মোটে দুই দিন বাকি, আমি লাল শাড়ি পিনদা সাইজা গুইজা শ্বয়োর বাড়ি যামু। হ ভাইজান লাল টকটকা দেইখা একখান শাড়ি আনছে। হেইদিন কত্তমজা অইব। গান বাজনা অইব। বেবাকে নতুন কাপড় পিনদা সাজন কোজন কইরা আমাগো বাড়তে আইব। বড় পাতিল ভইরা পোলাও রানব, মাংস রানব। হ পাতিল ভইরা খির রানব। কতদিন অমন মজার খায়োন খাই না।
ছাগলের বাচ্চাটার গলা জরিয়ে ধরে আপন মনে কথাগুলো বলে যায় রেজিয়া।
হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় বিয়ে হলে অন্য বাড়িতে চলে যেতে হয়।
সে ছাগলের বাচ্চাটার গায়ে হাত বুলায় আর বিড়বিড় করে বলে- আমি চইলা গেলে আমার বুলবুলের কি অইব। অ বুলবুল তুই আমারে ছাইরা থাকবার পারবি। কেডায় তুরে ঘাস খাওয়াইব? নারে বুলবুল আমি তুরে ছাইরা থাকবার পারমু না। মা- আমিতো রাইতে মার গলা জরাইয়া ঘুমাই। বাবায়তো গত বছর মইরা গেল। আমি যে মায়ের গায়ের গন্ধ না পাইলে ঘুমাইবার পারি না। মাতো তা জানে। তয় মা কইছে ঐ বাড়তেও একখান মা আছে। হ্যায় আমারে আদর করব। তেঁতুল খাইতে দিব। আর গাছে উইঠা পেয়ারা খাইলেও কিচ্ছু কইব না।
এত সব কথা ভাবতে ভাবতে রেজিয়া মায়ের কাছে গিয়ে বলে- মাগো আমি তোমারে ছাইড়া যামু না। ঐ ব্যাটাগো তুমি না কইরা দেও। আমি যামু না মা।

নূর ভানু কাজে ব্যস্ত। মেয়ের বিয়ের কত কাজ। মনটাও ভালো নেই। ছোট্ট মেয়েটাকে পরের হাতে তুলে দিতে হবে, এই কথাটি মনে হলেই চোখ দুটো ভিজে উঠছে তার। মনে পড়ে হারানো স্বামীর কথা। এত সবের মধ্যেও মেয়ের কথাটি শুনে সে চমকে উঠে বলে- কি কইলি মা? তুই যাবি না? অমন কতা কয়না মা। বেবাক ঠিক ঠাক অইয়া গেছে। কত দুঃখ কষ্ট কইরা বিয়ার খরচপাতি জোগাড় করলাম। ভাইয়ের কানে য্যান এমন কতা না যায়।
রেজিয়া মায়ের কথা শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ছলছল করে ওর চোখ দুটো। নূর ভানো বুঝতে পারে মেয়ের কষ্ট। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিজেও চোখের জলে ভাসে।
দু’দিন পার হতে বেশি সময় লাগল না।
বিয়ে বাড়ি। নানা কাজে ব্যস্ত সবাই। রেজিয়া চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়। হাঁটতে হাঁটতে সে খেলার সাথি সীমাদের বাড়িতে গিয়ে উঠে। সীমা তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। রেজিয়ার মুখে সীমা সব শুনে বলে- ও, কথাটা তাহলে সত্যি যা শুনেছিলাম। তুই চিন্তা করিস না। আমি আব্বাকে বলে তোর বিয়েটা বন্ধ করার ব্যবস্থা করব। আব্বা আমার সব আবদার পূরণ করেন। একটু দাঁড়া এখনই ব্যবস্থা করব।
সীমা স্কুলে যাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে মা বাবার কাছে অনেক অনুনয় করে অনুরোধ করল। শেষে কান্নাকাটি শুরু করল। গ্রামের মুরব্বিদের কাছে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে বুঝানোর চেষ্টা করল। কোনো লাভ হলো না। রেজিয়া ভাঙা মনে বাড়ি চলে গেল।
সেদিন সীমার স্কুলে যাওয়া, খাওয়া- গোসল কিছুই হলো না। অসুস্থ হয়ে দুদিন বিছানায় পড়ে রইল।

সাত দিন পরে সীমা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে তাই রাস্তা ভেজা। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় দেখতে পায় রেজিয়া শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। সাথে একজন অচেনা বয়স্ক লোক। রেজিয়া একটি সবুজ রঙের সুতি শাড়ি পড়েছে। চপ্পল দুটো হাতে। দু’ চোখ ভরা ছলছলে পানি। সীমা ওকে দেখে কিছুই বলে না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে শুধু। রেজিয়া চলে যায়। সীমা অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকে রেজিয়ার চলে যাওয়া পথে। বুকের মধ্যে কেমন কষ্ট হয় তা কাউকে বলতে পারে না। সে মনে মনে বলে- ছোটদের কত কষ্ট হয় তা বড় মানুষেরা বুঝে না। আমি যদি বড় মানুষ হতাম তাহলে রেজিয়ার বিয়েটা বন্ধ করেই ছাড়তাম। একদিন ক্লাসে স্যার বলেছিলেন- বাল্যবিবাহ শাস্তি যোগ্য অপরাধ। রেজিতো আমার চেয়েও ছোট। ও এখন বালিকা। তাহলেতো এই বিয়েটা বাল্যবিবাহই হয়। ছোট মানুষ দুষ্টুমি করলে বড় মানুষরা কত বকা দেয়। এখন যে তারা কত বড় অন্যায় করল তার কি হবে।
পার হয় একটি মাস। রেজির পায়ের গোড়ালিতে একটি কাল দাগ লক্ষ করে শ্বশুর বাড়ির লোকজন। এক সময় সেই গোড়ালি ফুলে পেকে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। রেজিয়ার গায়ে জ্বর থাকে। অকেজো বউটি শ্বশুরবাড়িতে মহা বিরক্তির কারণ হয়ে উঠে। ফিরে আসতে হয় মায়ের কাছে।

দিন যায় রেজিয়া ধীরে ধীরে আরও বেশি অসুস্থ হয় পড়ে। তরতাজা সুস্থ চঞ্চলা রেজিয়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। চলার ক্ষমতাটাও হারিয়ে ফেলে।
গ্রামের একজন হাতুড়ে ডাক্তার রেজিয়ার চিকিৎসা করেন কিছুদিন।
রেজিয়ার পরিবার ধরেই নেয় তাদের পক্ষে মেয়ের চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। রেজিয়া আর বাঁচবে না এটাই সত্যি।
রেজিয়াও এক সময় বুঝতে পারে সে আর বাঁচবে না। জানি না তখন ছোট মেয়েটির মনের অবস্থার কথা। কতটা কষ্টের কত বেদনার তা বর্ণনা করার সাধ্য নেই আমার।
উঠোনে একটি চটের উপর অসুস্থ রেজিয়া চুপচাপ বসে থাকত। পায়ের মধ্যে জানি না কতটা কষ্ট ছিল। মুখ দেখে মনে হতো ওর কোন কষ্টই নেই। মন এবং শরীরের কষ্ট মিলে ওর বুকের ভেতরে কত কষ্টের পাহাড় জমেছিল জানি না।
সারাক্ষণ চটের উপর বসে থাকত আর মনে মনে বলত- আর কয়দিন পরই আমি আর এই বাড়তে থাকুম না। কবর-, মাটির নিচে ক্যামনে থাকুম জানি না তয় আমার বেজায় ডর লাগে। মাগো তুমিতো আমারে ছাইড়া থাকবার পারই। আর বুলবুলও পারে। আমি- আমি পারি না মা। আমার খুব কষ্ট অয়। তয় আমার কষ্টের কতা আর কমু না। শ্বয়োর ঘরে আমি যাইবার চাই নাই। তোমারে কত কইলাম আমি তোমারে ছাইড়া থাকবার পারি না। আমার চক্কের পানি দেইখাও তোমার মায়া অইল না।
অ লাউ গাছের লকলইক্কা ডগা, আমার আদরের কুমরা ফুল, আমার লাল মুরগিখান, হ তগরেই কইতাছি। আমি চইলা গেলে আমার কথা আর মুনে রাখিস না। আমার খইয়া কইতর আমার লাইগা কান্দিস না। বাক-বাকুম বুইলা আমারে আর ডাকাডাকি করিস না। আমিতো আর ফিরা আমোনা। এইহানে আর বইয়া থাকুম না। মায়ের গলা জড়াইয়া আর ঘুমামু না। ভাইজানগো তোমারে আর আলতা আনতে কমুনা।
জানি না এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ওর চোখে জল এসেছিল কিনা। কেউতো ওকে কাঁদতে দেখেনি।
সীমা দুই একদিন ওকে দেখতে গিয়েছে। কিন্তু রেজি সীমার সাথে কোন কথা বলেনি। শুধু নির্বিকার তাকিয়ে ছিল। সীমা ওর কাছে আর যায়নি। ওর কষ্ট সীমা সহ্য করতে পারে না।
কয়েকদিন পরেই রেজিয়ার মৃত্যুর খবর পেল সীমা।
কবর দেওয়া হলো। বাড়ির আঙিনায় পাশেই। পরিবেশ শান্ত হলো। সীমা তখন কবরের কাছে গিয়ে কবরে হাত বুলায়। চোখের জল মুছে বলে- রেজি তোর উপর যে অবিচার হয়েছে আমি বড় হয়ে তার প্রতিবাদ করব।
স্যার বলেছেন- তোমরা একদিন বড় হবে, তখন সমাজের খারাপ নিয়মগুলো বাদ দিয়ে ভালো নিয়ম প্রতিষ্ঠা করবে। অন্যায়কে কখনো প্রশ্রয় দিবে না। রুখে দাঁড়াবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
স্যারের সেই কথাগুলো মনে রাখব, মনে রাখব তোর কষ্টের কথা, অকালে চলে যাওয়ার কথা। আর সেইভাবে আমাদের সমাজকে গড়ে তুলব। সেই সমাজের লোকজন মা বাবা ছোটদের কষ্ট বুঝতে পারবে। তাদের খুশি রাখবে। তুই খুব ভালো থাকিস রেজি।

Share.

মন্তব্য করুন