আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা। এজন্য বাংলা মাতৃভাষা। আমরা মাতৃভাষাতেই কথা বলি। পড়ি। লেখি। বাংলা ভাষাতেই গান করি। আমরা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। এই বাংলা ভাষার জন্ম সপ্তম শতকে। আজ থেকে প্রায় ১৩শ বছর আগে। সেই সময়ে বাংলা ভাষায় রচিত একমাত্র বই ছিল ‘চর্যাপদ’। অনেকেই বলেন, চর্যাপদের ভাষা পরিপূর্ণ বাংলা ভাষা নয়। পরিপূর্ণ বাংলা ভাষায় রচনা করা প্রথম বই ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। এটি একটি কাব্যগ্রন্থ। কবিতার বইকে কাব্যগ্রন্থ বলা হয়। সে জন্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বইটিকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’ বলা হয়। এই বইটির লেখক ছিলেন বড়– চণ্ডীদাস। তিনি বইটি যখন রচনা করেন; তখন বঙ্গের সুলতান ছিলেন শামসুদ্দিন ইলিয়াছ শাহ। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াছ শাহের অনুপ্রেরণায় বইটি রচিত হয় ১৪ শতকে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য থেকে চর্যাপদ পর্যন্তু দীর্ঘ সময়। প্রায় ৭০০ বছর। এই সাতশ বছর বাংলা ভাষায় বইপুস্তক রচিত হয়নি। যা হয়েছে সংস্কৃত ভাষায়; প্রাকৃত ভাষায় আর অপভ্রংশ ভাষায় মিলেমিশে। বাংলা ভাষা যেমন একটি ভাষা; সংস্কৃতও তেমন একটি ভাষা। প্রাকৃতও একটি ভাষা এবং অপভ্রংশও একটি ভাষা। এই দীর্ঘ সময়টাতে সংস্কৃত ভাষাতেই বইপুস্তক রচিত হয়েছে বেশি। সুলতানি যুগের আগে শোনা গিয়েছিল; বাংলা ভাষাতে বইপুস্তক রচনা করা অন্যায়। সেই সময়ের ব্রাহ্মণরা বলতো, বাংলা ভাষায় বইপুস্তক রচনা করা পাপের কাজ। তারা আরো বলতো, হিন্দুধর্মের বই বাংলা ভাষায় লেখা বা অনুবাদ করা আরো বেশি পাপের। সেজন্য হিন্দু ধর্মের শিক্ষিত মানুষ বাংলা ভাষার বই পড়ত না; বাংলা ভাষা লেখত না। তারা বাংলা ভাষায় পড়াশুনা করাকে নিচু জাতের কাজ বলে মনে করত। বাংলা ভাষায় বইপুস্তক লেখলে মানুষ রৌরব নামক নরকে যাবে। মানুষের অকল্যাণ হবে। এটা তারা মনে করত। অতএব, বাংলা ভাষা তখন ছিল অপুচ্ছ। এ অবস্থা রাজা লক্ষ্মণ সেনের আমল পর্যন্ত চলে এসেছে। লক্ষণ সেনের যুগে লেখা দুটি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। একটি রামাইপণ্ডিত রচিত শূন্যপুরাণ। অন্যটি হলায়ুধ রচিত সেক শুভোদয়া। গ্রন্থ দুটির ভাষাও পরিপূর্ণ বাংলা ভাষা নয়।

রাজা লক্ষ্মণ সেনের পরাজয় ঘটল। বঙ্গের রাজা হলেন ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি। তিনি মুসলমান ছিলেন। তার সাথে আরও মুসলমান বঙ্গে আসলেন। মুসলমানরা বাংলা ভাষার সাথে পরিচিত হলেন। বাংলা ভাষাকে ভালোবাসলেন। বাংলা ভাষাতে যারা কথা বলত তাদেরকেও ভালোবাসলেন। তুর্কি মুসলমানদের ভাষা ছিল আরবি ফারসি। ব্রাহ্মণহিন্দুরা তুর্কিদের সাথে মিশতে গিয়ে দেখল; মুসলমানদের কুরআন হাদিস ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। ফলে ব্রাহ্মণ হিন্দুদের মনে হলো, তাদের ধর্মগ্রন্থ বেদ পুরাণ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা বা লেখা দোষের কিছু নয়। তখন কিছু হিন্দু সাহস করে বাংলা ভাষায় বইপুস্তক লেখার চেষ্টা করল। এদিকে মুসলিম সুলতানরা বাংলা ভাষায় বইপুস্তক লেখাতে উৎসাহ দিলেন। সেজন্যই বড়–চন্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বাংলা ভাষায় লেখতে পেরেছেন।

সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলা ভাষার অনেক উন্নতি করেন। তিনিই প্রথম বঙ্গের সব জনপদ ও অঞ্চলকে একত্রিত করে বাঙ্গালা নাম দেন। তার সহযোগিতাতে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পায়। এরপর গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের উৎসাহে শাহ মুহাম্মদ সগির ইউসুফ জোলেখা কাব্য রচনা করে। বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাসকে জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ সাহস দিয়েছিলেন। রুকুনউদ্দিন বারবক শাহর অনুপ্রেরণায় মালাধর বসু লেখেন শ্রীকৃষ্ণবিজয়। শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহর বদান্যতায় জৈনুদ্দিন লেখেন রসূল বিজয়। এসব বইপুস্তক লেখা হয়েছিল বাংলা ভাষাতে। সুলতানদের প্রচেষ্টায় তখন মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলতে, বই লেখতে, পড়তে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছে। মানুষের মনে ভয় ছিল যে, বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করা পাপ। সুলতানদের আশ্বাসে সে ভয় কেটে গেল। মানুষ আনন্দে গান, কবিতা, গল্প লেখতে পড়তে থাকল। এভাবে সুলতানি যুগ শেষ হলো। প্রায় আড়াইশ বছর বাংলাদেশ সুলতানদের দখলে ছিল। তারপর এদেশে এলেন নবাবরা। তারও মুসলমান ছিলেন। তখন বাংলার স্বাধীন নবাব ছিলেন মুর্শিদ কুলি খান। আর শেষ নবাব ছিলেন সিরাজউদ্দৌলা। সিরাজউদ্দৌলার সময় পর্যন্তু বাংলা ভাষার কদর ছিল। সম্মানও ভালোই ছিল। এবং ইংরেজ আমল পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতি হয়েছিল মুসলমানদের দ্বারা। এরপর ইংরেজরা বঙ্গে আধিপত্য লাভ করল।

ইংরেজদেরকে ব্রিটিশ বলা হয়। এই ব্রিটিশরা বাণিজ্য করার জন্য বাংলাদেশে এসেছিল। বাণিজ্য করতে করতে তারা এদেশের কিছু মানুষকে হাত করেছিল। তখন বাংলাদেশের নবাব ছিলেন সিরাজউদ্দৌলা। ব্রিটিশরা নবাবের সাথে শত্রুতা শুরু করল। এক সময় বিদ্রোহ করল। তারপর ব্রিটিশদের সাথে নবাবের যুদ্ধ শুরু হলো। পলাশীর যুদ্ধ। এ যুদ্ধে নবাবের সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ নবাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। যুদ্ধে নবাবের পরাজয় হলো। ব্রিটিশরা এদেশকে দখল করল। এবার ব্রিটিশরা কৌশলে বাংলা ভাষার পরিবর্তে সেই সংস্কৃত ভাষাতে বইপুস্তক রচনা করতে শুরু করল। সেই সাথে ইংরেজি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করল। হিন্দুরা ব্রিটিশদের সাথে যোগ দিলো। হিন্দু ও ব্রিটিশ মিলে বলতে থাকল বাংলা মুসলমানদের ভাষা। তা চলবে না। এ সময়ও বাংলা ভাষার কদর আবার কমল। ব্রিটিশরা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ভাগে দিয়ে চলে গেল। পাকিস্তান দু’ভাগে ভাগ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান। বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান বলা হতো। পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের ভাষা ছিল উর্দু। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ছিল বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ ঘোষণা করল, উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা। পূর্ব পাস্তিানের মানুষ প্রতিবাদ করল। বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিল করল। সেই মিছিলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পুলিশ গুলি চালাল। বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার শহীদ হলো। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাংলা ভাষার দাবি ছাড়ল না। অবশেষে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হলো। তারপর ভাষাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হলো। সেই দিন থেকে বাংলা ভাষা আমাদের ভাষা। বাংলাদেশ আমাদের দেশ। বাংলা ভাষাকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অনেক চক্রান্ত হয়েছে। এখনো হচ্ছে। আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কেননা, বাংলা ভাষা দুর্বল হয়ে গেলে জাতি হিসেবে আমরাও দুর্বল হবো। আমাদের শক্তি হারাব। একতা হারাব। এমনকি দেশও হারাতে পারি।

Share.

মন্তব্য করুন