টিফিন পিরিয়ড শুরু হলে ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত কমনরুমে গিয়ে ইনডোর খেলা নিয়ে সময় কাটায়। তবে সুজন আর ওর বন্ধুরা তা করে না। ওরা স্কুল মাঠের শেষপ্রান্তে গিয়ে গাছের ছায়ায় বসে গল্প করে। আজও ওরা গল্প করছিলো। পৃথিবী থেকে ডোডো পাখি কেমন করে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সে সম্পর্কে ফাহিম বলছিলো। হঠাৎ পিউ জিজ্ঞেস করলো, আজ কয় তারিখ রে?
পিউ কাকে উদ্দেশ করে তারিখের কথা জিজ্ঞেস করেছে তা বোঝা না গেলেও ফাহিম থমকে গেল আর অঞ্জন রেগে গিয়ে বলল, ধ্যাত্! লাখ লাখ বছর আগে এ পৃথিবীতে কেমন করে ডোডো পাখি বলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো সে কথা শুনছিলাম, কিন্তু পিউটা ফাহিমকে থামিয়ে দিলো! কেনো রে বোন, তারিখ জানার কি এতো দরকার পড়লো?
পিউ বলল, নিজের জন্য নয়, আমি সবার জন্য জানতে চেয়েছি। বল্ না আজ ক’ তারিখ?
: আট তারিখ। হলো তো? এবার বল্ তারিখ দিয়ে তোর কী দরকার?
পিউ অঞ্জনের প্রশ্নের জবাব দিতে যাচ্ছিলো, সে সময় মৌসুমি বলল, আমি জানি কি দরকার। এ মাসের সাতাশ তারিখে পিউর জন্মদিন। সেদিন পিউ নিজ হাতে রেঁধে…
পিউ দ্রুত বাধা দিয়ে বলল, না না মৌ, সে জন্য নয়। আসলে আমি জানতে চেয়েছি একুশে ফেব্রুয়ারি আসতে আর কতো দিন বাকি।
: দাঁড়া আমি হিসেব করে বলছি।
মৌসুমি। আঙুলে গুনে নিয়ে বলল, আজ আট তারিখ তো? তাহলে বাকি রয়েছে আর বারো দিন। তেরো দিনের দিন একুশে ফেব্রুয়ারি- আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস।
মৌসুমির জবাব শুনে উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়ে নিলয় বলল, তাই তো! ফেব্রুয়ারি মাস চলছে, আর মাত্র কয়েক দিন পর আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস, অথচ আমার তা মনেই ছিলো না! সেদিন স্কুল বন্ধ থাকবে। আমরা মজা করে…
: ওটা মজা করার দিন নয়।
বড়োদের মতো গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলে সুজন নিলয়কে থমকে দিলো। বেচারা তখন মিনমিন করে বলল, স্যরি। তুই ঠিকই বলেছিস, ওটা মজা করার দিন নয়।
সুজন বলল, অনেকেই দিনটিকে আনন্দের দিন হিসেবে নেয়। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত বন্ধ থাকে। সে সুযোগে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। মোড়ে মোড়ে কান ফাটিয়ে গান বাজায়। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি তো ওসব করার দিন নয়। ওটা হলো ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার দিন। তাদের আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করার দিন।
ফাহিম বলল, আমরাও তাই করবো- শহীদ মিনারে গিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবো আর তাদের আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করবো। কিন্তু…
কথা শেষ না করে চেহারায় একটা বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে তুললো ফাহিম। সেদিকে তাকিয়ে সুজন জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু কি?
ফাহিম বলল, শহীদ মিনারে তো যাবো। কিন্তু আমাদের স্কুলে তো শহীদ মিনার নেই। তাই যেতে হবে আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে। নিজেদের স্কুল রেখে অন্য স্কুলের মিনারে ফুল দিয়ে আসতে আমার ভালো লাগে না।
: আমারও না। আত্মসম্মানে বাধে।
বেশ জোর দিয়ে ফাহিমকে সমর্থন করলো প্রীতি। আর ওর কথা শুনে সুজন বলল, আমাদের স্কুলে একটা শহীদ মিনার থাকলে সত্যিই খুব ভালো হতো। মন খারাপ করিস না। আমি কথা দিলাম- এবার থেকে নিজেদের শহীদ মিনারে নিজেরা শ্রদ্ধা জানাবো। শহীদদের বিদেহী আত্মার জন্য দোয়া করবো।
: কথা দিলেই তো হবে না। এ জন্যে আমাদের স্কুলে শহীদ মিনারও থাকতে হবে! কিন্তু আমাদের স্কুলে শহীদ মিনার নেই। প্রতি বছরই তো আমরা হেডস্যারকে বলে যাচ্ছি শহীদ মিনার চাই শহীদ মিনার চাই, আর তিনিও বলে যাচ্ছেন শহীদ মিনার বানাবো শহীদ মিনার বানাবো। কিন্তু দিনটা পেরিয়ে গেলেই তিনি তার প্রতিশ্রুতি ভুলে যাচ্ছেন।
প্রীতির কথার মাঝে শুধু অভিযোগই ছিলো না- দুঃখও ছিলো। তা বুঝতে পেরে সুজন বলল, একটা জিনিস বুঝতে পারছি, জোর দাবি না জানালে কোনো কাজ হবে না। এবার সবাই মিলে শহীদ মিনারের জন্য দাবি জানাবো। চল্, এখনই আমরা হেডস্যারের কাছে যাই।
: নীতু আপু আর জসিম ভাইয়াদের ডেকে নিই। ডাকবো?
অনুমতির জন্য মৌসুমী সুজনের দিকে তাকালো। সুজন ওকে উৎসাহ দিয়ে বলল, শহীদ মিনারের দাবিতে যতো স্টুডেন্ট আমাদের সঙ্গে থাকবে, ততোই দাবি জোরালো হবে। নীতু আপু আর জসিম ভাইদের সঙ্গে সিক্স-সেভেনের কয়েকজনকেও ডেকে নিও। আর নন্দিতা আপু তো ভালো কাজে আমাদের সঙ্গে থাকেনই। আজ কথা আদায় না করে হেডস্যারের সামনে থেকে নড়বো না।

দুই.
সুজন যখন দলবল নিয়ে হেডস্যারের রুমে গেল, হেডস্যার তখন ওদের দেখে হকচকিয়ে গেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এনি প্রবলেম? একসঙ্গে সবাই এসেছো যে?
ক্লাস নাইনের মাজহার বলল, সুজন আমাদের ডেকে এনেছে স্যার। ও নাকি দরকারি কথা বলবে।
হেডস্যার বললেন, বলো সুজন। কি এমন কথা বলবে যার জন্য স্কুলের সবাইকে নিয়ে এসেছো?
সুজন বলল, কথাটা আমার নয় স্যার- সবার। তাই সবাইকে নিয়ে এসেছি। স্যার! একুশে ফেব্রুয়ারি তো এসে গেল। প্রতি বছর আমরা আদর্শ বিদ্যালয়ে গিয়ে অনুষ্ঠান করি। এবার আর সেভাবে করতে চাইছি না।
: বেশ তো, যেভাবে করতে চাইছো সেভাবে করবে। সমস্যা কোথায়?
হেডস্যার সুজনের দিকে তাকালেন। সুজন বলল, সমস্যা আছে স্যার। আমাদের ইচ্ছে, এবার আমরা আদর্শ বিদ্যালয়ে না গিয়ে নিজেদের স্কুলে সব করবো। কিন্তু আমাদের শহীদ মিনার নেই। একটা শহীদ মিনার বানাতে হবে। ওটা যদি স্যার…
সুজনের কথার রেশ ধরে নাইনের কেয়া বলল, ওটা যদি স্যার বানিয়ে দেন, তাহলে সমস্যা মিটে যায়। আপনি অর্ডার দিলেই হয়ে যাবে স্যার।
হেডস্যার বললেন, এ তোমাদের ভুল ধারণা। ইচ্ছে করলেই আমি সব কাজের অর্ডার দিতে পারি না। আমার একক ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই। কোনো স্থায়ী কাজ করতে হলে স্কুল কমিটির অনুমোদন নিয়ে তা করাতে হবে। আগামী মিটিংয়ে আমি কমিটির সামনে কথাটা তুলবো। ইন্শাআল্লাহ আগামী বছরের মধ্যে তোমাদের আশা পূরণ হবে। আর কিছু বলবে?
সুজন বলল, জি না স্যার। আমরা তো এ কথা বলার জন্যই এসেছি।
হেডস্যার বললেন, গুড। এবার তোমরা যাও। আমাকে কাজ করতে হবে।
সবাইকে নিয়ে সুজন হেডস্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। তার পরপরই টিফিন পিরিয়ড শেষ হওয়ার ঘণ্টা বাজলো। সবাই দৌড়ে নিজ নিজ ক্লাসরুমে গিয়ে বসলো।

তিন.
স্কুল থেকে ফেরার পথে সুজন সাধারণত হৈ-হল্লা করে ফেরে। কিন্তু আজ যাচ্ছে গম্ভীর হয়ে। কারো সঙ্গে কথা বলছে না। তা দেখে প্রীতি জিজ্ঞেস করলো, তোমার কী হয়েছে ভাইয়া? কথা বলছো না যে?
সুজন বলল, কি বলবো! কিছু ভালো লাগছে না।
প্রীতি বলল, আমারও ভালো লাগছে না। তুমি যখন বলেছিলে আজ শহীদ মিনারের দাবি আদায় না করে ছাড়বে না, তখন ভালো লেগেছিলো। অথচ এবারও আমাদের অন্য স্কুলে গিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করতে হবে।
সুজন বলল, তোরা মন খারাপ করিস না। আমার মাথায় এক বুদ্ধি এসেছে। কাল আমরা স্কুল কমিটির সভাপতির কাছে যাবো। তাকে আমাদের দাবির কথা জানাবো। তোরাও যাবি আমার সাথে।
ফাহিম বলল, যেতে বললে যাবো। কিন্তু হেডস্যারকে ডিঙিয়ে স্কুল কমিটির সভাপতির কাছে গিয়েছি শুনলে তিনি দুঃখ পাবেন।
সুজন বলল, আমরা তো যাবো একটা মহৎ অনুরোধ নিয়ে। এতে ছাত্র-শিক্ষক সবারই উপকার হবে। স্কুলের মানও বাড়বে। আমার মনে হচ্ছে না এতে হেডস্যার দুঃখ পাবেন।
কথা বলতে বলতে ওরা দিঘলী বাজারের মোড়ে এসে গিয়েছিলো। এখান থেকে প্রীতি ভিন্ন পথ ধরে- আজও তাই করলো। সুজনের কথা সে শুনেছে কি শোনেনি, বোঝা গেল না।

চার.
স্কুল থেকে ফিরে সুজন খেলতে যায়নি। নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে রয়েছে। তা দেখে মা বললেন, তোর শরীর খারাপ নাকি? শুয়ে আছিস যে?
সুজন বলল, শরীর খারাপ না। তবে মন ভালো নেই। হেডস্যারের সাথে ঝামেলা বেধেছে।
সুজনের কথা শুনে মা চমকে উঠলেন- কি বলছিস এসব? আমি বলে রাখছি, কালই তিনি তোকে স্কুল থেকে বের করে দেবেন।
মায়ের কথা শুনে সুজন হেসে ফেললো- না, তেমন কিছুই হবে না। আসলে কি হয়েছে জানো? তুমি এখানে বসো, আমি বলছি।
মা দুরুদুরু বুকে সুজনের পাশে বসলেন। সুজন মায়ের কাছে সব খুলে বলল। সেসব শুনে মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন- ওহ্, এই কথা! আমি ভেবেছিলাম কি না কি! হাত-পা ঠা-া হয়ে আসছিলো।
সুজন বলল, হাত-পা ঠা-া হওয়ার মতোই কথা! এই যে বললাম হেডস্যার শহীদ মিনার বানানোর কাজটাকে এক বছরের জন্য ঝুলিয়ে রাখলেন, এটা তোমার কাছে সিরিয়াস মনে হচ্ছে না?
মা বললেন, দেখ্ বাবা, আমি অতোসব বুঝি না। তবে এটুকু বুঝি, স্কুল চালাবার জন্য হেডস্যারকে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। সেই নিয়মে হয়তো আছে স্কুল কমিটিকে না জানিয়ে কোনো কাজ করা যাবে না। তো হেডস্যার কী করবেন?
: তাহলে আমরা কি করবো? ফুল হাতে নিয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে আদর্শ বিদ্যালয়ে যাবো?
যা-ই করিস প্রধান শিক্ষকের মনে কষ্ট দিস না। জানিস তো শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করতে হয়।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক তিনি। স্কুলের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব তার। তিনি স্কুল কমিটির সভাপতির সাথে কথা বলে নিশ্চয় পদক্ষেপ নেবেন। তবে তোমাদের উচিত হলো-
বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য কাজ করা। বাংলা যেনো শুদ্ধ হয়। এই শুদ্ধতা বলায় এবং লেখায়।
সুজন অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মায়ের দিকে। ও যেনো নতুন করে মাকে দেখছে। একই সাথে শুনছে মায়ের মুখে বাংলা ভাষা।

Share.

মন্তব্য করুন