রিকশাওয়ালা চাচাকে ভাড়া দিয়ে নেমে পড়লো সাবিত। বাসের দমবন্ধ করা পরিবেশে চার ঘণ্টার একটা জার্নির পর খোলা হুডের রিকশায় বসে শেষ বিকেলের মৃদুমন্দ বাতাস তার মনটাকে বেশ ফুরফুরে করে তুলেছে। এমনিতেই মায়ের কোলে ফেরার আনন্দে মনটা আগে থেকেই হালকা ছিলো তার।
‘আরে সাবিত নাকি?’ হাসিমুখে সাবিতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন এলাকার এক মুরুব্বি।
‘জি চাচা, কেমন আছেন?’ সাবিতও হাত বাড়িয়ে দিলো।
‘মাকে দেখতে বাড়ি এলে বুঝি?’
‘জি চাচা। মা একা থাকেন তো। তাই ঘনঘন আসার চেষ্টা করি।’
‘বেশ বেশ। তোমার মতো ছেলে দুনিয়াতে আর কয়টি আছে বলো?’
‘না না চাচা, এভাবে বলবেন না। আমার থেকে ভালো ছেলে আরও অনেক আছে।’
‘তা হয়তো আছে।’ একটু ভেবে নিয়ে মুরুব্বি চাচা বললেন। কিন্তু তারা হয়তো তোমার চেয়ে বেশি মেধাবী বা বেশি ভদ্র কিংবা ধরো বেশি বেতনে চাকরি করে মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করছে। কিন্তু এই যে সপ্তাহে সপ্তাহে চার ঘণ্টা জার্নি করে মায়ের সাথে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে আসা- না বাবা, এই এক তোমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখি নি এরকম করতে।
‘দোয়া করবেন চাচা।’ লাজুক মুখে বললো সাবিত। এমন সময় চতুর্দিকে মাগরিবের আজান ধ্বনি ভেসে এলো।
পাশের এক মসজিদে ঢুকে নামাজটা পড়ে নিয়েই আবার হাঁটা দিলো সে। মা নিশ্চয় তার পছন্দের তরকারি রেঁধে গরম ভাত নিয়ে বসে আছেন তার অপেক্ষায়। আজ বাস যথেষ্ট লেট করেছে। দ্রুত পা চালায় সাবিত।

২.
‘নারে বাবা, আমি এই চিরচেনা এলাকা থেকে কোথাও গিয়ে শান্তি পাবো না। তা ছাড়া তুই তো সারাদিন অফিসে থাকবি। আমাকে সেখানেও একা একাই থাকতে হবে। তার চেয়ে নিজের বাড়িতেই বাস করা আমার কাছে আনন্দদায়ক হবে।’
মায়ের এ কথার পরে আর কিছু বলতে পারে নি সাবিত। গত বছর গ্রামের অদূরে এই শহরে নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে তারা। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে মাকে নিয়ে সেখানে বসবাস শুরু করলেও হঠাৎ করেই তার চাকরিতে বদলির অর্ডার আসে। অগত্যা তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় দূরে। সাথে মাকে নিয়ে যেতে চাইলেও তার মা কিছুতেই রাজি হননি। সেই থেকে তিনি এই ফ্ল্যাটে একাই থাকেন। সাবিত তার মায়ের একমাত্র সন্তান। তার বাবা ইন্তেকাল করেছেন বেশ কয় বছর আগে। তার মা ছেলের বদলির পরে গ্রামে ফিরে যেতে চাইলেও গ্রামের বাড়িতে সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় আর যাওয়া হয়নি। অবশ্য সাবিত মাকে একা রেখে মনে শান্তি পায় না। প্রতিদিন কয়েকবার মোবাইলে মায়ের খোঁজ নিলেও একটা অপরাধবোধ তাকে সর্বদা তাড়িয়ে ফেরে। তাইতো যতো কষ্টই হোক, প্রতি সপ্তাহেই মাকে দেখতে আসে। এবার মায়ের জন্য বেশ দামি একটা শাড়ি কিনেছে সে। অবশ্য এ কথাটা সে তার মাকে জানায়নি। সারপ্রাইজ হিসেবে রেখে দিয়েছে শাড়িটা। মা যখন লাজুক মুখে শাড়িটা নাড়াচাড়া করবেন তখন তার চেহারাটা কেমন হবে এটা ভেবেই মনে পুলক অনুভব করছে সে। এদিকে কাল তার মা তাকে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এবার বাড়ি এলে একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে সাবিতের জন্য। সেটা যে কি তা কিছুতেই অনুমান করতে পারেনি সাবিত। এজন্যও মনে উত্তেজনা কাজ করছে।

৩.
‘বাবা সাবিত, দরজাটা যে করেই হোক বাইরে থেকেই খুলতে হবে দেখছি।’ চিন্তিত কণ্ঠে বললেন প্রতিবেশী এক মহিলা।
‘নাহ, এমনটা তো কোনদিন হয় না।’ গরমে, ক্লান্তিতে আর টেনশনে ঘেমে উঠেছে সাবিত। প্রতি সপ্তাহে মা তার অপেক্ষায় যেন দরজার পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকেন। একটা ছোট্ট টোকা দিলেই হাসিমুখে ঝটপট দরজা খুলে ফেলেন। আর আজ প্রায় একঘণ্টা ধরে অনবরত ডাকাডাকি আর কলিংবেল টিপেও মায়ের কোন সাড়া না পেয়ে কি করবে বুঝতে পারে না সাবিত। তার ডাকাডাকিতে আশপাশের ফ্ল্যাটগুলো থেকেও প্রতিবেশীরা বের হয়ে এসেছেন।
‘চিন্তা করিস না বন্ধু। আমরা তোর পাশে আছি।’ পাশের বিল্ডিংয়ের সুমন সান্ত¡নার হাত রাখে সাবিতের ঘাড়ে।
সবার পরামর্শে এবং সহযোগিতায় শেষে ফ্ল্যাটের দরজা ভাঙা হয়। পাগলের মতো মাকে খুঁজতে গিয়ে রান্নাঘরে রাইস কুকার ধরে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পায়। রাইস কুকারে তখনো বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া আছে। উ™£ান্তের মতো মায়ের মুখের দিকে তাকায় সে। ছেলেকে বিরাট এক সারপ্রাইজ দিতে পেরে যেন গর্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সাবিতের মা। সেই দৃষ্টির প্রতি একনজর তাকিয়েই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে সাবিত।

Share.

মন্তব্য করুন