বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মধ্যে মেঘের ডাক। আকাশ, আয়ন এইমাত্র স্কুল থেকে এসে ঘরে ঢুকেছে। দাদু দরজাটা খুলতেই একগাল হাসি। দু’জন দাদুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘কি দাদু আজ বাইরে যাওনি?’ না ভাই এখন থেকে আর বাইরে যাবো না। ঘরে বসেই লেখালেখি করব। পত্রিকায় কি লেখেছে দেখোনি? করোনা আবার বেড়েছে। এখন নাকি বুড়ো আর শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। তাই তোমরাও সাবধানে থেকো। একটুও অবহেলা করা যাবে না। এমনিতেই তো তোমরা কদিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন। এখন সাবধানে থাকতে হবে না? তাহলে আমাদেরকে গল্প শোনাতে হবে, বলল দু’জনে। কি গল্প শোনাবো? দাদুর প্রশ্ন। আকাশ ব্যাগটা রাখতে রাখতে বললো, ‘আমাদের ইতিহাসের স্যার বলেছেন, আগামীকাল মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর ইতিহাস পড়াবেন। তুমি না বলেছিলে ঈশা খাঁর রাজধানী সোনারগাঁ বেড়াতে নিয়ে যাবে। ঈশা খাঁ সম্পর্কে না জানলে তার রাজধানী দেখে কি শিখবো? মজাই তো পাবো না।’ হ্যাঁ দাদুভাই ঠিকই বলেছ। তাহলে আজই ঈশা খাঁর গল্পটা হয়ে যাক। ভালোই হলো, তাহলে তোমরা তৈরি হয়ে এসো।
বিকেল বেলা, সবাই চা নাস্তা খেয়ে দাদুকে ঘিরে বসলো। ওদের সাথে রিয়াদ চাচ্চু সাকিব চাচ্চুও যোগ হয়েছে। দাদু গল্প শুরু করলেন। ইতিহাসের গল্প। মন দিয়ে শোন। সেই ষোড়শ শতাব্দী কথা। বাংলা প্রদেশ এর পূর্বাঞ্চল ছিল দুঃসাহসী এবং রোমান্টিক কার্যকলাপের আবাসস্থল। এ অঞ্চলে তখন আফগান, মগ, পর্তুগিজগণ অবাধ বিচরণ করতে পারত। ইসলাম শাহের রাজত্বকালে (১৫৪৫-৫৩) একজন দুঃসাহসী সংগ্রামী বীর বাংলায় আগমন করেন। তার নাম কালিদাস গজদানি। তিনি বৈশ্য রাজপুত বংশোদ্ভূত ছিলেন। একসময় কালিদাস গজদানি মুসলমান হয়ে যান। মুসলমান হলে তার নাম হয় সোলায়মান খান। তিনি ঢাকা ও মোমেনশাহীর উত্তর-পূর্ব অংশে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। একসময় কালিদাস ভাগ্যান্বেষণে গৌড়ে আগমন করেন এবং সৈয়দ সুলতান এর রাজস্ব বিভাগে চাকরি লাভ করেন। প্রতিভা বলে তিনি রাজস্ব উজিরের পদে অধিষ্ঠিত হন।
তারপর সোলায়মান খাঁ বাংলার সৈয়দ বংশের শেষ শাসক সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের কন্যাকে বিবাহ করেন। তার নাম ছিল সৈয়দা মোমিনা খাতুন। ১৫৪৫ সালে সোলায়মান খাঁ শেরশাহ এর পুত্র ইসলাম শাহ এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ফলে তাকে ইসলাম শাহের দুইজন সেনাপতি তাজখান ও দরিয়া খান যুদ্ধকালীন অবস্থায় সন্ধির জন্য আলোচনার কথা বলে কৌশলে ধরে ফেলেন এবং তাকে হত্যা করেন। ওই সময় তার দুই পুত্র ঈশা খাঁ ও ইসমাইল খাঁ আফগানদের হাতে বন্দী হন।
তারপর ঈশা খাঁ ও তার ভাই ইসমাইল খাঁকে তুরস্কের একদল বণিকের নিকট দাস রূপে বিক্রি করে দেয়া হয়। এই সময় চাচা কুতুব খাঁ নওয়াব তাজ খাঁর অনুগ্রহ লাভ করেন এবং উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত হন। বহু অনুসন্ধানের পর চাচা কুতুব খাঁ সুদূর তুরান দেশের কোন এক ধনাঢ্য গৃহে তাদের সন্ধান প্রাপ্ত হয়ে প্রচুর অর্থ প্রদান পূর্বক তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রদ্বয়কে তথা হতে মুক্ত করে আনয়ন করেন। তখন ঈশা খাঁ দীর্ঘ ১৬ বছর তুরস্কে অবস্থান করেছিলেন।
ঈশা খাঁর বয়স তখন কত জানো? মাত্র ১৭ বছর। তখন তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের সেনাপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এর মধ্যে তিনি অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অবশেষে ১৫৮১ সালের শেষের দিকে ঈশা খাঁ সমগ্র ভাটি রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন। তারপর সরাইল থেকে তার শাসনকেন্দ্র সোনারগাঁওয়ের নিকট কাতরাবোতে স্থানান্তর করে সেখানেই তিনি রাজধানী স্থাপন করেন। কলাগাছিয়া খিজিরপুরে দুর্গ তৈরি করলেন এবং এগারসিন্ধুরে প্রাচীন সামন্ত রাজাদের নির্মিত দুর্গটি সংস্কার করে একটি সেনাছাউনি নির্মাণ করলেন। হোসেনপুর, বোকাইনগড়সহ বেশ কয়েকটি প্রাচীন দুর্গ মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করে তোলেন।
তোমরা হয়তো ঈশা খাঁ আর মানসিংহের যুদ্ধের কথা শুনেছ। ১৫৯৪ খ্রি. ১৭ মার্চ জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের পুত্র যুবরাজ সেলিমের নির্দেশে রাজা মানসিংহ বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। রাজা মানসিংহ বাংলায় আসার সময় তার পুত্র দুর্জয় সিংহ, হিম্মত সিংহ, জগৎ সিংহ ও রাজা রাম চন্দ্র দেব ও বেশ কিছু সংখ্যক মোগল অমাত্য বাংলায় আগমন করেন। ১৫৯৬ খ্রি. জুলাই মাসে রাজা মানসিংহ শেরপুর থেকে রংপুরের ঘোড়াঘাটে এসে অবস্থান নেয়। ওই সময় তিনি হঠাৎ করে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ফলে চিকিৎসকরা তার জীবন সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েন।
ঈশা খাঁর নিকট এই সংবাদ পৌঁছার পর মাসুদ খান ও বীর করিমের নেতৃত্বে এক বিশাল নৌবহর মোগল সৈন্যদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার জন্য অতি দ্রুত তাদের অবস্থানের ২৪ মাইলের মধ্যে গিয়ে পৌঁছেন। ওই সময় ঈশা খাঁর বাহিনীকে প্রতিরোধ করার মত সামরিক শক্তি মোগলদের ছিলো না। ফলে ঈশা খাঁর সৈন্যদের আক্রমণে রাজা মানসিংহের বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। যুদ্ধে প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক মুঘল সৈন্য নিহত হয়।
রাজা মানসিংহ তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে অতিদ্রæত সোনারগাঁয়ের দিকে যাত্রা করলেন। ঈশা খাঁ সন্ধি করতে চাইলেন কিন্তু মানসিংহ তা প্রত্যাখ্যান করে শীতলক্ষ্যার তীরে একডালা দুর্গের দিকে অগ্রসর হলেন। এ সংবাদ পেয়ে ঈশা খাঁ এগারো সিন্ধুরে চলে এলেন। মানসিংহও ব্রহ্মপুত্রের তীরে অবস্থিত ঈশা খাঁর দুর্গের কাছে চলে এলেন। যুদ্ধ শুরু হলো। সাত দিন ধরে অবিরাম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হলো। রাত নেমে এলো। পরদিন আবার যুদ্ধ হবে।
এই রক্তক্ষয় বন্ধ করার জন্য ঈশা খাঁ এক দূত মারফত মানসিংহকে দ্ব›দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন। রাজপুত সেনাপতি সে আহ্বান গ্রহণ করলেন। কিন্তু মানসিংহ যুদ্ধে নিজে অবতীর্ণ না হয়ে তার জামাতাকে প্রেরণ করলেন। মানসিংহের জামাতা ধরাশায়ী হয়ে প্রাণ হারান।
এবার রাজপুত সেনাপতি ঈশা খাঁর সাথে যুদ্ধে নামলেন। প্রথমে অশ্বপৃষ্ঠে দুই বীরের মধ্যে চললো লড়াই। কিন্তু মানসিংহ তার অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পড়ে গেলেন। এমতাবস্থায় ঈশা খাঁ রাজা মানসিংহকে আঘাত না করে তাকে মাটি থেকে হাত ধরে তুলে নিলেন। অতঃপর মানসিংহ কৃতজ্ঞ চিত্তে ইসা খাঁর দিকে বন্ধুত্বের হাত সম্প্রসারিত করলেন।
১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ভাটি বাংলার অধীশ্বর হিসেবে ঈশা খাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটার পর দীর্ঘ ৩৬ বছরের দুর্জয় সংগ্রামী জীবনে তিনি প্রায় সমগ্র পূর্ব বাংলার মহান রাজ্য নায়ক হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অসামান্য রণকৌশল অসাধারণ প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার ফলে সম্রাট আকবরের প্রায় প্রতিটি সামরিক অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল ঈশা খাঁর দুর্জয় প্রতিরোধের মুখে।
দীর্ঘদিন যাবৎ মোগলদের সাথে তার অবিরাম যুদ্ধের ফলে জীবনের উচ্ছ¡লতায় কিছু ভাটা পড়ে গেল। ফলে তাঁর পুত্র মুসা খাঁকে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব দেন এবং তাকে মসনদ-ই-আলা উপাধিতে ভূষিত করেন।
তারপর ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময় ঈশা খাঁ কিছুদিনের বিশ্রামের জন্য সোনারগাঁও থেকে মহেশ্বরদী পরগনা বর্তমান গাজীপুরের কালীগঞ্জের নিকট বক্তারপুর দুর্গের প্রাসাদ বাটিতে গমন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েন। চিকিৎসকরা অবিরাম চেষ্টা করেও তাকে সুস্থ করে তুলতে ব্যর্থ হন। অবশেষে ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ সেপ্টেম্বর ঈশা খাঁ মৃত্যুবরণ করেন। বক্তারপুরেই বাংলার এই মহান বীরের সমাধি অবস্থিত।
কি দাদুরা কেমন লাগলো গল্পটা? খুব মজা তাই না। আজকে গল্প এখানেই শেষ করলাম কেমন।

Share.

মন্তব্য করুন