পরিযায়ী এক পাখির নাম মেঠো কাঠঠোকরা। সাইবেরিয়া ও চীনের দুর্গম অঞ্চল থেকে দীর্ঘ পথ উড়ে তবেই শীতের সময় দক্ষিণ এশিয়ায় আসে। আবার বসন্তে ফিরে যায় নিজ নিজ দেশে। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা জুড়ে মেঠো কাঠঠোকরার আনাগোনা।
এই পাখিটি লম্বা লেজওয়ালা ধূসর-মেটে রঙের হয়। এদের দৈর্ঘ্য মোটামুটি ১৯ সেন্টিমিটার, ডানা ৮.৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ১.৬ সেন্টিমিটার, পা ২ সেন্টিমিটার ও লেজ ৬.৮ সেন্টিমিটার। এদের বুক অসংখ্য কালো কালো ফুটকিতে যেমন রঞ্জিত, তেমনি মাথা-পিঠ ও ডানার উপরি ভাগে আছে সাদাটে-লালচে-বাদামি ও ধূসর-ছাইয়ের আশ্চর্য সুন্দর সমন্বয়। শরীরের নিচে লাল-পীতাভ আভা। কালচে চক্ষু-রেখা ঘাড়ের মাঝ বরাবর চলে গেছে। পিঠের দুই পাশে চওড়া কালো টান। বাদামি ডানা সূ² দাগে ভরা ও কালো, পীতাভ ও ধূসর রঙের ফোটা ও ডোরা রয়েছে। ডানার গোড়া ও পেটে কালো লাইন দেখা যায়। ডানায় সাদাটে তীর-ফলক চিহ্ন ও ৩-৪টি স্পষ্ট কালচে ছিটা-দাগ রয়েছে। লম্বাটে লেজটি ঘিরে চার-পাঁচটি চওড়া বলয় দেখা যায়। বলয়ের রং বাদামি-ধূসর। পা, পায়ের পাতা ও ঠোঁট বাদামি। চোখ পিঙ্গল-বাদামি। ছেলে ও মেয়ে পাখি দেখতে একই রকম হলেও ছেলেপাখি একটু বেশি উজ্জ্বল হয়ে থাকে।
উইপোকার ঢিবির সন্ধান পেলে এরা গলায় এক ধরনের চাপা শব্দ তোলে। পিঁপড়ে এবং এর ডিম-বাচ্চা, গুবরে পোকা ও অন্যান্য পোকামাকড় এদের মূল খাবার। খেজুরের রস নলি বেয়ে মাটিতে পড়ে জমা হলে সেখানেও ঠোঁট চালায়। ঠুকরে এরা মাটিতে ছোটখাটো চাষও দিয়ে ফেলে অনেক সময়। মাটিতে নেমে খাবার সংগ্রহে ব্যস্ত অন্য পাখিদের পেছনে পেছনেও ঘুরতে পারে অনিবার্য কারণেই। গ্রীষ্মকালে খোলা ঝোপঝাড়, মাঠ, বনপ্রান্ত, জমির আইল ও কৃষিজমির ধারে কাছে এবং শীতকালে বাগান ও কৃষি খামারের আশপাশে থাকতে পছন্দ করে। একাকী বা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরতে পছন্দ করে।
অত্যন্ত চতুর-বুদ্ধিমান ও সতর্ক পাখি মেঠো কাঠঠোকরা। গুইসাপ, বেজি, বনবিড়ালও এদের ধরতে পারে না। বিপদের গন্ধ পেলে স্থির হয়, মড়ার মতো শরীর এলিয়ে দিতে পারে। কাছে গেলে পালিয়ে যায়। কখনো কোনো মানুষ নাগালে চলে এলে ঘাড়ের পালক ফুলিয়ে, চোখ উল্টিয়ে ঘাড়-মাথা প্রায় ১৮০ ডিগ্রি কোণে ঘোরাতে থাকে, মাঝে মাঝে লেজ নাড়ায় ও মাটিতে শুয়ে পড়ে। দেখে যে কেউ ভাববে, পাখিটির ঘাড় ব্যথায় টনটন করছে এবং সে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। এই অবস্থায় তাকে বাঁচানোর জন্য হাতে তুলে নিলেও চুপচাপ অসুস্থতার অভিনয় করে যাবে। কিছুটা অন্যমনস্ক হলে, সেই সুযোগে পাখিটি হঠাৎ করেই তীরবেগে উড়ে পালাবে। আবার ভয় পেলে বুক ঠেকিয়ে মাটির সঙ্গে লেপটে থাকে কিংবা অনিচ্ছুকভাবে ঝোপে বা গাছে উড়ে যায়। শরীরের রঙ সহজেই এদের মাটির সঙ্গে মিলেমিশে যেতে সাহায্য করে। পালক এদের ছদ্মবেশ সহায়ক। এ সময় সুযোগ পেলে আশপাশের ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নেয়। ভয় কেটে গেলে ফের মাঠে আসে। এরা সহজে উড়তে চায় না, কিন্তু পরিযায়নের সময় এরা একনাগাড়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়। মাঝে মাঝে এরা নাকি সুরে ডাকে: চিওন-চিওন-চিওন…।
মে থেকে জুলাই মাস এদের ডিম পাড়ার মৌসুম। ছোট গাছের খোঁড়লে বাসা বানায়। সচরাচর কাঠঠোকরার পূর্বে ব্যবহার করা বাসা নিজেদের বাসা হিসেবে বেছে নেয়। বাসায় কেউ উৎপাত করলে সাপের মতো মাথাটিকে ঘুরিয়ে হিস-হিস শব্দ করে উৎপাতকারীকে ভয় দেখায়। এদের ডিমের রং হয় সাদাটে।
মেঠো কাঠঠোকরার বৈজ্ঞানিক নাম ঔুহী ঃড়ৎয়ঁরষষধ। ইউরেশীয় ঘাড়বাঁকা বা ইউরেশীয় ঘাড়ব্যথা চরপরফধব (পিসিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত এক প্রজাতির পাখি। গত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে, তবে আশঙ্কাজনক হারে এখনো পৌঁছায়নি। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এরা কাঠঠোকরা-জাতীয় পাখি। তবে এদের ঠোঁট কাঠঠোকরাদের মতো নয়, একটু ছোট। খাবারের জন্য বেশির ভাগ সময় মাটিতেই কাটায় বলে এরা মেঠো কাঠঠোকরা নামে পরিচিত।

Share.

মন্তব্য করুন