সময় থাকে অশান্ত তাই থাকে টালমাটাল ভয়ঙ্কর ঢেউ। বিকালের গোধূলিতে পশ্চিম বেড়িবাঁধে দাঁড়ালে সূর্যাস্তের দেখা মিলতেই স্নানে ডুব দিয়ে যায় হারিয়ে যায় সূর্যিমামা। এ যেন ক্ষণিকের তরে কক্সবাজার।
যোগাযোগের অব্যবস্থাপনার কারণে সন্দ্বীপ নিয়ে কেউ ভাবে না। চট্টগ্রাম মহানগর বন্দর এবং ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক ঘেঁষে এ দ্বীপ নিয়ে বহুবিধ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক মানের সমূহ সর্ববৃহৎ বাণিজ্য ও শিল্প অঞ্চল গড়ে বিশ্ব নেতৃত্ব দেওয়া যেতে পারে।
বন্ধুগণ! একবার এসে ঘুরে যান আমাদের এ মায়াভরা রূপে ভরা সোনালি দ্বীপ সন্দ্বীপ। হাজার দুঃখ দুর্দশার মাঝে টিকে আছে প্রায় চার হাজার বছরের হাসি আর কান্না লয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বুকে ধারণ করে বৈদেশিক ১১% রেমিট্যান্স যোদ্বাদের পরিবার। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা তিনি যেন সন্দ্বীপবাসীসহ পুরো দেশবাসীকে হেফাজত করেন। আমিন।

Share.

মন্তব্য করুন