কবি আল মাহমুদের নামটি তোমরা নিশ্চয় শুনে থাকবে। এবং জেনেও থাকবে যে আল মাহমুদ একজন বাংলাদেশের এবং বাংলা ভাষার বড় কবি। হয়তো কেউ কেউ তাঁর কোনো কোনো কবিতাও পড়ে থাকতে পারো। আবার কেউ কেউ কবিতা পড়ে যদি ভালো লেগে যায় তা হয়তো মুখস্থও করে রেখেছো। মজার কথা হলো আল মাহমুদের এমন অনেক কবিতা আছে যে কবিতাগুলো পড়লে তোমাদের ভালো লেগে যেতে পারে। আর তোমরা সেগুলোকে বারবার পড়ে মুখস্থ করে ফেলেছো অথবা মুখস্থ করবে। যেমন তাঁর একটি কবিতা আছে-
আম্মা বলেন পড়রে সোনা
আব্বা বলেন মনদে
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে।
আমার কেবল ইচ্ছে করে
নদীর ধারে থাকতে
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।
এই কবিতাটি অনেক অনেক সুন্দর একটি কবিতা। অনেক অনেক মজারও এই কবিতাটি। আম্মার কথা আব্বার কথা আবার কাঁঠাল চাঁপা ফুলের মিষ্টি সুবাসের কথা কবি খুব সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন এখানে। ছোট্ট মনে লেখাপড়ায় মন বসে না। কিন্তু আব্বা আর আম্মা মন দিয়ে পড়তে বলে। তখন ছোট্ট মনে কাঁঠাল চাঁপার সুবাস ভেসে ওঠে। লেখাপড়া রেখে কাঁঠাল চাঁপার গন্ধ নিতে বনের ভেতর ছুটে যায় মনটা। আহা কি সুন্দর কথার কবিতা গো।
তোমাদের কেমন মজা লাগছে! নিশ্চয় অনেক মজা লাগার কথা। আমার বিশ্বাস তোমরা মজায় মজায় কবিতাটা মুখস্থ করেই নিয়েছো হয়তো। কবিতা মুখস্থ করা খুব ভালো কাজ। কবিতা মুখস্থ করলে মন ভালো থাকে। মনের মধ্যে একরকম ফুরফুরে ভাব খেলা করে।
তাই তোমরা কবিতা মুখস্থ করতে পারো।
এই কবিতার আরেকটু অংশ পাঠ করে দেখো আরও কেমন মজা আছে এখানে। কবি লিখেছেন-
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়
দুধ ভরা ওই চাঁদের বাটি
ফেরেশতারা উল্টায়!
তখন কেবল ভাবতে থাকি
কেমন করে উড়বো
কেমন করে শহর ছেড়ে
সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো।
আহা আহা কী মজার কথা! কী সুন্দর করেই না কবি লিখেছেন কবিতার এই লাইনগুলো। পড়লে মনে হয় সত্যিই যেনো গভীর রাতে আকাশের পূর্ণিমার চাঁদটি গোলগাল দুধের একটি মস্ত বাটি। আর সেই বাটি থেকে দুধের রঙের মতো সাদা সাদা জোসনা সারা জগতে ঝরে ঝরে পড়ছে। আর গভীর রাতে সেই দুধের বাটিটা উল্টিয়ে খুলে দিচ্ছে ফেরেশতারা। আর এসময় কবির মনটা পাখি হয়ে উড়ে উড়ে যেতে চায় গ্রামের বিশাল সবুজ বনের কাছে। শহরের ওই ইট পাথরের সীমানা ছাড়িয়ে সবুজ গাছগাছালিতে ভরপুর গ্রামের ছায়া ঢাকা মায়াময় শ্যামল পরিবেশ হলো কবির খুব প্রিয়। তাই কবি মাঝরাতে চাঁদের সুন্দর আলোর খুশিতে শহর ছেড়ে চলে যেতে চান গ্রামের সেই মায়াময় পরিবেশের কাছে। কিন্তু আবার গ্রামে গিয়েও এক জায়গায় বসে থাকবেন না তিনি। বরং পাখির মতো উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে সারা গ্রামে বেড়ানোর ইচ্ছে পোষণ করেন।
তোমরা নিশ্চয় জানো আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের একজন অনেক বড় কবি। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার সবুজ ঘেরা মোড়াইল গ্রামে। তাঁদের বাড়ির নাম হলো মোল্লা বাড়ি। তাঁর পূর্বপুরুষেরা অর্থাৎ তাঁর দাদা, দাদার বাবা, তার বাবা, তার বাবা এরা সবাই ছিলো আতর বা সুগন্ধির ব্যবসায়ী। আল মাহমুদের বাবাও ব্যবসা করতেন। তবে তাঁর ব্যবসা আতর বা সুগন্ধির ছিলো না। তাঁর ব্যবসা ছিলো কাপড়ের। কাপড়ের ব্যবসায়ী হলেও কবির বাবা ছিলেন অত্যন্ত বিজ্ঞ একজন মানুষ। ছিলেন ভদ্র নম্র এবং ধার্মিক প্রকৃতির। আল মাহমুদের মাও ছিলেন খুব খুব ধার্মিক।
আল মাহমুদের গ্রাম ছিলো একেবারে খুব সবুজে ছাওয়া। এবং গ্রামের বাড়িটা ছিলো প্রাকৃতিক গাছপালা দিয়ে একেবারে ঘেরা। নানান রকম বৃক্ষ লতা পাতা আর নাম না জানা গাছগাছালি ও ফুল এবং ফলে ভরা। কত রকম পাখির ডাক ছিলো সেই গাছগাছালির ডালে ডালে। আল মাহমুদ পাখির ডাক শুনতেন একা একা। এসব গাছগাছালির বনে বনে ঘুরে বেড়াতেন সেই ছোটবেলায়। পাখি ধরার চেষ্টা করতেন অনেক। পাখির পিছে পিছে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে সকাল গিয়ে দুপুর হয়ে যেতো টেরই পেতেন না তিনি। কখনও কখনও দুপুর শেষে বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যেতো। তবুও পাখির পিছু ছাড়তেন না তিনি। পাখির পিছে ঘুরে বেড়ানো আর আর বনের গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায় ঘোরাঘুরি করা ছিলো আল মাহমুদের ছোটবেলার সবচেয়ে প্রিয় কাজ।
আবার রাতের বেলা চাঁদের আলোতে খোলা মাঠে ঘুরতেন দৌড়াতেন একা একা। আকাশে অগণন রূপালি তারার মেলায় তিনি তারা দেখতেন। তারাদের দিকে চেয়ে চেয়ে অনেক রাতও পার করে দিতেন।
পরে যখন তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন এবং কবি হয়ে গিয়েছিলেন তখন তিনি তাঁর জীবনের এসব কিছু কবিতায় লিখেছেন খুব সুন্দর করে। একটি কবিতায় লিখেছেন-
একটু ছিলো বয়স যখন ছোট্ট ছিলাম আমি
আমার কাছে খেলাই ছিলো কাজের চেয়ে দামী।
উঠোন জুড়ে ফুল ফুটেছে আকাশ ভরা তারা
তারার দেশে উড়তো আমার পরান আত্মহারা।
জোসনা রাতে বুড়িগঙ্গা তুলতো যখন ঢেউ
আমার পিঠে পরীর ডানা বিছিয়ে দিতো কেউ।
দেহ থাকতো এই শহরে উড়াল দিতো মন
মেঘের ছিটার ঝিলিক পেয়ে হাসতো দু’ নয়ন।
তারায় তারায় হাঁটতো আমার ব্যাকুল দুটি পা
নীল চাঁদোয়ার দেশে হঠাৎ রাত ফুরাতো না।
আহা কী সুন্দর করে কবিতায় প্রাকৃতিক এবং রাতের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। আবার কবিতার ভেতর ভাষার কী সুন্দর কারুকাজ। কী সুন্দর করে মনের মাধুরী মিশিয়ে বর্ণনা দিয়েছেন। কম বয়সে অর্থাৎ কিশোর বয়সে কবি ছোট্ট ছিলেন ঠিকই। কিন্তু এসময় কবির মনে কত জল্পনা কল্পনা ছিলো যা কবিতা হয়ে বেরিয়ে আসলো কবির কলম থেকে। আকাশে উড়ে যাওয়ার কল্পনা বা তারার দেশে হাঁটতে থাকার কথা সত্যি অবাক হওয়ার মতো।
আল মাহমুদের বাড়ির কাছেই ছিলো রেল স্টেশন। কখনও কখনও অনেক রাতে রেল স্টেশনে তিনি চলে যেতেন। গিয়ে গভীর রাতে যাত্রীদের ওঠানামা দেখতে থাকতেন।
একসময় কবিতা লেখা শুরু করে দিলেন তো দিলেন। ভাষা আন্দোলনের সময় লিখলেন ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটি কবিতা। এই কবিতা ছাপা হওয়ার পর পুলিশের চোখে পড়ে গেলেন তিনি। ফলে পালিয়ে পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে নানান জায়গা ঘুরে তিনি চলে এলেন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। ঢাকায় এসে অনেক কবিতা গল্প উপন্যাস লিখে পেয়ে গেলেন অনেক খ্যাতি।
লিখেছেন-
নোলক কবিতার মতো কবিতা।
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেলো শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।

Share.

মন্তব্য করুন