অনেক দিন হলো কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না। তাছাড়া আমাদের অনেক দিনের ইচ্ছা ঢাকা যাওয়া। তো একবার সুযোগ পাওয়া গেল। আমার ছোট বোনের পরীক্ষা শেষ। আর পূজা উপলক্ষে কিছুদিনের ছুটি আমিও পেয়ে গেলাম। যদিও স্কুল এসএসসি পরীক্ষার জন্য অনেক আগেই বন্ধ ছিল। কিন্তু তখনও কোচিং ছিল। তবে পূজা উপলক্ষে কোচিং থেকেও ছুটি পাওয়া গেল। তো সবাই মিলে ঠিক করেছি এবার কোথাও যাওয়া যায়। কিন্তু কোথায় যাবো? সে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক বেগ পেতে হলো। দুদিন চিন্তা করেও কোনো সিদ্ধান্তেই আসা গেল না ।
এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হলো রাজবাড়ি না হয় ঢাকা। দুটোর যে কোন একটিতে যাবো। তো এই একই সিদ্ধান্ত বহাল থাকলো ভ্রমণের আগের রাত অবধি। তখনও আমরা নিশ্চিত হতে পারলাম না, কোথায় যাবো? অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো ঢাকা যাবো। কারণ আমি অনেক ছোট থাকাকালীন একবার ঢাকা গিয়েছিলাম। আর মুসান্না একবারও ঢাকায় যায়নি। তাই এবারের মতো সিদ্ধান্ত হলো আমরা ঢাকায় যাবো। পরের দিন ভোর পাঁচটার সময় ঘুম থেকে উঠি। ফজর নামাজ আদায় করি। সামান্য পানি আর বিস্কুট খেয়ে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে আম্মুকে সালাম জানিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। আম্মু বললেন: ‘আয়াতুল কুরসি পড়ে রওনা কর।’ আমরা আম্মুর কথামতো আয়াতুল কুরসি ‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম… আলিউল আযিম’ পড়ে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে রওনা করলাম। আব্বু বিআরটিসি কাউন্টার থেকে এসি বাসের টিকিট কাটলেন। আমরা যথাসময়ে বাসে উঠলাম। যদিও বাস ছয়টার সময় ছাড়ার কথা ছিল, কিন্তু ১৫ মিনিট দেরি করে বাস ছাড়লো। বাস চলতে শুরু করলো। বাসে বসতেই আমাদের সিটের সামনেই একটি দোয়া আমার নজর পড়লো ‘সুবহানাল্লাযি ছাখ্খারা লানা হাযা অমা কুন্না লাহু মুক্রিনীন অইন্না ইলা রাব্বিনা লা মুনক্বালিবুন।’
যা আমি পরে জানতে পেরেছি যে এটি পবিত্র কোরআনে কারীমের সূরা যুখরুফের ১৩ নম্বার আয়াত। আমি জানালা দিয়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছিলাম। এরপর পদ্মা ব্রিজ দেখে বিমোহিত হলাম। আব্বু বলছিলেন সাঁকোতে কিংবা সেতুতে উঠলে পড়তে হয়, ‘বিছমিল্লাহি মাজরেহা ও মুর ছাহা ইন্না লাগাফুর রহিম।’ (সূরা হুদ আয়াত: ৪১)
অর্থাৎ ‘আল্লাহর নামেই এর গতি ও স্থিতি আমার পালনকর্তা অতি ক্ষমাপরায়ণ ও মেহেরবান।’
প্রাকৃতিক দৃশ্য কতই না সুন্দর করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সৃষ্টি করেছেন। যে আল্লাহ এত সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। না জানি তিনি কতই না সুন্দর!
আর মনে মনে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের সে বিখ্যাত গানের কলি আওড়াতে থাকলাম। নিজের অজান্তেই।
‘তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর!
না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর! কত সুন্দর!’
আমরা যখন বাসে উঠি। আকাশে মেঘ। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। আমি শঙ্কিত ছিলাম। বৃষ্টির মধ্যে এই ভ্রমণে খুব একটা আনন্দ হবে না ! তাই ভেবে। অবশ্য আমার এ ভাবনা মিথ্যে প্রমাণিত হলো।
অবশেষে ৮টা ৫০ মিনিটের সময় আমরা ঢাকায় পৌঁছালাম। বাস থেকে নেমে তারপর নিকটস্থ একটি পরিচ্ছন্ন হোটেলে হাত মুখ ধুয়ে সকালের নাস্থা সেরে নিলাম। তারপর আমরা সিএনজিতে করে বঙ্গবন্ধু মিলিটারি মিউজিয়ামের সামনে নামলাম। মিউজিয়ামে গিয়ে দেখলাম প্রবেশ করার সময় এখনো হয়নি। ১৫ মিনিট বাকি আছে। তাই আমরা ১৫ মিনিট অপেক্ষায় থাকলাম। কিন্তু অপেক্ষার পালা আর শেষ হচ্ছে না। কখন ঢুকবো মিউজিয়ামের ভিতরে। মনের ভিতর করছে কেবলি আকুলিবিকুলি। যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মিউজিয়ামের গেটে ঢোকার পূর্বে আব্বু আমাদের তিনজনের টিকিট কেটে নিলেন। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। সেনাবাহিনীর সদস্যরা টিকিট চেক করলেন। দেখলাম কতইনা সুন্দর! পরিচ্ছন্ন পরিপাটি। ওয়াশরুমে ঢুকেই মনে হলো ইন্টারনেটে দেখা বিদেশি ওয়াশরুম। কিংবা তারও পূর্বে আব্বুর কাছ থেকে শোনা কানাডার বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেলের সেই ওয়াশরুমের কথা। প্রথম দর্শন বলে একটা কথা আছে। সে দিক থেকে ওয়াশরুম দেখেই মনটা ভরে গেল!

সেখানে স্বয়ংক্রিয় হ্যান্ডওয়াশ ও ড্রাইয়ার আছে, যা আমি জীবনে সরাসরি প্রথম দেখলাম। তারপর আমাদের জাদুঘর ভ্রমণ শুরু হলো। জাদুঘর ঘোরার আগে এর সম্পর্কে কিছু তথ্য আপনাদের দিয়ে নেই। এই জাদুঘরটি ঢাকার বিজয় সরণিতে অবস্থিত। ১৯৮৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৯ সালে জাদুঘর স্থায়ীভাবে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে এর বর্ধিত সংস্করণ শুরু হয়ে শেষ হয় ৬ জানুয়ারি ২০২২ সালে। জাদুঘরটি ভূগর্ভস্থ দোতলাসহ মোট ছয়টি তলাবিশিষ্ট। এর মধ্যে ভূগর্ভস্থ দোতলা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য। প্রথম তলার ডান দিকের অংশে প্রাচীনকাল থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় তলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য। তৃতীয় তলা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্য। এবং চতুর্থ তলায় চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিভিন্ন কৃতিত্ব প্রদর্শন করা হয়েছে। আমরা এক এক করে প্রতিটা তলা ঘুরে দেখলাম। প্রথমতলা ঘুরে দেখলাম। সেখানে চলন্ত সিঁড়ির সাথে মনিটরের মাধ্যমে ঝরনার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। দেখলে মনে হয় সিঁড়িটা যেন ঝরনার উপর তৈরি করা হয়েছে। তারপর আমরা গেলাম মাটির নিচের তলার কক্ষে। প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল। বঙ্গবন্ধুর বিশাল ভাস্কর্য। অসাধারণ লাগছিল ভাস্কর্যটি। খেলার জন্য বেশ কয়েকটি মনিটর ছিল। মিউজিয়ামটিতে সশস্ত্রবাহিনীর ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস ছিল। যুদ্ধে ব্যবহৃত বন্দুক, বোমা, ক্রেন, বিমান, কামান ইত্যাদি ছিল। তবে সবচেয়ে ভালো লাগলো একটা যুদ্ধবিমান। যেটার ভিতরে ঢোকার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে ঢুকে নিজেকে বৈমানিক মনে হচ্ছিল। তো তারপর। আমরা মিউজিয়ামের ভবন থেকে বের হয়ে বাইরে দৃশ্য দেখলাম। সেখানে একটা আর্টিফিশিয়াল সাগর ছিল। সেখানে একটা আর্টিফিশিয়াল জাহাজ ও একটি সাবমেরিন রাখা ছিল। তারপর আমরা মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে বিজয় সরণিতে প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর কোন উপায় না পেয়ে আমরা হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে এসে পড়লাম। তখন মনে হলো গাড়ি না পেয়ে ভালোই হলো। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়তো দেখা হলো। সেখানে শামীম নামে একজন ট্রাফিক পুলিশ কিছুক্ষণ পর আমাদের একটি লোকাল বাসে তুলে দিলেন। পরে আমরা জানতে পারলাম, আমরা যেখানে যাবো; বাসটি সেখানে যাবে না। তাই আমরা বাস থেকে নামলাম । নামার পরে চাচ্চু আব্বুকে ফোন করে জানালো। চাচ্চু কুর্মিটোলা এসেছে আমাদের নিতে।

তাই আমরা একটি সিএনজি নিয়ে কুর্মিটোলার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। সিএনজি থেকে নামার পর ফুটপাথে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমরা চাচ্চুকে দেখতে পেলাম। আমরা চাচ্চুর সাথে সিএনজি করে আশকোনা রেলগেট পৌঁছালাম। সেখান থেকে রিকশায় করে আমরা চাচ্চুর মাদরাসার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। সেখানে আমরা রাতে থাকলাম। রাতে চাচ্চু আব্বুর একটা বন্ধুকে ফোন করে জানালো যে, আব্বু ঢাকায় এসেছে। আব্বুর বাল্যকালের বন্ধু দেখা করতে এলো। আব্বু তাঁকে দেখে খুবই আনন্দিত হলেন। চাচ্চু ও চাচীমার অনুরোধে পরদিন সকালে আমরা জলসিঁড়ি সেন্ট্রাল পার্কে গেলাম। পার্কে যাওয়ার রাস্থা ছিল ভারী সুন্দর। রাস্থার চারদিকে তেমন কোন ঘর নেই। চারদিকে শুধু কাশফুল আর কাশফুল। কাশফুলের মন ভরানো সৌন্দর্য। আর তার সাথে স্নিগ্ধ বাতাস বইছিল। সবমিলিয়ে এক চমৎকার পরিবেশ। এখানে এসে বিশ্বাসই হচ্ছিল না আমরা ঢাকায় আছি! চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা কখন যে পার্কে পৌঁছে গেলাম, তা টেরও পেলাম না। জলসিঁড়ি সেন্ট্রাল পার্কটি সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত। এটি বাংলাদেশের সেরা পার্কগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমরা পার্কে ঢোকার জন্য টিকিট কিনলাম। পার্কে ছিল স্লিপার। জাহাজের স্টাইলের স্লিপার পার্কে খেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগলো জাম্পিং প্যাড। এক পাশে ছিল একটি সুন্দর খাল। সেই খালের পাশে আর্টিফিশিয়াল ঝরনা ছিল। পার্কে ছিল অনেক বড় প্রায় একতলা সমান দুইটি ছাতা। পার্কে সবচেয়ে ভালো লাগলো কিডস মাজা। যাকে আমরা গোলকধাঁধা বলে থাকি। সেই গোলকধাঁধায় ঢুকলে কোথায় যে পৌঁছাব তা বোঝা যায় না। সেখানে বেশ কিছু ওয়াচ টাওয়ার ছিল। তাছাড়া গোলকধাঁধার ভিতর ছিল কয়েকটি সাপ লুডু কোর্ট ও দাবার কোর্ট। এক জায়গায় দেখতে পেলাম একটি কাঠের ঘর। সে ঘরটির নাম হোবিট হোম বা শখের ঘর। সেখানে গেম খেলার ব্যবস্থা আছে। আর এক জায়গায় দেখতে পেলাম মাটির নিচে একটি রেস্টুরেন্ট। আমাদের যাওয়ার সময় চলে এলো। ইতোমধ্যে আমরা জোহরের কসর সালাত আদায় করলাম। পার্কের লাগোয়া নামাজ ঘরে।

ইতঃপূর্বে চাচীমায়ের আনীত নাশতা আমরা খেয়ে নিলাম। বাড়ির উদ্দেশে রওনা করতে হবে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও পার্ক থেকে যেতে হয়েছিল। তবে পার্ক থেকে বের হওয়ার পর চার পাশের মনমাতানো সৌন্দর্যে মন খুশি হয়ে গেল। সেখান থেকে আমরা নিলা মার্কেটে গেলাম। মিরমুসা জামাইবাবু হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেলাম। হোটেলের খাবারগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লাগলো হাঁসের মাংস। আমরা হোটেল থেকে বের হওয়ার পর একটা মিষ্টির দোকানে গেলাম। সেখানে দেখলাম বেশ বড় কয়েকটি বালিশ মিষ্টি। আমরা দুই কেজি ওজনের একটি বালিশ মিষ্টি কিনলাম। এবার আমাদের ঢাকা থেকে বিদায় নেয়ার পালা। আমরা ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা হলাম। আসার সময় মনে হলো আর কয়টা দিন যদি থাকতে পারতাম!
রাতের পদ্মা সেতু দেখতেই অন্যরকম, যা আমাকে অনেক দিন ভাবাবে! মনোমুগ্ধকর এ স্মৃতি ভোলা কি যায় কভু!

Share.

মন্তব্য করুন