সততা মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ। জীবনে সততার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বর্তমান সময়ে সৎ মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই বলে অসম্ভব নয়! সততার সুন্দর উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন দু’জন ব্যবসায়ী যুবক। এমন-ই অবাক করা দুটি বিস্ময়কর ঘটনা যা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। তুলে ধরছি দুটি ঘটনা- আজ থেকে দু’বছর আগের কথা। রমজান মাসে খতম তারাবি পড়াচ্ছি। একদিন রাতের বেলা আমার এক মুসল্লির দোকানে গিয়েছিলাম একটি কাপড় ইস্ত্রি মেশিন কেনার জন্য।
সেখান থেকে শখ করে নিজের পছন্দসই একটি মেশিন কিনে আনি। সেটা সুন্দরভাবে টানা দু’বছর ব্যবহার করি। এতে তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। আলহামদুলিল্লাহ।
গেলো সপ্তাহের কথা। হঠাৎ করে আমার ইস্ত্রি মেশিনে সমস্যা দেখা দেয়।
কোনোভাবেই এর সমস্যা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বিদ্যুৎ আসতো না মেশিনটিতে। এরই মধ্যে আমি একদিন সময় করে ইলকট্রনিকস দোকানে নিয়ে যাই। ইলকট্রনিক মেকারকে বললাম- ভাই দেখুন তো মেশিনটির কী হয়েছে! ইলেকট্রিক মিস্ত্রি চেক করে বললেন- এটির সমস্যা হয়েছে। ঠিক করতে দু’শত টাকা লাগবে। এবং আমাকে একদিন সময় দিতে হবে।
বললাম-ঠিক আছে। রেখে দিন। তবে আমার কাছ থেকে একটু টাকা কম রাখবেন। এই বলে আমি চলে এলাম।
দু’দিন পর আমি তার সাথে ফোনালাপ করে দোকানে গেলাম। সেখানে গিয়ে এক অবাক করা দৃশ্যের সম্মুখীন হলাম! আমি যেতেই ভাই হেসে দিলেন। ভেবেছি, নিশ্চয়ই আমার মেশিন তিনি ঠিক করতে পেরেছেন, তাই হাসছেন। আসলে বিষয় তা নয়!
বরং ভিন্ন একটি মজার ব্যাপার রয়েছে। তা হলো, তিনি তার কর্মচারীকে বললেন, ‘হুজুরের ইস্ত্রি মেশিনটি চেক করে দাও।’ সেই কর্মচারী মেশিনটি বিদ্যুৎ সংযোগ দিলেই বাতি জ্বলে ওঠে। আমি খুব খুশি হলাম। পকেট থেকে একশত চল্লিশ টাকা বের করে দিলাম। সে টাকা হাতে নিলো। নিয়ে বললো, ‘হুযুর দুইশত টাকা পুরিয়ে দিন।’
বললাম, রাখেন ভাই! আবার বললেন, দেন পুরাইয়া দেন। আমি আরো দশ টাকা বের করে পঞ্চাশ টাকা পুরিয়ে দিলাম। তখনও সে সেই টাকা নিতে রাজি হলো না!
বরং সে সম্পূর্ণ টাকা আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমি অবাক হলাম! ভাবলাম, সে বোধ হয় রাগ করেছে।
তাই আমার টাকা নিচ্ছেন না। এর মানে তাকে পূর্ণ দুইশ টাকা দিতে হবে। অন্যথায় সে নেবে না। আমি বারবার বলছিলাম, ‘রাখেন ভাই রাখেন। এবারের মতো রাখেন। এই তো প্রথমবার এলাম। সামনে আবারো আসবো ইনশাআল্লাহ। আমাদের সাথে টাকা নিয়ে পীড়াপীড়ি করে কী লাভ! টাকাওয়ালাদের কাছ থেকে টাকা নেবেন। আমরা কি টাকা কামাই করি!’
এই সব কথা বলতে থাকলাম। এসব বলার পরও সে টাকা নিচ্ছেন না। বরং সম্পূর্ণ টাকা আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। বলছেন, ‘টাকা হাতে নেন। এরপর বলছি।
বললাম, আপনার হাতে রেখেই বলেন।
এরপরও সে মানছে না। শেষমেশ সে আমার হাতে টাকা ফিরিয়ে দিলো।’ এরপর বললো, ‘আপনাকে টাকা দিতে হবে না। কারণ আপনার ইস্ত্রি মেশিনটি ঠিক করার দরকার পড়েনি। এটি ঠিকই ছিলো। নষ্ট হয়নি। আমাকে কোনো কাজ করতে হয়নি। তাই আপনাকে টাকা দিতে হবে না। আমি তো অবাক, কী বলছেন এসব!
যেই মানুষটি গত দুদিন আগে তার মিটারে চেক করে বললেন যে, আপনাকে ঠিক করাতে দু’শ টাকা দিতে হবে।
তেমন বড় কোনো সমস্যা নাই। তবে আমাকে ঠিক করতে দু’দিন সময় দিতে হবে। সেই মানুষটিই আজকে কিনা বলছে, আপনার মেশিন ঠিকই ছিলো। কিছু করতে হয়নি। আমি আপনার কাছ থেকে টাকা নেবো কেন?
আমি অবাক হলাম। কারণ আমি তো বুঝতেই পারতাম না এটি ঠিক ছিলো না। চাইলে বিষয়টি গোপন রেখে আমার কাছ থেকে সম্পূর্ণ টাকা নিতে পারতো! কিন্তু তা করেনি।
বরং সে উদারতা এবং সততার পরিচয় দিয়েছে।
বললাম, আপনার সততায় আমি মুগ্ধ!
আপনাকে আমি এই টাকা দিয়ে দিলাম!
সে নিতে রাজি নয়। বললো- ‘নাহ্, হুজুর নিয়ে যান। সমস্যা নাই।’
বললাম, ‘আমি আপনাকে চা খেতে দিলাম।’
এতেও সে নিতে রাজি নয়।
শেষমেশ বললাম, ‘ভাই, আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া ও শুভকামনা রইল। আপনার আচরণে আমি মুগ্ধ!’
এ কথা বলে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
২.

দ্বিতীয় ঘটনাটি অন্যরকম মজার। আমি আখের গুড় কিনতে গেলাম একটি দোকানে। আমরা ভাবি ভালো মানুষ বোধ হয় দুনিয়ার বুক থেকে চলে গেছেন। খারাপ মানুষে ভরে গেছে জগৎ। বিষয়টা এমন নয়। বরং সম্পূর্ণই ভিন্ন। তারই বাস্তবতা আজকের ঘটনাটি। যা আমাদেরকে ভালো মানুষের যথেষ্ট উপস্থিতির জানান দেয়।
যাই হোক- গুড়ের দোকানে গিয়ে গুড় বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম- আখের গুড় কত টাকা কেজি? বললেন, ‘একশত বিশ টাকা।’
আমি ভেবেচিন্তে বললাম ‘চাচা, আমাকে আধা কেজি আখের গুড় দেন। তিনি আমাকে আধা কেজি গুড় দিলেন। আমি পকেট থেকে টাকা বের করে ভুলে এক কেজি গুড়ের দাম একশ বিশ টাকা দিলাম।
আমি যে ভুলে টাকা দিয়েছি দোকানি চাচা কিন্তু বুঝেছেন।
তিনি চাইলে পুরো টাকা নিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং বললেন, ‘আপনি আমাকে বেশি টাকা দিছেন!’
বললাম, কী বলেন!
বললেন, একশত বিশ টাকা দিছেন আপনি!
আমি পকেট চেক করে দেখলাম- সত্যি তো। আমি একশ বিশ টাকাই দিয়েছি তাকে।
আমি ভুল বুঝতে পারলাম যে, আমি আধা কেজি গুড় নিয়ে এক কেজির দাম দিয়ে দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমি তো বুঝতে পারতাম না ভুল যে করেছি। অথচ দোকানি চাচা অল্প টাকার ব্যবসা করে। তবুও লোভ করেন না তিনি। বরং সততার সাথে ব্যবসা করেন। আমার মনে হলো দুনিয়া এদের মতো কিছু সৎ লোকের জন্য টিকে আছে। আমার মনটি খুব ভালো হয়ে গেলো।
আমি তাকে শুকরিয়া ও মোবারকবাদ জানিয়ে টাকা ফেরত নিয়ে এলাম।
এই হলো দু’জন সৎ লোকের দুটি বিস্ময়কর ঘটনা। যা আমাদেরকে সততার সাথে জীবনযাপনের সবক শেখায়। আসুন আমরা সৎ ও সততার সাথে জীবনযাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের তাওফিক দান করুন।

Share.

মন্তব্য করুন