আদিল ক্লাস থ্রির নিয়মিত ছাত্র। তোমাদের মতো সেও খুউব ভালো। মা-বাবার কথা শোনে। দুষ্টুমি করে না। মা-বাবাকে জ্বালাতন করে না। আদিল নিয়মিত ইশকুলে যায়। মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করে। শিক্ষকদের পড়া শোনায়। ইশকুল ছুটি হলে অযথা কোথাও সময় নষ্ট করে না। সোজা বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে হোমওয়ার্ক করে।
আদিল প্রতিদিনের মতো আজও ইশকুল ছুটি হবার পর সোজা বাসার দিকে আসতে ছিলো। কিন্তু হঠাৎ আদিল একটি পাখি দেখে থমকে দাঁড়ালো। পায়ে পায়ে ও পাখিঅলার কাছে গেলো। পাখিঅলার খাঁচার ভেতর একটি পাখি আদিলকে দেখে বলতে লাগলো, ময়না কথা কয় না। ময়না কথা কয় না। আরে আশ্চর্য! পাখি কথা বলছে। পাখির কথা শুনে আদিল আনন্দে মেতে উঠলো। পাখি কথা বলতে পারে, ও আগে জানতো না। কি মজা, কি দারুণ! আদিল নেচে উঠলো।
আদিল বাসায় এসে বাবাকে বললো, আচ্ছা বাবা, পাখিরাও কি আমাদের মতো কথা বলতে পারে?
বাবা আদিলের মাথা হাত বুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, পাখিরাও কথা বলতে পারে। কিন্তু পাখিদের কথা শেখাতে হয়। তাহলেই তারা কথা বলতে পারে।
আদিল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে উসখুস করতে করতে বললো, আচ্ছা বাবা, সব ধরনের পাখিকে যদি কথা বলা শেখানো হয়, তাহলে কি তারা কথা বলতে পারবে?
বাবা বললেন, সব ধরনের পাখি তো কথা বলতে পারে না। আদিল বাবার আরো কাছে এসে বললো, তাহলে কোন কোন পাখি কথা বলতে পারে? বাবা ললেন, টিয়া, ময়না, ঘুঘু, শালিক… এই পাখিদের কথা বলা শেখালে তবেই তারা কথা বলতে পারবে।
পাখিদের কথা শোনার জন্য আদিলের মন উড়ু উড়ু করতে লাগলো। তার যেনো এখন একটাই হবি, পাখিকে কথা বলা শেখানো। পাখির কথা শোনা। তাই আদিল বাবার কাছে বায়না করে বসলো, বাবা, ও বাবা আমায় একটা ময়না পাখি কিনে দাও না। আমি ময়নাকে কথা বলা শেখাবো। ময়না পাখি কথা বলা শিখে গেলে আমার সাথে কথা বলবে। কত্তো মজা হবে।
বাবা বললেন, বাবা আদিল, পাখি কেনা ভালো নয়। পাখিদের বন্দী করে রাখা গর্হিত কাজ।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। আদিল বাবার বারণ না শুনে জেদ ধরে রইলো। সে মুখটা ভোঁতা করে বসে থাকলো। মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে না আদিল। ঠিক মতো খায় না। শেষমেশ আদিলকে খুশি করতে বাবা একটা ময়না পাখি কিনে আনলেন। আদিল খাঁচায় বন্দী একটা ময়না পাখি দেখে হু হু করে হেসে উঠলো। বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। সে ময়না পাখি পেয়ে ভারি খুশি।
আদিল ইশকুল থেকে এসেই ময়না পাখিকে কথা শেখাতে বসে যায়। ময়না পাখিকে বলে, এই পাখি আমার সাথে সাথে বলো, ময়না কথা কয় না। ময়না কথা কয় না। এভাবে আদিল এক সপ্তাহ ময়না পাখিকে কথা বলা শেখালো। কিন্তু ময়না পাখি একটা কথাও শেখেনি। আদিল ময়না পাখিকে কথা বলতে বললে ময়না পাখি উল্টো আদিলের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তাতে আদিলের ভীষণ রাগ চড়ে যায়। সে আবার বাবার কাছে গিয়ে বললো, বাবা, ময়না পাখি তো কথা বলে না। আদিলের কথা শুনে বাবা হেসে দিয়ে বললেন, বলবে, ময়না পাখি কথা বলবে। তবে আরো দেরিতে। ময়না পাখির সামনে বারবার কথা বলতে হবে। তুমি ময়না পাখির সামনে তার নাম ধরে ডাকবে। দেখবে হঠাৎ একদিন ময়না তোমার সাথে কথা বলছে।
আদিল ময়না পাখির সামনে ঘুরে আর বলে, ময়না কথা কয় না। আদিল ময়না পাখিকে খেতে দেয় আর বলে, ময়না কথা কয় না। কিন্তু তবুও ময়না পাখিটা কোনো কথা-ই বলে না। এভাবে কিছুদিন কেটে গেলো। ময়না পাখিকে আদিল কোনো কথা বলা শিখাতেই পারলো না। তবুও আদিল আশা ছাড়েনি। সে ময়না পাখিকে কথা বলা শেখাবেই, শেখাবে।
আদিল ইশকুলে যায়। বাসায় এসে হোমওয়ার্ক করে। ময়নাকে কথা বলা শেখায়। এভাবে কেটে গেলো আরো কিছুদিন। তবুও ময়না পাখিটা একটা কথাও শেখলো না।
একদিন ইশকুলে বাংলা স্যার বললেন, আগামীকাল তোমাদের ইশকুল বন্ধ।
আদিল ক্লাসে দাঁড়িয়ে বললো, কিসের বন্ধ স্যার। স্যার বললেন, আগামীকাল বাংলা ভাষা দিবস। আদিল আবারো বললো, আচ্ছা স্যার ভাষা দিবস কী?
এবার স্যার বলতে লাগলেন, আমাদের বাংলাদেশটা একসময় পূর্ব পাকিস্তান ছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের উপর অত্যাচার করতো। তাদের ভাষা ছিলো উর্দু। আমাদের ভাষা বাংলা। তাই তারা আমাদের উপর উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রভাষা উর্দু করতে চাইলো। এবং তারা আমাদের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করলো। ১৯৫২ সালে আমাদের দামাল ছেলেরা এর প্রতিবাদ শুরু করলো। আমাদের মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা রক্ষার্থে ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে দামাল ছেলেরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে দিলো। তখন পুলিশ বাহিনী তাদের উপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়লো। পুলিশের গুলিতে শহীদ হলো সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকে। এভাবেই আমাদের বাংলা ভাষা অর্জিত হয়ে ছিলো। এজন্য প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখে আমাদের মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। শুধু আমাদের বাংলাদেশেই এই দিবস পালিত হয় এমন নয়, বরং পৃথিবীর জুড়ে এখন আন্তর্জাতিক হিসেবে মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়।
স্যার দীর্ঘ বক্তৃতা দেয়ার পর সবাইকে বললেন, তাহলে তোমরা বুঝেছো আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা কিভাবে পেলাম? ভাষা দিবস কী বোঝেছো? ক্লাসের সবাই বললো, জি, স্যার।
আদিল শুধু এতোটুই বুঝেছে যে, বাংলা ভাষা অর্জন করতে অনেকে পুলিশের গুলি খেয়ে শহীদ হয়েছেন। ব্যস, তার আবারো মনে পড়লো ময়না পাখির কথা। ইশকুল ছুটি হলে আদিল এক দৌড়ে বাসায় আসলো। বসে পড়লো তার ময়না পাখিকে নিয়ে। কথা বলা শিখাতে লাগলো- ময়না কথা কয় না, ময়না কথা কয় না। ময়না সত্যি সত্যিই এখনো কথা বলেনি। আদিল সারাদিন ময়নাকে কথা বলা শেখানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ময়না এখনো কোনো কথা বলা শেখেনি। উল্টো ময়না পাখি আদিলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আদিল ময়না পাখির উপর রাগ করে রাতে ঘুমোতে গেলো। ঘুমালো আদিল।
আদিল এবার ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখলো তার ময়না পাখি কথা বলা শিখে গেছে। কি মজা, কি মজা! আদিল আনন্দে যেনো আধখানা। এবার সে লক্ষ্য করলো, ময়না পাখিটা তাকে বলছে, আদিল তোমাদের ভাষা বাংলা। তোমাদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলো। তারা তোমাদের উপর জুলুম-নির্যাতন করেছিলো। কিন্তু তোমাদের কিছু দামাল ছেলেরা নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়ে বাংলা ভাষাকে অর্জন করেছিলো। এক কওম-জনগোষ্ঠীর ওপর অন্য কওম-জনগোষ্ঠীর ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তোমাদের বাংলা ভাষাকে বিলুপ্ত করে তাদের উর্দু ভাষাকে তোমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলো, যা খুউব অন্যায়।
ময়না পাখি আদিলকে আরো বলতে লাগলো, আদিল, তুমি এটা ভেবে দেখেছো কি? আমরা পাখির জাত। আমাদেরও নিজস্ব ভাষা আছে। আমরাও আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলি। আমরা একে অপরের সঙ্গে আমাদের মাতৃভাষায় গল্পে মেতে উঠি। আমরা স্বাধীন হয়ে উড়তে ভালোবাসি। যেথায়-সেথায় আমরা মনের আনন্দে, দুই পাখা প্রসারিত করে, স্বাধীন হয়ে উড়াই আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু তোমরা মানুষ আমাদের স্বাধীনতাকে হরণ করো। আমাদের উপর অত্যাচার করো। আমাদেরকে খাঁচায় বন্দী করে রাখো। আমরা নিরীহ বলে আমাদের মায়ের ভাষার ওপর তোমাদের ভাষাকে চাপিয়ে দিয়ে দাও। এটা কি অন্যায় নয়, অত্যাচার নয়? পশ্চিম পাকিস্তানিরা তোমাদের উপর তাদের উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ায় তোমরা বিক্ষোভ মিছিল করেছিলে। কিন্তু আমরা তো নিরীহ। আমাদের তো বিক্ষোভ মিছিল করার শক্তি নেই। নেই সামর্থ্য।
ময়না পাখিটার চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ময়না পাখিটা কাঁদতে কাঁদতে আবার বললো, তোমরা মানুষ। তোমরা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। কিন্তু তোমরা আমাদের নিরীহ পেয়ে আমাদের স্বাধীনতা হরণ করো। আমাদেরকে ছোট্ট একটি খাঁচায় বন্দী করে রাখো। জোর করে তোমাদের ভাষা আমাদের ওপর চাপিয়ে দাও। কেনো, বলতে পারো? ময়না পাখিটা এবার হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলো।
আদিলের ঘুম ভেঙে গেলো। মোরগ ডাকা ভোরে। আদিল তার স্বপ্নের কথা ভেবে মনটা খুব খারাপ করে নিলো। মনে মনে ভাবলো, সত্যি-ই তো। আমি ময়না পাখিকে খাঁচায় বন্দী করে রেখেছি। তাকে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বাংলা ভাষা তার ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছি! এটা তো ঠিক নয়। তারও তো ভাষা আছে। তার মাতৃভাষা আছে। সেও তো মাতৃভাষায় কথা বলতে চায়। গতকাল বাংলা স্যার বলেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর জুলুম নির্যাতন করেছিলো। তাদের উর্দু ভাষাকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলো। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকে শহীদ হয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর অনেক অন্যায়-অত্যাচার করেছিলো।
আদিল এসব ভাবতে ভাবতে খাঁচাতে বন্দী ময়না পাখির কাছে গেলো। এবার সে ময়না পাখিকে বললো, ময়না পাখি, তুমি স্বপ্নে আমাকে যা বলেছো একদম ঠিক বলেছো। আমি তোমার প্রতি অনেক অন্যায় করেছি। আমি আমার বাংলা ভাষা তোমার ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। যেমনটা চেয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর। আমি ভুল করেছি। আমায় ক্ষমা দিয়ো। আজ ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ। আমাদের মাতৃভাষা দিবস। তোমারও মাতৃভাষা দিবস। এই মাতৃভাষা দিবসে আমি আর তোমাকে জোর করে আমার বাংলা ভাষা শিখাবো না। তোমাকে এই ছোট্ট খাঁচায় বন্দী করেও রাখবো না। আজ আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো। তুমি স্বাধীনভাবে উড়বে। তুমি তোমার মাতৃভাষায় কথা বলবে। তোমার মায়ের সঙ্গে। তোমার পাড়াপড়শিদের সঙ্গে।
আদিল ময়না পাখির খাঁচাটা নিয়ে তাদের বেলকনিতে আসলো। সূর্যের মিষ্টি মিষ্টি রোদ যেনো বেলকনিতে মেলা বসিয়েছে। আদিল সেই মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে খাঁচা থেকে ময়না পাখিটা বের করলো। দু’হাতে ধরে ময়না পাখিকে একটা চুমু দিয়ে দু’হাত ছেড়ে দিলো আদিল। ময়না পাখি তার মাতৃভাষায় চিঁ চিঁ করতে করতে ফুড়ুত করে উড়াল দিলো। আদিল মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো ময়না পাখির উড়ন্ত দুই ডানার দিকে। ময়না পাখি উড়ে গিয়ে বসলো আদিলদের সামনের বিল্ডিংয়ে। তাকালো আদিলের দিকে। কিছুক্ষণ। যেনো আদিলকে ময়না পাখি ধন্যবাদ জানালো। এবার ময়না পাখিটা উড়ে ওই দূর চলে গেলো। আদিল চেয়েই রইলো।
কিছুক্ষণ পর আদিল সবকিছু তার বাবাকে খুলে বললো। বাবা শুনে খুউব খুশি হলেন। এবং আদিলের কপালে একটা চুমু এঁটে দিলেন।

Share.

মন্তব্য করুন