একটা রাত পাঁচশ বছর ভোর হয়নি। উদিত হয়নি পাঁচশ বছর, কোনো ভব রাঙানো সোনালি রবি। রাশি রাশি বিকিরণে হাসি হাসি চেয়ে উঠেনি পাঁচশ বছর। গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল গোটা ভুবন। জ্যোস্না ছিল না। জোনাক ছিল না। তারার ঝিকিমিকি মেলাও ছিল না। কোথাও ছিল না যেমন আলোর নিভু নিভু শেষ পিদিমটাও, তেমনই এই আঁধারাক্রান্ত রাত কোনো নির্জনতাও পায়নি। পায়নি নিবিড়তা, নিস্তব্ধতা এবং নীরবতার লেশমাত্রও।
এই রাত-তাঁবুর বাঁধা ডোরে যাপিত যাদের জীবন, তারা আঁধারেই অভ্যস্ত ছিল। তারা কখনো নিদ্রাবৃত হয়ে যায়নি এই রাতে। বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েনি কখনো। এই অভিশপ্ত রাতেও তাদের হৃদয় ছিল নিতান্ত সুখী এবং প্রফুল্লতায় ভরপুর। তাদের ভ্রম, তারা স্বর্গে আছে। তাদের কোনো শেষ নেই।
কিন্তু তাদের মধ্যে অধিকারচ্যুতরা যারা ছিল, তারা নিতান্তই কিচ্ছা তৈরি করতো সমাপ্তি রচনার ইচ্ছায়। অবিরত হাতড়ে বেড়াতো সমাধান সন্ধানে। সততাই ছিল তাদের সব সময়ের আরাধনা। যে সমাজে নেই জীবনের মূল্য, নারীদের সম্মান, কন্যা সন্তানের বাঁচার উপায়, সেখানে আর কী জপমালা থাকতে পারে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা ছাড়া? তাদের প্রত্যাশা এমন হতো না যদি বিলুপ্ত না হতো তাদের অধিকার, সম্মান, স্বাধীনতা।
একটা আলোকে তারা কখনোই খুঁজে ফিরেনি। যে আলো সত্যের, সম্মানের, স্বাধীনতার। তারা কেবল হন্যে হয়ে খুঁজেছে তাদের অধিকার, মর্যাদা, সুখ।
তাদের একজনের সুখে অন্যজনের জান যেত। মানুষের প্রাণ ছিল তাদের খেলার উপকরণ। তাদের খেলা ছিল দ্রুতগামী ঘোড়ার সঙ্গে নারী-শিশুকে বেঁধে ছেড়ে দেওয়া। তাদের অনিয়ম ছিল তিলকে তাল বানিয়ে লড়াই, প্রাণকে নিষ্প্রাণ বানিয়ে বড়াই, আর একটুতেই ধরো-মারো-হত্যা করো। এভাবেই বয়ে যেতো তাদের নষ্টামির স্রোত। তারা আঁধারেই হাসতো ভীষণ। সুখে ভাসতো অগণন অকারণেও।
আবার কেউ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ত অবিরাম। প্রতিনিয়তই নিষ্পেষিত ছিল যারা। পশুও যাদের চেয়ে সুখে দিনাতিপাত করতো। কেউ কামনাও করতো মৃত্যুকে। যাদের মাংস-মজ্জায় শয্যা গ্রহণ করেছিল বিতৃষ্ণা ও অতিষ্ঠতা।
হঠাৎ সবার হৃদয়ে জ্বালাতে শুরু করল আশার আলো। অধিকারচ্যুত, অনাথ ও দুঃখীরা হঠাৎ বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। পাঁচশ বছরের সেই সুদীর্ঘ রজনী, যে রজনী কোনো শনি রবি বা বৃহস্পতির না, বরং জাহেলিয়াতের নষ্ট আঁধারের সৃষ্টি, তা অবশেষে ভোর হতে শুরু করলো।
সঙ্গে সূচনা হলো একটা কাচস্বচ্ছ জীবনের। আবির্ভাব ঘটল এক মহা মানবের। যার প্রভাবে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে যেতে লাগলো এক দৈব আলোকরশ্মি। প্রতিটা কুটিরের বাতায়নে আমূল প্রবিষ্ট হতে লাগলো সেই আলো। পারস্যের শিরাজ শহর সংলগ্নে, এক হাজার বছর যাবৎ প্রজ্বলিত অগ্নিকু-ে, গিয়ে পড়ল এক অপ্রত্যাশিত ফুৎকার। হাজার বছরের শক্তিশালী অগ্নি নিভে গেল নিমেষেই। ভূমিকম্প শুরু হলো পারস্যের সুবিশাল রাজপ্রাসাদের বারান্দায়। ধসে পড়লো একে একে চৌদ্দটি দৃঢ় স্তম্ভ। ধারাবাহিকতা সৃষ্টি হলো সর্বত্রই এক আমূল পরিবর্তনের। সত্যের চেরাগ জ্বালতে শুরু করলো প্রতিকুটিরে।
মরুভূমির প্রতিটা ধূলিকণাও চিকচিক করে হাসতে শুরু করলো যে জীবনের সূচনায়, পৃথিবী থেকে সে জীবন চিরবিদায় করেছে অবশ্যই আদর্শের অভাবতাকে। নিমেষেই পরিণত হলো প্রতিহৃদয়ের প্রেমাস্পদে। সবার মুখ তৃপ্তি পায় যে প্রথম নামের উচ্চারণে। মুহাম্মদ। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
এক অনুপম আদর্শ হয়ে আবিষ্কৃত হলো তার জীবন। যে জীবন ও আদর্শ সকলের আবশ্যকীয়। কিয়ামতের আগ মুহূর্তে জন্ম নেয়া নবজাতকের জন্যও প্রয়োজন যে জীবনের, যে আদর্শের। সে জীবনই হয়ে ওঠুক তোমার আমার আদর্শ। যে জীবন আজীবনের।

Share.

মন্তব্য করুন