১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। আমাদের জাতির ইতিহাসে একটি মহান প্রতীক্ষিত দিন। অনেক দিনের অপেক্ষা আর আট মাস কুড়ি দিনের সশস্ত্র লড়াই, নিযুত প্রাণের আত্মাহুতি, অযুত সম্ভ্রমের বদলায় পাওয়া এই মহান দিবস। এ যেন অপেক্ষার মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রতীক্ষার সুবর্ণ দিন। আমরা বলতেই পারি-
আমোদে আহ্লাদে টইটম্বুর
মহান ষোলো ডিসেম্বর।
সত্যিই ষোলো ডিসেম্বর আমাদের আনন্দের দিন। মহান অর্জনের দিন। এর ঠিক এক মাস ছয় দিন বাদে ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারিতে এই দিনকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করা হয়। সমারোহে এবং সোৎসাহে দেশের সর্বত্র উদযাপিত হয় এই দিন। বিজয় দিবস হিসেবে রব পড়ে যায় সারা বাংলায়। বিজয় সরোবরে ¯œাত হয় এ দেশের মানুষ।
এ দিন সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান ছুটি থাকে। স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানও থাকে ছুটির আওতায়। ছাত্রাবাস, মেস, আবাসিক প্রতিষ্ঠান, শিশু সদন, এতিমখানায় উন্নতমানের খাদ্য সরবরাহ করা হয়। সকল প্রেক্ষাগৃহে একাত্তরের স্মৃতি সংবলিত ফিল্ম ও শর্টফিল্ম বিনামূল্যে প্রদর্শিত হয়। বেতার ও দূরদর্শনে প্রচারিত হয় বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। টেলিভিশন চ্যানেলসমূহ স্বাধীনতার চেতনা উদ্দীপক নাটক, ফিল্ম, টেলিফিল্ম, সঙ্গীত, কুইজ, স্বাধীনতার স্মরণ ইত্যাদি রকমারি অনুষ্ঠানে সাজানো হয়। গাড়ি, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পতাকা উড়ানো হয়। সারাদেশের সর্বত্র থাকে সাজ-সাজ রব।
এর বাইরেও সামাজিক সংগঠনগুলো নিয়ে থাকে বর্ণিল কর্মসূচি। পেশাজীবীরাও নানা রঙে উদযাপন করেন এই দিন। সাংস্কৃতিক সংগঠনের রঙিন কর্মসূচিতে উজ্জীবিত হয় দেশের মানুষ। রাজনৈতিক দলসমূহের উদ্যোগে চলে আলোচনা সভা। ১৯৭১ সালের স্মরণ, বুদ্ধিজীবী ও আলেম সমাজের চিন্তাপুষ্ট ও যৌক্তিক কলামে সমৃদ্ধ হয় জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক, সাপ্তাহিকের বিশেষ ক্রোড়পত্র। পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ম্যাগাজিন, লিটল ম্যাগ ইত্যাদি সজ্জিত হয় দৃষ্টিনন্দন রঙিন আয়োজনে। কাগজের পাতা ভরে উঠে স্বাধীনতার স্মরণে। বিজয়ের আলাপনে।
এই সকল আয়োজনের মূল লক্ষ্য থাকে- এই প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় জাগ্রত করা। বর্তমান প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমাদের সন্তানদের আত্মদানে আগ্রহী করা। জাতির জন্য নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করতে উদগ্র করা। আগামীর জাতির কর্ণধার যারা তাদেরকে সতর্ক ও সচেতন করা।
¯্রষ্টার অমোঘ বিধান এটিই যে- মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন। স্বাধীনতা প্রত্যেক মানুষের জন্মগত অধিকার। অথচ এই অধিকারকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে সুযোগ সন্ধানীগোষ্ঠী। স্বাধীনতার অধিকারের উপর চলেছে অত্যাচারের নির্মম খড়গ। এই অত্যাচারের খড়গ ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়েছে। বিশেষত রাষ্ট্র বা দেশ যখন তার স্বাধিকার হারিয়েছে তখনই প্রতিবন্ধকতা উপড়াতে হয়েছে এক সমুদ্র রক্তের বিনিময়ে। এই স্বাধীনতাকে অর্জন করতে প্রয়োজন হয়েছে অপরিমেয় আত্মত্যাগের। বইয়ে গেছে রক্তের বন্যা। ঝড়ে গেছে অনেক প্রাণ। কেটে গেছে বেলার পর বেলা। সকল কিছুর বিনিময়ে আস্বাদিত হয়েছে স্বাধীনতার অমৃত স্বাদ।
বিশ্বের প্রায় সকল দেশেরই রয়েছে স্বাধীনতা অর্জনের রক্তাক্ত ইতিহাস। দু-একটি দেশের হয়তো এ অভিজ্ঞতা নাও থাকতে পারে। বিশ্বের যে অঞ্চলের শাসকরা কোনো কারণে শক্তিমান হয়েছে তারাই শাসক থেকে শোষকে পরিণত হয়েছে। পাশর্^বর্তী অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উপর দখলদারিত্বের আক্রমণ চালিয়েছে। তাদেরকে পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ করেছে। ডুকরে কেঁদেছে স্বাধীনতা হারানো দেশের আপামর জনসাধারণ। ক্রমশ তারাও একদিন শক্তি সঞ্চয় করতে চেষ্টা করেছে। সামন্ত রাজা ও দখলদারদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে জীবন বাজি রেখেছে। একদিন অবশ্যই তারা স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
বন্ধুরা! স্বাধীনতা অর্জনের পরিক্রমা অতিশয় দীর্ঘ। অমসৃণ। কণ্টকাকীর্ণ। তবে লক্ষযোগ্য বিষয় হলো- স্বাধীনতার আন্দোলন অবশ্যই অব্যর্থ। অপরাজেয়। কারণ স্বাধীনতা সত্যেরই আরেক রূপ। আর সত্য কখনও ব্যর্থ হয় না। পরাজিত হয় না।
আমাদের স্বাধীনতা অর্জনেরও রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। একাধিক প্রজন্মের সুদীর্ঘ আন্দোলন, নিখুঁত পরিকল্পনা, নির্ভুল নেতৃত্ব, ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা এবং এক নদী রক্তের বদলাতে পাওয়া আমাদের এই মহান স্বাধীনতা।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে / বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা /
আমরা তোমাদের ভুলব না॥ / দুঃসহ বেদনার কণ্টক বেয়ে /
শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা / আমরা তোমাদের ভুলব না॥

নতুন স্বদেশ গড়ার পথে / তোমরা চিরদিন দিশারী রবে / আমরা তোমাদের ভুলব না॥
অনেকেই বলে থাকেন- বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস মাত্র পৌনে নয় মাসের রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস।
বন্ধুরা! আমরা এ কথা মানি না। মানতে পারি না। আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। তবে ইতিহাসের পাঠ থেকে জেনেছি- আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের রয়েছে দীর্ঘ পরিক্রমা। এটিই ইতিহাসের নির্মম সত্য। এটি অস্বীকার করা ইতিহাসকে অস্বীকার করারই নামান্তর। তাই স্বাধীনতার স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসকে ধারণ করতে হবে হৃদ-অলিন্দে। স্বাধীনতার চেতনা লালন করতে হবে হৃদয়ের অতলে জাগ্রত অনুভবে।
বন্ধুরা! স্বাধীনতাযুদ্ধ তো আমরা দেখিনি। কিন্তু বাবা-দাদাদের কাছে স্বাধীনতার গল্প শুনেছি। স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি মর্মে মর্মে। তাদের আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠায় পেয়েছি আমাদের আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। আজ আমরা জন্ম নিয়েই আমাদের মতো করে কথা বলতে পারি। বাবা-মার মতো করে কথা বলি। নিজেদের মতামত প্রকাশ করি স্বাধীনভাবে, স্বাধীন ভাষায়। স্বাধীনতা না থাকলে কি এমনটি পারতাম? অবশ্যই পারতাম না।
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায় / ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়॥
কইতো যাহা আমার দাদায় / কইছে তাহা আমার বাবায় / এখন কও দেহি ভাই / মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়॥
আমাদের স্বাধীনতার পশ্চাতে আমাদের পূর্ব প্রজন্মের যে আত্মত্যাগ ছিল তা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে। স্বাধীনতার সেই অমর চেতনা হৃদয় মাঝে চিরজাগরূক রাখতে হবে। নতুবা যেকোনো সময় স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। আমরা যদি মেনেও নিই আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে লেগেছিল মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। কিন্তু স্বাধীনতা রক্ষা করতে লাগবে চেতনার সার্বক্ষণিক জাগরণ এবং তার অনুরণন।
যেকোনো অর্জনে প্রয়োজন উপযোগী কর্মসূচি। আর এই অর্জনকে স্থায়ী করতে প্রয়োজন চেতনার দৃঢ়তা, অনুভূতির অবিচলতা।
বন্ধুরা!
ষোলো ডিসেম্বর ১৯৭১- আমাদের বিজয় দিবস।
আমাদের বিজয় দিবস- আমাদের চেতনা স্মারক।
আমাদের এ মহান দিবস- আমাদের মহিমার স্তম্ভ।
আমাদের ১৬ ডিসেম্বর- আমাদের ঐতিহ্যের স্বর্ণচূড়া।
তাই আমাদের অস্তিত্বের সবটুকু জুড়ে আমাদের স্বাধীনতার চেতনা, সার্বভৌমত্বের অনুপ্রেরণা।

বন্ধুরা!
তোমাদের চেতনার দৃঢ়তা যুগে যুগে আঘাত হানবে রাষ্ট্রগ্রাসী সন্ত্রাসীদের সূতিকাগারে।
তোমাদের জাগ্রত চেতনায় নিপাত যাবে স্বাধীনতাগ্রাসীদের দুষ্টু মানসিকতা।
তোমাদের সুতীব্র চেতনায় বারবার হোঁচট খাবে জুলুমবাজের আক্রমণাকাক্সক্ষা।
তোমাদের সত্য প্রতিবাদ প্রকম্পিত করবে অত্যাচারীর তখতে-তাউস।
স্বাধীনতা তুমি
পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের ন¤্র পাতায় মেহেদির রঙ
স্বাধীনতা তুমি
বন্ধুর হাতে তারার মতোন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার॥
তাই বলি-
বাংলার দামাল কিশোর-যুবকরাই আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ
অমানিশার আকাশে সীমাহীন সাহসের দ্বিধাহীন রাজপথ॥
স্বাধীনতার চেতনায় আপ্লুত বিশ্বের সকল কিশোরদের জন্য রক্ত-জবার আজাদ সালাম।

Share.

মন্তব্য করুন