নাকিবের মন খারাপ। এটি বাসার কেউ বুঝতে পারছে না বলে মাঝে মাঝে তার বেশি খারাপ লাগছে। তিন বন্ধু পটল, টগর, রাতুলের সাইকেল আছে; শুধু তার সাইকেল নেই। অন্য দিকে স্বর্ণা, মুনীরা, আফসানা টিফিনে চিংড়ির বিরিয়ানি নিয়ে আসে; শুধু সে নিয়ে যায় রুটি-ভাজি। বাবা বলেছেন, ক্লাসে আবারও ফার্স্ট হলে তাকে সাইকেল কিনে দেবেন। রেজাল্ট দিয়েছে গত সপ্তাহে। যথারীতি নাকিব ক্লাসে প্রথম হয়েছে! বাবা-মা খুব খুশি হলেন কিন্তু সাইকেল কবে দিবেন, বললেন না। অন্য দিকে, মা-কে সে কতবার বলল টিফিনে চিংড়ির বিরিয়ানি নিতে চায় কিন্তু এটি শুনলেই মা কোনো কথা বলেন না!
গতকাল বাবা বললেন, ‘আব্বু, তোমার সাইকেলের কথা আমাদের মনে আছে। চাকরিতে একটু সমস্যায় পড়েছি। খুব তাড়াতাড়িই তোমাকে একটা লাল টুকটুকে সাইকেল কিনে দেব।’ নাকিব অবশ্য কিছুটা বুঝতে পারছে যে তার বাবা-মা খুব কষ্টের মধ্যে আছেন। হয়তো বাবার চাকরি নেই! এসব ভেবে নাকিবের মন আরও খারাপ হয়ে যায়।
আজ স্কুল থেকে ফিরে নিজের ঘরে জানালার সামনে বসল নাকিব। জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখতে থাকল। ভীষণ কড়া রোদ পড়েছে; সঙ্গে বাতাসের প্রবাহ তেমন নেই। মেঘ হলে, ঠাণ্ডা বাতাস বইলে, বৃষ্টি পড়লে ভালো লাগত। নাকিব এসব ভাবছে, হঠাৎ তার ভাবনায় ছেদ পড়ল। একটি টিকটিকি জানালার কার্নিশে বসে নাকিবের দিকে তাকিয়ে হাঁপাচ্ছে।
নাকিবকে ছোট মামা বলেছিলেন, কোনো কথা ঠিক হলে টিকটিকি বলে ‘ঠিক ঠিক’! টিকটিকি ‘টিক টিক’-এর বদলে সত্যিই কখনো ‘ঠিক ঠিক’ বলে কিনা সেটি পরীক্ষা করার ইচ্ছা নাকিবের কখনো হয়নি; তবে টিকটিকির ওপর অন্য একটি পরীক্ষা চালানোর ইচ্ছা নাকিবের আছে। নাকিব বইতে পড়েছে, টিকটিকির লেজ চেপে ধরে রাখলে লেজ ফেলে পালায়! জানালায় টিকটিকি দেখে নাকিবের মনে হলো, এই পুঁচকে টিকটিকির ওপর লেজের পরীক্ষাটি করলে ভালো হয়।
হাঁপাতে থাকা টিকটিকিটির লেজ চেপে ধরল নাকিব। তাকে অবাক করে দিয়ে টিকটিকি কথা বলে উঠল, ‘উহু, লেজ ধরো না বাচ্চা ছেলে! ভদ্রতা শেখোনি?’
নাকিব ভয় পেয়ে গেল। তার নিজের লেজ থাকলে লেজ ফেলে সে-ই পালাত। টিকটিকির লেজ ছেড়ে দিতেই সেটি মনের আনন্দে দুলতে থাকল আর ছন্দে ছন্দে বলল,
‘আমি হলাম মিস্টার টিকটিকি,
ইচ্ছাপূরণ করি ঠিকঠিকই।
তিনটা ইচ্ছা বলো চটপটই,
পূরণ করব আমি ঝটপটই।’
নাকিব এতদিন জানত, চেরাগের দৈত্য ইচ্ছাপূরণ করে কিন্তু এখন তো দেখছে মিস্টার টিকটিকিও ইচ্ছাপূরণ করে! কিন্তু নাকিবের জীবনে অনেক ইচ্ছা; তিনটা ইচ্ছাপূরণ কম হয়ে গেল। তারপরও নাকিব বলল, ‘আমাকে একটা লাল টুকটুকে বাইসাইকেল এনে দাও।’
টিকটিকি জাদুকরের মতো কিসব বলতে থাকল। তার চোখ দুটো হঠাৎ জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে ধপ করে একদম সাদা হয়ে গেল! ঠিক তখনই ঘরের ভেতরে আওয়াজ পেল নাকিব। পেছনে তাকিয়ে দেখে সেখানে লাল টুকটুকে বাইসাইকেল হাজির! খুশিতে লাফাতে ইচ্ছা করছে নাকিবের। মিস্টার টিকটিকির দিকে তাকিয়ে দেখল, তার চোখ দুটো আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
নাকিব খুশি হয়ে দ্বিতীয় ইচ্ছাটির কথা বলল, ‘আমি চিংড়ির বিরিয়ানি চাই।’ মিস্টার টিকটিকি কিসব আওড়াতে শুরু করল; আবারও চোখ দুটো হঠাৎ জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে ধপ করে একদম সাদা হয়ে গেল। তারপর নাকিবের পড়ার টেবিলের ওপর আওয়াজ হলো। সেদিকে তাকিয়ে নাকিব দেখল, বিশাল থালাতে চিংড়ির বিরিয়ানি। বিরিয়ানিতে আছে গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, আরও আছে চিংড়ির মতো দেখতে বিরাট বড় লবস্টার! নাকিব ভীষণ খুশি হলো।
মিস্টার টিকটিকি বলল, ‘শেষ ইচ্ছার কথা বলো।’
এবার নাকিবের মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ, তার জীবনে তো ইচ্ছার শেষ নেই। যেমন: সানগ্লাস, ফুটবল, ট্যাব প্রয়োজন; তাছাড়া রাগী সুজন স্যারের বেতটা চুরি করা দরকার; বিভিন্ন স্থানে ম্যাজিক কার্পেটের মতো কিছুর সাহায্যে উড়ে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা; আরও কত কী! এতসব ইচ্ছা অপূর্ণ থাকতে মিস্টার টিকটিকি বলছে শেষ ইচ্ছার কথা জানাতে!
হঠাৎ নাকিবের মাথায় একটি বুদ্ধি চলে এলো- ক্লাসের ফার্স্ট বয় বলে কথা! নাকিব বলল, ‘আমার তিন নম্বর ইচ্ছা হলো, আমাকে আলাউদ্দিনের চেরাগ এনে দাও।’
মিস্টার টিকটিকি নাকিবের চালাকি ধরতে পেরে কিছুটা মন খারাপ করে জাদুকরের মতো কিসব আওড়াতে থাকল; এক পর্যায়ে চোখ দুটো হঠাৎ জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে ধপ করে একদম সাদা হয়ে গেল। একটু পর দেখল, নাকিবের খাটের ওপর আলাউদ্দিনের চেরাগ হাজির! নাকিব মহা খুশি। এবার সে চেরাগ ঘষে দৈত্য নিয়ে আসবে। দৈত্যও পূরণ করে তিনটা ইচ্ছা। নাকিব ঠিক করেছে, দুটো ইচ্ছা পূরণ করার পর তৃতীয় ইচ্ছা হিসেবে দৈত্যকে বলবে, মিস্টার টিকটিকিকে এনে দিতে! এভাবে মিস্টার টিকটিকি আর চেরাগের দৈত্যের সাহায্যে সারাজীবন ইচ্ছাপূরণ করে যাবে নাকিব। নিজের বুদ্ধিতে নাকিব নিজেই বিস্মিত, তাই খুশি হয়ে নিজেকে ট্রিট দিলো চিংড়ির বিরিয়ানি!

Share.

মন্তব্য করুন