পর্ব-০৩

পরদিন-
সুহা চিৎকার করে নানাকে ডাকছে, নানার কোন সাড়া নেই এবার নানুকে ডাকছে, ‘নানু নানু দেখে যাও একটা পাখি রান্নাঘরে ঢুকেছে। নানু-নানু ও নানু….’
সুহা ঠাশ্ ঠাশ্ করে রান্নঘরের দরজা-জানালাগুলো বন্ধ করছে। জানালার সাদা কাঁচ দিয়ে দেখে নানা পুকুরঘাট থেকে ফিরছেন। সুহা মনে মনে খুব খুশি, এবার নানাকে বলবে পাখিটা ধরে দিতে। দোতালার বাথরুমে খিচ্ খিচ্ আওয়াজ হচ্ছে ও বুঝতে পারে নিশ্চয় নানু কাপড় কাঁচছেন। সুহার আম্মুতো দোতলার বারান্দায় শাহানকে রুটি হালুয়া খাওয়াছেন। সুহার আব্বু সেই সকালে গেছেন মাহমুদ নানার সাথে ভুইয়া বাড়িতে এখনো ফিরেননি। দরজা-জানালা আটকে সুহা পাখিটাকে হুশ হুশ করে তাড়াছে। ওর ইচ্ছা পাখিটা ওড়তে ওড়তে হয়রান হয়ে নিশ্চয়ই ধরা দিবে। আজ ওটাকে ধরতে হবে, তারপর সুতোয় বেঁধে রাখবে।
নানা ঘরের কাছাকাছি আসতেই সুহা ডাকে ‘নানা নানা এদিক আস, রান্নাঘরের দিকে।’ নানার হাতে একটা লম্বা কচু। গত রাতে সুহার আম্মু বলেছেন, টান কচু দিয়ে শুঁটকি রান্না করবে। কচুতে প্রচুর আয়রন আর ভিটামিন আছে। ডাক্তার আম্মুকে কচু, কচুশাক, পালংশাক আরো নানান সবুজ শাক-সবজি খেতে বলেছেন।
গত পরশু নানি কচুপাতার ভর্তা করেছেন। নানু সুহাকে বল্লেন, ‘খেয়ে দেখ দারুণ মজা হয়েছে। খেতে বসে সুহা এক চিমটি চেখে নেয়। পরে মজা পেয়ে বলে, নানু আরেকটু দাও না আমাকে।’
শাহানতো ওসব একদম খেতে চায় না। ওতো শুধু আলু তরকারি খায়, এমনকি শাকও খেতে চায় না। আম্মু ভাতের সাথে কচু শাকের ভর্তা একটু মিশিয়ে লালশাকের ঝোল দিয়ে ভাত রাঙিয়ে দেন।
শাহান এক লোকমা মুখে দিয়ে কেমন কেমন করে একবার ওয়াক্ করে, দ্বিতীয়ার ভুলে ভালে খেয়ে ফেলে। আসলে শাহান জানালা দিয়ে দোয়েল পাখিটার ওড়াওড়ি দেখছিল। দোয়েল পাখিটা এ গাছ ও গাছ উড়ে পোকা মাকড় খুঁজছিল। তার সাথিটা এক সময় ফিরে এলো, দুটো পাখিই তুলা গাছের মগডালে গিয়ে বসে। শাহান এবার উঠে গিয়ে বারান্দার গ্রিল ধরে ওদের খুনসুটি দেখছে আর মজা পাচ্ছে।
সুহা, শাহান প্রায় সপ্তাহ ধরে নানাবাড়ি বেড়াচ্ছে। খুব মজা হচ্ছে ওদের। ঘরের ভেতর নানা-নানির কথায় মজা, নানার সাথে বাইরে বেড়াতে গেলে পাখি দেখে, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি গাছ-গাছালি কত্তোকি। গরুর বাছুরটার লাফালাফি ওর খুব দেখতে হচ্ছে হয়। একবার এদিক ছুটে যায়, আবার ফিরে আসে মার কাছে মা তার লেজ শুকে শুকে নিজ বাচ্চা চিনে নেয়। আবার বাচ্চার ঘাড়, পিঠ, জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে আরাম দেয়।
সকাল বেলা নানা লালশাক, বরবটি, মূলা তুলতে খেতে নিয়ে যান সুহা শাহানকে। ওরা লালশাক, ধনে পাতা, পালং শাক তুলতে খুব পছন্দ করে। লালশাকের পাতার লাল রঙ হাতে মেখে শাহান আম্মুকে দেখায়। সুহা লালশাকের আলতা রঙে নিজের পা রাঙিয়ে নেয়।
সুহার আম্মু গ্রামে এসে অনেকটা নিশ্চিন্তে আছেন। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোনো টেনশন নেই। ঢাকায় থাকতে লেখা-পড়া, স্কুল ড্রেস, স্কুলে আনা-নেয়া, রাস্তাঘাটে ভিড়, ধুলাবালি সব কিছু এড়িয়ে গ্রামে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে নির্ভেজাল জীবনযাপন করছেন।
সুহা-শাহান খোলামেলা জায়গা পেয়ে খেলা-ধুলা ছুটাছুটি করছে মনের আনন্দে। এমনকি পুরান বাড়ির অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে। রামিসা, মাওয়া, রিমি, ছাফা ওদের সাথে আমতলায়, জামতলায়, পুকুরঘাটে যাওয়া-আসা, মালা-খোলা নিয়ে মিছেমিছি জোলাভাতি খেলেও আনন্দ পাচ্ছে।
শাহান-সুহা ক’দিন থেকে মা-বাবার মোবাইল নিয়ে টানাটানি করে না, মোটা-পাতলু কার্টুন ছবি দেখাও ভুলে গেছে। ঢাকায় থাকতে মোবাইল গেম, টেলিভিশনে কার্টুন ছবি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতো। মা কত বিরক্ত হতো, বাবা অফিস থেকে ফিরে রাগ করতেন এখন ওসব কিছুই বলতে হয় না। ডাক্তার কতবার বলেছেন ‘মোবাইলে গেমস্ খেলো না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিভি দেখো না, চোখের দৃষ্টি কমে যাবে, মাথার ব্রেন শূন্য হয়ে যাবে।’ হয়েছেও তাই সুহা এখন চশমা ছাড়া পড়তে পারে না, শাহান প্রায়ই চোখ কচলায়, মাঝে মাঝে বলে ‘মাথা ব্যথা করে,’ খেতে বল্লে বলে খাব না। মুখে খাবারের লোকমা না গিলে ফেলে দেয়। এখনতো নানু বলেন, ‘আমার নানুরা মাশাআল্লাহ্ যা দেই তাই খায়, পেট ভরে খায়। মজা করে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়।’
এদিকে নানাতো ঘরে ঢুকেই সুহার ডাকডাকি শোনে। ও বলছে নানা, নানা, চোট্টা পাখিটাকে রান্নাঘরে আটকে রেখেছি। তুমি রান্নাঘরে চুপ করে ঢুকে পাখিটা আমাকে ধরে দাও।
নানা টান কচুটা দরজায় আড়ালে খাড়া করে রেখে বলেন, ‘সুহামনি দরজাটা খোল দেখি কি হয়েছে?
‘নানা চোট্টা পাখিটাকে আটকে রেখেছি, দরজা খুল্লে বেরিয়ে যাবে।’
‘দরজাটা যদি না খোল, আমি ঢুকবো কি করে? একটা কাজ করো পাখিটাকে ঐ পাশে তাড়িয়ে দাও-’
‘জান নানা চোট্টা পাখিটা তোমার পাকা পেঁপেটা ফুটো করে খেয়েছে।’
‘তাই বলো সকালে ডাইনিং টেবিলে যে রেখে ছিলাম সেটার কথা বলছ? এখন দরজা চট্ করে খুলে দাওতো, ওটাতো বুলবুলি, লেজের নিচে লালচে দাগ আছে তাইতো?’
‘একদম ঠিক। কিভাবে দরজা খুলবো, ওটা যদি ফুড়ৎ করে পালায়। নানা নানা রেডি, ওটা ঐদিকে মিটসেফের উপর বসেছে। এই যা, আবার চলে এসেছে এ পাশে। দাঁড়াও আবার তাড়িয়ে দিচ্ছি। আমাকে কিন্তু ধরে দিবে। আমি ওটাকে পালবো। বাজার থেকে একটা খাঁচা এনে দিবে হ্যাঁ’
‘আচ্ছা সে হবে, এখন দরজা খোল।’
সুহা দরজা ফাঁক করতেই নানা রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। বুলবুলিটা উড়ে এসে দরজার ওপরে লাইট হোল্ডারের ওপর বসে।
‘এই দেখ তোমার পাকা পেঁপের কি অবস্থা। পেছন দিকের হলুদ অংশটুকু খেয়ে নিয়েছে চোট্টা পাখিটা।’
‘ওটা যে ওর খাদ্য, ওদের বাইরের খাবার কমে গেছে। আগে অনেক জঙ্গল ছিল, গাছ-গাছালিতে ভরা ছিল গ্রাম, কত রকমের গাছ-গাছালি, আশেপাশের আমরা গাছ কেটে ফেলেছি, জঙ্গল সাফ করে ফেলেছি। এখন ওদের খাবার কমে গেছে। জানতো গাছের নানান জাতের ফল হয় কিছু মানুষ খায় কিছু পশু-পাখি খায়। কত কত রকমের পাখ-পাখালি ছিল আমাদের এলাকায়। সে শত জাতের পাখি হারিয়ে গেছে, খাবার আর আশ্রয়ের অভাবে।’
‘হারিয়ে গেছে। মানে কি বল্লে? সুহার প্রশ্নে কাতরতা, মনটা বিষণœ’
‘কোথাও চলে গেছে, আবার হয়তো মরেও গেছে। পাখ-পাখালি আমাদের পরিবেশের বন্ধু। আমাদের একান্ত আপন। ওরা পোকা-মাকড় খায়, কত সুন্দর ওদের ওড়াওড়ি, ওরা বাসা বানায়, ছানা ফোটায় বলতে পার প্রকৃতির অলংকার। ওরা না থাকলে আমাদের পৃথিবী অসুন্দর হয়ে যেতো। ভাবতে পারো?
‘ওকে ছেড়ে দাও নানা ভাই’-
‘না-না ওটা বেশ সুন্দর পাখি আমি ওকে খাঁচার ভরে পালবো। ওকে কথা শিখাবো-আমাকে ডাকবে-’
‘না-না তা-কি হয়? ওটাকে যে পাখি, মুক্ত আকাশে ওড়ার জন্য আল্লাহ্ পাখি সৃষ্টি করেছেন, তাছাড়া ওর পরিবার পরিজন রয়েছে না। এ পাখিতো ওর পরিবারের অংশ।’
‘পরিবার কি বলছ নানা? মানে আব্বু-আম্মু, ভাই-বোন এসব আছে?’
‘আব্বু-আম্মু ছাড়াও ওর নিজের ছানাও থাকতে পারে। ও যদি স্ত্রী জাতীয় পাখি হয় ওর স্বামী আছে। আর যদি পুরুষ জাতীয় হয়, ওর স্ত্রী থাকতে পারে। ওর ভাই-বোন নিশ্চয় রয়েছে। ধর শাহান তোমার ছোট ভাই। ও যদি অনেকক্ষণ বাইরে থাকে বা কোথাও চলে যায় তখন কি করবে!’
‘কি করবো মানে ওকে খুঁজে আনবো।’
‘তাহলে ঐ দেখ জানালা দিয়ে, কদমগাছে একটা বুলবুলি দেখছ? সুহা তাকিয়ে দেখে সত্যিইতো আরেকটা বুলবুলি কদমের ডালে ডালে অস্থিরভাবে লাফাচ্ছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে-
‘তা হলে এখন কী করবে।’
‘জানালাটা খুলে দেই নানা?’
জানালার এক পাট খুলতেই ফুড়ুৎ করে বুলবুলিটা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে একদম কদম ডালে। সুহা বাইরে এসে লক্ষ্য করছে ওরা একজন আরেকজনকে দেখছে, নড়েচড়ে লাফাচ্ছে, একজন আরেকজনের পালক পরিচর্যা করে দিচ্ছে ঠোঁট দিয়ে। একটু পরেই দু’টি বুলবুলি মনের আনন্দে উড়ে যায় আকাশে। ‘সুহা হায় হায় করে ওঠে। নানাকে বলে, ‘নানা চলে গেল তো!
‘আবার আসবে দেখে নিও।’
‘আচ্ছা নানা, তুমি ওদের ভাষা বোঝ?’
‘না ভাষা বুঝি না, তবে ওদের আচরণ লক্ষ্য করলে অনেক কিছুই বোঝা যায়।’
‘তাই নাকি!’
‘তুমিও বুঝবে। পাখিগুলোর দিকে নজর রাখ এক দুই তিন দিন দেখবে-অনেক কিছু বুঝতে পারবে-’
নানি কাপড় কেচে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখে বন্ধ জানালা এমনকি দরজাও ভেজানো। ওদের দুজনকে রান্নাঘরে দেখে নানিতো অবাক।
নানী পেঁপেটার দিকে তাকিয়ে বলেন ও বুঝেছি; ‘বুলবুলি, আমার বুলবুলিটা এসে খেয়ে গেছে। দরজা জানালা বন্ধ দেখে বলেন, ‘ওটাকে আটকে রাখতে চেয়েছিলে তাই না?’
‘নানি মজা করে বল্লেন, ‘ও দু’টাকে আমি পালন করি। একটা আমার নারী সই, অন্যটা পুরুষ সখা।’
‘নানা নানির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে অভিমানের সুরে বলেন ‘তাইতো বলি আমার প্রতি এতো অবহেলা কেন!’ ওরা তিনজনেই এক সাথে হেসে ওঠে।

পরদিন সকালে-
‘মামনি, মামনি এসব কি রেঁধেছে তোমার আম্মু! এসব আমি খাই কখনো? না না অন্য নাশতা দাও, খাবো না এসব।’ সুহার কথাশুনে শাহানও দাঁড়িয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখে লাল লাল আটার রুটি আর ভাজিটাও যেন কি দিয়ে তৈরি হলুদ-হলুদ! সেও দু’হাত তুলে বলে, ‘নো-নো-নো, আমিও খাবো না। সুহার আম্মু বলেন, ‘এটা তোমার নানার প্রিয় নাশ্তা।, খেয়ে দেখনা কি মজা।’
সুহা ঘরের বাইরে নানার গলার আওয়াজ শুনে বেরিয়ে আসে। নানা কাছে আসলে বলে, ‘নানা তোমাকে সকাল থেকে দেখছি না, কোথায় গিয়েছিলে?’
‘কোথায় গিয়েছিলাম জানতে চাও? তাহলে শোন আমাদের কাচারির মক্তবে। শুক্রবার মক্তবে কিরাত প্রতিযোগিতা হয়। বাড়ির মুরুব্বীরা ছোটদের কিরাত শুনে। সারা সপ্তাহে যা পড়ানো হয় শুক্রবার তা শোনায় আমাদের।’
শাহান দরজার বাইরে এসে বলে, ‘তা হলে তো খুব মজা।’
‘হ্যাঁ মজা, কিরাত শেষে ওদের খেজুর খাওয়ানো হয়। কাল ভোরে ভোরে উঠবে কাচারিতে নিয়ে যাবো। মক্তবে সবার সাথে চাটাইতে বসবে, পড়বে, আনন্দ পাবে। তুমিতো আমসিপারা পড় তাই না শাহান? শহরে তোমরা একা একা পড় হুজুরের কাছে। এখানে এক সাথে সবাই মিলে পড়ে খুউব মজা হয়। আজ কি নাশতা বানালো তোমার নানু? খেয়েছ তোমরা?’
সুহা এগিয়ে এসে বলে, ‘পচা, নানা নানুকে বল কালকের মতো পিঠা বানাতে। নানুর হাতের পিঠা দারুন মজা। খালি খালি লাল আটার রুটি। দেখতেই কেমন! এসব মানুষে খায়?’
‘বুঝেছি, সাথে কুমড়া ভাজি। আসলেই একদম পচা, তাইনা শাহান?’
‘ইয়েস নানা, একদম তাই। ওসব আমি খাই না। তুমি খাও?’
‘তবে কথা একটা রয়ে গেল, তোমরা যে সাদা আটার রুটি খাও, আসলেই সেটা কিন্তু আসল নয়। গমের বাকল মানে লাল খোসাটা ফেলে দিলেই সাদা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য লাল আটাই ভালো। গমের খোসা আমরা গরুকে খাওয়াই, হাঁস-মুরগি খায়। জান, ওরা মিট মিটিয়ে হাসে আর বলে আহ্ মানুষ কি বোকা আসল জিনিসটা আমাদের খাওয়ায় আর ভেতরের সাদা অংশটা আটা করে খায়।’ ‘নানার হাসি খক্ খক্ শব্দ তোলে, সুহা বলে, ‘নানা, এসব কি বলছ?’
নানা ওর চিবুক ধরে আদর করে বলেন ‘তোমার বইয়ের পাতা খোল, পত্রিকার পাতায় দেখ, ওরা বলে পূর্ণশস্য দানা, মানে খোসাটা ফেলে নয়। তোমার, বাবাকে জিজ্ঞেস কর দেখ সে কি বলে।’
সুহা বলে, ‘বাবাও তো সাদা আটা খায়।’
‘হয়তো লাল আটা পাচ্ছে না, নয়তো তোমরা খেতে চাও না, তাও হতে পারে। আমি আস্ত আস্ত গম কিনে বেছে পরিষ্কার করে তারপর কলে ভাঙ্গিয়ে আনি- কোন ভেজাল নেই তাতে। আর মিষ্টি কুমড়াতো শিশুদের উত্তম খাদ্য। তোমাদের ব্রেন গঠনে সাহায্য করে, পেট পরিষ্কার রাখে। ঘরের পেছনের খেতে দেখনি ইয়া ইয়া সাইজের দশ বারোটা কুমড়া শুয়ে আছে।’
হি হি হি সুহা হাসতে হাসতে বলে ‘দেখেছি, ঘুমিয়ে আছে- তাইনা শাহান।’
‘বলতে পার, তবে ওরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বড় হয়, পরিপক্ব হয়। তবে প্রায় সব রকমের ভিটামিন ধারণ করেই ওরা শুয়ে থাকে বা ঘুমিয়ে থাকে। তাছাড়া তোমার নানুর হাতের লাগানো গাছ-মিষ্টি মিষ্টি…’
‘শাহান খিক খিক করে হাসতে হাসতে বলে, রসগোল্লা একদম তাই না নানা?’
‘নানা এবার জোরে শোরে বলেন, ‘ঠিক বলেছ তোমার নানুর মাতৃ ভাণ্ডারের মিষ্টান্ন, কই শুনছ, ওদের ডিমভাজি করে দাও। আমিও তোমাদের সাথে বসবো। দেখবে কেমন মজা করে রুটি, কুমড়ো, ডিম দিয়ে মজা করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। তোমরা তৈরি? আমি পুকুরঘাট থেকে হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে আসি।’
নানার পিছু পিছু শাহানও পুকুর ঘাটে যায়। রান্না ঘর থেকে সুহার চিৎকার শোনা যায়, ‘নানু নানু, ডিম ভাজিটা নিয়ে গেল দোয়েল পার্খিটা।’
নানু ডাইনিং টেবিল থেকে ফিরে আসেন, ‘পুরোটাতো নিতে পারেনি একটু ছিড়ে নিয়ে গেছে। ওরা প্রায়ই মাংস মাছ, তরকারি এটা ওটা এক জানালা দিয়ে ঢুকে অন্য জানালা দিয়ে নিয়ে যায়। আমি ওদের আদর করি, ওরা আমার নিকটতম প্রতিবেশী। যেমন বুলবুলিকে কলা, পেঁপে ঝুলিয়ে দেই জানালার পাশে, ওরা মজা করে খায়, আমার দিকে ঘাড় কাত করে তাকায়, আমাকে ভালোবাসা দেয়।’
সুহা বলে, ‘বুঝেছি, ওগুলো তোমার পোষা পাখি, তাহলে খাঁচায় পুরে রাখ না কেন!’
নানু বলেন, ‘ওরা মুক্ত আকাশে ওড়ার জন্য আল্লাহ্ ওদের সৃষ্টি করেছেন। মুক্ত পাখিকে খাঁচায় বন্দি করা অন্যায়। নানা বাইরে হাঁক মেরে কালুকে ডাকেন। ‘কালু বাইরে বিছানাটা বিছিয়ে দে, ওদের নিয়ে শীত সকালের রোদে নাশ্তা করবো।’
কালু ছুটে এসে ঘর থেকে শীতল পাটিটা নিয়ে ভৌ দৌড়। নানু ওকে থামায়, ‘শোন শোন চাদরটা নিয়ে যা পাটির ওপর বিছিয়ে দিবি। শীতল পাটিতো একদম ঠাণ্ডা।’
সুহার আম্মু এক বাটিতে কুমড়ো ভাজি, প্লেটে রুটি আর ডিম ভাজি নিয়ে উঠানের দিকে যায়। সুহার আম্মু মজা করে বলে আমিও তোমাদের সাথে বসবো। যেমন ছোটবেলার বাবার সেই মেয়েটি হয়ে।’
বাহ্ বাহ্ বলে, নানা হেসে ওঠেন। তাইতো, তাহলে আকেজন বাকি থাকে কেন! নিয়ে এসো তোমার মাকে, সবাই মিলে রোদভোজন হয়ে যাবে।’
নানার হাসি দেখে সুহা আর শাহান যেন কাতুকুতু নিয়ে হাসির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। শাহান ছুটে গিয়ে নানুর আঁচল টেনে নিয়ে আসে। নানু কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছে।
নানা বলেন, ‘আরে জীবনটাকে নিয়ে মজা করতে হয়, মন ভালো থাকে। হজমি শক্তি বেড়ে যায়।’ আবার এক পশলা হাসি দিয়ে নানা বলেন ‘কালু তোর নানুর জন্য একটা মোড়া নিয়ে আয়, তিনি তো আর আমাদের মতো নন। লেপ্টে বসতে পারেন না। কত বলি একটু আধটু ব্যায়াম কর, শুনে না। সুহা এবার হাসির মাত্রা বাড়িয়ে খক্ খক্ করে হেসে ওঠে।
শাহান প্রশ্ন করে, ‘কেন নানা?’
‘তোমার নানুর এই ব্যথা, সেই ব্যথা, এই ধরা, সেই ধরা কিন্তু ধরা-ধরিতে তো কাউকে কখনো দেখলাম না হে। দাও দাও তাড়াতাড়ি খাবার বেড়ে দাও, বেশ খিদে লেগেছে।’
কালা আর ধলা বাড়ির কুকুর দুটো অন্য বাড়ির একটা কুকুরকে তাড়া করে সীমানা ছাড়া করে ফিরে আসে। ওরা একটু দূরে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে তারপর সামনের পা দুটো গেড়ে বসে। নানা ‘কালা, ধলা নে ’বলে দুটো রুটি ছুড়ে দেন ওদের দিকে ওরা খপ করে রুটি দুটি ধরে খেতে থাকে।
উঠানের কোনায় লিচু গাছে দুটো টুনটুনি এ ডালে ও ডালে লাফালাফি করছে। শাহান তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। পাশের বাঁশের খুঁটায় একটা দোয়েল উড়ে এসে বসে। সুহার নজরে পড়তেই বলে, ‘ঐ যে পাজিটা।’
নানু কৃত্রিম রাগ টেনে বলেন, ‘সুহামনি ওদের পাজি বলবে না। বলি নাই ওরা আমার বন্ধু-প্রতিবেশী।’
‘হ্যাঁ’ তাইতো বলেছিলে, সরি নানুমনি।’ এবার নানা গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘জানতো দোয়েল আমাদের জাতীয় পাখি, ওদের বকা দিলে অবমাননা হবে বলে দিলাম।’
‘কী অবমাননা নানা?’ শাহান প্রশ্ন করে-
‘এই ধর যে অবহেলা, অমর্যাদা। তবে এর জন্য আইন হওয়া উচিৎ কী বল তোমরা?’
সুহা এবার নানুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘নানু কুমড়া না খেলে কি হবে, বল না?’
‘কুমড়া না খেলে আমার অবমাননা হবে। আমার অবমাননা হলে কাল মজার পিঠাতে কিন্তু লবণ বেশি দিয়ে দেব।’
‘না না তা করোনা, আমি তো খাচ্ছি। শাহানের কথা শুনে সুহাও বলে আমিও খাচ্ছি। বেশ মজা হয়েছে।
‘শোন তোমার বাবা বলেছেন যাওয়ার সময় চারটা কুমড়া নিয়ে যাবে। কি তোমরা মজা করে খাবে তো?
নানুর কথা শুনে একটু ভাবনায় পড়ে সুহা, ‘তাই বলেছে বুঝি! তবে একটা কথা আম্মুকে বল তোমার মতো মজা করে রাঁধতে হবে।’
‘ঠিক আছে, আজই আমি শিখিয়ে দেব।’
‘নানা খাবার প্রায় শেষ করে এনেছেন, ওদের শুনিয়ে বলেন, ‘খাবার দেখে কখনো ইশ্ খাবো না, ভালো হয়নি, এসব বলবে না। তোমরা জান এ দেশের তিন কোটি মানুষ এখনো দুবেলা খেতে পায় না। আল্লাহর শোকর আদায় কর, আল্লাহর কাছে রিজিক বৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করো, ওদের জন্য দোয়া কর। যারা তোমার আমার খাবার প্রস্তত করার জন্য রোদ বৃষ্টিতে খেত-খামারে কাজ করছে। খাবার শেষে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর বল, আলহামদুল্লিাহ্।’ [চলবে]

Share.

মন্তব্য করুন