‘বাড়ি যাবার সময় সব ঘুরে দেখে নিয়ে তারপর যেও। এতো কষ্ট মনের মধ্যে রেখে ফিরে যেও না।’
কথাটা বলেই শেষ নার্সটিও বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে।
যমুনার চরে গড়ে ওঠা বিশাল ক্লিনিকের দোতলার এক কেবিনে বসে আছে সাতদিন আগে ওপেন হার্ট সার্জারি করা অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া। তার চোখ আটকে আছে জানালার বাইরের ছোট্ট বাগান পেরিয়ে ওটির বাইরের দেয়ালে আটকে থাকা বড় বড় প্রশস্ত পাইপের উপর বসা কবুতরগুলোর দিকে।
আজ পনেরো দিন থেকে কবুতরগুলো প্রতিদিন তাকে দেখে যায়। জানালা দিয়ে কিছু খাবার তাদের জন্য ছড়িয়ে দেবার ইচ্ছা থাকলেও ক্লিনিকের কঠোর নিয়মনীতির কারণে তা আর হয়ে ওঠে না।
আজ চলে যাবার পূর্ব মুহূর্তে কবুতরগুলোর জন্য প্রাণটা কেমন করে ওঠে সুমাইয়ার।

বাড়ি থেকে বহুদূর এসে ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে যখন সুমাইয়া জানতে পারলো যে তার অপারেশন সপ্তাহখানেক দেরি হবে, তখন মনে মনে চুপসে গেছিলো সে। মা তাকে সর্বদা সান্ত¡নার কথা শুনালেও দিনগুলো কেন যেন তার কাটতেই চাচ্ছিলো না। না, অপারেশনের ভয়ের জন্য নয়, তার চিন্তা ছিলো অন্য জায়গায়। একদিন দুদিন নয়, টানা সাতদিন কিভাবে বই ছাড়া কাটাবে সে? বাড়ি থেকে বই না এনে বড় ভুল করে ফেলেছে বলে সারাক্ষণ পস্তাতে থাকে। অবশেষে বাবা তাকে তার অষ্টম শ্রেণির বই এনে দিলেন পড়ার জন্য। কিন্তু সেই বই হাতে নিলেই সুমাইয়ার মনে হয়, দুদিন বাদ অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে তো মারাই যাবো, কি হবে এইটের বই পড়ে। তার মা ক্লিনিক সংযুক্ত মেডিক্যাল কলেজ থেকে মাত্র দুইটা সাহিত্যের বই সংগ্রহ করতে পারলেও সেগুলো সুমাইয়া একদিনেই শেষ করে ফেলেছে।
এলোমেলো চিন্তারা অবশেষে ঠাঁই নেয় কলমের নিবে। লিখে ফেলে বেশ কয়েকটি ছড়া। তার ওই কঠিন রোগকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে নিয়েই সে লেখে,

ওগো আল্লাহ সবার তুমি
সকল কিছু দেখতে পাও
যে পরীক্ষা দিলে আমায়
তাতে সফলতা দাও।
পরীক্ষায় যেন পাস করি গো
তুমি সাথে থেকো
ধৈর্য যেন ধরতে পারি
মোরে ভালো রেখ।

সাথে থাকা সাহিত্যের বইয়ে ছড়াগুলো ভরে রাখলেও তা কেমন করে এক নার্সের হাতে পড়ে যায়। রাতারাতি তার ওয়ার্ডের সকল চিকিৎসক ও নার্সরা জেনে ফেলে তার ছড়া লেখার খবর। এক জুনিয়র ডাক্তার আবদার করে বসে তাদেরকে নিয়ে ছড়া লেখার। অপারেশনের পরে সুমাইয়া লিখেও ফেলে ক্লিনিকের সার্ভিসকে উপজীব্য করে। কিন্তু তারা যে তাকে দীর্ঘ পনেরোটি দিন কঠোর শিডিউলে একপ্রকার বন্দী করে ফেলেছিলো, পাশের যমুনার ঢেউ হাতছানি দিয়ে ডাকলেও সুমাইয়া যে একবারও সেখানে যেতে পারলো না এমনকি প্রবেশের সময় এই ক্লিনিকেরই আউটডোরের বাইরের লনে নানান রঙিন ফুল তাকে হাত নেড়ে ডাকছিলো, সে সাড়া দিতে পারলো না- এ কষ্ট সে এড়াবে কি করে? আজ রিলিজের সময় যখন কেবিন ভর্তি চিকিৎসক ও নার্স দাঁড়িয়ে থেকে তার রচিত লেখাগুলো তারই কণ্ঠে শুনছিলেন, তখন কি সেই বেদনাটা তারা ধরতে পারেননি সুমাইয়ার কণ্ঠে? তাই তো একজন নার্স শেষ পর্যন্ত এই কথাটা বলেই তাকে সান্ত¡না দিয়ে গেলো।

‘আসো সুমাইয়া তুমিও আমাদের সাথে খেলো।’
‘খেলবো না। আমাকে ভালো লাগছে না।’
‘আস্তে হাসাহাসি করে সবাই। সুমাইয়ার মনটা বড্ড খারাপ লাগছে দেখে।’
জোরে একটা ঘোষণা দিয়ে সুমাইয়ার প্রতি সহপাঠীর দায়িত্ব পালন করে আবার খেলায় মগ্ন হয়ে পড়লো মারিয়া।
একটু আগে বলে যাওয়া প্রিয় শিক্ষিকার কথাগুলো বারবার আলোড়ন তুলছে সুমাইয়ার মনে। সে নিশ্চিত, তার মা নিজে বলতে না পেরে সহকর্মী এই শিক্ষিকাকে তার কাছে পাঠিয়েছে কথাটা নিয়ে।
মন দিয়ে শিক্ষিকার কথাগুলো শুনে সাহসের সাথে ইতিবাচক সাড়া দিলেও পরক্ষণেই মনটা শ্রাবণের ভারি মেঘে ঢেকে গেলো সুমাইয়ার। বিশাল আকাশও তার এই মন খারাপের সাথী হয়ে কেঁদে ফেললো একেবারে মুষলধারে। অবশ্য আজ সকাল থেকেই প্রচুর কাঁদছে আকাশটা। রাস্তা-ঘাট, স্কুলমাঠ পানিতে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। তাই আজ স্কুলে শিক্ষার্থী অধিকাংশই অনুপস্থিত। এই সুযোগে উপস্থিত অল্প ক’জন ছাত্রী শিক্ষিকাদের অনুমতি নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছে। শুধু খেলতে পারছে না সুমাইয়া।

ক’দিন আগে বাবাও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তাকে।
‘তাহলে এ বছর আর জেডিসি পরীক্ষা দেওয়া হচ্ছে না তোমার।’ বলেই বাবা সাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছিলেন সেদিন।
বাবার সামনে একেবারে চুপ করে থাকলেও পরক্ষণেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে আঙিনায় ফলের ভারে নুয়ে পড়া মোহময় ঘ্রাণ ছড়ানো বিশাল আমগাছটার নিচে বসে থাকা সুমাইয়া। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই মা এসে তাকে এই বলে অভয় দিয়েছিলেন যে, ‘সব কিছুর উপর তোমার পরীক্ষা প্রাধান্য পাবে। পরীক্ষা বাদ দিয়ে কিছু নয়।’

আজ শিক্ষিকার মুখে কথাগুলো শুনে তার মন আলোড়িত হয়।
‘দেখছি ক’দিন থেকে চিকিৎসার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছো। ডাক্তার কি বললো সুমাইয়া?’
‘রিপোর্ট ভালো নাই। অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যাচ্ছে।’
‘তাহলে অযথা দেরি করে লাভ নাই। সাহস করে অপারেশনটা করেই ফেলো। তোমার আব্বাকে বলো কথাটা।’ কণ্ঠটা কেঁপে উঠলো বলে মনে হলো সুমাইয়ার কাছে। এই শিক্ষিকা তাকে সর্বদা কন্যা হিসেবেই দেখে থাকেন। এমনকি সুমাইয়া নামটাও তারই রাখা।
হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে ক্লাসে ফিরে আসে সুমাইয়া। সে জানে তার বাবা ইতোমধ্যেই তার অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অবশ্য বাবার ইচ্ছা ছিলো না এই বয়সের মেয়েকে ওপেন হার্ট সার্জারির বেডে তুলে দেবার। মেধাবী মেয়েটা এবার জেডিসি পরীক্ষা দিবে তার জন্য কতো প্রস্তুতি নিচ্ছে।
‘স্যার, নতুন শিক্ষানীতির আলোকে এবার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষা হবে। ততদিন দেখি মেয়েটা কেমন থাকে।’ ডাক্তারের ঘরে সুমাইয়ার সামনেই অপারেশনে অনাগ্রহী বাবা নিজের মত প্রকাশ করেছিলেন।
‘আপনার মেয়েই যদি না থাকে, পরীক্ষা নিয়ে কি করবেন?’
বাবাকে আর একটা কথাও বলতে শুনেনি সুমাইয়া। সেও নীরবেই বাড়ি ফিরে এসেছিলো বাবার সাথে।
তাহলে কি সত্যিই তাকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হচ্ছে, সে কি তাহলে দুনিয়ার জীবন শেষ করতে যাচ্ছে! না সে মৃত্যুকে ভয় পায় না। সে জানে মৃত্যুর জন্য নির্দিষ্ট কোন বয়স নাই। এখনি এই মুহূর্তেও সে মরতে প্রস্তুত। মনে সাহস সঞ্চয় করে সুমাইয়া।

‘ম্যাম, আমার জন্য আপনাদের দোয়া কবুল হয়েছে।’
পৌষ মাসের মাঝামাঝি সময়ে কুয়াশায় ঘিরে থাকা নদী তীরের স্কুল মাঠে শোয়েটার-চাদর গায়ে দিয়ে খেলতে থাকা একদল ছাত্রীর পাশেই দাঁড়ানো দর্শক সুমাইয়ার কণ্ঠ কলকলিয়ে ওঠে ক্লাস এইটের শ্রেণি শিক্ষিকাকে মাঠে ঢুকতে দেখে।
খুশিতে ভরে ওঠে শিক্ষিকার মুখখানা। তিনি তো মনে প্রাণেই চেয়েছিলেন কন্যাসম ছাত্রীটার পড়ালেখার ছন্দপতন না হোক। সেজন্য তার বিষয় গণিতে আলাদা যত্ন নিয়েছিলেন তার। এমনিতেই তিন মাস পড়ালেখার ক্ষতি হয়েছে মেয়েটার। তার আশা পূরণ করে কোন ক্লাসেই প্রথম স্থান না ছাড়া মেয়েটি আজও প্রতিষ্ঠানের সেরা ফলাফল ছিনিয়ে নিয়েছে।

Share.

মন্তব্য করুন